#হৃদয়ের_দখিন_দুয়ার
#পর্ব-৩২
“সুপ্রীতি তোমার সঙ্গে একবার দেখা করতে চেয়েছে ইশরাক। ”
ইশরাক উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন করে,
“সব ঠিক আছে তো ভাবী?”
“কিছু ব্যাপার ও তোমার সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলে মিটিয়ে নিতে চায়। ”
“আচ্ছা। আমি বিকেলে আসব?”
“আসো। ”
নাতাশা একবার ভাবলো বলবে ঝিলিক কে নিয়ে আসতে। তারপর বাদ দিলো। দুজনের মধ্যে ঝিলিক কে আনতে বলা বোধহয় ঠিক হবে না।
ইশরাক বাকী সময়টুকু কাজে মন দিতে পারলো না। অনেক ভাবনা চিন্তা মাথায় ভর করছে। সুপ্রীতি ও’কে কী বলবে দেখা হলে। ও কী বিশ্বাস করে ওরকম একটা ছোটলোকি কাজ ইশরাক করতে পারে। না, এই দেখা হওয়াটা আসলে জরুরী। দুজনের মিসআন্ডারস্টান্ডিং গুলো ক্লিয়ার করার দরকার আছে।
ইশরাক এলো বিকেলে। নাতাশা সুপ্রীতিকে বলল,
“ইশরাক এসেছে। ডাকব?”
নাতাশা সময় নিলো। চোখ বন্ধ করে নি:শ্বাস নিলো। তারপর বলল,
“আচ্ছা। ”
দুজনের হঠাৎ দেখায় ওরা স্বাভাবিক আচরণ করার চেষ্টা করলো। কিন্তু চাইলেও স্বাভাবিক আচরণ আসে না। সুপ্রীতি এখন অন্য একজনের বউ, ইশরাকও তেমনি অন্য একজনের স্বামী। না ওরা বন্ধু এখন, না প্রেমিক প্রেমিকা। শুভাকাঙ্ক্ষীও বলা যায় না। প্রথম কথা বলা শুরু করলো সুপ্রীতি।
“কেমন আছ ইশরাক?”
ইশরাক স্মিত হাসলো। বুকের ভেতর হারানো ব্যথাটা আরও একবার জানান দিলো। বলল,
“আমি ভালো। তোমার শরীর কেমন? ”
“ভালো। ঝিলিক ভালো আছে?”
“হ্যাঁ খুব। ও সবসময় ই ভালো থাকে। ”
“সেদিন দেখলাম পালকের সঙ্গে ছবি পোস্ট করায়। ভীষণ মিষ্টি লাগছে। ”
ইশরাক মাথা নিচু করে ফেলেছে। কোনোদিন এরকম কথোপকথন দিয়ে ওদের কথা শুরু হবে সেটা ও ভাবে নি। সুপ্রীতি ইশরাকের চেয়ে বেশী স্বাভাবিক। ভনিতা ছাড়াই বলল,
“সরি ইশরাক। ”
ইশরাক সরি শব্দটা শুনে চমকে উঠলো। কেন সরি বলছে সুপ্রীতি সেটা জিজ্ঞেস করার মতো ক্ষমতাও যেন ওর নেই। সমস্ত শব্দভাণ্ডার যেন ফুরিয়ে গেছে এই মুহুর্তে। সুপ্রীতি বলল,
“নাতাশা আপু তোমাকে একটা বিষয় জানিয়ে বিব্রত করেছে। ওই সময়ে আসলে আমার মাথা কাজ করছিল না। ”
ইশরাক অনুভূতি শুন্য হয়ে সবটা শুনতে লাগলো। সুপ্রীতি বলল,
