হৃদয়ে প্রণয়ের বাস পর্ব-০২

0
20

#হৃদয়ে_প্রণয়ের_বাস
#পর্ব_০২
লেখনীতেঃ রোদসী রঙ্গন

বিয়ের প্রথম রাতেই স্বামী তার প্রেমিকার সাথে প্রেমালাপে ব্যস্ত! এমন ঘটনায় আর পাঁচটা স্ত্রী কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাত মৃধার জানা নেই।তবে সে একদম চুপচাপ স্বাভাবিক হয়েই সমস্ত কথা শুনল। পুরোটা সময় স্থির চাহনিতে তাকিয়ে থাকল নিশীথের পানে। যে নিশীথকে সে কিশোরী কাল থেকে ভালোবেসে এসেছে সে নিশীথই অন্য কাউকে ভালোবাসে? অন্য কাউকে চায়? এই কথাটা মাথায় ঘুরতেই যেন চাপা কষ্ট অনুভব হলো হৃদয়ে।জ্বলন্ত আগুনের ন্যায় বুকের ভেতর তরতাজা দহনের যন্ত্রনা নাড়া দিল! অথচ সে যন্ত্রনা সে কাউকে প্রকাশ করতে পারল না। কাউকে দেখাতে পারল না। বোবা কান্নাদের গলায় চেপে রেখে পুনরায় সেখান থেকে চলে আসতে নিতেই শোনা গেল নিশীথের ডাক,

“ মৃধার বাচ্চা মৃধা? তুই লুকিয়ে লুকিয়ে আমার প্রেমালাপ শুনছিলি এতক্ষন? ”

মৃধা বিস্ময় নিয়ে চাইল। কি বলবে উত্তর খুঁজে না পেয়ে বলে বসল,

“ না,না। তোকে রুমে দেখতে পাইনি তাই ভাবলাম বেলকনিতে আছিস কিনা। ”

নিশীথ ভ্রু বাঁকাল। সরু চাহনি ফেলে বলল,

“তুই আজকাল আমায় খুঁজিসও? কেন? কোন দরকারে? ”

মৃধা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকাল। আসলেই তো। কেন খুঁজবে সে নিশীথকে? তবুও মৃদু আওয়াজে উত্তর দিল,

“এমনিই, ঘুম ভেঙ্গে গেল তাই আরকি। ”

নিশীথ ভ্রু উঁচু করে চাইল। বুকে হাত গুঁজে মৃধাকে পর্যবেক্ষন করতে করতে শুধাল,

“ তো তুই কি ভেবেছিলি আমি তোর পাশে থেকে তোকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে থাকব মৃধা? ইয়াক! ”

শেষের কথাটা বলেই নাক মুখ কুঁচকাল নিশীথ। সাথে মৃধাও কথাটা শোনা মাত্র মুখ কুঁচকাল। বাক্যটাই জঘন্য বোধ হলো। বলল,

“ ছিঃ! এসব আমি মরে গেলেও ভাবতাম না।”

“ তাহলে? ”

মৃধা এই বিষয়টা এড়িয়ে যেতে চাইল। কথাটা শোনামাত্রই তো যেন কান ঝনঝন করে উঠল তার। তবুও নিশীথ ও কথাতেই আটকে আছে? মৃধা কথা ঘুরাতে বলল,

“ ঘুমাসনি তুই? ”

নিশীথ ডোন্ট কেয়ার ভাব বেলকনির গ্রিল ভেদ করে আকাশ পানে তাকাল। পরমুহুর্তেই বলে উঠল,

“পাশে সুন্দরী যুবতী মেয়ে ঘুমালে আমার ঘুমাতে ইচ্ছে করে না। অন্য কিছু করতে ইচ্ছে করে! তাই প্রেমিকার সাথে কথা বলে রাত পার করছিলাম। কিন্তু তুই তাও হতে দিলি না! ”

মৃধা বোধহয় নিশীথের প্রথম কথার অর্থটাই বুঝে উঠল না। তবে পরের কথাটা শুনেই হেসে উঠল আওয়াজ করে। ভ্রু নাচিয়ে বলল,

