হৃদয়ে প্রণয়ের বাস পর্ব-০৩

0
16

#হৃদয়ে_প্রণয়ের_বাস
#পর্ব_০৩
লেখনীতেঃ রোদসী রঙ্গন

“ আব্বু? তুমি আমার বউকে কোথায় নিয়ে গেছো? আশ্চর্য! সকাল সকাল আমার বউ হাওয়া হবে কেন? ”

ফোনের অপরপ্রান্তে নিশীথের কথা শুনে চাপা হাসলেন মাহমুদ সাহেব। আর যায় হোক এই মানুষটা জানেন তার ছেলে কেমন। এই মানুষটা দেখেছেন ছেলেটা কি ভীষণভাবে চায় তার সামনের মেয়েটাকে। সেজন্যই তো শেষমেষ সুযোগটা হাতছাড়া করলেন না। অবশ্য সেদিন যদি সুযোগটা উনি না পেতেন তাহলে যে সারাজীবন ছেলের কি ভীষণ রাগ তাদের সহ্য করতে হতো তা বোধহয় কেবল উপরওয়ালাই জানেন। মাহমুদ সাহেব এসব ভেবে হাসলেন। পরক্ষণেই দু পা বাড়িয়ে মৃধার থেকে একটু দূরে গিয়ে গম্ভীর স্বরে উত্তর দিলেন,

“ নিশীথ? তুমি কাল বিয়ের সময় যা করেছো তারপর তোমার সাথে কথা বলার ইচ্ছে আমার আর আসছে না। আমি ভেবেছি তুমি আর তোমার আম্মু যেহেতু বিয়েটা মানতে চাইছোই না সেহেতু মৃধাকে ওর বাসাতেই দিয়ে আসি আজ কি বলো? ”

নিশীথ মুহুর্তেই কপাল কুঁচকে নিল। তড়িঘড়ি করে বলে উঠল,

“ ছিঃ! কি হিটলার বাপ তুমি আব্বু। শেষে কিনা বাংলা সিনেমার শ্বাশুড়িদের মতো কুটনামি করাতে লেগে গেলে তুমি আব্বু? ছিঃ!”

মাহমুদ সাহেব পাত্তা দিলেন না। গম্ভীর আওয়াজে বলতে লাগলেন,

“ তোমার ছিঃ তুমি তোমার কাছে রাখো নিশীথ।তোমার আম্মু ভাবছে আমি তোমায় জোরজবরদস্তি করে বিয়ে দিয়েছি। এই নিয়ে কাল রাতে ঝগড়াও হয়েছে আমাদের। যদি সত্যিই আমি তোমায় জোরজবরদস্তি করে বিয়েটা দিয়েই থাকি তো আমার মনে হয় এর সমাধানটাও আমারই করা উচিত। তাই না? ”

নিশীথ মুহুর্তেই প্রতিবাদ জানাল। তীব্র স্বরে বলে উঠল,

“ ছিঃ আব্বু! নিজের সংসারে আগুন লেগেছে বলে তুমি আমার না হওয়া সংসারে আগুন দিতে চাইছো? কী নির্দয় তুমি! আমি তো সংসারের স ও বুঝে উঠিনি এখনো আব্বু। তার আগেই আমার সংসার ভাঙ্গার প্ল্যান করছো? আমি অতো কিছু জানি না।তাড়াতাড়ি বাসায় আসো আমার বউ নিয়ে। ”

মাহমুদ সাহেব এবারেও হাসলেন। তবে বরাবরের মতো হাসি লুকিয়ে গম্ভীর আওয়াজে উত্তর দিলেন,

“ ঠিকাছে, আসছি। কল রাখছি এখন। ”

.

নতুন বউ বিয়ের পরদিন সকালেই উধাও। বিষয়টা পছন্দ হলো না নিশীথের মায়ের। মনে মনে কিছুটা মনঃক্ষুন্ন ও হলেন মৃধার উপর। মৃধাকে উনি ছোট থেকেই চেনেন। এমন নয় যে উনি মৃধাকে অপছন্দ করেন বলেই বিয়েটা মানতে চাইছেন না। মূলত এই বিয়েতে উনি নারাজ কেবল নিশীথের কথা ভেবে। নিজের ছেলেকে জোরজবরদস্তি করে বিয়ে করানো হবে এটা নিশ্চয় কোন মায়েরই পছন্দ নয়। নিশীথের মায়েরও পছন্দ হয় নি। এই ভেবে চাপা শ্বাস ফেললেন উনি। পাশে দাঁড়ানো মৃধার দিকে এক নজর তাকালেন শান্ত নজরে। মৃধারা ফিরেছে একটু আগেই। তাও একেবারে বাইরে থেকে সকালের নাস্তা সেরেই৷ এই নিয়ে প্রথমে নিশীথের মা হালকা কথাও শোনালেন মাহমুদ সাহেবকে। সকাল সকাল নাস্তাটা বাইরে বা করবে কেন? বাইরের খাবার কি অতো ভালো নাকি? মৃধা অবশ্য পুরোটা সময় চুপচাপ থেকে তাদের দুজনের কথা শুনেছে। নিশীথের মা অবশেষে মৃধার দিকে চেয়ে বললেন,

