#হৃদয়ের_দখিন_দুয়ার
#শেষ পর্ব
“কেমন আছ ইকরা? অবশ্য তোমাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে ভালো আছ। ”
ইকরা আজও ঠিক একই রকম নার্ভাস। অথচ ও এখন আর এই লোকের আন্ডারে চাকরি করছে না। কিবরিয়া সাহেব বরাবরই এমন মিষ্টি করে কথা বলেন। এবং এরপর ই শুরু হয়ে যায় তার একশন। ইকরার অবশ্য নার্ভাস হওয়ার কোনো কারণ নেই। ও যেহেতু এখন এই লোকের আন্ডারে কাজ করে না, সেহেতু ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। ইকরা সহজ স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“আমাকে হঠাৎ আপনার মনে করার কী স্পেশাল কারণ আছে? ফোনে আপনার গলা শুনে মনে হলো জরুরী কিছু বলবেন। ”
কিবরিয়া সাহেব হেসে বললেন,
“আরে এতো ব্যস্ত কেন হচ্ছো? চা কফি কিছু খাও?”
ইকরা একটু ম্যুডি গলায় বলল,
“আমি আসলে সবসময় ই ব্যস্ত। ছোট হলেও আমার নিজস্ব একটা প্রতিষ্ঠান আছে। ”
কিবরিয়া সাহেব চোখ কপালে তুলে বললেন,
“ছোট কোথায়? তেইশ জন কর্মচারী তোমার আন্ডারে কাজ করে। প্রতি মাসে তেইশ জনের স্যালারি চেকে তোমার সাইন থাকে। ঠিক বলছি?”
ইকরা গর্বিত গলায় বলল,
“হ্যাঁ। আপনাদের দোয়া।”
ঠিক সেই সময়ে কফি এলো। দুই কাপ কফিই রাখা হলো কিবরিয়া সাহেবের সামনে। তিনি ইকরাকে প্রশ্ন করলেন,
“ফাহাদের কী খবর?”
ইকরা তীর্যক হেসে বলল,
“আমি আসলে থার্ড ক্লাশ মানুষজন দের ব্যাপারে জানিনা। যারা আমার জন্য ক্ষতিকর তাদের আমি এড়িয়ে চলি। ”
“ভেরি গুড ইকরা। তোমার চিন্তা ভাবনা কে স্যালুট করছি আমি। ডিভোর্স কী হয়ে গেছে? ”
“না। ডিভোর্স এর প্রসেসিং চলছে। ”
“আচ্ছা। এখন একটা ব্যাপার জানার ছিলো। তোমার লজিক অনুযায়ী ফাহাদ কে তুমি এড়িয়ে চলছ। তুমি কী তার ব্যাংক একাউন্টকেও এড়িয়ে চলছ?”
ইকরার ভ্রু কুঞ্চিত হলো। কিবরিয়া সাহেব ইকরার সামনে ছুড়ে মারলেন হলুদ রঙের একটা ফাইল। হাতে তুলে নিলেন কফি। ইকরাকে সৌজন্যতাবশতও কফি খেতে বললেন না। ইকরা আমতা আমতা করে বলল,
“ম..ম..মানে?”
“ফাহাদের অনুপস্থিতিতে ওর ব্যাংক একাউন্টের টাকা ব্যবহার করে নিজের ব্যবসা বাড়াচ্ছ না ইকরা?”
