#হৃদয়ের_দখিন_দুয়ার
#পর্ব-৩৭
ঘুমন্ত ফাহাদ কে এই মুহুর্তে ইকরার একই সঙ্গে বিশ্রী ও বিরক্তিকর লাগছে। মাস তিনেক আগে ফাহাদ একবার বলেছিল চলো ইকরা আমরা ফ্যামিলি প্ল্যানিং করে ফেলি। ইকরার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলেও নিজেকে সামলে ঠান্ডা গলায় বলেছিল,
“কেন? তোমার তো অলরেডি বেবি আছে। বাপ হবার আবার শখ জাগলো কেন?”
ফাহাদের মুখটা চুপসে গেল বেলুনের মতো। ইকরা বলল,
“আই ডোন্ট লাইক বেবিজ। তাছাড়া মা হবার মতো কোনো শখ নেই আমার। কোনোকালেও হবেও না। ”
ফাহাদ আর কিছু বলে নি। ইকরা এই মাসে খেয়াল করলো বিশ দিন পাড় হয়ে গেলেও ওর পিরিয়ড হচ্ছে না। শেষমেস প্রেগন্যান্সি টেস্ট করে দেখলো পজিটিভ। ইকরার খুব রাগ হলো। বিশ্রী কিছু শব্দ বেরিয়ে এলো ফাহাদের জন্য। ইকরা বুঝতে পারছে যে রুবাবের কাছ থেকে বেরিয়ে ও আরেকটা আস্তাকুঁড়ে এসে পড়েছে। ফাহাদ কে ওর অফিসেই ঠিকঠাক লেগেছিল, সেখানেই ঠিক ছিলো। সম্পর্ক চালিয়ে যেত সেটাই ভালো হতো। রুবাবের উপর জেদ করে নিজের পায়ে আসলে ঠিক কুড়াল মারে নি। কুপিয়ে কুপিয়ে জখম করেছে।
ইকরা প্রেগন্যান্সি স্ট্রিপ টা নিয়ে বসে রইলো। জীবনে এতো সমস্যার মধ্যে আরেকটা সমস্যা এসে জুটেছে। এই মুহুর্তে কেন আগামী পাঁচ বছরেও ওর মা হবার কোনো ইচ্ছে নেই। বাচ্চাদের প্রতি ওর তেমন টান নেই। ভাইয়ের বাচ্চাদের প্রতি ওর স্নেহ, ভালোবাসা আছে সেটা সত্যি। কিন্তু তাই বলে নিজের বাচ্চা হবে, সেরকম স্বপ্ন ও দেখে না। দশ মাসের দীর্ঘ জার্নি, শরীর মুটিয়ে যাওয়া, সুন্দর ত্বকে বলিরেখা আসা এসব একসেপ্ট করার মতো, আরেকজনের জন্য দীর্ঘ রাত জাগার মতো সক্ষমতা এখনো ওর মধ্যে আসে নি। তাই এই আনপ্ল্যানড প্রেগন্যান্সি ওর কাছে রাগ ও বিরক্তি ছাড়া আর কিছুই নয়।
ফাহাদ পাশে ইকরাকে না পেয়ে ডাকলো,
“ইকরা, সোনা কী হয়েছে? ওভাবে বসে আছ কেন?”
ইকরা শুনেও জবাব দিলো না। ফাহাদ আতঙ্কিত হয়ে গেল। কী না কী হয়ে গেল আবার! উঠে চলে এলো। জিজ্ঞেস করলো আবারও,
“কী হইছে ইকরা?”