“ তোর সুন্দরী প্রেমিকা জানে তোর পাশে কোন সুন্দরী যুবতী মেয়ে ঘুমাচ্ছিল নিশীথ? ”

নিশীথ ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাল মৃধার দিকে। রাগ রাগ ভাব টেনে উত্তর দিল,

“ তোর মতো আহাম্মক নাকি আমি? তুই নাহয় নিজের হবু বরকে বলে আসলি তুই অমুককে ভালোবাসিস, তমুককে ভালোবাসিস। তাই বলে আমিও কি তোর মতো ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে বলে বেড়াব সব?”

মৃধার মুখ কালো হলো এবারে। মাসখানেক আগে যখন আবিরের সাথে তার বিয়ে ঠিক হয়েছিল তখন বিয়ে ভাঙ্গার আশা নিয়ে নিশীথের প্রতি তার একপাক্ষিক ভালোবাসার গল্প শুনিয়েছিল সময় নিয়ে। কিন্তু নিশীথ কি করে জানল? নিশীথ কি জানে মৃধা যে নিশীথকে ভালোবাসে? মৃধা বুঝে উঠল না। প্রশ্ন ছুড়ল দ্রুত,

“ তুই কিভাবে জানলি আমি যে আবিরকে বলেছি কারোর কথা? ”

নিশীথ এবারে বাঁকা হাসল। ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল,

“ তোর মতো গাঁধারা বলতে পারে এসব! আমার ধারণা আছে এই নিয়ে। ”

মৃধা স্বস্তি পেল। যাক! নিশীথ তবে জানে না। শুধু ধারণা করে বলেছে। যদি জানত তাহলে মৃধা লজ্জা পেত। হয়তো নিশীথের সামনেই আর সাহস করে আসতে পারত না। কিন্তু এখন স্বস্তি লাগছে।শুধাল,

“ ওহ! আচ্ছা শোন? ”

“কি?”

“বেলকনি থেকে কে নিয়ে গেল আমায়?মানে আমি তো বেলকনিতেই ছিলাম।ঘুম থেকে উঠে দেখি বিছানায়। ”

নিশীথ ভ্রু বাঁকিয়ে তাকাল। কিছুই জানে না এমন একটা ভাব নিয়ে বলে উঠল,

“আমি কিভাবে জানব? হয়তো ভূতে। ”

মৃধা নাক ফুলাল। ভূত? ভূত কোথায় থেকে আসবে? নিশীথ নিশ্চিত মিথ্যে বলছে এই ভেবে নাক ফুলিয়ে বলল,

“ মিথ্যে বলবি না নিশীথ। তুই নিয়ে গিয়েছিস আমায় ? ”

“ আমারে ভূতে কামড়াইছে যে তোর মতো হাতিকে কোলে তুলব? তোর ওজন সইতে পারব আমি? ধপাস করে পড়ে যেতাম নির্ঘাত!”

মৃধা এবার কাঁদো কাঁদো হয়ে তাকাল। তার ওজন অতোটাও বেশিনয়। এই জীবনে তাকে কেউ কখনো ওজন নিয়ে খোঁটা দেয়নি অন্তত। কিন্তু নিশীথ দিল? এমন বিচ্ছিরি ভাবে অপমান করল? মৃধা নাকমুখ লাল করে বলল,

“ নিশীথের বাচ্চা নিশীথ! ভুলভাল বলে সত্যি লুকাবি না। এই ঘরে তুই ছাড়া কেউ ছিল না। সুতারাং তুইই নিয়ে যাবি নিশ্চয়?”