“এটা যদি হয়েও থাকে তাহলে তাতে আপনার কী ক্ষতি হচ্ছে। এই জবাবদিহিই বা কেন আপনাকে আমি করব।”
ইকরার বড় গলায় কথা বলার ধরন দেখে কিবরিয়া সাহেব হেসে বললেন,
“ফাইল টা পড়ে দেখো। ফাহাদের একাউন্টে তেত্রিশ লক্ষ টাকা জমা হয়েছে বিভিন্ন মাধ্যমে। এগুলো কোম্পানির টাকা, যেটা ফাহাদ সরিয়েছে। ”
ইকরা এসির মধ্যেও কুলকুল করে ঘামতে লাগলো। ফাহাদের ব্যাংক ব্যালেন্স সম্পর্কে ইকরার ধারণা আছে। বিয়ের সাত আট মাস পর ফাহাদ ও’কে পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছিল। পরে আরও আটলাখ। এতগুলো টাকা ওর জমানো ছিলো না। ফাহাদ ও’কে জানিয়েছিল কিছু ইনভেস্টমেন্ট এর ব্যাপারে। ইকরা সেসব নিয়ে মাথা ঘামায় নি। ভেবেছে স্টক মার্কেট কিংবা অন্য কোথাও ইনভেস্ট। এখন তো শুনছে অন্য ঘটনা!
ইকরা ফাইল খুলল। পুরোটা দেখলো না। জোর করে কনফিডেন্ট দেখানো একটা ব্যর্থ প্রয়াস করলো।
“এগুলো আমাকে কেন দেখাচ্ছেন? আমি এসবের কিছু জানিনা। ”
“ফাইল পুরোটা দেখো। ফাহাদ সব কিছু স্বীকার করেছে, ও জানিয়েছে যে এসব ব্যাপারে তুমি কতটুকু যুক্ত ছিলে!”
ইকরা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। ও তো এসব ব্যাপার কিছুই জানেনা।
“মিথ্যে বলছে ফাহাদ…! আমি এসবের কিছু জানিনা।”
“ইকরা তুমি প্রমাণ আর লজিকে বিশ্বাস করো না! ফাহাদ যখন এই কাজ শুরু করেছে তখন তুমি এই অফিসে ছিলে। ফাহাদ নিজ মুখে স্বীকার করেছে যে এসব তোমার প্ল্যান ছিলো। সময় আর প্রমাণ তাই বলছে। এজন্য বলছি ফাইলগুলো দেখো। ”
ইকরার নি:শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ঠিক একই কষ্ট, একই অনুভূতি হয়েছিল যখন রুবাব ও’কে এক্সপোজ করেছে। ইকরা বুঝতে পারছে যে ফাহাদ ও’কে ফাঁসাচ্ছে। কিবরিয়া সাহেবের এসিট্যান্ট ম্যানেজার হিসেবে যোগ দিয়েছিল ইকরা। ভালো সম্পর্কের সুবাদে ইকরার ল্যাপটপ থেকে ফাহাদ ডেটা নিতো। তখন থেকেই….
ইকরা মাথা চেপে ধরলো। কিবরিয়া সাহেব সামনে না থাকলে ও স্ল্যাং ইউজ করে ফেলতো এই মুহুর্তে। এরা সবাই ফাহাদের পক্ষ নিবে, ইকরাকে ফাঁসাবে। ইকরা চোখ বন্ধ করে ফেলল। এইবার বিনা দোষে ফাঁসতে যাচ্ছে… আর কতবার ওর পতন হবে! আর কত!
