#হৃদয়ের_দখিন_দুয়ার
#পর্ব-৩১
“তোর কী মনে হচ্ছে না ফাহাদ কে বিয়ে করার ডিসিশন টা তুই একটু তাড়াতাড়ি নিয়েছিস। ”
ইকরা চোখ তুলে তাকালো। প্রশ্নটা করেছেন ওর কাজিন তানিয়া আপু। ইকরা নিজেও এই বিষয় টা নিয়ে ভাবে। অফিসে ফাহাদ কে যতটা স্মার্ট আর ইন্টিলিজেন্ট মনে হয়েছিল এখন তেমন মনে হচ্ছে না। মিডল ক্লাস মেন্টালিটি যেমন আছে তেমনি সেখান থেকে বেরিয়ে আসার বিন্দুমাত্র চেষ্টাও নেই। ইকরার মনে পড়ে প্রথম ফাহাদ দের বাড়িতে যাবার ঘটনা। বেশ কয়েক পদের ভর্তা, মাছ, মাংস টেবিলে ছিলো। ইকরা সবকিছু অল্প করে নিয়ে গুছিয়ে খাচ্ছিলো অথচ ফাহাদ হাভাতের মতো খাচ্ছিলো। ওর খাওয়ার ধরন দেখে ইকরার রুচি নষ্ট হলো। খাওয়ার ধরন দেখে মানুষ কতটা রুচিশীল সেটা বোঝা যায়। এই সামান্য ঘটনা থেকে শুরু হয়েছে বিরক্ত লাগা। এর আগে এই ব্যাপার গুলো খেয়াল করে নি। তোয়ালে ইউজ করে সেটা যে এখানে ওখানে ছুড়ে মারে, বাইরে থেকে এসে জুতাটা র্যাকে রাখে না এসব ব্যপার নিয়ে কথা বলতে ইকরারও খারাপ লাগে। তবুও বলতে হয়, কারণ ও এসবে অভ্যস্ত নয়। একটু বেশী গুছিয়ে চলা মানুষ ও সবসময় ই। মনে আছে একবার রুবাব পুরো বিছানা জুড়ে বইপত্র বিছিয়ে রেখেছিল। সেই সামান্য ব্যাপার নিয়ে ও রেগে দুই দিন অন্য রুমে ছিলো। আর এখন আস্ত এক জঞ্জাল কে নিয়ে বসবাস শুরু করেছে।
“কী হলো জবাব দিচ্ছিস না কেন?”
ইকরা আক্ষেপের সুরে বলল,
“আমার গোছানো জীবন টা রুবাব এলোমেলো করে দিয়েছে আপু। ও আমাকে এতোটা ভেঙেচুরে দিয়েছে যে ডিসিশন নেবার মতো অবস্থায় আমি ছিলাম না। ”
তানিয়া ইকরার পক্ষ হয়ে রুবাব কে গালমন্দ করলো। রুবাবের দোষ না থাকলেও এটুকু করতে হয়। নাহলে সম্পর্ক ঠিক থাকে না।
“রুবাব খুব খারাপ কাজ করেছে। ওর মতো ছেলের কাছে এরকম কিছু আশা করা যায় না। এসব কেন করেছে এখন বুঝি। অনেক ফলোয়ার কামিয়েছে। লাস্ট বইটা দেখলাম অনেক বিক্রিও হয়েছে। ওহ আরেকটা জিনিসও দেখলাম, দেশীয় একটা ওটিটি প্ল্যাটফর্ম থেকে ওর স্ক্রিপ্টে ওয়েব সিরিজ আসছে। ”
তানিয়া রুবাবের নিন্দাচ্ছ্বলে ইকরাকে খোঁচা দেয়ার সুযোগ নিলো। ইকরাকে বুঝিয়ে দেয়া যে রুবাব ও’কে ছাড়ার পর আরও বেশী সফলতা কুড়াচ্ছে।
