#হৃদয়ে_প্রণয়ের_বাস
#পর্ব_১১
লেখনীতেঃ রোদসী রঙ্গন
মৃধার থেকে একটু দূরে দাঁড়ানো নিশীথের মুখে অদ্ভুত হাসি। বোধহয় মৃধার গোল গোল চোখে চেয়ে থাকাটা তার কাছে বড় মজার বিষয় ঠেকছে। অপর দিকে মৃধার এখনও সত্যাটা হজম হলো না ৷ নিশীথকে নিবির, নীলাদ্রী সহ আসতে দেখে একবার ওদিকে তো একবার রাহির দিকে চাইল। রাহি সে দৃষ্টি পর্যবেক্ষন করে বলল,
“ তুমি বড্ড বোকা ভাবি৷ ভাইয়া তোমায় কতোটা ভালোবাসত এতকাল তার একটুও টের পেলে না তুমি? উল্টে আবির ভাইকে বিয়ে করে ফেলতে চাইলে? কি সাংঘাতিক! এদিকে তো আমার ভাইটা মরতে বসত তখন। ”
মৃধার কাছে এবারে মনে হলো রাহি রসিকতা করছে। ভ্রু কুঁচকে বলে উঠল,
“ তোমরা কি নাটক করছো আমার সাথে? আমি নিশীথের সব কাজিনকে চিনি। কই, তোমাকে তো কখনোই দেখিনি। কেমন বোন হও তুমি ওর? ”
রাহির এই পর্যায়ে মুখ মলিন হলো। গলার স্বর নামিয়ে উত্তর দিল,
“ আপন বোন। ভাইয়া আর আমি একই মায়ের সন্তান। তোমাকে ভাইয়া ইচ্ছে করে কষ্ট দিতে এই নাটক সাঁজিয়েছে। বিশ্বাস করো। তুমি ভাইয়াকে কষ্ট দিয়েছো বলে সেও তোমায় ভালোবাসার কষ্টটা বুঝাতে চেয়েছিল। ”
মৃধার কাছে এবারে বিষয়টা আরো রসিকতার মনে হলো। বলে উঠল,
” বোকা বানাচ্ছো রাহি? নিশীথকে আমি ছোটকাল থেকে দেখছি। নিবির নীলাদ্রী ছাড়া ওর কোন ভাইবোন আছে বলে আমি জানি না। তাহলে? ”
তখনই পাশে এসে দাঁড়াল নিশীথ, নীলাদ্রী আর নিবির। রাহিকে দেখেই নীলাদ্রী নিবির লাফিয়ে উঠল। জড়িয়ে বলল,
“ আপু? কেমন আছো? কতদিন পর দেখা! তুমি চলে গেলে তখন তোমায় খুব মিস করব আপু। কল করবে তো ওখানে গেলে ?”
মৃধা আশ্চর্য হয়ে বিস্ময় নিয়ে চেয়ে থাকল আবারও। নিশীথ নাটক করলেও নিবির নীলাদ্রী নিশ্চয় নাটক করবে না? এবারে নিবির নীলাদ্রী তার দিকে চেয়েই বলল,
“ মৃধা আপু! আজ কিন্তু তোমাদের বিয়ে উপলক্ষ্যে তুমি তোমার তিন ননদ-দেবরকে ট্রিট দিবে। আমরা কিন্তু সে আয়োজনেই ছুটে এসেছি এতদূর। ”
মৃধা পুণরায় অবাক। তার ব্যাগে এই মুহুর্তে আধৌ টাকাপয়সা আছে কিনা এটাই তো সন্দেহ! ট্রিট কি করে দিবে? এখন যদি এভাবে চাওয়ার পরও ট্রিট না দিতে পারে সেটাও তো লজ্জাজনক। মৃধা অপ্রস্তুত স্বরে বলল,
“ হু। ”
পরমুহুর্তে রাহির বিষয়টা হজম করার চেষ্টা চালিয়ে নিশীথকে ম্যাসেজ করল,
“ তুই বলেছিস আমি ট্রিট দিব? ”
নিশীথ ম্যাসেজ পেয়ে চাপা হাসল। ম্যাসেজে লিখল,
“ তো এই প্রথম আমার প্রাণপ্রিয় বোনের সাথে সাক্ষাৎ করতে আসছেন ভাবি হিসেবে। ট্রিট দিবেন না? ”
মৃধাও লিখল,
“ আসার আগে তুই বলেছিলি তোর প্রাণপ্রিয় বোন এর সাথে সাক্ষাৎ করাবি ? তুই বলেছিলি তোর স্পেশাল মানুষের সাথে দেখা করাতে নিয়ে আসবি।”
ম্যাসেজটুকু দেখেই হেসে ফেলল নিশীথ। দ্রুত হাতে টাইপ করল,
“ এটাই তো চমক! ”
পরমুহুর্তেই রাহি আর মৃধার দিকে চেয়ে শুধাল,
“ তোরা কি নিজেরা নিজেরা পরিচয় হয়ে নিয়েছিস? নাকি আমি পরিচয় করিয়ে দিব?”
