হৃদয়ের দখিন দুয়ার পর্ব-১১+১২

0
1384

#হৃদয়ের_দখিন_দুয়ার
#পর্ব-১১
স্বপ্না এই প্রথম কাউকে এতোটা ভয় পেলেন। হ্যান্ডসাম, জেন্টলম্যান ছেলেটা যে জেদি সেটার প্রমাণ প্রথম দর্শনে পেলেও তখন অন্যরকম কিছু ভাবে নি। মিষ্টি কথা দিয়ে মানুষের হৃদয় জয় করার রেকর্ড তার আছে। এভাবেই বহুবার বহু কিছু সহজে নিজের কব্জায় এসেছে। কিন্তু অর্ণব অন্যরকম। তাকে সহজে বাগে আনা যে সম্ভব না সেটা এই ক’মাসে বুঝে গেছে। কথা বলার সময় বিনয়, আন্তরিকতার কোনো কমতি তার মধ্যে নেই। কিন্তু শাশুড়ীর অতি আহ্লাদ কে যে ভালোভাবে দেখে না সেটা বুঝিয়ে দিয়েছে স্পষ্টভাবে।

বিভিন্ন ঘটনা, কারণ বুঝিয়ে দিয়েছে যে স্বপ্না চাইলেই অর্ণব সুপ্রীতির সংসার কন্ট্রোল করতে পারবে না। গত মাসের একটা ঘটনা, স্বপ্না ফোন করে অর্ণব কে বললেন,

“বাবা বিকেলে তোমরা চলে এসো। প্রীতির মেজ মামা বিলের মাছ পাঠিয়েছে। দেশী চিংড়ি সহ আরও অনেক মাছ। ”

অর্ণব স্বাভাবিক গলায় বলল,

“সো সুইট আম্মু। বাট মাছ নিয়ে আমার অতো আগ্রহ নেই। আমাদের অলরেডি অন্য প্ল্যান আছে। বাওয়াল রিসোর্টে বুকিং আছে। সন্ধ্যায় চলে যাব, কাল সারাদিন সেখানেই থাকব। আপনার মাছ ফ্রিজে রাখুন। ”

অর্ণবের মিষ্টি কথায় স্বপ্না আরও বেশী জোর দিলেন। বললেন,

“এসব মাছ তাজা খেতে হয়। স্পেশালি তোমার জন্যই পাঠানো হয়েছে। রিসোর্টে এডভান্স বুকিং না করলে ক্যান্সেল করে ফেলো। ”

অর্ণব হেসে ফেলল। কথা হচ্ছিলো ভিডিও কলে। সুপ্রীতি শাওয়ার নিচ্ছে তখন। অর্ণব মুখের হাসিটা ধরে রেখে বলল,

“আম্মু আপনি বারবার ভুলে যান যে আমি আপনার ছেলে নই, জামাই। তাই জোর করে এটাসেটা চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করেন। আপনার বিলের মাছে আমার আগ্রহ নেই সেটা আবারও রিপিট করলাম। সরি টু সে আপনার হাতের মাছ রান্না খাওয়ার জন্য আমি আমার প্ল্যান কখনোই ক্যান্সেল করব না। ”

স্বপ্না থতমত খেয়ে যান। চটজলদি নিজেকে সামলে নিতেও পারেন না। তার সঙ্গে এভাবে কেউ কথা বলেন না। বাবা, মায়ের পাঁচ ছেলেমেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী ও ছোট মেয়ে বলে আদর আস্কারায় অহংকারের পাশাপাশি কিছু বাজে স্বভাব এসে গেছে। সে যেটা ভাবে সেটাই ঠিক, তার যুক্তিতে কেউ প্রশ্ন তুললে প্রতিশোধপরায়ন হতেও দ্বিধাবোধ করে না। প্রচন্ডরকম সেল্ফ সেন্টারড পার্সন একই সঙ্গে।

অর্ণব সুপ্রীতিকে পানির গ্লাস টা এগিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করলো,

“এখন কেমন লাগছে? ”

সুপ্রীতি হাসার চেষ্টা করলো। গালে, মুখে অসংখ্য মারের ছাপ আছে। তবুও হাসিটা ধরে রেখে বলল,

“আই এম ওকে। ডোন্ট ওরি। ”

