হৃদয়ে প্রণয়ের বাস পর্ব-১৪

0
10

#হৃদয়ে_প্রণয়ের_বাস
#পর্ব_১৪
লেখনীতেঃ রোদসী রঙ্গন

তখন মধ্যরাত। অথচ কপোত কপোতির চোখে ঘুম নেই। নিশীথ তখন মৃধার কোলে মাথা দিয়ে শুঁয়ে আছে। মৃধাকে বলেছে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে। মৃধাও তাই করল নিরবে থেকে। নিশীথ তা দেখল আর হাসল।হঠাৎ বলল,

“ আমি ভেবেছিলাম তোকে হারিয়ে ফেলব সুখ। ভেবেছিলাম সত্যিই আমার করেও আমার করতে পারিনি। কি যে যন্ত্রনা হচ্ছিল!”

মৃধা নিচু করে নিশীথের দিকে চাইল। কি গভীর চাহনি। যে চাহনিতে তাকিয়ে মৃধা ভড়কে গেল। অপ্রস্তুত হয়ে অন্যদিকে ফিরে বলল,

“ তুই আমায় জোর করে এনেছিস৷ ”

নিশীথ ঠোঁট এলিয়ে হেসে বলল,

“ আনলে আনলাম। দরকার হলে জোর করেই তোকে আমার করে রাখব সারাটা জীবন! ”

মৃধা অভিমানী চাহনিতে চাইল। বলল,

“ তুই যদি এক বারের জন্য ও বলতি আমায় তুই আমাকে নিজের করে চাস। আমি একবারও নিষেধ করতাম না নিশীথ। উল্টে খুশিতে কান্না করে দিতাম আমি। কিন্তু তুই তা করলি না। করলি কি? আমায় নিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুড়লি। আমায় ছোট করলি। ”

“ আমি না। চ্যালেঞ্জটা তোর আবিরই দিয়েছিল প্রথমে। চ্যালেঞ্জ এক্সেপ্ট না করলে ভাবত আমি ভীতু! ”

মৃধা ভ্রু কুঁচকে বলল,

“ মানে?

নিশীথ চাপা শ্বাস ফেলল। উঠে বসে বলল,

“ আমার জীবনের পুরোটা গল্প তুই জানিস না মৃধা। সবটুকু কাহিনী তোর জানা নেই৷ ”

“ হ্ হু?”

“ হু। ঐ আবির আমার কাজিন হয়। খালাতো ভাই! গুণে গুণে তিন বছরের বড় আমার চাইতে। ”

মৃধা অবাক হলো। বিনিময়ে বলে উঠল,

“ কি? ”

নিশীথ বলতে লাগল,

“ হ্যাঁ। ওর যখন ওর সাতবছর তখন ওর মা মারা গেল। তারপর আমার বায়োলজিক্যাল মাদারকেই ছুটতে হলো ওর দেখাশোনা করার জন্য। সম্পর্কে খালা হয় বলে কথা! তখন আমি চারবছরের বাচ্চা!তারপর আবিরের মা মারা যাওয়ার দুই মাস পরই রাহির আগমনি খবর পাওয়া গেল। উনি তখন প্র্যাগন্যান্ট! সব মিলিয়ে আমার সেই বায়োলজিকাল মাদারের বেহাল অবস্থা। কিন্তু তবুও ঐ আবিরের বাচ্চা আবির আমার বায়োলজিক্যাল মাদারকে ছাড়বে না। বাড়ি ব্যাক করতে বললেই শুরু হয় কান্নাকাটি আর ওর জেদ। আব্বু তখন সেনাবাহিনীর ক্যাপটেন পদে জব করত চট্টগ্রামে। বছরে এক দুবার আসত। এদিকে আবিরও ঐ মহিলাকে ছাড়তে রাজি নয় দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো আমরা আবিরদের বাসাতেই থাকব। তারপর? তারপরের জীবনটা বিলাসিতায় কাঁটছিল। আমার বায়োলজিকাল মাদারের কোন কষ্টই হতে দিচ্ছিল না আমার ডিয়ার খালুজান। এর ছয় সাত মাস পর জম্মাল রাহি। কি সুন্দর ছোট একটা বাচ্চা মেয়ে। আমি কত খুশি হয়েছিলাম।তারপর? তারপর কি হলো জানিস? ”

মৃধা কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে ছিল। কি হলো মস্তিষ্কে জানার জন্য আগ্রহ আসতেই বলল,

“ কি হলো? ”

“ তারপর ঐ আবির আমার বায়োলজিক্যাল মাদারকে কেড়ে নিতে চাইল। উনাকে আম্মু ডাকত । সবসময় আম্মু আম্মু করত। আর আমার সেই বায়োলজিক্যাল মাদার কি করল জানিস? দু দুটো সন্তানের সামনে লজ্জাশরম ভুলে প্রেমে পরে গেল নিজের একমাত্র বোনের বরের! বাহ! কি সুন্দর! আমি নিজের চোখে সে ছোটবেলায় দেখতে পেতাম, ঐ মহিলা আর ঐ আবিরের বাবার ঘনিষ্ঠরূপ! ছিঃ!”

