হৃদয়ের দখিন দুয়ার পর্ব-৩৯+৪০

0
123

#হৃদয়ের_দখিন_দুয়ার
#পর্ব-৩৯
ইকরা বুঝতে পেরেছিল যে ও’কে কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসছে না ফাহাদের কারণে। ইকরা বেরিয়ে গেল চিৎকার চেঁচামেচি করে গেট খুলে। পরদিন দুপুর নাগাদ পুলিশ এসে ধরে নিয়ে গেল ফাহাদ কে। ইকরার হাতের দুটো আঙুল ভেঙে গেছে। পায়ের জখমও গুরুতর। ফাহাদের নামে মামলা করা হয়েছে। ফাহাদের মেজাজ নিয়ন্ত্রণে ছিলো না। ইকরা যদি বেরিয়ে যাবার সুযোগ টুকু কাজে না লাগাতো তাহলে হয়তো ফাহাদ ও’কে মেরেই ফেলতো। তবে ইকরাও ছেড়ে দেবার পাত্রী নয়। হাজতে গিয়ে ফাহাদও পুলিশের হাতে বেশ মার খেল। ওর বাড়িতে খবর পৌছানোর পর খুশি আর ওর স্বামী এলো ঝামেলা সামলাতে। ততক্ষণে ইকরা ঝামেলা আরও বেশী করে পাকিয়ে দিয়েছে। এরপর অ্যাপার্টমেন্টের কেয়ারটেকার কেও তার কৃতকর্মের জন্য উচিত শিক্ষা দিলো।

খুশি বিরক্ত গলায় ফাহাদ কে বলল,

“এগুলো কী হচ্ছে ভাই? মাত্র দুইটা বছরও গেল না। তার মধ্যেই অশান্তি। এইটারে তো অশান্তি বলে না। আমাদের বংশে এই প্রথম কেউ বউ পিটায়ে হাজতে আসছে। ”

“কু*ত্তী এবোর্শন না করালে আমার মাথায় রক্ত উঠতো না।”

“তোমার সব কাজ এমন হুটহাট। ভাবীর সাথেও এমন করছ। এমন রাগ যে কতো ক্ষতি, এখন টের পাবা। চাকরি থাকবে এরপর? ”

ফাহাদ গমগমে গলায় বলল,

“ভ্যাজর ভ্যাজর করিস না। এখন ছাড়ানোর ব্যবস্থা কর। হাতি কাদায় পড়লে চামচিকায়ও লাত্থি মারে। আমার হইছে সেই দশা।”

“টাকা পয়সা কই আছে বলো। উকিল, পুলিশ সবাইকেই টাকা খাওয়ান লাগবে। ”

ফাহাদের মনে পড়লো ওর কার্ড, চেকবুক সব ইকরার কাছে। একটা ডেবিট কার্ড আছে ওর ওয়ালেটে। সেটায় বেশী টাকা নেই। ”

ফাহাদ নিস্তেজ গলায় বলল,

“ব্যবস্থা কর তোরা… বের হয়ে টাকা দিয়ে দেব। ”

খুশি বিরক্ত হলো। ওর এখানে আসা ছাড়া আর উপায় ছিলো না। বাবা, কাকা কেউ আসবে না। তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে এবার ফাহাদের বাড়ির চৌকাঠ পেরোনো বন্ধ। মায়ের কান্নাকাটি দেখে বাবা এতো জোরে ধমক দিলেন যে খুশি কেঁপে উঠলো। তিনি বললেন প্রয়োজনে সে ফাহাদের মা’কেও বাড়ি থেকে বের করে দিবেন যদি বেশী বাড়াবাড়ি করে।

খুশির স্বামী বলল,

“কী বলল তোমার ভাই?”