ইকরা মুখে কিছু না বললেও মনে মনে আক্ষেপ করতে লাগলো। ও’কে এখনো সোশ্যাল মিডিয়ায় বুলিং সহ্য করতে হয়। ফাহাদের সঙ্গে সেদিন একটা ছবি আপলোড করেছিল। এতো মানুষ হাসির রিয়েক্ট দিয়ে ভরিয়ে দিলো যে ওর ফেসবুকে ছবি আপলোড করার ইচ্ছেই নষ্ট হয়ে গেল। বিজনেস পেজ থেকে লাইভ করতে গেলে অসংখ্য হেট কমেন্টে ভরে যায়। অথচ একই রকম ঘৃনা ফাহাদ কে খুব কম ই ফেস করতে হচ্ছে।
“এই ইকরা, কী খাবি দুপুরে? ঘরে রান্না করব নাকি বাইরে থেকে অর্ডার করব। ”
ইকরা শুকনো গলায় বলল,
“নাথিং। আমার কাজ আছে, যেতে হবে। ”
“রাগ করলি নাকি আমার কথায়? আমি তোর ভালোর জন্য বলেছি। ”
ইকরা তীর্যক হেসে বলল,
“ভালোর জন্য হলে তো তুমি এই টপিক টা তুলতেই না আপু। অনেক টপিক আছে কথা বলার। আমার পাস্ট লাইফ নিয়ে কথা না বললেও চলতো। অনেক দিন পর যেহেতু কথা হচ্ছে, অনেক কিছু নিয়েই গল্প করতে পারতাম। ”
ইকরা কথাগুলো বলে বেরিয়ে গেল। তানিয়া মুখ বাঁকা করে হাসলো, মনে মনে বলল, নিজে করতে পারবে আর কেউ কিছু বলতে পারবে না।
ইকরা আজকাল সত্যিকারের অশান্তি টের পাচ্ছে। আসল অশান্তি টা ওর মনের অশান্তি। সাইকোলজিস্ট এর কাছে যাওয়া দরকার।
***
“তোর কষ্ট হবে না? ”
“সমস্যা নেই আপু, জিড়িয়ে উঠতে পারব। ”
নাতাশা সুপ্রীতির হাত ধরলো। সুপ্রীতির ঘরে একা ভালো লাগছে না, ওদিকে মায়ের বাসায় যেতেও ইচ্ছে করছে না। তাই নাতাশাকে কল করে বলল এখানে আসার কথা। নাতাশার ভালো লাগছে। সুপ্রীতির শ্বশুর বাড়ি এক দুইবার গিয়েছে।কিন্তু সেখানে গিয়ে থাকতে ওর অস্বস্তি আছে। স্বপ্না কখন কী খারাপ বলে ফেলে তার তো ঠিক নেই।
ছয়তালায় উঠতেই সুপ্রীতি হাপিয়ে গেল। নাতাশা দেখলো ও’কে কী সুন্দর লাগছে। প্রেগন্যান্সি পিরিয়ডে শরীর টা একটু ভারী হয়, দেখতে কী মিষ্টি লাগছে। নাতাশা বলল, তুই একটু বোস তো সুপ্রীতি। তোকে একটু দেখি, খুব সুন্দর হয়েছিস।
সুপ্রীতি হাসলো। নাতাশাকে বলল,
“তোমাকে একটা কথা বলতে চাই আপু। ”
“কী কথা?”
“আমি ইশরাকের সাথে কথা বলতে চাই। ”
নাতাশা স্থির চোখে দেখলো সুপ্রীতিকে। সুপ্রীতি বলল,
“আমার মনে হলো ইশরাকের সাথে কথা বললে একটু হালকা লাগবে। ”
নাতাশা সুপ্রীতির অবস্থা টা বুঝতে পারলো। প্রথমবার মা হওয়ার অনুভূতি একদিকে যেমন মিষ্টি হয়,অন্যদিকে মনে ভয়ও ঝেকে বসে। ওর হাত ধরে বলল,
“বাজে স্বপ্ন দেখিস না? এইসময় এরকম হয়। ”
সুপ্রীতি হাসার চেষ্টা করলো। ইদানীং আরেকটা ভয় কাজ করে। এই ভয়ের অনুভূতি কাউকে বলে বোঝাতে পারবে না।
নাতাশা আবারও বলে,
“অর্ণব কে জানাবি না?”