“হ্যাঁ বুঝতে পারছি। এরকম মার খেয়ে তোমার অভ্যাস আছে। ”

স্বপ্নার পা কাঁপছে। কী থেকে কী হতে যাচ্ছে বুঝতে পারছে না। একটা কথাও গুছিয়ে উঠতে পারছেন না মনে মনে। আজকের দিন টা এতো খারাপ যাবে সেটা কখনো ভাবেন নি। সুপ্রীতির বাবা বসে আছেন গম্ভীর মুখে। স্বপ্না প্রচন্ডরকম জেদি একরোখা স্বভাবের সেটা টের পেলেন বিয়ের কিছুমাস পরেই। বাবা, মায়ের সঙ্গে তখন একসাথে থাকতেন। পররাস্ট্রমন্ত্রনালয়ে চাকরি ছিলো। সুপ্রীতির জন্মের পর কৌশলে জয়েন ফ্যামিলি থেকে বেরিয়ে এসে নিজের সংসার পাতলো। যত দিন যায় ততো বেশী বেপরোয়া হয়। বড় মেয়ে হিসেবে সুপ্রীতি যতটা আদর ভালোবাসা মায়ের থেকে ডিজার্ভ করতো তারচেয়ে বেশী পেয়েছে শাসন। ক্লাস ফোরে অংকে আশির ঘরে নাম্বার পেয়ে যে মার টা খেয়েছিল সেটা কোনো মায়ের কাজ হতে পারে না। তার রাগ জেদের কারণ ছিলো একই সঙ্গে পড়া অন্য একটা বাচ্চা ওর চেয়ে বেশী মার্কস পেয়েছিল।

স্বপ্না এবার একটু কথা বলা শুরু করলেন।

“অর্ণব বসো তুমি… একটু চা করে দেই তোমাকে? ডাল বাটা আছে একটু পিঁয়াজু ভেজে দেই। ”

অর্ণব শীতল গলায় বলল,

“আপনার সঙ্গে পরে কথা বলব। ”

****
ঝিলিক মাত্র জানতে পারলো নাতাশা আর ফাহাদের কথা। ব্যাপার টা জেনে ভীষণ কষ্ট পেল। সকাল থেকে অসংখ্য বার নাতাশার নাম্বারে কল করেছে। নাতাশা কল রিসিভ না করে কেটে দিচ্ছে বারবার। ভাবী পালক কে নিয়ে কোথায় গেছে ভেবে দুশ্চিন্তা হচ্ছে। আছে হয়তো মামাদের বাসায়, কিন্তু ওর মনের অবস্থাটা এখন কী। ঝিলিক রিয়াদ কে কল করে বলল একটা খোঁজ নিতে।

ইশরাক এসে দেখলো ঝিলিক কে কেমন এলোমেলো লাগছে। সকালে যেমন পোশাকে দেখেছিল তেমন। ইশরাক জিজ্ঞেস করলো,

“কোনো সমস্যা? আজ ভার্সিটি ছিলো না?”

“ছিলো। যাই নি। ”

ইশরাক আড়চোখে দেখলো একবার। ম্যুড অফ মনে হচ্ছে। এতো গম্ভীর গলায় তো সচরাচর কথা বলে না।

“তোর শরীর ভালো? চোখ দেখে মনে হচ্ছে জ্বর আসবে। ”

ঝিলিক একটা বক্স এনে সামনে রাখলো।

“খালা পিঠা এনেছেন। চা বানাচ্ছি, আর কিছু লাগবে? ”

ইশরাক কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে ঝিলিকের হাত ধরলো। কী হয়েছে প্রশ্নটা করতে গিয়েও থেমে গেল। জিজ্ঞেস করলো,

“এতো আপসেট দেখাচ্ছে কেন তোকে ঝিলিক?”