“এই সরি টা তোমাকে বলা দরকার ছিলো ইশরাক। কারণ তোমাকে অবিশ্বাস করে তোমার প্রতি অসম্মান দেখানো হয়েছে। আমি মন থেকেই সরি ফিল করছি।”
দুজনের কথোপকথনের মাঝখানে হঠাৎ ঝিলিকের আগমন ঘটলো। নাতাশা নিজেও ভীষণ অবাক হলো। ঝিলিক ঘরে ঢুকেই নাতাশাকে বলেছিল, ভাবী আমি এখানে কয়েকটা দিন থাকব। তখনও ওর নজরে ইশরাক কিংবা সুপ্রীতি আসে নি। হঠাৎ দুজন কে দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেল। ইশরাকের চোয়াল শক্ত হলো। রুক্ষ গলায় বলল,
“তুই এখানে? ”
বাক্যটা ভীষণ কর্কশ শোনালো ঝিলিকের কাছে। হঠাৎ ওর নিয়ন্ত্রণহীন রাগ টা ফিরে এলো। নাতাশা, সুপ্রীতি আর ছোট্ট পালকের সামনেই ইশরাক কে একটা থাপ্পড় মারলো। সবাই হতভম্ব হয়ে গেছে। ঝিলিক ইশরাকের উদ্দেশ্যে শুধু একটা শব্দই বলেছে। ইতর একটা।
যাবার আগে নাতাশার দিকে ঘৃনার দৃষ্টিতে তাকালো ঝিলিক। অনেক কিছু বুঝিয়ে দিয়েছে ও’কে এই মুহুর্তটা। ঝিলিক দরজায় শব্দ করে বেরিয়ে গেল।
সুপ্রীতি চোখ বন্ধ করে ফেলল। কী ভীষণ বাজে পরিস্থিতি। ইশরাক একই রকম ভাবে বসে আছে। নাতাশা কাকে কী বলবে কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না।
***
“কেমন আছ প্রকৃতি? ”
প্রকৃতি এই সময়ে অর্ণব কে দেখে একটু অবাক হলো। বলল,
“আমি তো ভালোই। খালা হবো এই আনন্দে এখনো বিভোর। ”
অর্ণব হাসলো। বলল,
“হ্যাঁ, তোমার কিন্তু অনেক কাজ সামনে।”
“আমিও অপেক্ষা করছি তো। ”
স্বপ্না অর্ণবের গলা শুনে ছুটে এলেন। তার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে খুশি না। বলেই ফেললেন,
“অর্ণব তুমি এখানে? ”
“আপনার হাতের চা খেতে এলাম। ”
স্বপ্না বিগলিত হাসি দিয়ে বললেন,
“কী সৌভাগ্য আমার। শুধু চা। ”
“আপনি বসুন। চা টা প্রকৃতি বানাক। ”
প্রকৃতি বুঝতে পারলো পরিস্থিতি জটিল হতে যাচ্ছে। অর্ণব খুব ঠান্ডা মাথায় ভয়ংকর সব জটিল কাজ করে ফেলে।
প্রকৃতি চলে যাবার পর স্বপ্না গলা নামিয়ে বলল,
“নাতাশার ওখানে গেলে না? ”
অর্ণব তাকিয়ে আছে শীতল চোখে। স্বপ্না এই চোখের ভাষা বুঝতে পারলে সতর্ক হতেন আরেকটু। বলল,
“আপনি শিওর যে ইশরাক সুপ্রীতির সঙ্গে দেখা করতে গেছে। ”
“হ্যাঁ। আমি খবর পেয়েছি। ”
“কিভাবে খবর পেলেন? লোক লাগিয়ে রেখেছিলেন নাতাশার পিছনে? ”
স্বপ্না থতমত খেলেন। বললেন,
“ওখানে আমার পরিচিত একজন থাকে….