ইকরাকে বিয়ে করার পর থেকে ওর স্বামী আর ফাহাদ কে পছন্দ করে না। এমনকি খুশিকেও বলছে দুশ্চরিত্র ভাইয়ের দুই চার টাকা খাওয়ার আশায় আলগা সম্পর্ক রাখবা না। আমার মান সম্মান আছে। আমরা ভদ্র বাড়ির ছেলে। ঘরে বউ রেখে অফিসের মেয়েতে মজি না।

খুশি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

“কী আর বলবে? বলল ওরে যেন ছাড়ানোর ব্যবস্থা করি। ”

“তাইলে করো। টাকা পয়সার বন্দোবস্ত করতে আমাকে বলবা না। তুমি সামলাও।”

“আমি কেমনে সামলাব? আমার টাকার গাছ আছে?”

“তাইলে চলো আমার সাথে। আর যদি ভাইয়ের জন্য দরদ উতলায়ে পড়ে খুব তাইলে নাতাশা ভাবীর কাছে গিয়ে একবার পায়ে ধরে মাফ চাও। তার অভিশাপ তো লাগছে। লাগার কথাই। ”

***
নারী নির্যাতনের কঠিন মামলায় ফাহাদের জামিনের ব্যবস্থা করা গেল না। ইকরা ওর উকিল কে টাকা খাওয়াচ্ছে। ইশরাক উকিল ধরেছে। বাড়িতে কেউ এই ব্যাপারে নাক গলাতে রাজি নয়। বাধ্য হয়ে ও’কে আসতে হলো। ঝিলিক গেল একদিন ফাহাদের সাথে দেখা করতে। টিফিন বক্স ভরে খাবার নিয়ে গেল। ফাহাদ খুব খুশি হলো। পুরোনো রাগ পুষে রাখলো না ঝিলিকের জন্য। ও’কে বলল,

“আরেকবার পালকের সঙ্গে আমাকে দেখা করাতে পারবি?”

“এখান থেকে বের হও। আমি ব্যবস্থা করব। ”

“নাতাশা কেমন আছে?”

“আমি জানিনা। ”

ফাহাদ ভারী অবাক হলো। বলল,

“জানিস না? ও তাহলে কিভাবে আছে? ওর মামাদের ওখানে আছে নাকি সুপ্রীতিদের ওখানে? ”

ঝিলিক হেসে বলল,

“বাসা ভাড়া করে সে একা আছে। আশ্চর্য তুমি সেটাও জানো না, পালকের জন্য অন্তত জানা উচিত। ”

ফাহাদ অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। নাতাশা একা থাকে এটা ও সত্যিই জানেনা। একবার শুধু ও’কে রিয়াদ বলেছিল ভাবী মিরপুরে থাকে। নাতাশার ছোট মামাও থাকে মিরপুরে। ভেবেছে সেখানেই থাকে হয়তো। মা’ও কখনো সেভাবে বলেনি। ফাহাদ জিজ্ঞেস করলো,

“কিছু কী করে?”

“হ্যাঁ। বিজনেস পেজ আছে। হোম ফুডের কাজও চলছে। ভাইয়া সে আসলে ভালো আছে। তার হাতে এতো কাজ যে সে খারাপ থাকার সময় পায় না। ”

ফাহাদ তাকিয়েই রইলো। ওর যেন বিশ্বাস হতে চায় না। নাতাশা এতো কিছু কিভাবে করতে পারছে। ও তো গাজীপুর থেকে ঢাকাও কখনো একা যেতে সাহস করতো না।

ঝিলিক বলল,

“ইকরা আসে নি দেখা করতে?”

“খা**র নাম নিস না।”

ঝিলিক বলল,

“আজকের সবকিছুর জন্য আসলে তুমিই দায়ী ভাইয়া। ইকরার আমি তেমন দোষ দেখিনা। ইকরার পশ লাইফস্টাইল দেখেই তুমি তার প্রেমে পড়েছ। সে তো আর রান্না বান্না, বাচ্চার মা হয়ে তোমার সেবা যত্ন করবে না।

“যা জানিস না সেগুলো নিয়ে বলিস না। বাচ্চা নষ্ট করা মানে বুঝিস? একটা ভ্রুন, একটা প্রান কে হত্যা করা। ”

“বাহ! আর পালক যে দুনিয়াতে আছে ওর কোনো গুরুত্ব নেই?”