ঝিলিক মুখোমুখি চেয়ারে বসে সব টা বলল। নাতাশা আর ফাহাদের কথা। ইশরাক স্তব্ধ হয়ে গেল। অনেকক্ষন বাদে মুখ খুলে বলল,

“এটাও সম্ভব! ভাবী আর ফাহাদ ভাই আলাদা হয়ে যাবে? ফাহাদ ভাই উন্মাদ হয়ে গেছে। ”

ঝিলিক তীর্যক হেসে বলল,

“তোমাদের পক্ষে তো সব ই সম্ভব। তুমি এতো অবাক হচ্ছো কেন? কোনো এক এঙ্গেল থেকে তুমিও ভাইয়ার মতো। তবে আমি ভাবীর মতো ভালোমানুষ নই। আমি ভ্যাম্প। ”

ইশরাক তাকিয়ে রইলো ঝিলিকের দিকে। যথোপযুক্ত জবাব দিতে পারলো না।

***
“আমি নাতাশা। সুপ্রীতির খালাতো বোন। ”

অর্ণব স্মিত হেসে বলল,

“আপনি বসুন প্লিজ। ”

অর্ণব এবার তাকালো ঘুমন্ত পালকের দিকে। নাতাশা বলল,

“সমস্যা নেই। ওর গাঢ় ঘুম, সহজে ঘুম ভাঙে না। ”

“আপনি বিয়েতে কেন এলেন না?”

নাতাশা এই প্রশ্নে বিচলিত হলো না। বলল,

“ভাই ব্যক্তিগত ঝামেলাটা এতো প্রকট ছিলো যে সেটা সামলে প্লাস্টিকের হাসি মুখে ঝোলাতে পারতাম না। সুপ্রীতি আমার ভীষণ পছন্দের। আমার দোয়া আর প্রার্থনায় সব সময় ই থাকে আর থাকবে।”

“আমি বুঝতে পারছি। সরি প্রশ্নটা করা উচিত হয় নি। আমার বোঝা উচিত ছিলো যে আপনার সঙ্গে এদের আচরণ টা একচুয়েলি কেমন। ”

“না না। আঙ্কেল, প্রকৃতি, সুপ্রীতি এরা সবাই আমাকে ভালোবাসে। খালামনিও।”

“আমি বাচ্চা ছেলে নই। ও’কে লেটস চেঞ্জ দ্যা টপিক, আপনি এখন কী চাইছেন? ”

নাতাশা হাসলো। সামনে বসে থাকা নায়কের মতো দেখতে ছেলেটার সঙ্গে ওর কথা বলতে ভালো লাগছে। এতো আন্তরিক গলায় অপরিচিত কেউ কখনো ওর সঙ্গে কথা বলে নি অনেকদিন। প্রকৃতিকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিল সুপ্রীতির বর সম্পর্কে। প্রকৃতি বলেছিল, আপুর জন্য একদম পারফেক্ট।

অর্ণব প্রশ্নটা করে অপেক্ষা করে আছে। নাতাশার চোখে জমে থাকা জল দেখে টিস্যু এগিয়ে দিয়ে বলল,

“আপনি শক্ত হবেন নাকি নরম হবেন সেটা আপনার ব্যক্তিগত ইচ্ছে। প্রথম দেখায় ভারী কিছু কিংবা জ্ঞানের কিছু বলব না। আপনি যে স্টেজে আছেন সেটা খুবই ভয়ংকর স্টেজ। একেকটা পদক্ষেপ ভাবনা চিন্তা করেই নিবেন ”

নাতাশা চোখের পানি মুছে বলল,

“ফাহাদ চলে যাবার পর ওর এক কলিগ কে আমি কল করেছিলাম, সে বলেছে ভাবী ইকরা এমন একটা মেয়ে যাকে দেখলে আপনিও প্রেমে পড়ে যাবেন। আমি তখনই বুঝতে পেরেছি ফাহাদের সঙ্গে আমার আর কথা বলা উচিত নয়। ”

অর্ণব কে একটু কনফিউজড দেখালো। কী বলবে সামনের এই মানুষ টাকে। ঘন্টাখানেক হলো তার সঙ্গে পরিচয়ের। তবুও কেমন নিজের বলে মনে হচ্ছে, ইচ্ছে করছে কিছু একটা বলে মন ভালো করে দিতে। কিন্তু ওর শব্দভান্ডারে তেমন কিছু আসছে না।

****
অর্ণব নাতাশার সঙ্গে কথা শেষ করে বাইরে এলো। ড্রইং রুমে সবাই বসে আছে। স্বপ্না দুই, তিনবার চেষ্টা করেও অর্ণবের সঙ্গে কথা বলতে পারে নি। অর্ণব স্বপ্নার উদ্দেশ্যে বলল,