“সে সবসময় নাতাশার খেয়াল রাখে যে ওর বাসায় কখন কে আসে! ”
স্বপ্না বুঝতে পারলেন তিনি আবারও অর্ণবের কথার জালে জড়িয়ে পড়ছেন। এই টপিক এখানে শেষ করা ভালো হবে। এখন মনে হচ্ছে ব্যাপার টা অর্ণব কে জানানো উচিত হয় নি। সে ভেবেছিল তার কল পেয়ে অর্ণব ওই বাসায় যাবে। নাতাশাকে জনমের শিক্ষা দেয়া যাবে।
“আমার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন না কেন?”
“আরে বাদ দাও। হয়তো আমার ভুল হয়েছে। কী খাবে বলো?”
“এই মুহুর্তে আপনার কলিজা ভুনা দিয়ে রুটি খেতে ইচ্ছে করছে। ”
স্বপ্না বোকার মতো তাকিয়ে রইলো। অর্ণব কী রসিকতা করছে তার সাথে। এতো স্বাভাবিক গলায় কথাটা বলছে রসিকতাও ভাবা যায় না। অর্ণব আবারও বলল,
“আপনি কী চান? আমার থেকে সুপ্রীতিকে আলাদা করতে চান?”
স্বপ্না বুঝলেন তিনি ফ্যাসাদে পড়েছেন। প্রকৃতি এতক্ষণ কেন সময় নিচ্ছে! বাসায় এখন আর কেউ নেইও।
“জবাব দিন। আপনি বোবা হয়ে থাকলে তো হবে না। দেড় ঘন্টা ড্রাইভ করে আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছি। আমার সময়ের ভীষণ দাম এখন। ”
স্বপ্না আলগা হাসি দিয়ে বললেন,
“তুমি সবসময় আমার কথায় রাগ করো। তুমি তো আমার ছেলে। ছেলে মায়ের কথার এতো দোষ ধরলে হয়!”
“টপিক ঘোরাবেন না। আপনি কী চান বলুন? আপনার মেয়ের কন্ডিশন আপনি জানেন না? তাহলে এসব কেন করছেন। ”
স্বপ্না শুকনো ঢোক গিললেন। রান্নাঘরের দিকে তাকালেন একবার। প্রকৃতির সাড়া শব্দ নেই কোনো। এসিতে থেকেও ঘামছেন।
“কী চাইছেন? সুপ্রীতি বাচ্চাটা জন্ম না দিক তাই তো? ওর এতো তাড়াতাড়ি বাচ্চা নেয়া উচিত হয় নি। সেক্স করার আগে আপনার পারমিশন নেয়া উচিত ছিলো? ”
স্বপ্না এবার ভয়ে কাঁপছেন। গলা ধরে আসছে। অর্ণবের স্বাভাবিক কথাগুলোও অস্বাভাবিক ঠেকছে। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন প্রকৃতিকে দেখে। ও চায়ের কাপ রেখে বলল,
“শুধু চা খাবে ভাইয়া? একটু পাস্তা করে দেই?”
“শুধু আমার জন্য চা আনলে? মায়ের টা। ”
“আনছি। ”
প্রকৃতি চলে যাবার পর অর্ণব হাই তুলে বলল,
“কাল আমি সুপ্রীতিকে বলেছি যে আপনি ওর আর ইশরাকের ছবিগুলো আমাকে পাঠাচ্ছেন। আপনি নিজেকে যতই চালাক ভাবুন, আমার চেয়ে চালাক না। আমার চেয়ে হারামিও না। আমার সুদর্শন চেহারা দেখে আমাকে নরম ভেবে আপনি ভুল করেছেন।”
স্বপ্না এখন অর্ণবের দিকে তাকাচ্ছেও না। প্রকৃতি এলো চায়ের কাপ নিয়ে। অর্ণব প্রকৃতিকে বলল,
“তুমি একটু বসো। ”
প্রকৃতি মায়ের ফ্যাকাসে, বিব্রত মুখ দেখে বুঝেছে ঝামেলা আছে কিছু একটা। ও বলল,
“ভাইয়া সব ঠিক আছে। আপুর সাথে আমার দুপুরে কথা হলো তো….