ইকরা রাগী চোখে তাকিয়ে হাতের জিনিস টা ফাহাদ কে দিলো। ফাহাদ ড্রিম লাইটের মৃদু আলোতে স্পষ্ট দেখতে না পেয়ে বাতি জ্বালিয়ে দেখলো। মুহুর্তেই হাসি ফুটে উঠলো। ইকরাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল। ইকরা এক ধাক্কা দিয়ে মেঘস্বরে বলে উঠলো,
“খুশি হবার মতো কিছু ঘটে নি ফাহাদ। আমার ডিসিশন চেঞ্জ হবে না।”
ফাহাদের হাসিমুখ টা মলিন হয়ে গেল। চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। বলল,
“এবোর্ট করতে চাইছ বাচ্চাটাকে? ”
“অফ কোর্স। আমি তো আগেই বলেছি বাচ্চা আমার পছন্দ না।”
ফাহাদ শীতল গলায় বলল,
“ভুলেও এটা করতে যাবে না ইকরা। আমার বাচ্চা পৃথিবীতে আসবে।”
ইকরা অবাক হলো ফাহাদের গলা শুনে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আমাকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করানোর চিন্তা ভুলেও করবে না। আমি কিন্তু… আমি কিন্তু নাতাশা না যে তোমার কথামতো বাচ্চা জন্ম দেব। লুজার কোথাকার।”
সবসময় ইকরার রাগ, তিক্ত কথা গিলে ফেলা ফাহাদ আজ আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। এক থাপ্পড় মারলো ইকরার গালে। আকস্মিক থাপ্পড়ে ইকরা হতভম্ব হয়ে গেল! এই প্রথম এভাবে কারো হাতে থাপ্পড় খেয়েছে ও। মা, বাবার হাতে কবে মাইর খেয়েছে ওর ভালো করে মনে পড়ে না। ফাহাদ হিসহিস করে বলল,
“আমার বাচ্চার ক্ষতি করার কথা আর একবারও যেন না শুনি। ”
ইকরা হতভম্ব ভাব কাটিয়ে ফাহাদের গালে এক থাপ্পড় মারলো। মারার পর মনে হলো থাপ্পড় টা জোড়ালো হয় নি। দ্বিতীয় বার আবার থাপ্পড় মারলো। ফাহাদ এবার নিজেও হতভম্ব। কোনো বউ যে স্বামীকে থাপ্পড়ের বিনিময়ে থাপ্পড় ফিরিয়ে দিতে পারে সেটা ও প্রথম আবিষ্কার করলো।
****
সুপ্রীতি সুন্দর হেলদি এক ছেলে বাচ্চার জন্ম দিয়েছে। মা, বাচ্চা দুজনেই ভালো আছে। শেষ ক’টা দিন ওর সঙ্গে অর্ণবও রাত জেগেছে। প্রথম বার অর্ণবের রাগী চেহারার বদলে ফ্যাকাসে মুখটাও দেখতে পেল। হসপিটালে যাবার আগে সুপ্রীতি যখন অর্ণবের হাত ধরেছিল তখন সেই হাতটা কাঁপছিল। সুপ্রীতির খেয়ালে তখন একটা কথা এলো, আল্লাহ এই মানুষ টা আসলেই আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে না। আমার যেন কিছু না হয়, ওর জীবন সত্যিই থমকে যাবে।
অর্ণব সন্তানের মুখ দেখে ভীষণ খুশি। আনন্দে বুক যেন ভারী হয়ে গেল। এতো আনন্দ! ঠিক একই দিনে বাবা হিসেবে ওরও জন্ম হলো যেন।
স্বপ্না দেখতে এসেছিলেন মেয়ে আর নাতিকে। অর্ণব তাকে দেখতে দেন নি। স্বপ্না তবুও কঠিন গলায় বললেন,
“আমাকে আটকাবার তুমি কে? তোমার কথাই বা আমার কেন শোনা লাগবে। ”
অর্ণব হেসে বলল,