“এটা আপনাদের পারসোনাল প্রবলেম। আমি যেমন আমার পারসোনাল প্রবলেমে ইন্টারফেয়ার করা পছন্দ করি না, তেমনি অন্যের ব্যাপারেও মতামত দেই না। কিন্তু এখানে সুপ্রীতি যুক্ত আছে এবং তাকে বাজে কিছু ফেইস করতে হয়েছে বলে আমাকে কিছু বলতে হচ্ছে। আপনি আপনার সন্তানদের মারতে অভ্যস্ত, রাগের বহি:প্রকাশ হিসেবে এটা আপনার কাছে নরমাল কিন্তু আমার কাছে এটা এবনরমাল। আমার বউ কারো হাতে মার খাবে, হোক সে তার মা সেটা আমি সহ্য করব না। প্রথমবার আপনাকে অসম্মান করলাম না, তবে এটার রিপিট হলে আপনাকে যে কীসব ফেস করতে হবে আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। আপাতত একটা ব্যপারই বলতে চাই, আগামী ছয়মাসে আপনি সুপ্রীতিকে কোনো কল, মেসেজ কিছু করবেন না এমনকি আমার বাসায়ও যাবেন না। বাকীদের সঙ্গে সুপ্রীতি চাইলে যোগাযোগ রাখুক। আই হ্যাভ নো প্রবলেম। কিন্তু আপনাকে যেটা বলছি সেটা করবেন। ”

সুপ্রীতি মা’কে দেখলো। হঠাৎ ই কেমন যেন বোকা বোকা লাগছে। এরকম কথা দিয়ে জব্দ আজ অবধি কেউ করতে পারে নি। স্বাভাবিক ভাবে ওর খারাপ লাগার কথা থাকলেও লাগছে না। এই মানুষ টা অন্যকে অপমান করতে ভালোবাসেন। তিনি জানেন না, একজন কে অপমান কিংবা আঘাত করে আনন্দ পাওয়ার কিছু নেই। সেই একই অপমান কিংবা আঘাত তার জন্যও অপেক্ষা করে কারো না কারো থেকে।

সুপ্রীতি অর্ণবের সামনেই বাবাকে বলল,

“বাবা, নাতাশা আপুর এক বছরের যাবতীয় খরচ তুমি বহন করবে। ততদিনে ও যা কিছু করে হোক নিজেকে গুছিয়ে নিবে। সম্ভাবনাময় একটা মেয়েকে জোর করে বেচারি তোমরা বানিয়েছ। এইটুকু তোমরা অবশ্যই করবে। ”

সুপ্রীতির বাবা মাথা নেড়ে সায় দিলো। সুপ্রীতি যখন বাসা থেকে বেরিয়ে আসছে স্বপ্না তখন স্থির হয়ে কাঁদছেন। কেন কাঁদছেন! মেয়ের জন্য নাকি জীবনে প্রথম হেরে যাওয়ার তিক্ত জ্বালাময়ী অনুভূতির জন্য!

চলবে…..

#হৃদয়ের_দখিন_দুয়ার
#পর্ব-১২
ঝিলিক সরাসরি চলে গেল ফাহাদের অফিসে। বাড়িতে মা, বাবার সঙ্গে কথা বলে শান্তি পেল না। ইশরাক বলেছিল বাড়ি চলে যেতে। ঝিলিক যায় নি। এই মুহুর্তে ওর মা আর শাশুড়ীকে খুব বিরক্ত লাগছে। শাশুড়ী নাতাশাকে নিয়ে বেশ কিছু খারাপ কথা বলেছে সেটা ওর শুনতে ভালো লাগে নি।

ফাহাদের অফিসে ঝিলিক প্রথমবার এলো। অফিস চিনতে সমস্যা হয় নি। রিসিপশনে গিয়ে নাম বলতেই টেলিফোন করলো। ঝিলিক কে বেশী অপেক্ষা করতে হলো না। ফাহাদ এলো ব্যস্ত ভঙ্গিতে। এসে বলল,

“কিরে তুই? কী দরকার?”

“তুমি থাকছ কোথায়? ”

“মিরাজের কাছে। কেন?”

“ভাবী পালক কে নিয়ে বাড়ি ছেড়েছে শুনেছ?”