“রিলাক্স… আমারও হয়েছে। আচ্ছা নাতাশার পিছনে তোমার মা গোয়েন্দা লাগিয়েছে কেন?”
প্রকৃতি বিস্মিত হলো।
“গোয়েন্দা!”
“হ্যাঁ। আজ নাকি ইশরাক সেই বাসায় গিয়েছে। ”
প্রকৃতি বিস্ফোরিত চোখে তাকালো মায়ের দিকে। অস্ফুটস্বরে একবার বলল,
“মা! ছি:!”
ছি: শব্দটা উচ্চারণ করলো জোরে। স্বপ্না মাথানিচু করে আছেন। অর্ণব বলল,
“উনি সম্ভবত আমাকে আর ইশরাক কে আলাদা করতে চাইছেন। সুপ্রীতির প্রেগন্যান্সি নিয়ে খুশি না, ইশরাকের ছবিগুলো পাঠিয়ে আমাদের মধ্যে ঝামেলা ক্রিয়েট করতে চাইছেন। এগুলো কী উনি মানসিক রোগ থেকে করছেন। তোমরা ওনাকে ডাক্তার দেখাও ভালো করে। ”
প্রকৃতি কাঁদছে। মা’য়ের দিকে তাকাতেও ওর ঘৃনা লাগছে। মায়ের সাইকোলজি ওর জানা আছে। সুপ্রীতি, অর্ণব কে সে কন্ট্রোল করতে পারছে না। সেই আক্ষেপ থেকে… তাই বলে এতো নিচে নামবে।
“প্রকৃতি শোনো। ”
প্রকৃতি অর্ণবের দিকে তাকালো। ও বলল,
“আমার ক্লোজ ফ্রেন্ড সুপ্রীতিকে নিয়ে সস্তা রসিকতা করেছিল। আমি নিতে পারিনি। কুত্তার মতো মেরেছিলাম। এখন তোমার মায়ের সঙ্গে আমার কী করা উচিত! ”
প্রকৃতি ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। অর্ণব চায়ের কাপ টা হাতে নিলো। আরেক হাতে স্বপ্নার মুখ টা তুলে গরম চা ছুড়ে মারলো। স্বপ্না জান্তব চিৎকার করার পর ই দ্বিতীয় কাপ ছুড়ে মারলো। মুখের সঙ্গে এবার জিহবাও পুড়ে গেছে। অর্ণব বেরিয়ে গেল সেখান থেকে। স্বপ্নার গগনবিদারী চিৎকার শুনেও প্রকৃতি ওর জায়গা থেকে নড়লো না। একই জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
চলবে….
#হৃদয়ের_দখিন_দুয়ার
#পর্ব-৩৩
সেদিন দুপুরের ঘটনা। অর্ণব অফিসের গুরুত্বপূর্ণ মিটিং সামলাতে ব্যস্ত। সুপ্রীতির লাগাতার ফোন কল দেখে মিটিং এর মধ্যেই কল রিসিভ করলো।
“অর্ণব একটা কথা বলার জন্য তোমাকে কল করেছি। ”
“বুঝতে পারছি। বলো তুমি। ”
“আমি একটা ব্যাপার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ”
অর্ণব চুপ করে থেকে সুপ্রীতিকে সময় দিলো। ও বলল,
“আমার এই সিদ্ধান্ত টা তোমার পছন্দ হবে না। ”
“তবুও কেন আমার অপছন্দের কাজ টা করতে হবে। ”
“জানিনা। আমি বোধহয় এমনই খামখেয়ালী স্বভাবের। কাজ টা তোমাকে না জানিয়ে করতে চেয়েছিলাম। জানালে তুমি কষ্ট পাবে স্বাভাবিক। কিন্তু আমার গাট ফিলিংস বলছে করা উচিত। ”
“আচ্ছা।”
“অর্ণব আমি তোমাকে কষ্ট পেতে দেখতে চাই না। তোমাকে একটা কথা বলি, শুধু বলার জন্য এই কথা বলা নয়। এই মুহুর্তে আমার জীবনে তোমার থেকে গুরুত্বপূর্ণ আর কেউ নেই। আমার বাবা, মা, বোন এমনকি যার আসার প্রহর গুনছি তারচেয়েও বেশী গুরুত্বপূর্ণ তুমি। সবসময় তুমি আমার জীবনে এমন গুরুত্বপূর্ণই থাকবে। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না। ”
“ধরো, আমি যদি তোমাকে আজ বলি তুমি যে কাজ টা করতে চাইছ সেটা কোরো না। প্রয়োজনে কষ্ট কে গিলে ফেলো। সেটা করতে পারবে?”