মৃধা তাকাল যেন সে এখনো বিষয়টা হজম করে উঠতে পারেনি। নিশীথ বুঝে উঠে বলে বসল,
“ ও রাহি। তোর ননদ, আমার বোন, আমার আব্বুর এবং আমার বায়োলজিকাল মাদারের সন্তান। ”
মৃধা বুঝে উঠল না। বায়োলজ্যিকাল মাদার? নিশীথের আম্মু যে সে কি নিশীথের বায়োলজিক্যাল মাদার নয়? মৃধা তখনও বুঝে উঠল না। তবুও কৌতুহল দেখিয়ে বলল,
“ কিন্তু ও আলাদা কেন? মানে তোর সাথে, নিবিরের সাথে, নীলাদ্রীর সাথে ওকে কখনো দেখতাম না কখনো। ”
নিশীথ এড়িয়ে গেল যেন। বলল,
“ কাহিনী আছে। পরে শুনাব। এখন ওদের ট্রিট দেওয়ার ব্যবস্থা কর। ”
মৃধা আড়ালে ব্যাগ চ্যাক করল। শুধু দুইশত টাকার একটা নোট আর খুচরো আশি টাকা। হতাশ হয়ে দ্রুত নিশীথকে টাইপ করল,
“ খাবারের বিলটা ধার দিতে পারবি নিশীথ? তোকে পরে দিয়ে দিব। ”
এইটুকু লিখে রাহির দিকে চেয়ে হাসল। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল রাহিকে। অনেকটকই মাহমুদ সাহেবের চেহারা যেন। মেয়েটা সুন্দর, শান্ত। চোখে মায়, যেন কতকালের দুঃখ এই চোখজোড়ায়। মৃধা চাপাশ্বাস টানতেই রাহি বলল,
“ তুমি অন্যায় করেছো ভাইয়া। ভাবিকে কাঁদিয়ে যে মজা নিয়েছো তার জন্য ভাবিকে স্যরি বলেছো? কি নিষ্ঠুর তুমি! ”
মৃধা শুনল। নিশীথকে আবারও হাসতে দেখে নাক ফুলিয়ে নিল রাগে। তাকে ইচ্ছে করে কষ্ট দিয়েছে। ইচ্ছে করে কাঁদিয়েছে। এতোটা নির্দয় এই ছেলেটা? মৃধা মনে মনে পণ করল, সে ও বদলা নিবে। তাকে এতোটা কষ্ট দেওয়ার মূল্য সে হারে হারে বুঝিয়ে দিবে।
.
দুপুরটা তাদের এভাবেই কাঁটল। তারপর মৃধা, নীলাদ্রী আর নিবির বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। নিশীথ বোনের সাথে আরেকটু ঘুরে হোস্টেলে পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে এগোতে নিবে তখনই দেখা মিলল লিয়নের। নিশীথ হাসল। বন্ধুর কাঁধে চাপড় মেরে শুধাল,
” তোকে আগে আসতে বলেছিলাম। ভাবির দেওয়া ট্রিট মিস করলি তো দোস্ত। ”
লিয়ন হাসল। চাপা হেসে শুধাল,
“ ভাবিকে ভাবি বলে ডাক দিলে রেগে যায় বন্ধু। কি দুঃখ! ফ্রেন্ড সম্বধীয় কেউ ভাবি হলে মনের সুখে ভাবি ও ডাকা যায় না । দুঃখ!”
কথাটুকু বলেই লিয়ন কপাল চাপড়ে হাসল। পরক্ষণেই নিশীথের পাশে থাকা রাহিকে নিরব চাহনি ফেলে তাকিয়ে থাকতে দেখে হাসি দমে গেল। এই মেয়েটা এভাবে কেন তাকায়? এতোটা শীতল চাহনি! লিয়নের হৃদয় কাঁপে যেন। ইচ্ছে হয় মেয়েটিকে বুকে টেনে নিতে। অথচ সে অসহায়। বুকে টেনে নেওয়ার মতো নিষিদ্ধ আবদার তার মন পুষতে পারে না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
” হঠাৎ সবার এত জরুরী আয়োজন? কি দরকারে? ”
নিশীথ শুধাল,,
“ রাহির ভিসা কার্যক্রম সম্পন্ন। আর অল্প কয়েকদিন পরই চলে যাবে। মৃধার সাথে এখন দেখা করিয়ে দেওয়াটা ভালো ভাবলাম। ”
লিয়ন অবিশ্বাস্য চাহনিতে তাকিয়ে রইল। আর কয়েকদিন? কয়েকদিন পরই চলে যাবে মেয়েটা? অথচ তাকে জানাল না? লিয়ন রাহির দিকে গম্ভীর চাহনি ফেলে শুধাল,
“ আর কয়েকদিন? জানালে না তো রাহি। ”
রাহি অপ্রস্তুত দৃষ্টিতে চাইল। উশখুশ করে বলে উঠল,