নিশীথ একলাফে অস্বীকার করল সত্যটা। নাকমুখ কুঁচকে দ্রুত বলে উঠল,

“ ছিঃ!আমার কি খেয়ে দেয়ে কাজ নেই যে তোকে পাশে ঘুমাতে দিয়ে আমি নিজের ঘুম নষ্ট করব? ”

মৃধা এবারে দমে গেল। আসলেই তো। নিশীথ তো বললই পাশে মেয়ে ঘুমাচ্ছে বলে সে ঘুমাতে পারছিল না। তাহলে নিশ্চয় নিজেই নিজের ঘুম নষ্ট করার প্ল্যান করত না?মৃধা বোকা কন্ঠে শুধাল,

“ তাহলে? ”

নিশীথ এবারে হাসল আড়ালে। বলল,

“হতে পারে তুই ঘুমের মধ্যে হেঁটে হেঁটে চলে গেছিস। তোর বিশ্বাস আছে নাকি? সব করতে পারিস তুই।”

মৃধা অবিশ্বাস্য চাহনিতে তাকাল। এটাও সম্ভব?ঘুমের মধ্যে তার হাঁটাহাটির কোন অভ্যেস আছে বলে তো সে জানত না। তবুও অবিশ্বাস্য স্বরে বলল,

“আ্ আমি? সত্যিই?”

“ তো কি আমি মিথ্যে বলছি? বাই দ্যা ওয়ে, তুই আমার টিশার্ট পড়ে আছিস কোন আক্কেলে? এক্ষুনি খুল। তোর কাছে শীতের জামাকাপড় নেই? ”

মৃধা এখনো আগের ভাবনাতেই ডুবে। তবুও সরল কন্ঠে উত্তর দিল,

“এখানেই পেয়েছিলাম।ঠান্ডা লাগছিল বলে পড়ে নিয়েছিলাম। দিয়ে দিচ্ছি দাঁড়া। ”

নিশীথ দ্রুত আবার উত্তর দিল,

“ না, থাক থাক। এটা তোরে ভিক্ষা দিলাম যা। আমার আবার দয়ালু মন তো। কেউ শীতের পোশাকের অভাবে ঠান্ডায় ম’রে যাবে এই দৃশ্য দেখতে কষ্ট হবে। তার থেকে এটা তোর। রেখে দে। বিনিময়ে আমার মাথা টিপে দিবি এখন। ওকে? ”

মৃধা ফের জ্বলে উঠল। চোখমুখে জ্বলন্ত রাগ দেখিয়ে বলল,

“ কি? আমি তোর মাথা টিপে দিব? আমাকে কি তোর চা’কর মনে হচ্ছে নাকি আর পাঁচটা টিপিক্যাল ওয়াইফদের মতো ভাবছিস? কোনটা বেয়াদব? ”

নিশীথ হাসল। বেলকনি ছেড়ে যাওয়ার আগে দিয়ে মৃধার দিকে ঝুঁকে বলে গেল,

“ বাহ বাহ!এইতো দেখি ম্যাম আগের রূপে ফিরে চলে এসেছেন।গুড। বাট আমার মাথা ব্যাথা করছে। আপনার সাথে ঝগড়া করার মুড নেই।”

.

বাকিটা সময় মৃধা জেগেই কাঁটাল। ভোরের আলো ফুটতেই মৃদু পায়ে বেলকনি ছেড়ে রুমে আসল। নিশীথের টিশার্টটা খুলে বিছানার এককোণে রেখে রুমের বাইরে বেরিয়ে দেখল কয়েক পলক। এখনও কেউ ঘুম ছেড়ে উঠে নি। নিস্তব্ধ নিরব হয়ে আছে বাসা।আরেকটু পা বাড়াতেই চোখে পড়ল মাহমুদ সাহেবকে। শীতের জামাকাপড় পড়ে একদম তৈরি।শুধু মুখটাই দেখা যাচ্ছে। বাকি গলা কান সব ডেকে নিয়েছেন শীতের পোশাকে। মৃধা হাসল মৃদু এহেন রূপ দেখে।মাহমুদ সাহেব তখন সদর দরজা চাপিয়ে দিয়ে বোধহয় হাঁটতে বের হচ্ছেন সকালে। মৃধা আবারও হাসল। দ্রুত এগিয়ে মাহমুদ সাহেবের সামনে গিয়ে শুধাল,