সুপ্রীতি সময় নিলো না। বলল,
“পারব।”
অর্ণব নি:শব্দে হাসলো। বলল,
“থ্যাংক ইউ। আজ ই শেষবার আমি ব্যাপার টা মেনে নিচ্ছি সুপ্রীতি। আমি জানিনা তোমাদের কী কথাবার্তা হবে। আমি শুনতেও চাই না। সত্যি কথা হলো আমার ব্যাপার টা ভালোও লাগবে না। তবুও একটা ব্যাপার তো নিশ্চিত হলো যে আমার চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ তোমার জীবনে আর কেউ নেই। এটাই আমার অহংকার। এই অহংকার আর কেউ করতে পারবে না, কেউ না। ”
সুপ্রীতিও ফোনের ওপাশে নি:শব্দে হাসলো। ভেজা গলায় বলল,
“থ্যাংক ইউ অর্ণব। ”
“তোমার কলের অপেক্ষায় থাকব। আমি নিতে আসব তোমাকে। ”
সুপ্রীতির সঙ্গে কথা শেষ হবার সাড়ে তিন ঘন্টা পর স্বপ্না অর্ণব কে কল করলো। অর্ণবের ভ্রু কুঞ্চিত হলো। আজকেই এই সময়ে স্বপ্নার ফোন কল টা স্বাভাবিক তো! অর্ণব কল রিসিভ করতেই স্বপ্না বলল,
“বাবু আজকে অফিস সেড়ে নাতাশার ওখানে যাবে তো?”
অর্ণবের মাথা গরম হয়ে গেল মুহুর্তেই। এই ভদ্রমহিলাকে ও অনেকবার বলে এবং বুঝিয়ে দিয়েছে সব মানুষের সব কিছুতে একটা লিমিট থাকে। উনি ওনার স্বামী, সংসারে কেমন ছিলেন সেটা নিয়ে অর্ণবের আগ্রহ নেই। কিন্তু সুপ্রীতি তার প্রাপ্তবয়স্ক বিবাহিত মেয়ে। যেখানে ও নিজে সুপ্রীতিকে কন্ট্রোল করতে চায় না সেখানে উনিও যেন এই ভুল না করেন। অর্ণব স্বাভাবিক গলায় বলল,
“যাব। কিন্তু দেরি হবে। আপনি যাচ্ছেন নাকি? একগাদা রান্না করে নিয়ে যাবেন না প্লিজ। আপনি এতো কষ্ট করে রান্না করেন, আমি অল্প খেয়ে রেখে দেই। সুপ্রীতির খাবার দাবারেও চেঞ্জ আসছে এখন। ”
স্বপ্না বিগলিত গলায় বললেন,
“না সোনা আমি যাব না। একটা ব্যাপার তোমাকে জানানোর জন্য বলছি। নাতাশাকে তো জানো, আমি এর আগে ব্যাপার টা তোমাকে জানাই নি। ওই হারামজাদি চেয়েছিল ওর চাচাতো দেবরের সঙ্গে সুপ্রীতির বিয়ে হোক। আমার বোকা সরল মেয়েটার মাথা বিগড়ে দিয়েছে। অনেক কষ্টে সামলেছি আমি। এখন আবারও নতুন নাটক শুরু করেছে। ”
অর্ণব নিজেও সেই মুহুর্তে বোকা সরল হবার ভান করে বলল,
“কী বলছেন?”