“ আমি জানতাম পরের মাসে যাব তবে কখন তা জানতাম না। ভিসা কার্যক্রমটা এত দ্রুত সম্পন্ন হবে তাও বুঝে উঠিনি। আর কয়েকদিনই যে সময় আছে বা চলে যাব তাও ভাইয়াই সকালে জানিয়েছে। আপনাকে জানানোর চেষ্টা করেছি কিন্তু আপনি বোধহয় সবকিছু থেকে আমায় ব্লক দিয়েছেন লিয়ন ভাই। ”
লিয়ন চাপাশ্বাস ফেলল। এইতো কাল রাতেই তো সে পণ করল এই মেয়েটাকে আর মনে করবে না সে। একটিবার ও কথা বলবে না, দেখা করবে না। অথচ হলো না তো। সে তো আবারও জড়িয়ে যাচ্ছে। আবারো মিশে যাচ্ছে।লিয়ন দূরত্ব বাড়ানোর উদ্দেশ্যে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতেই নিশীথ বলে উঠল,
“ রাহিকে একটু হোস্টেলে পৌঁছে দে তো।”
লিয়ন শান্তস্বরে প্রশ্ন ছুড়ল,
“ আমি কেন? ”
“ আমি বলছি তাই। ”
লিয়ন মেনে নিল। না চাইলেও কেন জানি সে নিষেধ করতে পারল না। অবশেষে রাহি সহ পা এগোল নিরবে। তারপর অনেকটা সময় পরই রাহি শুধাল,
“আমি চলে যাওয়ার পর আমাকে কি ভুলে যাবেন লিয়ন ভাই? ”
লিয়ন অবাক হয়ে তাকাল। ইচ্ছে হলো তারও জিজ্ঞেস করতে,“ তুমি ওখানে গিয়ে আমায় ভুলে যাবে না তো রাহি?” অথচ বলতে পারল না। উল্টো শুধাল,
“ কেন? ”
“ আমার অনুপস্থিতিতে আপনার হৃদয়ে যদি অন্য কেউ জায়গা করে নেয়?”
লিয়ন শান্ত কন্ঠে বলল,
“ নিলে নিবে। ”
উত্তরটা পছন্দ হলো না রাহির। বদলে বলল,
“ আমি আপনাকে ভালোবাসি। ”
লিয়ন কি সুন্দর মুখের উপর বলে দিল,
“ আমি তো বাসি না। ”
রাহির দুঃখ হলো। কন্ঠে বিষাদ এনে অনুরোধসমেত বলল,
“ আমাকে কি ভালোবাসা যায় না লিয়ন ভাই?”
লিয়ন রাহির চোখের দিকে তাকাল না। উত্তরে বলল,
“ তুমি এখনো বড্ড ছোট রাহি। এসব চিন্তাভাবনা বাদ দাও।”
.
নিশীথ বাসায় ফিরে মৃধাকে পেল না। খোঁজাখুঁজি করে জানতে পেরেছে মৃধা তার বাবার বাসায় গিয়েছে। তার মা এসে নিয়ে গিয়েছে। নিশীথের অস্থির লাগল যেন। কল করে প্রথমেই বলল,
” দেখিয়ে দিলি আসল রূপ? যেই এতদিন কষ্ট পাচ্ছিলি কষ্ট কমানোর জন্য সবটা জানিয়ে দিলাম তখনই আমার কষ্ট পাওয়ার ব্যবস্থা করে ফেললি? বেয়াদব!”
মৃধা ও অপরপাশ থেকে দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল,
“বাহ!আমায় কষ্ট দেওয়ার জন্য ইচ্ছে করে এসব প্ল্যানিং করেছিস! তুই তো সেরা লায়ার! মিথ্যুক কোথাকার!”
নিশীথ আহত স্বরে বলল,
“ বেশি মিথ্যে তো বলিনি। কষ্টও বেশি দেয়নি, যতোটা তুই আমায় দিয়েছিস। ”
মৃধা দাঁতে দাঁত চেপে ফের বলল,
“ আমি তোকে কষ্ট দিইনি। আমায় দোষী করবি না।”
নিশীথ ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,
“ সুখ দিয়েছিস কবে? ”
“ আমার তোকে সহ্য হচ্ছে না নিশীথ! অসহ্য লাগছে। তুই আমায় ইচ্ছে করে হার্ট করেছিস। ”
নিশীথ এবারে হেসে বলল,
” দেখতে চেয়েছিলাম আপনি আমায় ভালোবাসেন কিনা। কিন্তু মহারানী তো দুঃখে কষ্টে জ্বর নিয়ে চলে এসেছেন শরীরে। ”
মৃধা ফের রেগে গেল। নিজের দুর্বলতা প্রকাশ্যে এসে এভাবে নিশীথের সামনে জানাজানি হয়ে গেল বিষয়টা ভেবেই রাগ হলো। বল,
“ তোর কথা সহ্য হচ্ছে না আমার। ”
কথাটুকু বলেই কল রাখল মৃধা। নিশীথ অসহায়ের মতো চেয়ে থাকল। ঠোঁট নাড়িয়ে বলল,
“একটু সুন্দর করে কথাও বলল না? কি নিষ্ঠুর মেয়ে! ”
#চলবে….