ফাহাদের বুলি বন্ধ হয়ে যায়। তবুও জিততে হবে এমন গলায় বলে,

“কেন পালকের দায়িত্ব তো আমি নিতে চেয়েছি। আমি নাতাশাকে কতো কল করেছি জিজ্ঞেস কর। ”

“তুমিও নিজেও জানো যে কী কী করেছ। তুমি জানোই না পালক আর পালকের মা কোথায় আছে। ”

“তো? তোরা আছিস না? বাবা তো আর পালককে ফেলে দেয় নি তাই না?”

“তুমি পালকের মা’কে বা*ল চিনছ। একটা টাকা সে নেয় নাই আমাদের থেকে। শুধু পালকের সঙ্গে দেখা করার সুযোগটুকু ছাড়া আর কোনো সুযোগ সে আমাদের দেয় নাই। আর পালকের প্রতি এই ব্যবহার এর কারণে ইকরা তোমার বাচ্চার মা হতে চায় নি। কারণ ও জানে দুই দিন পর তোমাদের সেপারেশন হলে তুমি বাচ্চার দায়িত্ব এড়িয়ে যাবে।”

ফাহাদ শ্লেষ এর হাসি হেসে বলল,

“এখন তোর কাছ থেকেও আমাকে এতো জ্ঞান নিতে হবে। ”

“জ্ঞান নিয়েও তোমার আর কাজ হবে না। সর্বনাশ সব করে ফেলেছ যা করার।”

ফাহাদ কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। ওর জন্য কারোর খারাপ লাগা নেই, আছে শুধু ধীক্কার। কেউ ইকরার দোষ টা দেখছে না। দেখছে শুধু ওর দোষ।

***
ইকরা ওর জীবনে এমন মার খাওয়া লোকের পাল্লায় কখনো পড়ে নি। পরিবারে একটু বেশী প্যাম্পার ও’কে বেপরোয়া করেছে ঠিকই। কিন্তু তাই বলে এমন মানুষের সাহচর্য কাম্য হতে পারে না। থাপ্পড় এর ব্যাপার টা ও সহজ ভাবে মেনে নিয়েই ভুল টা করেছে। একটা থাপ্পড় যে মারতে পারে সে দশটা থাপ্পড়ও মারতে পারবে সুযোগ পেলে। ইকরা ভেবেছিল থাপ্পড়ের বিপরীতে থাপ্পড় খেয়ে ফাহাদ আর গায়ে হাত তোলার সাহস করবে না। কিন্তু ফাহাদ ওর কল্পনার বাইরে গিয়ে কাজগুলো করেছে। এমন মাইর ও জীবনে খায় নি। মনে হচ্ছিলো ওখান থেকে না বেরোলে ফাহাদ হয়তো ওর জান ই নিয়ে নিবে।

ইকরা ফাহাদ কে ছাড়বে না। ওর জীবনে আগুন জ্বালিয়ে যাবে লাগাতার। এই সুযোগ টাকে কাজি লাগিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা সিম্প্যাথি গেইন করলো। সোশ্যাল মিডিয়া আরও একবার উত্তপ্ত হলো ইকরার জন্য। কমেন্ট বক্সে কেউ কেউ ওর জন্য দু:খ প্রকাশ করেছে কেউ কেউ আবার খুশি হয়েছে। রিভেঞ্জ অব নেচার বলে উপহাস করতেও কেউ ছাড়ে নি। এখন আর ইকরার এসব ভেবে হতাশ লাগে না। হ্যাঁ ভুল একটা ও করেছে, ফাহাদ কে ওই সময়ে বিয়ে করাটা ওর ভুল ছিলো। রুবাবের আকস্মিক ধাক্কা না সামলে ফাহাদ কে বিয়ে করা আসলে বড়সড় ভুল ই। কিন্তু তাই বলে পরবর্তী স্টেপেও একই ভুল তো আর করবে না।

ইশরাক পরেরবার যখন ফাহাদের সঙ্গে দেখা করতে গেল তখন জানালো যে বাড়িতেও ওরা স্বস্তি পাচ্ছে না। একদল লোক বাড়ি গিয়ে ভাঙচুর করেছে। কারো গায়ে হাত তোলে নি কিন্তু অনেক ক্ষতি করেছে। ভাড়াটিয়া যারা ছিলো তারা বাড়ি ছেড়ে দিচ্ছে, এলাকার মানুষজন ওদের পাশে দাঁড়ানোর বদলে বিরক্ত হচ্ছে। ফাহাদ আতঙ্কিত গলায় বলল,

“বাবা, মা এখন কোথায়?”