স্বপ্না নিখুঁত অভিনয় করে বললেন,
“এসব ব্যাপার কী বলতে ভালো লাগে। তুমি তো দেখো আমি কন্ট্রোলফ্রিক। কিন্তু কেন আমি এসব করছি সেটা তো বোঝাতে পারি না। ”
অর্ণব একটু সময় নিয়ে বলল,
“আপনি যা বলেছেন সেটা কী শিওর হয়ে বলছেন? ”
“হ্যাঁ বাবা। ”
“আমি দেখছি ব্যাপার টা। ”
অর্ণব কল কাটার পাঁচ মিনিট পর আবারও কল করলো। বলল,
“আপনি এই ব্যাপার টা কাউকে বলবেন না কেমন! ”
স্বপ্না বিগলিত গলায় বলল,
“কাকে বলব আর! আমি যে কতো কী করেছি নাতাশার খপ্পর থেকে থেকে বের করার। আমার মেয়ে চিরকাল আমাকে ভুল বুঝে এসেছে। তোমাকেও কী না কী ভুল বোঝাচ্ছে। আমি চাই ভুল ভাঙুক। বিয়ে হয়েছে, সংসার করছে, বাচ্চা হবে। এখনও এসব পাগলামী করলে হয়!”
ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ পেয়ে অর্ণব বলল,
“আপনি শান্ত হন। আমি দেখছি। ”
অর্ণব কল রেখে চুপচাপ বসে রইলো খানিকক্ষন। ভীষণ রাগ হচ্ছে। আজকের পরিস্থিতি টা ভিন্নরকম হতে পারতো যদি সুপ্রীতি ও’কে কিছু না জানাতো। অর্ণব সেই মুহুর্তে চোখ বন্ধ করে অনেক বছর আগের একটা দৃশ্য দেখতে পায়। সেইবার ওর বড় ফুপু এসেছিলেন বাসায়। বাবা তার বড় বোন কে মাথায় করে রাখেন। তার সেই বড় বোন তাকে মায়ের মতো পেলেপুষে বড় করেছেন। তার কথায় প্রয়োজন হলে দুই তিন জন নির্দোষ মানুষকেও খুন করে ফেলবেন। ওর তখন বছর দশেক বয়স হবে। ভাই, বোনেরাও সবাই বড়। বড় আপু কলেজে যান। বড় ফুপু বাসায় এসে মায়ের এটা সেটা দোষ ধরেন। সবাই স্বাভাবিক ভাবে ব্যাপার টা নেয়। উনি অমনই, ওনার চরিত্র ওরকম ই। সেই অমন চরিত্রের বড় ফুপু একদিন বাবা আসার পর তাকে বললেন, আলী অর্ণবের মায়ের স্বভাব চরিত্র কিন্তু ভালো ঠেকতেছে না। অর্ণবকে যে ব্যটা পড়াতে আসে তার সাথে কথা বলার সময় যেই হাসি দেয়। আজকে দেখলাম চা দেবার সময় মাথাতে কাপড় দেয় নাই। কাপড় চোপরের কথা তো না’ই বলি।
বাবা উঠে গিয়ে সুপুরি কাঁটার সরতা দিয়ে মা’কে জানোয়ারের মতন মারলেন। বড় আপু, ভাইয়া মা’কে বাঁচাতে ছুটে গেলেন। অর্ণব স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। বড় আপু কাঁদছেন খুব। বাবা তার পছন্দের ছিলো ভীষণ। বোকা সরল মা’য়ের সঙ্গে খিটমিট লেগে থাকতো তার। সেদিন বড় আপু মাথা পেতে সরতার আঘাত নিয়ে মা’কে বাঁচালো। মা ব্যকুল হয়ে কাঁদলেন। লজ্জা, ঘৃনা, ভয়ে। প্রচন্ড জ্বর বাঁধিয়ে হাসপাতাল ঘুরে এলেন। বাবা বিমর্ষ মুখে হাসপাতালে এসে বসে থাকেন। তবুও একবার স্বীকার করেন না যে তার ভুল হয়েছে। অর্ণব কে পড়ানো সেই টিচার মা’কে খালা বলে ডাকতেন। বাড়িতে ভালো রান্না হলে মা তার জন্য বক্সে দিয়ে দিতো। সেই টিচার বড় আপুর চেয়ে বছর পাঁচেকের বড়। মায়ের দোষ ছিলো তার প্রতি আন্তরিকতা দেখানো।