মৃধার মুখ হা হয়ে এল। অজান্তেই বলল,

“ কি? ”

নিশীথ হালকা হাসল। উত্তরে বলল,

“ হুম! দুর্ভাগ্যবশত আমি একজন চরিত্রহীন নারীর সন্তান মৃধা।আমার আব্বু এই ঘটনা জানতে পারল আরো বছর দুয়েক পর। যখন আমার ছয়বছর। তারপর সব ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। আমার সুখ সব পেয়ে গেল ঐ আবির! সব কেড়ে নিল! মাঝখান থেকে আমি মা-হারা হলাম। রাহি বাবা-হারা হলো। আব্বু অবশ্য আমায় কখনো মায়ের অভাব বুঝতে দেয়নি।আমার যখন ছয় কি সাতবছর তখন বাবা এইখানে বাসা বানাল।তারপর আম্মুকে এনেছেন! তারপর আমরা এই বাসায় সুখীভাবে থাকতে লাগলাম। জানিস মৃধা? আমি চোখ বন্ধ রেখেই বলতে পারি আম্মু আমায় যতোটা ভালোবাসেন আমার বায়োলজিক্যাল মাদার তার এইটুকুও বাসেনি। এইটুকুও না। বাসলে কি উনি এই ঘৃণ্য কাজটা করতে পারতেন বল? ”

মৃধা এবারে উত্তর দিল না৷ তার কাছে এখনও এসব সত্য বোধগম্য নয়। এখনও বুঝে উঠছে না সব। শুধু বিস্ময় নিয়ে চেয়ে থাকছে আর ভাবছে। সত্যিইটা এমনটা করতে পারে কোন মা? সত্যিই? নিশীথ ফের বলল,

“ জানিস? এইসবে সবচেয়ে দুঃখটা পেল কে? রাহি? আব্বু ভাবে রাহি আব্বুর মেয়ে না। যেহেতু আবিরের মা মারা যাওয়ার মাস দুই পর উনার প্র্যাগনেন্সির খবর এসেছিল তাই আব্বু ভাবে রাহি খালুর মেয়ে! এসব নিয়ে তো ছোটবেলায় বুঝতাম না। তবে এখন বুঝি, তাই আন্দাজ করি। রাহির জন্য আমার খুব কষ্ট হয় জানিস। বুঝ হওয়র পর থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে যোগাযোগ করতাম ওর সাথে। ও যখন বারো বছর বয়সী তখন খালু ওকে একদিন ব্যাড টাচ করেছিল। আমাকে জানাতে আমি অবাক হলাম। সতেরো বছরের ছিলাম তখন। কি করব বুঝে না উঠে রাহিকে নিয়ে চলে এলাম এখানে। অথচ আব্বু মেনে নিলেন না। বরং রাহির দায়িত্ব নিবে বলে রাহিকে হোস্টেলে দিয়ে আসল। আমি আব্বুর মুখের উপর এখনও কিছু বলতে পারি না। বলতে পারি না, রাহি আমারই বোন৷ কারণ আমার বায়োলজিক্যাল মাদার যে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল তাতে তার হয়ে আব্বুর কাছে যুক্তি দিয়ে কথা বলার আর মুখ নেই মৃধা। ”

মৃধা অনেকটাক্ষন চুপ থাকল। তারপর সবকিছু বুঝে নিয়ে আচমকা প্রশ্ন ছুড়ল,

“ মানে তোর আম্মু তোর আসল মা নয় নিশীথ? সৎ মা? আমরা এতকাল যাকে তোর মা…”

নিশীথ মুহুর্তেই মৃধার ঠোঁটে আঙ্গুল রাখল। বলল,

“ হুশশশ! উনিই আমার আসল মা। উনিই আমার একমাত্র মা। আমার আর কোন মক নেই মৃধা। তোরা এতকাল যা জেনেছিস তাই সত্যিই। উনিই আমার মা। আর কখনো সৎ মা শব্দটা উচ্চারণ করবি না মৃধা। ”

মৃধা মাথা নাড়িয়ে বলল,

“ হু। ”