***
রুবাব আজ আয়োজন করে রান্না করছে। কলার মোচা, চিংড়ির দোপেয়াজা, ডাল দিয়ে পুইশাক, বিফ ভুনা। আজ একজন বিশেষ গেস্ট আসবে। যে ও’কে অনেকবার মজার রান্না করে খাইয়েছে। অসম্ভব মজার ভর্তা খিচুড়ি খাইয়ে প্রায় পাগল বানিয়ে ফেলেছিল, কিন্তু রুবাবের নিজের প্রতি কন্ট্রোল ছিলো বলে পুরোপুরি পাগল হয় নি।
কলিংবেলে টুংটাং শব্দ হলো। রান্নাঘরে যুদ্ধ করে ক্লান্ত বিধ্বস্ত রুবাবের একটা শাওয়ার নেয়ার প্রয়োজন ছিলো। সেই সময় টা পেল না। দরজা খুলে বলল,
“তোমরা বোধহয় আগে চলে এসেছ? আমি এখনো সব টা গুছিয়ে উঠতে পারিনি। ”
নাতাশার কোলে পালক ঘুমিয়ে আছে। ও ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
“কোনো সমস্যা নেই। আমি হেল্প করব।”
রুবাব নাতাশার হাত থেকে ব্যাগ টা নিতে নিতে বলল,
“পালক কে শুইয়ে দাও। আর ও কী রিকশায় উঠেই ঘুমিয়ে যায়। বিদেশ বিভূঁইয়ে তো সমস্যা হবে মেয়েটার।”
নাতাশা হাসলো। রুবাবের সঙ্গে বাড়তি আন্তরিকতা টুকু তৈরী হয়েছিলো দেশের বাইরে যাবার সিদ্ধান্তের পর। এরপরই রুবাব নাতাশার সঙ্গে চঞ্চল হয়ে ওঠে। ভেতরে থাকা আড়ষ্ট ভাবও কাটিয়ে উঠতে পারে রুবাব, নাতাশা দূরে চলে যাবে। প্রতি মাসে, দুই মাসে দেখাও আর হবে না। কোনো অ্যাটাচমেন্ট তৈরীও হবে না। এখন তো আর ভয় নেই চমৎকার এই মেয়েটির সঙ্গে মন খুলে কথা বলার। একই ভাবনা নাতাশারও। সেই তো দূরে চলে যাবে। নতুন দেশ, নতুন মানুষ, নতুন জীবন। সেখানে ও থাকবে ওর মতো ব্যস্ত, এদিকে রুবাব থাকবে ওর জীবন নিয়ে। দুজনের মধ্যে ইমোশনাল কোনো বন্ড তৈরী হবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। যেটুকু সময় এখন আছে সেটুকু সময় বন্ধুর মতো চলুক।
রুবাব নাতাশাকে বলল,
“আমি একজন কে আমাদের সঙ্গে খেতে বলেছি। একজন না আসলে, দুজন। আমার ম্যানেজার সিয়াম আর ওর ওয়াইফ।”
নাতাশা হেসে বলল,
“আচ্ছা।”
নাতাশা এই বাড়তি সতর্কতা টুকু বুঝতে পারে। রুবাবের প্রতি ভরসা আর বিশ্বাস থেকেই ও এখানে এসেছে। তবুও এই বাড়তি সতর্কতার কারণে রুবাবের জন্য মনে একটা শ্রদ্ধাবোধ তৈরী হয়েছে।
রুবাবের ম্যানেজার আর তার স্ত্রী এলো কিছুক্ষনের মধ্যেই। খাওয়া দাওয়া, গল্প, আড্ড হলো অনেকক্ষন পর্যন্ত। ফিরে যাবার সময় যখন হলো তখন রুবাব বলল,
“আমি তোমাদের এগিয়ে দিয়ে আসি।”
নাতাশা মেনে নিলো। পালক গাড়িতে উঠে রুবাবের সঙ্গে কথা বলল অনেক। নাতাশা নিজে কিছু বলল না। দুজনের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলো। ফেরার সময় রুবাব বলল,
“নাতাশা, তোমরা ভালো থেকো। ”
নাতাশা অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে রইলো রুবাবের দিকে। রুবাবও থতমত খেল। প্রশ্ন করার আগেই নাতাশা প্রশ্ন করলো,
“এয়ারপোর্টে আসবেন না?”
রুবাব হতবিহ্বল গলায় বলল,
“আমি! হ্যাঁ, হ্যাঁ আসব তো। এই কদিন ভালো থাকার কথা বললাম। ”
***
“তুই কাল ই চলে যাবি?”
“হ্যাঁ। সকালে। ”
শুকনো ঢোক গিলে কথাটা বলল ঝিলিক। উত্তরায় একটা কর্মজীবী লেডিজ হোস্টেলে সিট পেয়েছে। ইশরাক বলল,
“রিয়াদ কে একটা কল করতি? ও এসে তোকে হেল্প করতো।”
ঝিলিকের এবার কান্না পেল। নাক, গলা বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“আসতে পারবে না, পরীক্ষা চলছে। ”
ইশরাক স্বাভাবিক গলায় বলল,
“আচ্ছা।”
ঝিলিক আড়চোখে ইশরাক কে দেখলো একবার। গভীর মনোযোগে কাজ করছে। প্রেশার কুকারের সিটিতে ধ্যান ভাঙে ঝিলিকের। ছুটে যায় রান্নাঘরে। বেশী ঝাল দিয়ে গরুর মাংস খাবে বলে মাংস এনেছিল। কিন্তু রান্না করার সময় ঝাল দিলো না। নাতাশা গরুর মাংসের একটা প্রিপারেশন করতো । মাংস টা টকদই, বাদাম বাটা, পেয়াজ, রসুন, আদা আর অল্প তেল দিয়ে একসঙ্গে বসিয়ে দিতে হয়। রান্না হয়ে গেলে কয়েক ফালি কাঁচা মরিচ দিয়ে উঠিয়ে নিতে হয়। ইশরাক এই আইটেম খুব পছন্দ করে। ঝিলিক প্রথমবার করছে এটা। এতোদিন একসঙ্গে থেকেও আজ প্রথম মাংস রান্না করতে গিয়ে এই প্রিপারেশন এর কথা ওর মনে পড়লো। ঝিলিক কাঁদতে চাইছে না, তবুও অবিরাম পানি ঝরছে দুই চোখ বেয়ে। সবকিছু চলছে নিয়মে। শুধু ওর হৃদয় থেমে আছে এক জায়গায়। অফিসের ব্যস্ত সময়গুলোও কেটে যাচ্ছে, পাঁচ দশ মিনিটের ব্রেকে এক কাপ চা খেতে গিয়েও হঠাৎ মনে পড়ে যায় ওর বুকের ভেতর কতটা হাহাকার। চাওয়ার মতো করে চেয়েছিল বলে একজন কে পেয়েছিল। বলুক সবাই জোর করে পাওয়া। কিন্তু সেই পাওয়াও তো ঘটেছিল ওর চাওয়ার জোরে। যতই লোকে বলুক ঝিলিক জোর করে পেয়েছে, ও সেটা মানতে রাজি নয়। ওর ললাটে ছিলো বলেই পেয়েছে। পাওয়ার পর হারিয়ে ফেলাও ভাগ্যে ছিলো বলেই হয়েছে।
“ঝিলিক! ঝিলিক কী হয়েছে তোর? ”
ঝিলিক সম্বিত ফিরে পায়। ইশ মাংস টা পুড়ে গেল। ঝোল শুকানোর চুলার আচ বাড়িয়ে দিয়েছিল। ইশরাক চুলাটা বন্ধ করে দিয়ে বলল,
“পোড়া গন্ধে ঘরে টেকা যাচ্ছে না। আর তুই এখানে বসেও টের পাচ্ছিস না। ”
ঝিলিক তাকিয়েই রইলো মাংসের পাত্রটার দিকে। হঠাৎই মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠলো। যেন মাংস পুড়ে যাবার মতো দু:খের ঘটনা এর আগে কখনো ঘটে নি। ইশরাক বলল,
“কাঁদছিস কেন? শরীর খারাপ লাগছে? ”
ঝিলিক কিছু বলল না। কাঁদতে লাগলো। ইশরাক চলে এলো ঘরে। ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়লো আবারও। দুইঘন্টা ধরে একই জিনিস দেখছে। চোখ ই কেবল স্ক্রিনে আছে। আর মন টা! ইশরাক দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বাড়িতে বিশাল একটা ঝামেলা চলছে। ইশরাকের বাবা, মা ঝিলিকের উপর অহেতুক একটা রাগ দেখাচ্ছে। কেন ঝিলিক ইশরাকের সঙ্গে যাচ্ছে না। ক্যারিয়ার এর ব্যাপারে একটা বছর পর ভাবলেও তো পারতো।
ওদের দুজনের পথ যে আলাদা হয়ে যাচ্ছে সেটা জানলে যে এরা কী করবে ইশরাক ভেবে পায় না।
ইশরাক জানে ঝিলিক কেন কাঁদছে। ঠিক একই রকম যন্ত্রণা, তোলপাড় ইশরাকের হৃদয়েও হচ্ছে। কিন্তু পার্থক্য শুধু একটাই যে ও ঝিলিকের মতো কাঁদতে পারছে না কোনো এক বাহানায়।
দুজন একসঙ্গে খেতে বসলো। গরম ভাতের সঙ্গে ডিমভাজি। অনেক খুঁজে একটা কাঁচামরিচ পাওয়া গেছে। দুজনে ভাগ করে নিলো। ঝিলিক ইতস্তত গলায় বলল,
“সরি। আমার বেখেয়ালির জন্য কষ্ট করতে হলো। ”
“আরে থাক বাদ দে তো। বড্ড বেশি ফর্মাল হচ্ছিস কিন্তু। হজম করতে কষ্ট হয়।”
ঝিলিক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“কী যে করি আমি! আমাকে আসলেই হজম করা যায় না।”
“আমি আসলে ওভাবে বলিনি… তুই ডাবল মিনিং কেন খুঁজে বের করিস সব কথার!”
ইশরাক হঠাৎই রেগে গেল খুব। ভাত ওভাবে রেখে উঠে গেল। ঝিলিক ভাতমাখা হাত নিয়ে বসে রইলো খানিকক্ষণ। অনেকক্ষন পর ইশরাক কে বলল,
“ওঠো, চলো। আমি খিচুড়ি রান্না করেছি। খাবে। ”
ইশরাক শক্ত হয়ে শুয়ে রইলো। ঝিলিক নত হয়ে ইশরাকের ঠোঁটে চুমু খেল। ইশরাক চমকালো না, বিস্মিত হলো না। যেন তৃষিত ছিলো এই আদরটুকুর জন্য। ইশরাক বাধ্য ছেলের মতো উঠে গেল। মাঝরাতে প্লেটে গরম খিচুড়ি নিয়ে বসে আছে ইশরাক। বাইরে এক ফোঁটা বৃষ্টি নেই, নেই ঠান্ডা বাতাসটুকুও। তবুও এই রাত, এই মুহুর্ত টুকু অমলিন হয়ে থাকবে স্মৃতিতে। ইশরাক ঝিলিক কে বলল,
“আমার পাশে বস ঝিলিক। একটা কথা বলব তোকে। কথাটা চুপচাপ শুনবি, কোনো প্রশ্ন করবি না। আমার কথা শেষ হওয়া মাত্রই এখান থেকে চলে যাবি।”
ঝিলিক ইশরাকের পাশের চেয়ার টেনে বসলো।
“আমার আর সুপ্রীতির সেদিনের দেখা হওয়া নিয়েই আমাদের মধ্যে যত ঝামেলা তাই না। অনেক দিন পর আমাদের দেখা হয়েছে মানে আমরা একজন আরেকজনের খোঁজ খবর জানতে চাই নি। আমি যেমন ও’কে দেখে বুঝেছি ও ভালো আছে, তেমনি ও আমাকে দেখে বুঝেছিল আমিও ভালো আছি। সুপ্রীতি আমাকে কেন ছেড়ে গিয়েছিল এটার উত্তর আমি জানিনা! আসলে আমি উত্তর টা জানি। সুপ্রীতি আমাকে ভরসা করে নি, সেদিন আমি ওর ইমোশনের প্রায়োরিটি দেই নি, ও ভেবেই নিয়েছে দ্বিতীয় বার সুযোগ দিলেও আমি কখনো ওর গুরুত্ব বুঝব না। এটা সত্যি, আমি আসলে কখনো ওর গুরুত্ব বুঝিনি। সেদিন সুপ্রীতি আসবে সেটা আগের দিন জেনে পুরো রাত আমার ঘুম হয় নি, ভয় আতঙ্কে রাত কেটে গেছে। সকালে যখন শুনলাম আমাদের তানভীর ভাইয়ের এক্সিডেন্ট হয়েছে তখন আমি তার কাছে ছুটে গেলাম। হৃদয়ে চলা ঝড়, তুফানও থেমে গেল। আমাকে আর যেতে হবে না সুপ্রীতির কাছে। সুপ্রীতিকে আমি সবসময় ই নিজের করে চেয়েছি কিন্তু ওই সময়ে ওর মায়ের অপমান, ঝামেলা, লুকিয়ে বিয়ে করে বাবার সম্মান নষ্ট করার মতো ব্যাপার গুলো কিভাবে সামলাবো সেটা ভেবে কাতর হচ্ছিলাম। তবুও নিজেকে স্বার্থপর ভাবতে পারছিলাম না। তাই সবসময় বলতাম আমার আসলে কী দোষ সেটা জানিনা। আসলে আমি পুরোপুরি ভুলে ভরা একজন মানুষ। না কাউকে ঠিক করে ভালোবাসতে পারি, না কাউকে নিজের করে রাখতে পারি। অথচ আমি সবসময়ই বলি না তুই খারাপ, তোর দোষ। তুই আসলে ঠিকই আছিস। দোষ আমার, আমি তোকেও তোর মতো করে ভালোবাসতে পারিনি। তাই তুই নিজেকে দোষ দিবি না। ”
ইশরাক খেতে শুরু করলো এলোমেলো ভাবে। ঝিলিক উঠে গেল শর্ত অনুযায়ী। কীসব কথাবার্তা বলে গেল এক নাগাড়ে। অথচ মনের কথা বলল না।
শেষ রাতে ঘুমাতে এলো দুজন। ফজরের আজান শুরু হয়ে গেছে। ইশরাক ঝিলিক কে বলল,
“ঝিলিক কালকের দিন টা থেকে যাবি? ”
ঝিলিক হাসলো। বলল,
“কোনো বিশেষ কারণ? ”
“কোনো কারণ নেই। তুই থাকলেও যা, না থাকলেও তাই। ”
ঝিলিক অতি সন্ত:র্পনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ইশরাক গভীর গলায় বলল,
“থাকলেও কষ্ট, না থাকলেও কষ্ট। না থাকলে বোধহয়…..! ”
ঝিলিক পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো ইশরাক কে।
***
নাতাশা ভেবেছিল প্রকৃতি, সুপ্রীতি ছাড়া আর কেউই আসবে না এয়ারপোর্টে। ঝিলিক, ইশরাক দেখা করে গেছে চট্টগ্রাম যাবার আগে। এমন ডেটে ওর ফ্লাইট পড়েছে যে ওরা কোনোভাবে ম্যানেজ করতে পারছিল না। পালকের দাদা, দাদু, রিয়াদ এসেও দেখা করে গেছে একদিন। পরিচিত যারা ছিলো সবাই ই ও’কে আর পালক কে স্পেশাল ফিল করিয়েছে। শুধু স্বপ্না কিছু বলে নি। নাতাশাকে নিয়ে তার আচরণ এখনো আগের মতো নির্লিপ্ত। এখনো সে তার ভাবনায় অবিচল। ফাহাদের সঙ্গে সংসার ভাঙার কারণ হিসেবে সে নাতাশাকেই দায়ী মনে করেন।
রুবাব কে দেখে নাতাশা অপ্রস্তুত হলো। সুপ্রীতি, প্রকৃতি রুবাব কে চিনে। অর্ণবও চিনতে পেরেছে রুবাব কে। তিনজনের কেউই বিস্মিত হবার পরও নাতাশাকে অপ্রস্তুত করলো না। নাতাশা প্রাথমিক অপ্রস্তুত হবার ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠলো কিছুক্ষণের মধ্যেই। যে ইমোশনাল বন্ডিং পালক আর রুবাবের তৈরী হয়েছে সেটা হয়তো ব্যখ্যাতীত। একইভাবে রুবাবের সঙ্গে ওর অ্যাটাচমেন্ট কেও অস্বীকার করা যায় না। নাতাশা জানে এই সম্পর্ক অনেক দিন থাকবে। ওদের জীবনে আলাদা আলাদা মানুষ যদি আসে তবেই বদলাবে এই সম্পর্ক। অবশ্য এটাকে সম্পর্ক বলাও যায় না। কী নামে বিশেষার্থক করবে সেটাও নাতাশার জানা নেই।
রুবাব সকলের সঙ্গে গল্প করলো স্বাভাবিক ভাবে। মন খারাপ করবে না ভেবে রাখলেও শেষ মুহুর্তে পালকের জন্য চোখ ভিজে উঠলো। ভেজা চোখেই বলল,
“ভালো থেকো নাতাশা। ”
আজও মনে হলো এই কথাটা আসলে অর্থহীন। নাতাশা ভালো থাকবেই, এটা না বললেও চলতো।
***
রাত একটা পয়তাল্লিশ বাজে এখন। অনন্য মায়ের বুকে লেপ্টে ঘুমিয়ে আছে। অর্ণব ড্রাইভিং সিটে। প্রকৃতিকে নামিয়ে দিয়ে এলো বাসায়। প্রকৃতি বাবার সঙ্গে একসাথে থাকে। স্বপ্নাকে এক আকাশ পরিমাণ বিস্মিত করে এই কাজ সত্যিই সম্ভব করেছে। অর্ণব সুপ্রীতিকে প্রশ্ন করলো,
“তুমি এখনো ওদের কথা ভাবছ?”
“হ্যাঁ। আমি আপুর সঙ্গে এতো ক্লোজ। অথচ কখনো আমাকে বলে নি।”
“বলতে চায় নি, তাই বলে নি। তুমি এটা নিয়ে প্রশ্ন করে বিব্রত করবে না। আমাদের জীবনে কিছু বিষয়, কিছু সিক্রেট তো থাকেই, যেটা ভীষণ ব্যক্তিগত হয়। ”
সুপ্রীতি আনমনে বলল,
“হ্যাঁ। ”
“তবে তোমার জীবনে এরকম কিছু না থাকুক। থাকলেও সেটা জানতে চাইবো জোর করে।”
সুপ্রীতি হেসে ফেলল। অর্ণব হাসলো না। গম্ভীর গলায় বলল,
“চলো আজ তোমার মা’কে চমকে দেই। তার কাছে যাই, গিয়ে বলি একটু ভালো কিছু রান্না করুন তো। আপনি আজ প্লেট ভরে যা খাবেন তাই খাব। আপনি জন্য সুপ্রীতির সঙ্গে আমার বিয়েটা হয়েছিল। এই একটা ব্যাপার ভেবেই আপনার সব দোষ ক্ষমা করে দিতে ইচ্ছে করে। আচ্ছা যান, ক্ষমা করেই দিলাম। কোনো রাগারাগি নেই আমাদের মধ্যে। আপনি এই পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মেয়েটির মা। আপনার সঙ্গে কিসের রাগ!”
সুপ্রীতি নি:শব্দে হেসে বলল,
“চলো। ”
পরিশিষ্ট:
অনেক অনেক দিন পর ফাহাদ নাতাশাকে দেখলো। চুলে ডাই করা, ওয়েস্টার্ন পোশাক পরা, নেইল পেইন্ট করা। হাটা, চলা, কথাবার্তা সবকিছু পাল্টে গেছে। চোখ বন্ধ করে পুরোনো নাতাশার সঙ্গে মিলাতে গিয়ে ভুল করে ফেলে ফাহাদ। সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা ওর ভিডিও গুলোর জন্য অপেক্ষা করে থাকে ভীষণ। সেখানে পালক কে দেখতে পাবে। এটুকুতেই তো জীবনে শান্তি এখন। এটুকুতেই সুখ…..!
সমাপ্ত….