হৃদয়ের দখিন দুয়ার পর্ব-৩৬

0
236

#হৃদয়ের_দখিন_দুয়ার
#পর্ব-৩৬
যাপিত জীবনে সবাই আছে সবার মতো। সুপ্রীতি অপেক্ষা করছে অনাগত সন্তানের। নিজের মতো করে ভালো আছে। ভয় ভীতিও আছে কম বেশী। সেগুলো সামলে উঠেছে আস্তে ধীরে। মায়ের সঙ্গে ওর আর কথা হয় নি। বাবা আর প্রকৃতি ও’কে দেখতে আসে। কেউ ভুলেও মায়ের কথা বলে না। সুপ্রীতিও জিজ্ঞেস করে না। মাঝেমধ্যে একটা ব্যাপার ভেবে মন খারাপ করে। ঠিক একই রকম কষ্ট তো ও’কে জন্ম দেবার সময়ও ওর মা করেছিল। তবুও ওদের বোঝাপড়া, মানসিক দূরত্ব এতো কম। স্বপ্না সুস্থ হয়েও সুপ্রীতিকে কল করেন নি। তিনি আদৌ পুরো ব্যাপার টা নিয়ে দু:খবোধ করেছে কী না সেটা সুপ্রীতি জানে না।

এক বিকেলে সুপ্রীতির ভীষণ খারাপ লাগলো। হঠাৎ এক শূন্যতা ভর করলো হৃদয়ে। মনে হলো যেন ওর কোথাও কেউ নেই। কেন মনে হলো জানে না। সারাক্ষণ মন খারাপ থাকলো। বিকেলে অর্ণব ফিরলো অফিস থেকে। এসে ওর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলো,

“সুপ্রীতি কেন তোমার এতো মন খারাপ বলো আমাকে? ”

সুপ্রীতি হাসলো, মনও ভালো হয়ে গেল মুহুর্তেই। আজ থেকে পাঁচ বছর পর ওদের সম্পর্কের সমীকরণ ভালো হবে নাকি গিট্টু লেগে কমপ্লিকেটেড হবে সেটা ও জানেনা। কিন্তু ওই বিকেলে ওর মনে হয়েছিল সারাজীবনে ও আসলে অর্ণবের মতোই একজন কে চেয়েছিল। যে ও’কে বুঝবে। বাকী সব যেমন ই হোক, ও’কে বোঝার ক্ষমতা যার আছে তার কাছে ও স্পেশাল।

***
নাতাশা একটু একটু করে এগুচ্ছে। সাফল্যও পাচ্ছে তবে সেই সফলতা কে বড় করে দেখছে না। জীবনে কোনোকিছুই চিরস্থায়ী নয়। যে মাসে ফাহাদের বাড়ি ছেড়েছিল সেই মাসের শুরুতে আচার বানিয়ে ছাদে রেখেছিল রোদের জন্য। মিনিমাম চল্লিশ দিন না রোদ না পেলে ওই আচারে স্বাদ হবে না। কতো ভাবনা চিন্তা ছিলো আচার কে ঘিরে। অথচ একবারও ভাবনায় আসে নি যে ওই বাড়িতে থেকে আচার খাবার মতো দিন ওর আর থাকবে না। তাই যা কিছু মিলছে তার জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া আদায় করছে কিন্তু অহংকারে আকাশে ওঠার কথা ভাবতে পারে না। ভয় হয়, কখন আকাশ থেকে ধপ করে মাটিতে পড়ে যাবে।

নাতাশার সঙ্গে ফাহাদ যোগাযোগ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। পালক কে একবার দেখতে চায়। নাতাশা রাজি হয় না, রাজি না হবার কারণ আছে। মেয়ে এখন আর বাবার কথা মনে করে না। সময় হোক আর অন্য কারণে হোক ভুলে গেছে। ভুলেও একবার পাপার কথা জিজ্ঞেস করে না। এই কথাটা ফাহাদ কে জানানোর পর ফাহাদ অবাক গলায় বলল,

“ভুলে গেছে মানে? আমার মেয়ে আমাকে কেন ভুলে যাবে? ”

“কারণ তুমি পালক কে ভুলে গিয়েছিলে।”

“না তো। পালক আমার রক্ত। ও’কে কেন ভুলে যাব। আমি তোমাকে স্পেস দিয়েছি যেন পালক কে মানিয়ে নিতো পারো। ”