“ও ব্যাপার টা পছন্দ করবে না। ”
“তাহলে আমি বলব তোর ইশরাকের সঙ্গে কথা বলার দরকার ই নেই। অর্ণব যেটা চায় না, সেটা করার দরকার নেই। ”
সুপ্রীতি কেমন অন্যরকম চোখে তাকালো। নাতাশা ওর হাত ধরলো শক্ত করে। সুপ্রীতি অনুনয় করে বলল, তোমার ফোন থেকে একবার কল করো। এক মিনিটের বেশী কথা বলব না।
****
ঝিলিক কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছে না। এতো খারাপ ওর এর আগে কবে লেগেছে মনেও নেই। হাঁসফাস অবস্থা হয়েছে। একবার ভাবলো ইশরাকের সঙ্গে এই বিষয় নিয়ে আর কথাই বলবে না। কিন্তু কিছু না বলেও পারছে না।
ইশরাক অফিসে যাবার জন্য তৈরী হয়েছে। ঝিলিক জিজ্ঞেস করলো,
“পাঁচ মিনিট সময় হবে? আমি একটু কথা বলব। ”
ইশরাক কঠিন গলায় বলল,
“না। ”
“কেন?”
ইশরাক বিরক্ত গলায় বলল,
“অফিসের লেট হচ্ছে ঝিলিক। তোর কী কমনসেন্স নেই?”
“তুমি একটা ব্যাপার প্লিজ ক্লিয়ার করে বলো, আমাকে এতো খারাপ কেন মনে হলো তোমার। এতো নীচ কাজ আমি করতে পারি! তোমার সেটা মনে হয়। ”
ইশরাক ঝিলিকের দিকে তাকালো। চোখের ভাষা পড়ার অব্যর্থ চেষ্টা করলো ঝিলিক।
“জানিনা ঝিলিক, তুই তো সব করতে পারিস তাই না? ফাহাদ ভাইয়ার বাসায় যেটা করেছিস সেটাও তো অনেকের পক্ষে অসম্ভব তাই না!”
ঝিলিকের ভেঙেচুরে কান্না পেল। দুটো ঘটনা কী এক হলো। ইশরাক ও’কে এই চিনলো! হায়, এরচেয়ে তো না চেনা ভালো ছিলো।
“দুটো ব্যাপার তো এক না তাই না। ইকরার ওখানে আমার যেটা ঠিক মনে হয়েছে করেছি। তাই বলে….
ঝিলিক কে কথা শেষ করতে দিলো না ইশরাক। বলল,
“এটাই তো বলছি ঝিলিক, তোর যেটা মনে হয় তুই সেটাই করিস। হতেই পারে তুই আমার উপর শোধ নেবার জন্য সুপ্রীতিকে ছবিগুলো পাঠাচ্ছিস। তুই তো নিজেই বলিস ভালো, মন্দের জ্ঞান তোর নেই। যা মনে আসে করিস। ”
ঝিলিক আহত চোখে তাকিয়ে আছে। শব্দভান্ডারে যৌক্তিক সব শব্দও যেন ফুড়িয়ে গেছে ওর। দূর্বল গলায় বলল,
“আমি ভুল, একশ ভাগ ভুল। কিন্তু সুপ্রীতির সঙ্গে ভুল কিছু করি নি। আমি আরও একটা কথা বলি সেটা তুমি ভুলে গেছ। কাউকে কিছু বলার হলে, করার হলে সেটা সামনাসামনিই করি। হোক সেটা ভালোবাসা কিংবা ঘৃনা। ইকরাকে ঘৃনা যেমন সামনাসামনি দেখিয়েছিলাম। তেমনি তোমার প্রতি ভালোবাসাও সামনাসামনি দেখিয়েছি। রাখঢাক নেই আমার। সেল্ফ রেসপেক্টও নেই। সব ই ঠিক আছে। কিন্তু তোমার মনে আমাকে নিয়ে যে ভাবনা আছে সেটাও ভুল। একশ ভাগ ভুল। ”
ইশরাক বিড়বিড় করে বলল,
“তাই যেন হয়। ”
ঝিলিক নিজেকে আড়াল করলো। ইশরাক একদিন ও’কে থাপ্পড় মেরেছিল। সাময়িক ব্যথাটুকু ছাড়া তেমন কিছু হয় নি। তবে আজ ইশরাক জিতে গেল। ঝিলিক কে এবার সত্যিই আঘাত করতে পেরেছে। শরীরের আঘাতের যন্ত্রণা না হয় ওষুধ লাগিয়ে ঠিক করা গেছিল। কিন্তু মনের আঘাত! এই আঘাতের ক্ষত কোনোদিন মিটবে না। কোনোদিন না।
চলবে….
(পরের পর্ব সোমবার রাতে ইনশাআল্লাহ।)