মা সুস্থ হয়ে যাবার পর অর্ণব বাবাকে প্রশ্ন করেছিল, তুমি কিভাবে বিশ্বাস করতে পারো যে আমার মায়ের চরিত্র খারাপ। বাবা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে ছিলেন অর্ণবের দিকে। তিনি আশা করেন নি দশ বছরের ছেলে এরকম প্রশ্ন করতে পারে। তিনি গমগমে গলায় বলল, আমি কী করব না করব সেটা তোমাকে বলব না। তুমি ছোট, ছোটর মতো থাকো। আমাকে এসব ব্যাপার নিয়ে প্রশ্ন করবে না।
অর্ণব চুপ করে রইলো। পরবর্তী তিন দিনে না কথা বলল, না কিছু খেল। বড় আপু, ছোট আপু, ভাইয়া কাঁদে। মা সমানে কাঁদেন, আদর করেন। বাবা এসে খেতে বললে ও কঠিন গলায় বলে যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি বড় ফুপুর সামনে আমার মায়ের পা ধরে ক্ষমা না চাইবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমি খাব না।
অর্ণব কে হসপিটালে ভর্তি করা হলো। বাবা ঠিক সেই কাজ করেছিল যেটা ও করতে বলেছিল। সেদিন অর্ণব শুধু মা’কে জিতিয়েই দেয় নি, তার জীবনটাও পাল্টে দিয়েছিল। বাবা পরবর্তী জীবনে কখনো মায়ের সঙ্গে ওদের ভাই বোনেদের সামনে উচ্চস্বরে কথা বলে নি। বড়ফুপু এলে মা’কে তটস্থ হতে দেখা যায় নি। বোকা, সরল মা বাবার চোখে চোখ রেখে না বলা শিখে গিয়েছিল। অর্ণব সেদিন জেনেছে পৃথিবীতে বিনয় তার সঙ্গে দেখাতে হয় যে সেটার কদর জানে। যে ভালোবাসে তার জন্য ভালোবাসা, যে ছুড়ি মারে তার জন্য ছুড়িই মোক্ষম জবাব। নীরব থেকে অপমান হজম করার কোনো মানে হয় না।
***
ঝিলিক সব জিনিসপত্র নিয়ে পাশের ঘরে গেল। একটা কিছুও রাখলো না। ইশরাক ঘরে ঢুকে সবকিছু দেখে বলল,
“তোর নাটক দেখে এতোটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে এখন আর কিছুতে এফেক্টেড হই না। ”
ঝিলিক তীর্যক হেসে বলল,
“থ্যাংক ইউ সো মাচ। তোমার কাছে আর কিছু এক্সপেক্টও করি না। গায়ে পড়ে বিয়ে করেছিলাম তার জন্য পায়ে ধরতে রাজী আছি। কখন ধরতে হবে বলে দিও। ”
ইশরাকের চোখ দুটো রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। এমনি মুখে কতো কিছু বলে, ইশরাক কে কতো ভালোবাসে, ইশরাক ওর জন্য কী। অথচ আজ একটা ব্যাপার দেখে কীরকম বাজে রিয়েক্ট করছে।
