হৃদয়ে প্রণয়ের বাস পর্ব-০৫

0
15

#হৃদয়ে_প্রণয়ের_বাস
#পর্ব_০৫
লেখনীতেঃ রোদসী রঙ্গন

নিশীথ বাইক চালানোয় পারদর্শী হলেও মৃধা সাধারণত বাইকে করে যাতায়াতে অভ্যস্থ নয়। তাই তো বাইকের সামনে এসেই নিরস চাহনিতে তাকাল। উঠবে কি উঠবে না সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগল কিছুক্ষন। নিশীথ এতক্ষন বোধহয় বাইকে বসে তাই পর্যবেক্ষন করল। পরক্ষনে বিরক্ত স্বরে বলে উঠল,

“ তুই কি উঠবি আধো? নাকি এমনে দাঁড়িয়েই থাকবি? ”

মৃধা অসহায়ের মতো চাইল একপলক। বাইকে উঠতে ভয় হচ্ছে ওর। যদি পরে যায়? বাইকে চড়ে তো সে অভ্যস্ত নয়। এমনকি জীবনে কখনো বাইকে উঠেছে বলেও মনে পড়ছে না। শুকনো ঢোক গিলে পরক্ষণে নিশীথকে বলে উঠল,

“নিশীথ? শোন, আজ বরং আমরা রিক্সায় যাই। যাবি? ”

নিশীথ ভ্রু কুঁচকাল। এতক্ষন চুপচাপ দাঁড়িয়ে কি এই মেয়ে এটাই ভাবছিল। নিশীথ বিরক্ত স্বরে বলল,

“ আচমকা রিক্সায় যেতে যাব কোন দুঃখে ? ”

মৃধা চুপ থাকল। নিশীথের দিকে চেয়ে ছোট শ্বাস ফেলল। কিয়ৎক্ষন পর মৃদু আওয়াজ তুলে উত্তর দিল,

“ আচ্ছা,তুই বরং তাহলে চলে যা নিশীথ। আমি রিক্সায় করে আলাদা যাচ্ছি। ”

নিশীথের এবারে রাগ হলো।কলে তাকে একসাথে যাবে বলে বাসায় আনল। অথচ এখন বলছে আলাদা যাবে। আলাদাই যখন যাবে এত কাহিনী করল কেন? নিশীথ বিরক্তে ফের ভ্রু কুঁচকে চাইল। পরমুহুর্তেই বলল,

“ আলাদা যখন যাবিই তো একসাথে যাব একসাথে যাব বলে আমায় বাসায় আনলি কেন? আশ্চর্য! ”

মৃধা নিরস স্বরে উত্তর করল,

“ আমি আসলে ভাবিনি তুই আসবি। ”

নিশীথের রাগে যেন ঘি পড়ল। বাহবা দিয়ে তাচ্ছিল্য করে বলে উঠল সে,

“ ওহ, বাহ! জাস্ট বলার জন্য বলছিলি তাহলে তখন। ”

“ না, না! আন্টি আংকেল বলেছিল তোকে বলতে।”

ভ্রু উঁচিয়ে নিশীথ ফের শুধাল,

“ সে জন্য বলেছিলি? ”

মৃধা বোকা হাসি দিয়ে উত্তরে জানাল,

“ ঐ আরকি। ”

রাগ যেন এবার চূড়ায় পৌঁছাল। নিশীথ বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে থাকল। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে শাসানোর সুরে বলে উঠল,

”তোর ডং দেখে আমার গা জ্বলছে মৃধার বাচ্চা মৃধা। উঠ। আম্মু বলেছে তোকে সাথে নিতে আবার সাথে আনতে। ”

“ আমি কি ছোট বাচ্চা নাকি? ”

নিশীথ ত্যাড়া গলায় উত্তর দিল,

“ ছোট বাচ্চা নোস বলেই বাইকে উঠতে ভয় পাচ্ছিস। ”

নিশীথ সত্যটা বুঝে গেছে এই ভেবে ফ্যালফ্যাল করে চাইল মৃধা৷ তবুও সত্যটাকে লুকিয়ে সাহসী ভাব নিয়ে শুধাল,

“ আশ্চর্য! ভয় কেন পাব আমি ? ”

নিশীথ বাঁকা হাসল এবারে। ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে মৃধার পানে তাকিয়ে বলে উঠল,

“ তুই শিওর ভয় পাচ্ছিস না?”