“ আঙ্কেল? আঙ্কেল? হাঁটতে বের হচ্ছো বুঝি? ”

মাহমুদ সাহেব তাকালেন। মৃধাকে দেখে মিষ্টি করে হেসে বলে উঠলেন,

“ আরেহ আম্মাজান? এত তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে গেছিস? আচ্ছা তাহলে আজ বরং আমরা দুজন একসাথে হাঁটতে বের হই? কি বলিস? ”

মৃধা প্রত্যুত্তরে হাসল। বাসা ছেড়ে বেরিয়ে বলল,

“ যাওয়া যাক। অনেকদিন হলো সকাল দেখা হয়না বাইরে বুঝলে। ”

মাহমুদ সাহেব মৃধার দিকে চাইলেন। চোখমুখ কুঁচকে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন,

“এই,এভাবে যাবি নাকি? বাইরে যা ঠান্ডা। দাঁড়া দাঁড়া, তোর আন্টির শালটা এনে দিচ্ছি এক্ষুনি। ”

কথাটা বলেই মাহমুদ সাহেব দ্রুত গেলেন ভেতরে। আবার মিনিটের মাথায় ফিরেও এলেন। তবে হাতে একটা শাল নিয়ে। সেটা মৃধার হাতে তুলে দিয়েই বললেন,

“এটা ভালো ভাবে পরে নে। ঠান্ডা লাগবে না আর তাহলে। ”

মৃধা হেসে উত্তর দিল,

“ ঠিকাছে,যথাজ্ঞা মাহমুদ আংকেল!”

কথাটা বলেই চাঁদরটা ভালোভাবে শরীরে জড়িয়ে নিল। গুঁটি গুঁটি পা ফেলে চলতে লাগল মাহমুদ সাহেবের পেছনে পেছনে।

.

নিশীথ ঘুম ছেড়ে উঠল আরেকটু পর। ঘুম ছেড়ে উঠেই বিছানার এককোণে মৃধার পরনের সে টিশার্টটা দেখে ভ্রু কুঁচকে চাইল। পরমুহুর্তেই উঠে ফ্রেশ হয়ে রুমের বাইরে যেতেই চোখে পড়ল নিবির, নীলাদ্রীকে। চারপাশে চোখ বুলিয়ে বারকয়েক মৃধাকে খুঁজলও বোধহয়। পরমুহুর্তে রান্নাঘরে গেল দু পা বাড়িয়ে। এবারে চোখে পড়ল কেবল তার মাকে। নিশীথ নিরাস হলো। সকাল সকাল কি এই মৃধা উধাও হয়ে গেল নাকি টিশার্ট ফিশার্ট দিয়ে? নাকি এখনও বেলকনিতে পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে? নিশীথ দ্রুত পা বাড়াল এবারে। কিন্তু বেলকনিতে গিয়েও নিরাস হলো সে। সূক্ষ্ম কৌতুহল নিয়ে এপাশ ওপাশ চাইতেই মোবাইলের রিংটোনের আওয়াজ কানে এল তার। নিশীথ কপাল কুঁচকে রুমে গিয়ে রিংটোনের আওয়াজ অনুসরন করে মোবাইল নিতেই বুঝতে পারল এটা মৃধার মোবাইল। কিন্তু পরমুহুর্তেই মোবাইলের স্ক্রিনে ফুটে উঠা নামটা দেখে দাঁতে দাঁত চাপল। নাকের অগ্রভাগ লাল দেখাল। হাত নিশপিশ করে কলটা রিসিভড করতেই ওপাশ থেকে কেউ চাপাস্বরে জানান দিল,

“ মৃধা? আমি আপনাকে সত্যিই ভালোবাসি। বিশ্বাস করুন, আমি আপনাকে ভালোবাসি। একটাবার দেখা করুন মৃধা।শুধু একটাবার!আমি আপনাকে সবটা খুলে বলব। ”

#চলবে…

( কেমন হয়েছেন জানাবেন। ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।)