“তারা ঢাকায় আছে। আমাদের বাসায়। বাড়িতে রাখার রিস্ক নেই নি। ”

“ভালো করছিস। ”

“আমাকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করছিস?”

“কেস কোর্টে উঠুক। জামিন সম্ভব না এখন। ”

ফাহাদ চুল খামচে ধরে বলল,

“আমাকে শেষ করে দিলো…. একদম শেষ করে দিলো।”

“বেরিয়ে তারপর কী করবে? ইকরা তো মনে হচ্ছে না এতো সহজে তোমাকে ছাড়বে। ওর লোকবল আছে। ”

“ও’কে আমি দেখে নেব। সব হিসাব বুঝে নেব। নাতাশা আর পালক ঠিক আছে। ”

“ওদের চিন্তা বাদ দাও। ওরা ওদের মতো আছে। ”

ফাহাদ এখন সবাই কে নাতাশা আর পালকের কথা জিজ্ঞেস করে। বহুকাল পর মনে পড়ে গেল বোধহয় যে নাতাশা আর পালক ওর জীবনে জুড়ে আছে।

***
ফাহাদের জন্য সুপ্রীতির চিন্তা নেই। ওর চিন্তা নাতাশাকে নিয়ে। ফাহাদের পরিস্থিতি আবার নাতাশাকে যেন দূর্বল না করে সেটা নিয়েও ওর শঙ্কা আছে। ও নিজে না গেলেও অর্ণব কে পাঠালো। অর্ণব নাতাশাকে বলল,

“চলুন কয়েকটা দিন আমাদের ওখানে গিয়ে থাকবেন। ”

নাতাশা হেসে বলল,

“আরে ভাই আমার আবার কী হবে? আমি তো ঠিক আছি। ”

“সে তো জানি। আপনার বেঠিক থাকার কোনো কারণও নেই। আর শুধু যে বিপদে থাকলেই আমি আপনাকে মনে করব তাও তো না। আমার এতো সুখের দিনেও নাহয় আপনাকে একটু মনে করলাম। ”

নাতাশা ফিরাতে পারলো না এই আন্তরিকতা। অনেক কঠিন মানুষও সময় অসময়ে দূর্বল হয়ে পড়ে। ও তো কঠিন না, দূর্বলই। ওরও লোভ হয় কারোর আদর, যত্ন, এটেনশন পেতে। মন খুলে নিজের গল্প বলতে। তাই অর্ণবের সঙ্গে চলে গেল ব্যাগপত্র গুছিয়ে। অর্ণবের সঙ্গে যাবার পর ঝিলিক এসেছিল পালক কে নিতে। বাবা, মায়ের সঙ্গে দেখা করাবে সেই উদ্দেশ্যে পালক কে নিয়ে যেতে। ওর মনে অবশ্য গোপন ইচ্ছাও ছিলো ফাহাদের সঙ্গে একবার পালকের দেখা করানোর। রক্তকে তো আর অস্বীকার করা যায় না। ভাইয়ের এই খারাপ সময়ে তাকে যতই কথা শুনিয়ে আসুক, মনটা একটু হলেও আদ্র হয়। ইশরাক ঝিলিকের মনের ভাবনা শুনে বলল,

“নাতাশা ভাবীর সঙ্গে এতো নিষ্ঠুর হোস না ঝিলিক। আর পালকের স্মৃতিতেও বাবার সঙ্গে এরকম দেখা হওয়া না থাকুক। আবেগ নয়, অন্তত বিবেক দিয়ে এই ব্যাপার টা চিন্তা কর।