“শুনেছি তবে বিশ্বাস করিনি। এখানে এসব বলার জায়গা না ঝিলিক। বাসায় যা, ফোন করব আমি। ”

“ভাইয়া হাতের কাজ শেষ করো, আমি বসি। ক্যান্টিন আছে না তোমাদের এখানে? আজ লাঞ্চ করব।”

ফাহাদ জানে ঝিলিক কে বেশি কিছু বলতে যাওয়া মানে সিন ক্রিয়েট করা। শুনবে না কিছু, যা মন চাইবে তাই করবে।

ঝিলিক ঘড়ি দেখলো। বারোটা বেজে এগারো মিনিট। নরমালি একটায় লাঞ্চ ব্রেক হবার কথা। ও অপেক্ষা করছে রিসিপশনে বসেই। ঝিলিকের ইকরাকে দেখার আগ্রহ নেই। ইকরা যে বিশ্বসুন্দরীই হোক, নাতাশাকে বিট করার যোগ্যতা কোনো দিক থেকে নেই। থাকলে বাচ্চার বাপের সাথে পরকিয়া করতে পারতো না।

***
ক্যান্টিনে বসে ফাহাদ বলল,

“কী খাবি? বিরিয়ানি তেহারি হবে আজ। অন্য ব্যবস্থা নেই। ”

“তোমার যা ইচ্ছে হয় অর্ডার করো। আমার গলা দিয়ে এমনিতেও খাবার নামবে না।”

ফাহাদ ঝিলিক কে শীতল চোখে একবার দেখে বলল,

“তুই এসব ব্যাপারে ঢুকিস না। আমি কাউকে কোনো ব্যখ্যা দেব না। নট ইভেন ইউ। বাজে ব্যবহার করলে মন খারাপ করবি তাই কিছু বলছি না।”

ঝিলিক শান্ত গলায় বলল,

“ভাবী তোমাকে সরি বলবে ভাইয়া। আমি বলাব। প্লিজ এরকম ডিসিশন নিও না। পালক তো তোমারও মেয়ে নাকি?”

“অবশ্যই পালক আমার মেয়ে। আমি মেয়ের দায়িত্ব নিতেও রাজি, কিন্তু নিজের সঙ্গে রাখতে চাই না। নাতাশার সঙ্গে ইনজাস্টিস যেন না হয় সেটাও দেখছি।”

ঝিলিক এই কষ্টের সময়ও হেসে ফেলল। এটা ও কাকে দেখছে। যতই মুখে বলুক পালক তার মেয়ে, চোখে এক ফোঁটা আকুলতা ফুঁটে উঠছে না। ঝিলিক অনুনয় করে বলল,

“ভাইয়া প্লিজ, এভাবে একটা সম্পর্ক ভাঙা যায় না। পালকের কথা ভাবো, ওর ভবিষ্যতের কথা ভাবো। ”

ফাহাদ ঝিলিকের হাত ধরে বলল,

“বাসায় যা। পালকের ভবিষ্যৎ আমি সিকিউর করে দেব। মেয়েকে বিদেশে পড়তে পাঠাব। সেখানে কেউ এসব নিয়ে প্রশ্ন করে না। আর একটা ব্যাপার শোন, কাউকে বলিনি কিন্তু তোকে বলছি। নাতাশাকে আমার এখন আর ভালো লাগে না। হতে পারে আমার চোখে সমস্যা, তাই বলে কী চোখ উপড়ে ফেলব? যেটা করছি ঠিক করছি। ”

ঝিলিক উঠে আসার সময় বলল,

“আমার সঙ্গেও সম্পর্ক রেখো না। আমি রাখতে চাই না, প্লিজ আর কোনো ধরনের আদিখ্যেতা দেখাবে না। ”