“ঝিলিক শোন, আমার কাছ থেকে তুই একটা এডভাইজ নে তো ফ্রী তে। তুই যতটা প্রগতিশীল চিন্তাভাবনা নিয়ে চলিস বলিস না, ততটা তুই না। জীবন সিনেমা না এটা মনে রাখিস। ”
“ওহ রিয়েলি! আমি প্রগতিশীল? এটা আমি বলেছিলাম! উঁহু কখনো বলি নি। প্রগতিশীল মানুষজনের সেল্ফ রেসপেক্ট থাকে। আমার তো নেই। তোমার বোকা লজিক তোমার জুতার মধ্যে রাখো। ”
“মুখে লাগাম দে ঝিলিক। আমি কিন্তু তোকে থাপ্পড় এর জন্য কিছু বলিনি। ”
“এক্সকিউজ মি! কেন বলবে? একদিন তুমি আমাকে থাপ্পড় মেরেছিলে, আজ আমি তোমাকে মেরেছি। সেদিন তোমার মনে হয়েছিল আমি ভুল, আজ আমার মনে হয়েছে তুমি ভুল। ”
“আচ্ছা শুনলাম আর মেনেও নিলাম। ”
“আরও একটা ব্যাপার শুনে নাও। এখন থেকে তুমি আর ইকরা আমার কাছে সেইম। ”
ইশরাক মেঘস্বরে ঝিলিকের নাম উচ্চারণ করলো। ঝিলিকের তাতে কিছু যায় আসে না। ও অন্যঘরে ঢুকে ফোন বন্ধ করে দিলো।
ফোন অন করতেই দেখলো নাতাশার অসংখ্য মিসড কল জমেছে। ও কলব্যাক করে বলল,
“তুমিও ঠিক আমার ভাইয়েরই মতো। খুব ভালো শত্রুতা দেখালে। ”
“ঝিলিক শোনো….
“উঁহু শুনব না। তোমার দোষ নেই। যার যেখানে থাকা উচিত তাকে সেখানে না রেখে মনে জায়গা দেই আমি। তাই সব দোষ আমার। ”
“ভুল বুঝছ ঝিলিক। ”
“ঠিক বুঝছি। আমার বিয়েতেও তুমি খুশি ছিলে না। এজন্য চেয়েছ ইশরাকের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হোক। তুমিই বলেছিলে না আমি সুপ্রীতিকে হেনস্তা করছি। কম তো দেখনি আমাকে, এই চিনলে! আরেহ তুমি চিনবে কী করে, তুমি হলে সুপ্রীতির বোন। আমার তো কেউ না। ”
নাতাশা কেঁদে ফেলল। অজান্তেই একটা ভুল হয়েছে ওর। ঝিলিক ও’কে ভুল বুঝছে। ভেজা গলায় বলল,
“ঝিলিক শোনো আমার কথা…
ঝিলিক চোখ বন্ধ করলো, ভীষণ ব্যথা করছে চোখ দুটো। কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। ভাঙা গলায় বলল,
“তুমি আমার পালকের মা, ঘৃনা তো কোনোদিন করতে পারব না কিন্তু টাচেও থাকব না। ভালো থেকো। ”
নাতাশা লাগাতার কল করতে গিয়েও ব্যর্থ হলো। ঝিলিক ব্লক করে দিয়েছে। ঝিলিক আজ নি:শব্দে কাঁদছে। নি:শব্দে কাঁদার সুবিধা এই যে কেউ ওর হৃদয়ের ক্ষত টের পাচ্ছে না। কী যে ভুলভাল ভাবে! ওর হৃদয়ের খবর নেবার মতো কেউ তো নেই এই ব্রক্ষ্মান্ডে।
ইশরাক আজও অপেক্ষা করছে অন্যান্য দিনের মতো। ঝিলিক আসবে, এসে ওর রাগ ভাঙাবে।
চলবে…..
সাবিকুন নাহার নিপা
( বানান ভুল ধরিয়ে দিয়েন।)