ঝিলিক মেনে নেয়। ওর জীবনের এই পরিস্থিতিতে ও মেইলবক্সে সুপ্রীতির লেখা চিঠিটা পায়। ভালো খারাপ কোনো অনুভূতি হয় না। অনেক কিছু লিখতে গিয়েও লিখলো না। এতো সুন্দর একটা সময় সুপ্রীতি কাটাচ্ছে সেটা নষ্ট করতেও চাইলো না। ও কাগজে লেখা চিঠি পাঠালো সুপ্রীতিকে।

সুপ্রীতি,

আমার তোমার উপর অনেক অভিযোগ আছে। একদিন যখন আমি বড় হবো তখন হয়তো মনে হবে আমার অভিযোগ যুক্তিহীন। তবে একটা ব্যাপার সত্যি যে ভাবীর এই বোনটাকে আমি কখনো পছন্দ করতে পারি নি। আজও যে পছন্দ করি সেটা বলতে পারব না। তুমি তোমার জীবনে ভালো আছ, আনন্দে আছ ভেবে আমিও খুশি হবার চেষ্টা করি কিন্তু খুশি হতে পারি না। কারণ না চাইতেও তুমি আমার জীবনে জুড়ে আছ। এখনো তোমার প্রাক্তন তোমাকে মিস করে। হয়তো হৃদয়ের গহিনে লালনও করে। গহিনে কেন বলছি, তার হৃদয়ে অনেক টা জায়গা জুড়ে তুমিই আছ। আমি সেখানে জোর করে একটু জায়গা করার ব্যর্থ চেষ্টা করছি। এই চেষ্টা সম্ভবত সফল হবে না। না হবার জন্য দায়ী তো তুমিই থাকবে না! তবুও সেই আক্ষেপ থেকেও তোমার ভালো চাই। তোমার ছেলের জন্য উপহার পাঠালাম ভালোবেসে। নির্ভেজাল ভালোবাসাটুকু গ্রহনের অনুরোধ রইলো। তোমার প্রতি যত আক্ষেপ ই থাকুক। বাবুর জন্য ভালোবাসা রইলো। ব্রক্ষ্মান্ডের সকল আনন্দ আর খুশি এসে ওর কাছে জমা হোক। কারো নজর না লাগুক। আর আমাদের কখনো দেখা হবে কী না জানিনা। তোমার সঙ্গে মন খুলে গল্প বলার মতো কোনো গল্প যদি জমে আমি সেদিন তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসব।

ঝিলিক ওর একটা সোনার চেন পাঠালো সুপ্রীতির ছেলের জন্য। এই চেন টা ওর দাদীর দেয়া। সবার মধ্যে সে ঝিলিক কে ভালোবাসতেন বেশী। ও সুপ্রীতির ছেলের জন্য কিছু কিনে পাঠাতে পারতো কিন্তু মনে হলো এটাই পাঠানো যাক।

চলবে…

#হৃদয়ের_দখিন_দুয়ার
#পর্ব-৪০
অনেক বেশী পরিশ্রম আর স্ট্রেস যাচ্ছে ইশরাকের। ফাহাদের হয়ে ও’কেই সবচেয়ে বেশী দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছে। বাকীরা সবাই হাত, পা গুটিয়ে নিয়েছে। ইশরাকের বাবা, মা দুজনেই এই বিষয় টা নিয়ে রাগারাগি করছে। তারা কিছুতেই চাচ্ছেন না ফাহাদের জন্য ইশরাক কিছু করুক। ফাহাদের বাবা অবশ্য কিছু বলছেন না, তবে মা খুব তড়পাচ্ছেন। তিনি ছেলের সঙ্গে দেখা করার কথাটা সাহস করে বলতে পারছেন না। তার স্বামী এমনিতেই খুব রেগে আছেন। একদিন ইশরাক কে ডেকে বললেন,

“শুধু শুধু টাকা খরচ করছ ইশরাক। আমি কিন্তু একটা টাকাও খরচ করতে আগ্রহী না।”