****
বাড়ি থেকে আসার পর অর্ণব সুপ্রীতিকে তিন দিন কোনো কাজ করতে দিলো না। নিজেই রান্না করে খাওয়ালো। এদিকে ওদের হেল্পিং হ্যান্ডও আসছে না। অর্ণব নিজেই সবকিছু করলো। সকালে ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ বানিয়ে অফিসে যেত। ফিরে এসেও রান্না করতো ডিনারের জন্য। তিন দিন পর সুপ্রীতি রান্নাঘরে ঢুকলো। একটু বেশী আইটেম রান্না করবে। অর্ণবের যেটা ভালো লাগবে খাবে। স্বামী হিসেবে অর্ণব এখনো একশ তে একশ পাবে ওর কাছে। কোনো কাজেই খুঁত ধরে না, যেটায় সমস্যা হয় সেটা নিজে থেকে গুছিয়ে করে রাখে। সুপ্রীতি ওর জীবনে এতো বুঝদার পারফেক্ট কাউকে কল্পনা করে নি। ওর স্বপ্নে কল্পনায় শুধু ইশরাক ই ছিলো। ওদের প্রথম দেখা হয়েছিল নাতাশার গায়ে হলুদে। ইশরাক চটপটে ছেলে, সেখানে সুপ্রীতি কথা বলে মেপে মেপে। প্রথম কথা হবার ঘটনাও ভীষণ নাটুকে। বেখেয়ালে হাটতে গিয়ে সুপ্রীতির গায়ে শরবত পড়ে গেল। ইশরাক অতো মানুষের মধ্যে ছুটে এসে টিস্যু দিয়ে গেল। হাসাহাসি, হৈ হুল্লোড়ও হলো এটা নিয়ে। ইশরাক জিজ্ঞেস করেছিল,

“আর ইউ ওকে?”

সুপ্রীতি তখন মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললেও খুব নার্ভাস ছিলো। এতো মানুষের মধ্যে ঘটনাটা ঘটলো তার উপর ড্রেস টা নষ্ট হলো পুরোপুরি। নাতাশার সঙ্গে সুপ্রীতিও গেল। সেখানে দুজনের কথাবার্তা হলো, ইশরাক আগ বাড়িয়ে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিলেও সুপ্রীতির ইতস্তত ভাব যাচ্ছিলো না। ছেলেটা অহংকারী, দেমাগি ভাববে বলে বন্ধুত্ব টুকু গ্রহন করেছিল। এরপরের সবকিছু স্বাভাবিক ভাবেই হলো। কলে কথা, চ্যাটিং, দেখা হওয়া থেকে প্রেমের শুরু। শুরুর দিকে সবকিছুই কতো সুন্দর ছিলো। আস্তেধীরে সেটা অসুন্দর হয়ে গেল!

সুপ্রীতি জানে ইশরাক ঝিলিক কে বিয়ে করেছে। ঝিলিক কতো পছন্দ করে সেটাও জানতো। ইশরাকের প্রতি ওর এখন আর অভিযোগ নেই। ও স্বেচ্ছায় ওই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে এসেছে। যেরকম জীবন ও চেয়েছিল ইশরাক সেটা কখনো দিতে পারতো না। তাই ও স্বার্থপর হয়েছে। তাছাড়া একটা ব্যাপার ও নিজে থেকে শিখেছে সেল্ফ রেসপেক্ট এর চেয়ে বড় কিছু পৃথিবীতে আর নেই।

“কী করছ?”

অর্ণব নি:শব্দে রান্নাঘরে ঢুকলো। সুপ্রীতি চমকে গেল। অর্ণব কিচেনের অবস্থা দেখে বলল,

“তুমি রেস্ট করতে। এতো কিছু জরুরী ছিলো না।”

সুপ্রীতি হেসে বলল,

“থ্যাংক ইউ। ”

অর্ণব জবাবে কিছু বলল না। স্মিত হাসলো।

চায়ের কাপ হাতে নিয়ে অর্ণব প্রশ্ন করলো,

“তোমার বাবা কখনো তোমার মা’কে কিছু বলতেন না?”

“বলার চেষ্টা করেছিল। মা সুইসাইড করতে গেছিল। তারপর থেকে বলে না। মা না থাকলে আমাদের কী গতি হতো!”

অর্ণব সুপ্রীতির হাতে হাত রাখলো। অনেক কিছুই বুঝতে পারছে ও। অন্তত একটা বিষয় ক্লিয়ার হলো যে সুপ্রীতি কেন এতো চাপা স্বভাবের। এতোদিন মনে দ্বিধা দ্বন্দ ছিলো। একটা প্রবল সন্দেহ ছিলো যে সুপ্রীতি হয়তো অন্য কাউকে ভালোবাসে। সব টা উজাড় করে ভালোবাসা যাকে বলে সেই ভালোবাসা হয়তো ওর মনে অন্য কারোর জন্য আছে। যদি অর্ণবের এই সন্দেহ সত্যি হতো তবে সেটা ওর জন্য ভালো হতো না। কিছুতেই এক্সেপ্ট করতে পারতো না, কিছুতেই না।

চলবে…