“ এরপর সকালে বের হলে বলে যাবি মৃধা। তুই কোথায় গিয়েছিস এটা তো আমরা জানতাম না। তোকে সকাল সকাল না পেয়ে তোর খোঁজ করতে তোর আম্মু আব্বুকেও গিয়ে জিজ্ঞেস করে আসা হয়েছে। ভেবেছি ও বাড়ি চলে গিয়েছিস কিনা ভোরে ভোরে। ”

মৃধা হাসল। বাড়ি পাশাপাশি হলে এক সুবিধা। আসা যাওয়ায় নো সমস্যা। মৃধা উত্তর দিল,

“ কাল থেকে বলে যাব আন্টি। ”

“ ঠিকাছে। ”

গম্ভীর কন্ঠে উত্তরটা দিয়েই চুপ করে থাকল নিশীথের মা। নিজের কাজে মন দিল। মৃধা উশখুশ করছিল। রান্নার কাজে হাত লাগাবে কিনা বুঝে উঠছিল না। অবশেষে সাহস করে শুধাল,

“ আমি কিছু সাহায্য করি? তুমি একা একা করছো সব। ”

উনি শান্তস্বরে উত্তর দিল,

“ লাগবে না। রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে এখন। আর যাওয়ার সময় নিশীথের কফিটা নিয়ে যাস। ”

“আচ্ছা।”

মৃধা ভালো মেয়ের মতোই উনার কথা অনুযায়ী কফি হাতে রুমে গেল। চারপাশে চোখ বুলিয়ে একবার নিশীথকে খুঁজল।পরমুহুর্তেই চোখে পড়ল খাটে পাতলা চাদর পেঁচিয়ে শুঁয়ে থাকা নিশীথকে। তবে ঘুমন্ত নয়। জেগেই আছে। মৃধা চাপা শ্বাস ফেলে শুধাল,

“ এখন কয়টা বাজে জানিস? ”

নিশীথ ভ্রু কুঁচকে চাইল মৃধার দিকে। ব্যঙ্গ করে বলে উঠল,

“ না, জানব কি করে? সময় দেখতে তো কেবল তুই জানিস তাই না? ”

মৃধা ঠোঁট গোল করে শ্বাস ফেলল।নাক ফুলিয়ে শুধাল,

“তো? তাহলে দিনের নয়টা পর্যন্ত বিছানায় শুঁয়ে আছিস কোন দুঃখে? উঠ। ”

নিশীথ নাকোচ করল মুহুর্তেই। উত্তরে ত্যাড়া স্বরে জানান দিল,

“ উঠব না। আমার বিছানা আমার ইচ্ছে। কিন্তু তুই কোথায় ছিলি দিনের নয়টা পর্যন্ত? এতক্ষন নিশ্চয় আব্বুর সাথে মর্নিং ওয়াক করিসনি তাই না? ”

মৃধা ও ত্যাড়া স্বরে বলল,

“ তোর প্রেমিকার সাথে দেখা করতে গেছিলাম। ”

নিশীথ এবারে উঠে বসল। টানটান স্বরে বলে উঠল,

“সত্যিটা বল মৃধা। আমার মেজাজ এমনিতেই খারাপ! ”

মৃধা সুচালো চাহনিতে চাইল। যদি সুন্দর করে নিশীথ জিজ্ঞেস করত এতক্ষন কি করছিল তাহলে মৃধাও সুন্দরভাবে জবাব দিত যে সে এতক্ষন মাহমুদ আঙ্কেলের সাথে বাইরে হেঁটেছে, চা খেয়েছে, নাস্তা করেছে।আসার সময় নিজের বাসা থেকে ঘুরেও এসেছে। কিন্তু এবারে ইচ্ছে করেই দিল না। ত্যাড়ামি দেখিয়ে বলল,

“ তো আমি কি করব? ”

নিশীথ তখন ফোনে ম্যাসেজের টিউন শুনে সরু চোখে তাকাল মৃধার ফোনের দিকে। এতক্ষন যাবৎ মৃধার ফোনটা তার কাছেই আছে। এবং এই নিয়ে আবিরের শতর উপরে কল আর ম্যাসেজ পর্যবেক্ষন করে চলেছে। অবশেষে এখন আবারও ম্যাসেজ দেখে বিরক্ত হলো। রাগে মুখ টানটান করে মৃধাকে জবাব দিল,

“ কিছুই করা লাগবে না। তুই আমার চোখের সামনে থেকে দূর হ। তোকে দেখলেই আমার রাগ লাগতেছে। প্লিজ যা। ”