মৃধা ফ্যালফ্যাল করে চাইল। সত্যটা লুকিয়ে লাভ নেই ভেবে নিরস চাহনি ফেলে তাকিয়ে ফেলল।মৃদু আওয়াজে উত্তর দিল,

“ নিশীথ চল, রিক্সায় যাই । বাইকে যদি পড়ে যাই আমি? ”

নিশীথের রাগ ভুলে হাসি ফেল। একদম ভুবন কাঁপানো হাসি আসার জোগাড়। তবুও বহু কষ্টে নিজেকে দমাল। গম্ভীর স্বরে বলল কেবল,

“ পড়বি না, উঠ।”

মৃধা সঙ্গে সঙ্গে নাকোচ করল। এক লাফে বলে উঠল,

“ না, না! নো রিক্স ভাই! আমি উঠব না। ”

নিশীথ ফের ভ্রু কুঁচকে তাকাল। মৃধার দিকে ভ্রু নাচিয়ে বলে উঠল,

“ কে ভাই?কোন জম্মের ভাই? কোন প্রকারের ভাই আমি তোর?”

মৃধা এবারেও অসহায় বোধ করল। বারংবার নিশীথের কাছে কথায় হেরে যাচ্ছে, যুক্তিতে হেরে যাচ্ছে। এটা অসহায়ত্ব নয়? মৃধা অবশ্য পরেরবার যুক্তিতে হারতে চাইল না। বুদ্ধি করে ভেবে ভেবে বোকা বোকা গলায় উত্তর দিল,

“আরেহ পাড়াতো ভাই না তুই আমার? একই পাড়ায় থাকি তো আমরা। ”

নিশীথ বাহবা দিয়ে বলল,

“ গুড বইন! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম আমার একটা পাড়াতো বোন ও আছে। ভাগ্যিস মনে করিয়ে দিলি! ”

মৃধা ফুসফাস শ্বাস ফেলল। মুহুর্তেই সামনে একটা খালি রিক্সা আসতে দেখে নিশীথকে দ্রুত বলে উঠল,

“ রিক্সা পেয়ে গেছি নিশীথ। তুই বরং চলে যা। আমি এটা করে চলে যাই হু?”

নিশীথের রাগে নাক লাল হলো এবারে। এতক্ষন দাঁড়িয়ে আছে সে কিজন্য? এই মুহুর্তে ইচ্ছে হচ্ছে মেয়েটাকে ঠাস করে একটা চড় লাগাতে। নিশীথ ফুস করে শ্বাস ছাড়ল। এমনভাবে চাইল যেন ও মৃধাকে পারলে এখনই উপরে তুলে ছুড়ে মারবে। মৃধা দাঁত কেলিয়ে হাসল। খিলখিলিয়ে হেসে বলে উঠল,

“ রাগলে তোর নাকটা লাল টকটকে হয়ে যায়। কিউট লাগে দোস্ত! ”

“ আর হাসলে তোকে ডিরেক্ট পেত্নি লাগে। ”

মৃধা মুখ ভেঙ্গিয়ে বলল,

“ তোরে তো হাসলে একদম রাজকুমার লাগে মনে হচ্ছে! ”

নিশীথ চোখ সরু করে বলল,

“ লাগে না? ”

মৃধা মুখ কুঁচকে বলল,

“ বিচ্ছিরি লাগে! ”

“ ভালো, তোর সাথে ঝগড়া করার সময় নাই আমার। তুই থাক। আমি গেলাম। ”

কথাটুকু বলেই নিশীথ বাইক নিয়ে এগিয়ে গেল অনেকটা দূর। মৃধা বোকার মতো চেয়ে থাকল।একটু আগেই একটা খালি রিক্সা দেখল। অথচ নিশীথের সাথে কথা বলতে বলতে ডাকাই হলো না। মৃধা আপসোস করল। তারপর আরো কিছুটা সময় রিক্সার জন্য দাঁড়িয়ে থাকল। কিন্তু রিক্সার দেখাই মিলল না আর। অবশেষে হতাশ হয়ে মন খারাপ করে ঠোঁট উল্টে নিতেই দেখা পেল নিশীথের। রিক্সায় বসা। রিক্সার এককোণে বসেই ভ্রু উঁচিয়ে চেয়ে থাকল মৃধার পানে। তারপর অতি ব্যঙ্গ সুরে বলে উঠল,

“ কিরে মৃধার বাচ্চা মