হৃদয়ের দখিন দুয়ার পর্ব-০৭

0
1472

#হৃদয়ের_দখিন_দুয়ার
#পর্ব-৭
ঘুরে আসার পর থেকে অর্ণব বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছে। প্রায় দিনই সুপ্রীতিকে নিয়ে বাইরে যায়। অফিসের পর নিজে ড্রাইভ করে শহরের বিভিন্ন জায়গায় খেতে যায়। একদিন রাতে খাওয়া দাওয়ার ঘন্টাখানেক আগে বলল,

“সুপ্রীতি চলো বাইরে যাই। মিরপুরে একটা ভালো খিচুড়ি পাওয়া যায়। দশটার মধ্যে যেতে হবে। প্রচুর ভীড় সেখানে। ”

সুপ্রীতি এক সেকেন্ডও ভাবতে সময় নিলো না। বলল,

“আচ্ছা। ”

অর্ণব জিজ্ঞেস করলো,

“যে খাবার গুলো কষ্ট করে রান্না করেছ সেগুলো কী করবে? ”

“ফ্রিজে রেখে দিচ্ছি। ”

অর্ণব খুব খুশি হলো। বলল,

“ঠিক আছে। চলো।”

সুপ্রীতি এখন সাজগোজের ব্যাপারেও সচেতন হয়েছে সেদিনের পর থেকে। সাধারণ সালোয়ার কামিজ পরে বেরিয়েছে দেখে অর্ণব বলল,

“সেদিনের সেই ইনসিডেন্ট এর জন্য তোমার পোশাকের ধরন পাল্টানোর দরকার নেই। তুমি তো আর ধরে ধরে লোকের মেন্টালিটি চেঞ্জ করতে পারবে না। জানোয়ার দের আচরণ সব জায়গায় জানোয়ারের মতোই হবে। ইটস নরমাল। ”

অর্ণবের চোয়াল শক্ত করে বলা কথাগুলো সুপ্রীতির ভালো লাগলো। বলল,

“আমার তো সাজতে সময় লাগে। তাহলে দশটার মধ্যে পৌছাতে পারব না। ”
অর্ণব হেসে ফেলল।
***
দশটার খানিক পরে পৌছে গিয়েও ওদের লাইন দিতে হলো। সুপ্রীতি বিরক্ত হলো না, তবে অর্ণব খুব বিরক্ত হলো। বন্ধুদের সঙ্গে এরকম অনেক এসেছে। এখানে সেখানে খাবারের রিভিউ দেখে ছুটেও গেছে। আজকে বিরক্ত লাগছে সুপ্রীতির জন্য, বেচারি এভাবে দাঁড়িয়ে আছে।

প্লেটে গরম খিচুড়ির সাথে ঝোলে মাখানো গরুর মাংস আর শসা, কাঁচামরিচ। সুপ্রীতি একটু মুখে দিয়েই অর্ণবের দিকে তাকালো। চোখের ইশারায় বোঝালো ভালো লাগছে। অর্ণব নিজেও অর্থপূর্ণ হাসি দিলো। যার অর্থ হলো থ্যাংক ইউ।

সুপ্রীতির এই যে সহজে সব পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার চমৎকার ব্যাপার টা এটা অর্ণব কে মুগ্ধ করেছে। বিয়ের প্রথম রাতে দুজনেই ছিলো ক্লান্ত বিধ্বস্ত। অর্ণব ঘরে ফিরে সুপ্রীতিকে বলেছিল,

“তোমার খাওয়া হয়েছে ঠিকঠাক? ”

সুপ্রীতি মাথা নাড়লো। অনেকের কাছেই গল্প শুনেছে শ্বশুর বাড়ি এসে প্রথম খাবার টা উত্তেজনায় গলা দিয়ে নামেই না। সুপ্রীতির তেমন কিছু হলো না। প্লেটের ভাত টুকু চিকেনের পাতলা ঝোল দিয়ে ভালোভাবেই শেষ করলো। এরজন্য অবশ্য প্রথমে একটু লজ্জাও পেয়েছিল। সবাই কী না কী ভাবলো।

অর্ণব আবারও বলল,

“তাহলে ঘুমিয়ে পড়ো। আমাদের দুজনের ই এই মুহুর্তে ভীষণ ঘুমের দরকার। ”

সুপ্রীতি ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়লো। গয়নাগাটি সব খুলে রাখলো। লাগেজে প্রকৃতি একটা সুতির কুর্তি দিয়েছিল। ঘুমানোর সময় কম্ফোর্টেবল জামা ছাড়া ওর অসুবিধে হয়। অর্ণব এসে শুয়ে পড়লো ওর পাশেই। আধহাত দূরত্ব দুজনের মাঝে। অর্ণব ওর এক হাত সুপ্রীতির গালে রাখলো। সুপ্রীতি একটু কেঁপে উঠলো। অর্ণব গভীর গলায় জিজ্ঞেস করলো,

“আমার হাত কী বেশী ঠান্ডা? ”

সুপ্রীতি হঠাৎ যেন জমে গেল। অর্ণব ও’কে ঘুমিয়ে পড়তে বলেছে বলে মাইন্ডসেট অন্যরকম ছিলো। এরকম কিছু প্রত্যাশা করে নি। অর্ণব প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষায় আছে বলে ও বলল,

“উঁহু। ”

“একটা ব্যাপার বলি?”

বারান্দার মৃদু আলোয় দুজন দুজনের মুখ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। সুপ্রীতি জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে আছে। অর্ণব বলল,

“আমি যে প্রথম দিন তোমার সঙ্গে কথা বলতে গেছি তখন কী তোমার আমাকে খারাপ মনে হয়েছে?”

সুপ্রীতি মাথা নেড়ে না বলল।

“তোমার মায়ের কিন্তু মনে হয়েছে। ”

সুপ্রীতি ভীষণ অবাক হলো। অর্ণবের হাতটা তখন ঘুরছে সুপ্রীতির চুলের ভাজে। অর্ণব আবারও বলল,

“সেদিন আমি যখন কথা বলছিলাম তখন তোমার মা সাদাত কে পাঠিয়েছিল। ও বেশ কয়েকবার এসে ঘুরে গেছে। ”

হ্যাঁ ব্যাপার টা সুপ্রীতির মনে পড়েছে। সাদাত তিন বার এসেছিল তিনটা বাহানায়। সুপ্রীতি খুব ই স্বাভাবিক গলায় বলল,

“মা একটু ওরকমই। আমরা সবাই তার কথায় চলি সেটা সে চায়। ”

“কিন্তু আমি চাই না সুপ্রীতি। আমাদের সংসারের কোনো কিছু অন্যকেউ কন্ট্রোল করুক সেটা আমি চাই না। আমার মায়ের জায়গা যেমন এক দিকে তেমনি বউয়ের জায়গা আরেক দিকে। দুজন দুজনের মতো গুরুত্ব পাবে। কেউই কম গুরুত্বহীন না। ”

সুপ্রীতি অনেক কিছু বুঝে যায়। স্বপ্নার চাওয়া ছিলো সুপ্রীতির নিজের সংসার হবে। এক ফ্যামিলিতে সবার থাকা নিয়েও ভীষণ আপত্তি ছিলো। অর্ণব এগুলো নিশ্চয়ই শুনেছে এবং শাশুড়ীর চরিত্র সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণাও পেয়েছে। সুপ্রীতি মাথা নেড়ে বলল,

“আমি ব্যাপার টা মনে রাখব। ”

“থ্যাংক ইউ সুপ্রীতি। ব্যাপার টা ইনসাল্টিং না? আমি আমার বিয়ের জন্য পাত্রী দেখতে গিয়ে নিশ্চয়ই অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটাব না তাই না? এরকম অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সম্মুখীন যদি তুমি কখনো হও সেটা আমাকে জানাবে। জরুরী নয়, সব মানুষ কে খুশি করে আমাদের চলতে হবে। এতো কম্প্রোমাইজ করে লাইফ চলে না। যেখানে যতটুকু দরকার ততটুকু করলেই হবে। ”

সুপ্রীতির ভীষণ ভালো লাগে। এরকম করে তো এই প্রথম কেউ কথাগুলো বলল। মনে আছে মেজ মামীর বাসায় একবার দাওয়াতে গিয়েছিল। রোস্ট কম পড়তে পারে বলে মেয়েদের রোস্ট দেয়া হলো না। সুপ্রীতি বিষয় টা মনে রেখে ওই বাসায় যেতে চাইতো না। মা বিষয় টা শুনেই বলল, ঢং! শ্বশুর বাড়ি গেলে এরকম কতো ঘটনা হবে, তাই বলে সংসার ছেড়ে আসবি! মেয়েদের জীবনে কম্প্রোমাইজ ছাড়া কী কোনোকিছু হয়!

অর্ণব সেদিন রাতে অনেকক্ষন ঠোঁট ছুঁয়ে রেখে ওর কপালে চুমু খেয়েছিল। সুপ্রীতি কেঁপে উঠে আড়ষ্ট হয়ে সামলে নিয়েছে নিজেকে।

বিবাহিত দম্পত্তির স্বাভাবিক যে সম্পর্ক শুরু হয় সেটা শুরু হতে বেশী সময় লাগে নি। অর্ণব স্পষ্ট বুঝতে পারে ও একমাত্র পুরুষ সুপ্রীতির জীবনে যে ও’কে গভীরভাবে ছুঁয়েছে। তবে একটা কিছু ব্যাপার যে সুপ্রীতির জীবনে ছিলো সেটা টের পায়। সুপ্রীতি নিজে থেকে বলতে চায় না। কিন্তু ওর কিছু আচরণে প্রকাশ পেয়ে যায়। অর্ণব সুপ্রীতির স্মার্ট আচরণ এর জন্য সিদ্ধান্ত নেয় এসব ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন করবে না। মেয়েটা শতভাগ চেষ্টা করছে ওর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলবার। তাই বাদবাকি যা আছে সব বাদ।

****
ফাহাদ কখনো ভাবে নি বাড়িতে এরকম একটা পরিস্থিতি তৈরী হবে। ঝিলিকের বিয়ের দিন যখন নাতাশা ইকরার কথা বলল তখন ও ব্যাপার টা পাত্তা দিলো না। নাতাশা সাংসারিক মেয়ে। চাল, ডাল, তেল, নুনের সঙ্গে বসবাস। এই যুগের মেয়েদের মতো স্মার্টও না। বেসরকারি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে অনার্স পড়েছে। মাস্টার্স করার ইচ্ছে ছিলো কিন্তু ফাহাদ এলাউ করে নি। তখন নতুন বউ ছিলো বললে মুখ ফুলিয়ে থাকবে তাই বলে নি যে তোমার ওই সার্টিফিকেট এর দাম আসলে দশ টাকাও না। প্রতিযোগিতার এই যুগে ওই বা* দিয়ে চাকরি জুটবে না।

বউ হিসেবে নাতাশা দশে দশ। এক ধমকে আশি ভাগ সিধা হয়ে যায়। মায়ের মুখের উপর কথা তো দূরে থাক, চোখে চোখ পর্যন্ত রাখে না। এমন বউ সবারই আকাঙ্খিত থাকে। ফাহাদেরও তো নাতাশাকে নিয়ে সমস্যা নেই। ইকরা ওর জীবনের আলাদা একটা চাপ্টার। একই অফিসে নয়টা থেকে ছয়টা অবধি এক সঙ্গে থাকতে হয়। কাজ করতে করতে একটু রিলাক্স ম্যুডের প্রয়োজন হয়। তখন বউ থাকে সংসারের কাজে ব্যস্ত। তাছাড়া ইকরা একদম নাতাশার বিপরীত। যেমন কথাবার্থায়, তেমন স্টাইলে, তেমন ব্যক্তিত্বে। তবুও ফাহাদ সংসার ভাঙার কথা মাথায় আনতে পারে না। এই ব্যাপার টা নিয়েই নাতাশার সঙ্গে কথা বলার ছিলো, যে তুমি আমার বাচ্চার মা, আমার ঘরের বউ। তোমার জায়গা আলাদা। বাইরে আমি যা কিছুই করি সেটা ওই পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকবে। ঘরে আসার সময় আমি একদম হাত, পা ধুয়েই ঢুকব। এটা নিয়ে বাড়তি নাটক কখনো করবে না।

কিন্তু বাড়াবাড়ি রকমের নাটক নাতাশা করে ফেলল। দুদিন ধরে বাড়ির পরিবেশ গরম। ঠিকমতো রান্না হচ্ছে না, খাওয়া হচ্ছে না। ফাহাদ কে সংসারে অল্প কিছু টাকা দিলেই হয়। যেমন বাবা শুধু বাজার খরচ টা নেন। তিনি হিসেবী মানুষ, খরচের চেয়ে জমিয়েছেন বেশী। সেটা কাজেও লাগছে অবশ্য। ঝিলিক কে ভালো ইউনিভার্সিটিতে পড়াচ্ছে। রিয়াদ ইউনিভার্সিটিতে রিলাক্সে পড়াশোনা করতে পারছে। তিনি চান ফাহাদও তেমন হোক। পালকের জন্য, নাতাশার জন্য কিছু জমাক। কিন্তু ফাহাদ জমানোর পরিবর্তে উড়িয়েই দিচ্ছে বেশী। প্রতিমাসে ইকরাকে তিন চারটে দামী গিফট দিতে হচ্ছে। ইকরা যে ডিমান্ড করছে ব্যাপার টা তেমন নয়, ফাহাদের দিতে ইচ্ছে করছে।

আজ সকালে মা এসে দুই পিস পাউরুটি আর ডিম সেদ্ধ দিয়ে গেলেন। বললেন,

“তোর বাবা কথা বলবেন। খুশি আর আতিকও এসেছে।”

ফাহাদ জানে কী কথা হতে পারে। ও মনে মনে কথাগুলো গুছিয়ে নিলো।

***

বাবা ভনিতা করতে গেলেন না। সরাসরি বললেন,

“আগামী মাস থেকে তোমাকে বাজার খরচ দিতে হবে না। তুমি এই চাকরি ছেড়ে অন্য চাকরি দেখো। বেতন কম হলে হোক, প্রয়োজনে বাড়তি খরচের টাকা আমি তোমাকে দেব। ”

ফাহাদ নাতাশার দিকে তাকালো। হাত ফুলে গেছে খুব। প্ল্যাসটার লাগানো আছে। পালক বসে আছে মায়ের পাশে। ওর মনোযোগ মোবাইলে। নিশ্চয়ই কার্টুন দেখছে। ফাহাদও সবাইকে চমকে দিয়ে বলল,

“নাতাশাকে আমি ডিভোর্স দেব। কাবিনের তিন লাখের সঙ্গে বাড়িয়ে আরও দুই লাখ দেব। সেই সঙ্গে পালকের দাবিও ছেড়ে দেব। আশা করি ওর কোনো সমস্যা হবে না। ”

হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাতে সবাই স্তম্ভিত ও স্তব্ধ।

চলবে…..

(বানান ভুল কনসিডার কইরেন প্লিজ। আমি এতো অসুস্থ যে স্ক্রিনে বেশী সময় তাকাতে পারি না।)