ইশরাক কারোর কথায় পাত্তা দিচ্ছে না। ভাই হিসেবে ওর যতটুকু করার ও করছে। বাকী ভাই বোনেরাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। নেয়ার কারণ অবশ্য ফাহাদ ই তৈরী করে দিয়েছিল। তাদের দোষ দেয়া যায় না।

ঝিলিক লেবুর শরবত করে রেখেছিল ইশরাকের জন্য। আজকাল ইশরাক কে দেখলে ওর মায়া হয়। স্ট্রেস আর পরিশ্রমের চিহ্ন মুখে স্পষ্ট বিরাজমান। ইশরাক শরবতের গ্লাস হাতে নিয়ে বলল,

“ঝিলিক তোর সঙ্গে আমার একটু কথা আছে। তোর মন মেজাজ ঠিক আছে এখন?”

ঝিলিক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

“হ্যাঁ বলো।”

“একটা রিকোয়েস্ট তোর কাছে। আমাদের বাবা মায়ের এখন যে অবস্থা তাতে আমাদের সম্পর্কের অবনতি সম্পর্কে না জানালে ভালো হয়।”

ঝিলিক শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। কী বলবে বুঝতে পারছে না। ইশরাক আবারও বলল,

“আমাকে আরেকটু কষ্ট করে সহ্য করে থাক। তারপর নাহয় ডিসিশন নেয়া যাবে। আমাদের ডিসিশন বড়দের মেনে নেবার মতো ক্ষমতাও তো থাকতে হবে তাই না!”

ঝিলিক কোনোরকম মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। ইশরাক কথা শেষ করার পরও ঝিলিক বসে রইলো দেখে বলল,

“আমার আর কোনো কথা নেই ঝিলিক। ”

শেষ বাক্যটা ঝিলিকের কাছে ব্যথার মতো লাগলো। ওদের সম্পর্কের বাঁধন সত্যি সত্যি আলগা হয়ে গেছে। মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। কী ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ওর!

***
“ও তোর এখানে? ”

“কেন? নাতাশা আপু আমার এখানে আসতে পারে না?”

“এমনিই এসেছে নাকি কিছু ঘটিয়ে এসেছে এজন্য জিজ্ঞেস করেছি।”

সুপ্রীতি মায়ের চোখে চোখ রেখে বলল,

“মা এটা আমার বাড়ি। আমার হাজবেন্ডের বাসা। এখানে কে আসবে আর কে আসবে না সেটা আমি ঠিক করব।”

স্বপ্না স্বাভাবিক গলায় বললেন,

“আমি তো স্বাভাবিক প্রশ্ন করেছি সুপ্রীতি। ”

“তুমি কেন এসেছ?”

“অনন্য কে দেখার জন্য এসেছি। আমি আমার নাতিকে দেখতে আসবই। তোমাদের নিয়ম কানুন তো মানব না।”

স্বপ্না অনন্যকে কোলে নিলো। সুপ্রীতি তাকিয়ে রইলো কপাল কুঁচকে। ওর একটুও ভালো লাগছে না মা’কে দেখে। কতো খারাপ একটা ব্যাপার। কেউ শুনলে ভাববে মা মেয়ের সম্পর্কও এমন হয়! অথচ শাশুড়ীর সঙ্গে ওর সম্পর্ক মায়ের মতো। বড় ননদ বয়সে কতো বড়। তাকেও মায়ের মতো মনে হয়। অথচ মা’কে ওর বিরক্ত লাগে। এমন দু:খের কথা কাউকে বলা যায় না। শুধু আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে যেন ওর আর মায়ের সম্পর্কের সমীকরণ একটু হলেও যেন পালটায়। অন্তত ওর মনে যে ঘৃনাটুকু আছে সেটুকু যেন মুছে যায়।

সুপ্রীতি অনন্যকে হাত বাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে বলল,

“হয়েছে এখন আমাকে দাও।”

স্বপ্না আরেকটু রাখতে চাইছিলেন। বললেন,

“ও আমার কাছে থাক। তুই তোর কোনো কাজ থাকলে করে নে।”