এই কথাগুলো শুনলে নাতাশার হাসি পায়। ফাহাদ প্রতিক্রিয়া দেখায়। নাতাশা তবুও তার সিদ্ধান্তে শক্ত থাকে। ফাহাদ এর বাইরে কিছু করতে পারে না। করার কিছু নেইও। নাতাশার মাঝেমধ্যে মনে হয় ও কী শাস্তি দিচ্ছে মেয়েকে। বাপের কাছ থেকে আলাদা করে ফেলতে চাইছে চিরতরে এটা কী শাস্তি! কিংবা বড়সড় অন্যায়! কখনো কখনো নিজের যুক্তির কাছেও পরাজিত হয়। মনে হয় এটুকু অন্যায় ও করতেই পারে। ওর মেয়ের সাথেও কম অন্যায় হয় নি।

ফাহাদের বাবা প্রায় অনেকদিন পর এসেছিলেন। ভদ্রলোক সবসময় নাতাশাকে বউমা বলেই ডাকতেন। আজকাল সেই ডাকটা এড়িয়ে যান। একটা সংকোচ থেকে যায় তার মনেও। নাতাশা আজও তাকে বাবা বলে ডাকেন। এই ডাক টা ওর মন থেকেই আসে। এখানেও হেরে যায় নিজের কাছে। সম্পর্ক ছাড়লেও এই মানুষগুলোকে ওর ছাড়া সম্ভব হয় নি।

রুবাবের সঙ্গে নাতাশার দেখা হয়েছিল ওর মনখারাপের দিনগুলোতে। একদিন হঠাৎ ই ওর মেসেঞ্জারের ইনবক্সে মেসেজ এলো।

“তোমার কী একটু সময় হবে? আমি পালকের সঙ্গে দেখা করব।”

নাতাশা সেই মেসেজ টা দেখলো দীর্ঘ সময় ধরে। নিজের সমস্ত যুক্তি আরও একবার গুলিয়ে ফেলল। লিখলো,

“কবে আসবেন? ”

রুবাব ওর সময়মতো এসেছিল। কতদিন পর দেখা পালকের সঙ্গে। তবুও পালক রুবাব কে দেখে চিনে ফেলল। রুবাব পালকের সঙ্গে গল্প করলো , কথা বলল। নাতাশার সঙ্গে সংক্ষিপ্ত বাক্যে কথা শেষ করলো। অথচ ওদের দেখা হওয়ার এই ঘটনা দূর থেকে দেখলে যে কেউই ভাবতো একজন আরবকজনের শুভাকাঙ্ক্ষী।

রুবাবও অনেক দিন শহরের বাইরে ছিলো। জাফলং, বান্দরবান, শ্রীমঙ্গল, ছাতক, তেতুলিয়া, টেকনাফ ঘুরেফিরে কাটিয়েছে আর নিজের লেখাটা মন দিয়ে চালিয়েছে। ঢাকা শহর কে ওর নিষ্ঠুর লাগে এখন। কারণ এই শহরে নিষ্ঠুর মানুষদের বসবাসই বেশী। কতদিন এমনও গেছে যে ফোন টা পর্যন্ত চেক করে নি। ওর এমন কে ই বা আছে যে প্রতিদিন ও’কে কল করে খোঁজ নিবে। শুভাকাঙ্ক্ষী কাজের জায়গা থেকে কল পেতেও বিরক্ত লাগছিল। হঠাৎ একদিন ছোট একটা বাচ্চাকে মায়ের হাত ধরে হাটতে দেখে ওর মনে হলো এবার শহরে ফেরা দরকার। ছোট্ট পালকের সঙ্গে এবার দেখা না করলেই নয়। নাহলে বাচ্চাটা ওর মুখটা ভুলে যাবে। ওর সঙ্গে করা খুনশুটি গুলো জীবনের স্মৃতির পাতায় জমা হোক। বরাবরই ওর বাচ্চা ভীষণ পছন্দের। ইকরার আবার বাচ্চা পছন্দ না। পরিচিত কিংবা আত্মীয়দের মধ্যে কারোর বাচ্চাকে আদর করে কোলেও নিতে দেখা যায় না। রুবাব একবার বলেছিল বাচ্চার কথা। ইকরা রাজী হয় নি, রুবাব জোর করতে পারে না। প্রেগন্যান্সি পিরিয়ডের এতো বড় কঠিন জার্নি ও চাইলেই চাপিয়ে দিতে পারতো না নিজের শখ পূরণ করার জন্য।

রুবাব ক্লান্ত মনমরা নাতাশাকে জিজ্ঞেস করতে চাইলো না ওর কী হয়েছে। ও কেমন আছে। নাতাশা নিজের জীবনের উঁচু নিচু সিড়িগুলো টপকে ফেলবে একদিন। ওর কাউকে লাগবে না। রুবাবের মতো কাউকে ওর কোনোদিনও দরকার হবে না। নাতাশারা ঠিকই নিজের ভালোবাসার জায়গা খুঁজে নিতে জানে। ওদের করুনার দরকার হয় না।

চলবে….