“ তোকে নিয়ে চ্যালেঞ্জটা হয়েছিল ভার্সিটি থেকে ফেরার পথেই। রাহির জম্মদিন ছিল সেদিন। ওকে উইশ করতে করতে তোর দুটো ছবি দিয়ে বললাম যেন তোকে তাড়াতাড়ি ওর ভাবি করতে পারি এই দোয়া করে। ব্যস! তখন আবিরও হাজির হলো ওখানে। রাহিকে উইশ করতেই গিয়েছিল। জা’নো’য়ারটা মা-বোন সব কেড়ে নিতে চেয়ছিল শান্তি হয়নি। এবারে আমার অনুভূতিও কেড়ে নিতে আসল। চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলল তোকে বিয়ে করে নিবে ও। আর আমি সারাজীবন একাই থাকব। মেজাজ তখন তুঙ্গে। মুখের উপরই চ্যালেঞ্জটা এক্সেপ্ট করেছিলাম। কিন্তু বেকার হওয়ায় প্রস্তাব পাঠাতে পারলাম। আব্বুকে বহুবার বললাম তোকে ভালোবাসি, বিয়ে করতে চাই৷ আব্বু বোধহয় তোর বাপকে বলেছিলও আকারে ইঙ্গিতে। কিন্তু তোর বাপ তো ছেলে প্রতিষ্ঠিত, পরিবার বড়লোকওয়ালা দেখে ঐ আবিরের সাথেই বিয়ে দিয়ে দিতে লাগল। তারপর? তারপর কতোটা কষ্টে লিয়নদের সাহায্য নিয়ে বিয়েটা করেছি আমি। এক্ষেত্রে অবশ্য আব্বুর অবদানও অনেক। আব্বু সেদিন শেষমুহুর্তে প্রস্তাব না রাখলে তো বিয়েটা হতোই না। ”

মৃধা ফ্যালফ্যাল করে চাইল। এতকিছু? এতকিছু না করে তাকে কি একবার জানানো যেত না যে নিশীথ তাকে ভালোবাসে? মৃধার কান্না এল যেন। নিশীথ হাসে আড়ালে। দুই হাতে মেয়ে মুখ আগলে ধরে ঠোঁট ছোঁয়াল মৃধার কপালে। পরমুহুর্তেই ঠোঁটে। বলল,

“ বুঝলেন ম্যাম? আপনি আমার অনেকদিনের সাধনার! অনেকদিনের না পাওয়া আকাঙ্ক্ষা! ”

মৃধা কেঁদে দিল। দুইহাতে ঝাপটে নিশীথের ঘাড়টা জড়িয়ে ধরল। চোখের জলে নিশীথের ঘাড় ভাসাতে ভাসাতে বলে উঠল,

“ অথচ একবার আমায় জানালে এসব কিছুই করতে হতো না। ”

নিশীথ হাসল। দুইহাতে সেও জড়িয়ে ধরে উত্তর দিল,

“ আপনি যে পরিমাণ ঝগড়ুটে! হয়তো বলতে যেতাম ভালোবাসি আপনি বুঝে নিতেন অন্য একটা। শেষমেষ প্রোপজ করা তো হতোই না বরং ঝগড়া করে বাড়ি ফিরতাম। ”

.

রাহি লিয়নের কাছে একটা দিন চেয়েও পেল না। কি নিষ্ঠুল! যোগাযোগের পথটুকুও বন্ধ রেখেছে। রাহি বান্ধবীর ফোন নিয়ে কল লাগাল লিয়নকে। ওপাশ থেকে কল রিসিভড হতেই বুক ধুকপুক করল। আকুতি নিয়ে বলল,

“ লিয়ন ভাই? আমায় বিয়ে করবেন? চলুন না? আমরা বিয়ে করে নিই। করবেন? ”

লিয়ন চোখ বুঝে নিল। এই মেয়েটার পাগলামোর দেখে ধমকে বলল,

“ পাগল হয়েছো তুমি? কিসব প্রলাপ বকছো? ”

রাহি জানে এটায় কখনোই রাজি হবে না লিয়ন। মন খারাপ করে শুধাল,

”আমায় একটাদিন সময় দিন তাহলে। একটা দিনই তো। আর এক সপ্তাহ পর চলে যাব লিয়ন ভাই। একটু কি মায়া হয় না আপনার?”

“ হয়না। ”

রাহি অভিমান করে বলল,

“ নিষ্ঠুর!”

লিয়ন দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অনেকটাক্ষন চুপ থেকে কি বুঝে বলে উঠল,

“ কাল সকালে তৈরি থেকো রাহি। কালকের দিনটা শুধুই তোমার। এরপর আর কখনো যোগাযোগ করবে না। ”

রাহির চোখ টলমল করল। জানাল,

“ করব না!কালই শেষ দিন!”

#চলবে…..