“না। ওর ব্যাপারে আমি রিস্ক নেব না।”

স্বপ্না মেয়ের সূক্ষ্ম খোঁচা বুঝতে পেরে বললেন,

“আমি ওর শত্রু না। ”

“আমিও তাই ভাবতাম। আমার মা আমার শত্রু হতে পারে না। কিন্তু তুমি দেখিয়ে দিয়েছ।”

“স্বপ্না নতমস্তকে বলল,

“শুরুটা তুই করেছিলি। আমি অর্ণবের অপমান মুখ বুজে সহ্য করেছি। অর্ণব কেন আমাকে অপমান করার সুযোগ পাবে। তুই আমাকে ভিলেন না বানালে এসব কিছুই হতো না।”

সুপ্রীতি হেসে বলল,

“অর্ণব তোমাকে অপমান করে নি। তুমি ডমিনেটিং আচরণ সবার সঙ্গে করো। ওর ভালো লাগে নি তাই বারন করে দিয়েছে। তোমার মেয়েকে যে বিয়ে করবে সে তোমার হাতের পুতুল হবে এমন ছোট ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসা উচিত ছিলো তোমার। ”

“অর্ণব তোর হাতের পুতুল হতে পেরেছে তো? নাকি তোকে বাচ্চার মায়ায় আটকে শেকল পরিয়ে রেখেছে।”

“তোমার ভাবনা কখনো বদলাবে না। আমি যতই আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি না কেন তুমি জীবনেও শোধরাবে না। ”

“বুকে হাত রেখে একটা কথা বল তো, আমি সবসময় ই তোর সঙ্গে খারাপ করেছি। আমি যদি অর্ণবের সঙ্গে তোর বিয়ে না দিতাম….!

সুপ্রীতি থামিয়ে দিয়ে বলল,

“এই একটা কাজ ই ভালো করেছ। এজন্য এখনো মা ডাকি।”

স্বপ্নার মাথা ব্যথা শুরু হয়ে গেল। খুব রাগ হলে এই ব্যথাটা হয়। সুপ্রীতি আবারও বলল,

“তোমার মেয়ে হওয়া সত্যেও আনফরচুনেটলি তোমার এই স্বভাব টা আমি পাই না। আমি অর্ণব কে সম্মান করি বলেই ওর থেকে সম্মান পাই। ও আমাকে প্রোটেক্ট করে। ”

“মানে বলতে চাচ্ছিস তোর বাবাকে আমি সম্মান দেই না।”

সুপ্রীতি হেসে ফেলল। বলল,

“সেটা সবাই ই জানে মা।”

স্বপ্নার রাগ এখন নিয়ন্ত্রণহীন। সুপ্রীতি শান্ত গলায় কথা বলছে।

“আচ্ছা মানলাম তোর বাবাকে সম্মান করি না। তাহলে সে আছে কেন?”

“আর থাকবে না তো।”

“কী?”

“বাবা আমাদের দুই বোন কে দিয়ে কিসব কাগজপত্রে সাইন করিয়েছে। কিসের কাগজপত্র জানতে চাইলে বলল যে তার অবসরের পর সমস্ত টাকা আমাদের দুই বোনের যেন হয় সেই ব্যবস্থা করেছে। এবং এটা করেছে কারণ সে আমাদের ভালো শৈশব, ইচ্ছেজীবন কোনোটাই দিতে পারেন নি। বাকী জীবন সে আত্মগ্লানিতে ভুগতে চান না।”

স্বপ্না স্থির চোখে তাকিয়ে আছে। সুপ্রীতি হেসে বলল,

“আমি আর প্রকৃতি হ্যাপিলি একসেপ্ট করে নিয়েছি মা। তুমি যতই বড়লোক পাত্র প্রকৃতির জন্য খুঁজে বেড়াও কাজ হবে না। এখন থেকে আমাদের জীবনে তাই হবে যা আমরা চাইব। ”

স্বপ্না অবিশ্বাস্য গলায় বলল,

“তোর বাবা এটা সত্যি করেছে?”