মৃধার এই পর্যায়ে মুখ কালো হয়ে গেল। ওকে দেখলে নিশীথের রাগ লাগছে কথাটা মস্তিষ্কে বারকয়েক ঘুরিয়েই চোখ টলমল করল। পরমুহুর্তেই নিশ্চুপে কফিটা রেখে পা বাড়াতে নিতেই মোবাইলটা বেঁজে উঠল। মৃধা ভ্রু কুঁচকাল। ফের পেছন ঘুরে ওর মোবাইলটা হাতে নিতে যাবে তার আগেই নিশীথ মোবাইলটা তুলে নিল। স্ক্রিনে চোখ বুলিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল।তারপর মৃধার দিকে তাকাল একনজর। পরমুহুর্তেই গমগমে স্বরে বলল,

“ কোথাও যেতে এবার থেকে তোর ফোন তোর সাথে নিয়ে যাবি বুঝলি? নাহলে দুনিয়ার মানুষ তো তোকে কল করে করে অজ্ঞান হয়ে যায়। কি আশ্চর্য! তোর যে এত ফ্যান ফলোয়ার দুনিয়াতে জানাসনি তো আগে। ”

মৃধা বুঝল নিশীথ যে ইচ্ছে করেই এভাবে কথা বলছে। শুধাল,

“ খোঁচা দিয়ে কথা বলবি না। যা বলার সোজাসুজি বল নিশীথ। ”

“ কিছুই বলার নেই তোকে। ”

মৃধা হাত পেতে ফোন চেয়ে বলল,

“ ফোন দে। ”

নিশীথ ফোন দিয়ে বলল,

” এই নে। তোর আবিরের সাথে মন খুলে গল্প করে আয় কিছুক্ষন!”

মৃধা অবাক হলো। কালকের পর আবির কোন মুখ নিয়ে কল করে তাকে? ভ্রু কুঁচকে বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,

“ আবির? ”

নিশীথ তাচ্ছিল্য করে বলল,

“ হু। এমন করছিস যেন তুই জানতি না সে যে কল করবে তোকে? ”

“ করার তো কথা নয়। কেন করেছে কল ? ”

নিশীথ ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে উত্তর দিল,

” আমি কিভাবে জানব? তোদের সিক্রেট বিষয় তোরাই তো জানবি। ”

মৃধা ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

“ তুই কল তুলেছিলি? ”

“ তুললে সমস্যা হবে? ”

” না, উনার সাথে তেমন কোন কথা আমার হতো না যে অন্য কেউ কল তুললে সমস্যা হবে নিশীথ! ”

“ তাও ভালো। ”

মৃধা চাপাশ্বাস ফেলল। এই নিশীথকে আগে বোধহয় সে চিনত না। আগে বোধহয় নিশীথের এই রাগটাও এমন ভাবে উপলব্দি করে নি কখনো। কিন্তু যখন থেকে আবিরের সাথে মৃধার বিয়ে ঠিক হয়েছিল ঠিক তখন থেকেই নিশীথ হঠাৎ বদলে গেল। এই মাস খানেকে নিশীথের সাথে দেখা হলেই এমন ত্যাড়া ত্যাড়া কথা শুনিয়ে রাগ দেখিয়েছে নিশীথ। মৃধা আশ্চর্য হতো বারংবার। বারবার ভাবত নিশীথের এত কিসের রাগ আবিরের উপর? কিসের? মৃধা এবারেও বুঝে উঠল না নিশীথের রাগের কারণ। শুধু শান্ত থেকে ফোনটা নিয়ে আবিরকে কল দিল। তাও নিশীথের সামনে। আর এটুকুই বোধহয় নিশীথের রাগের মাত্রাটা বাড়িয়ে সহস্রগুণ করার জন্য যথেষ্ট ছিল। আর সে রাগের বশেই নিশীথ ঐ সময়টা এমনভাবে চেয়ে থাকল মৃধার পানে যেন ঐ নজরটা বলে বেড়াচ্ছে, “তুই কেবল একবার ঐ আবিরের বাচ্চার সাথে কথা বল মৃধা, একবার কথা বল…। ” অথচ মৃধা সে দৃষ্টিটা দেখতেই পেল না। তার নজর তখন ফোনের স্ক্রিনে। অবশেষে ওপাশের আবির যখন কলটা রিসিভড করে মৃধাকে বারংবার ডাক দিলে মৃধা তখন ছোট শ্বাস ফেলে মৃদু আওয়াজে বলে উঠল,

“আসসালামুআলাইকুম আবির সাহেব।”

ব্যাস ! মৃধার কথাটুকু শেষ হলো কি হলো না জানা নেই। তবে গরম কফির মগটা নিজের হাতে নিয়ে এক ধাক্কায় ফেলে দিল ফ্লোরে। মুহুর্তের মধ্যেই মগটা ঝনঝন আওয়াজ তুলে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হলো। মৃধা অবাক হলো। আশ্চর্য হয়ে বিস্ময়ভরা চাহনি নিয়ে চেয়ে থাকল নিশীথের পানে। নিশীথ অবশ্য তখন বসে নেই। হনহন করে বেরিয়ে গেছে রুম ছেড়ে। অপরদিকে দাঁড়িয়ে থাকা মৃধা বিস্ময় নিয়ে কেবল চেয়েই থাকল।

#চলবে…