“আমি যে কে সেটা আপনি জানেন না? আপনার সামনে কবুল বলে, রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করে আপনার মেয়েকে বিয়ে করেছিলাম। বিয়ের ভিডিও ফুটেজ টা হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে রাখব দেখবেন আরেকবার। এখন আপনার আমার বউ, বাচ্চাকে দেখার কোনো দরকার নেই। তাদের পাশে এই মুহুর্তে তারাই থাকবে যারা ওদের ভালোবাসে। যে ক্ষতি চেয়েছে সবসময় তার সঙ্গে ফর্মালিটি করার প্রয়োজন মনে করছি না।”
স্বপ্না ঝামেলা করার চেষ্টা করেও দমে গেলেন। অর্ণব কে তার বিশ্বাস নেই। চূড়ান্ত রকম অসভ্য ছেলেটা তাকে ধাক্কা দিয়েও বের করতে পারে।
সুপ্রীতি হসপিটাল থেকে আসার পর ঝিলিক কে একটা চিঠি লিখলো। ঝিলিকের সঙ্গে কথা বলা কিংবা যোগাযোগ করার চেষ্টা ও করে নি। না চাইতেও ওদের সম্পর্কে সুপ্রীতি তৃতীয় ব্যক্তি। ইশরাকের সঙ্গে ঝিলিকের সেদিনের ব্যবহার ও’কে বুঝিয়ে দিয়েছে যে ভুল বোঝাবুঝির সম্পর্ক চলছে ওদের। সুপ্রীতি সেখানে এডভাইজর হতে চায় নি। স্বামী, স্ত্রীর সম্পর্ক একান্ত ব্যক্তিগত সম্পর্ক। সেখানে ওর কিছু করার নেই। ঝিলিকের ঠিক বোঝা যেমন ইশরাকের, তেমনি ভুল ভেঙে দেয়ার দায়িত্বও ইশরাকের। সুপ্রীতি চিঠিটা লিখেছে শুধু নিজের মনের কথাটা জানানোর জন্য।
ঝিলিক,
“আমাদের আসলে ঘৃনার সম্পর্ক না, আবার পছন্দের সম্পর্কও না। আমি জানি ঝিলিক আমাকে পছন্দ করে না। আবার এটাও জানি যে ঝিলিক আমাকে ঘৃনাও করে না। আমার ক্ষেত্রেও তেমন। চট করে কাউকে পছন্দ করা আমার স্বভাবে নেই। কারোর সঙ্গে সহজে মিশে যাওয়ার স্বভাবও আয়ত্ত করতে পারে নি। আমি খুব অল্পসংখ্যক মানুষের সঙ্গে মিশি। তাই তোমাকে পছন্দ, অপছন্দ করার পিছনে অন্য কোনো কারণ নেই। আমি সবসময় মনে করেছি এটা আমার ব্যর্থতা যে আমি তোমার পছন্দ করতে পারছি না। তবে এটা তো সত্যি যে আমাদের দুজন দুজন কে পছন্দ না করার কারণ একজন মাত্র ব্যক্তি। ঝিলিক অনেকবার একটা কথা এসেছে যে আমাদের দুজনের মধ্যে তুমি তৃতীয়জন হয়ে এসেছ। এটা সত্যি নয়। আমাদের সম্পর্ক ভাঙার জন্য আমরাই দায়ী ছিলাম। আমরা দুজন দুজন কে পছন্দ করলেও একজন আরেকজনের মতো ছিলাম না। দুজনের চাওয়ার ভীষণ অমিল ছিলো। আমি একটু আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর মানুষ। ইশরাক পুরোপুরি তার উল্টো। আমার চাওয়া ছিলো ইশরাক আমার জন্য বদলে যাক। এইরকম হাজারো অমিলের কারণ ছিলো আমাদের আলাদা হবার। আমি কখনো তার জন্য তোমাকে দায়ী করছি না। এতগুলো কথা তোমাকে বলতে হলো কারণ আমার মনে হচ্ছে তুমি আমাকে নিয়ে নেতিবাচক ধারণা মনের ভেতর পুষে রেখেছ। আমি চাই না, কোনোদিন তোমার আমার দেখা হলে চোখ নামিয়ে নিতে না হয় দুজনের কারোর ই। চিঠির উত্তর আশা করছি না ঝিলিক। তবুও যদি একদিন আমাকে আর বাবুকে দেখতে আসো সেদিন আমি তোমার সঙ্গে মন খুলে কথা বলব, গল্প বলব। সেদিন তোমার আমার গল্পে ইশরাক থাকবে না। আমরা শুধু আমাদের হয়ে কথা বলব।
চলবে….