“মিথ্যে কেন বলব? এখন তোমার প্রশ্ন হতে পারে যে সাদাত কে কেন বঞ্চিত করলো! ঠিক বঞ্চিত নয়, ও তো অলরেডি উচ্ছন্নে গেছে তাই ও’কে কিছু দেয়া হয় নি। তবে আমরা দুই বোন নিশ্চয়ই আমাদের ভাই কে ফেলে দেব না?”

স্বপ্না অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়েই রইলেন। সুপ্রীতিকে বলার মতো শব্দ তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না। সুপ্রীতি বলল,

“বোয়াল মাছ রান্না হয়েছে। ভাত টা হয়ে গেলে দিতে বলব। খেয়ে যেও। আর একা যেও না। ড্রাইভার গিয়ে দিয়ে আসবে। এতো চিন্তা কোরো না তো মা, অনেক বছর তুমি আমাদের কিভাবে চালাবে সেটা নিয়ে চিন্তা করে মাথার ব্যথাটা বাড়িয়েছ। মাথার মধ্যে শয়তানি কিলবিল করছে। এবার থেকে সেসব আর লাগবে না। আমি তোমাকে দেখব, তোমার বাড়তি ভাবনাগুলোও আমার। ”

সুপ্রীতি অনন্যকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। স্বপ্না খেয়াল করলেন তার রাগ টা আর নেই। মাথা ব্যথাও কমেছে। কিন্তু তিনি সুপ্রীতিকে ভয় পেতে শুরু করেছেন। তার ই মেয়ে সুপ্রীতি। তার রক্ত, সেজন্য ই কী ভয় পাচ্ছেন! নাকি সত্যি ধরে নিয়েছেন যে সুপ্রীতি তার জীবন কন্ট্রোল করতে শুরু করবে।

***
ফাহাদের মনে হচ্ছে বাড়ির লোক আসলে ও’কে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করছে না। সামান্য মামলায় জামিন হচ্ছে না এটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার। ঝিলিক সেদিন এসেছিল। জিজ্ঞেস করেছিল,

“খুশি আর ইমরান কি করে? ইমরানের তো পাতি নেতা আছে চেনাজানা। ”

“ভাইয়া বলছে আপুকে যেন এসবে না থাকে। তোমার জন্য তাদের সংসারে ঝামেলা হচ্ছে।”

ফাহাদ রাগে ফোস করে উঠে বলল,

“সবাই আমাকে পিঠ দেখাচ্ছে, আচ্ছা দেখাক। আমিও দেখব সব। ”

“তুমি মাথা ঠান্ডা করো তো ব্যবস্থা হচ্ছে। ”

ফাহাদ শান্ত হয়। ঝিলিক প্রতিবার ওর জন্য খাবার নিয়ে আসে। সিগারেটও নিয়ে আসে। বিরিয়ানি, তেহারি, গরু, খাসি যা খেতে চায় নিয়ে আসে। ঝিলিকের চ্যাটাং চ্যাটাং কথাও তাই মন্দ লাগে না। সেদিন ফাহাদ হঠাৎ বলে ফেলল,

“নাতাশাকে নিয়ে আসিস তো পরেরবার। ”

ঝিলিক কথাটা শুনেও আবার প্রশ্ন করলো,

“কী? ”

“নাতাশাকে নিয়ে আসিস। ওর সঙ্গে আমার কথা আছে ?”

“কী কথা? আর ভাবী আসবে না৷ তারে ঝামেলায় ফেলতে পারব না। ”

“ঝামেলা না। ওরে আমি একটা কথা বলতে চাই। ”

“কী কথা ভাবীর সাথে তোমার। ”

ফাহাদ মিটিমিটি হেসে বলল,

“প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই আমি।”

ঠিক এর পরের সপ্তাহে ঝিলিক বাবাকে নিয়ে নাতাশার ওখানে গেল। নাতাশা বুঝতে পারলো ওর সঙ্গে দেখা করার কিছু একটা উদ্দেশ্য তাদের আছে। তা নাহলে ওর কাছে আসতো না।

চলবে….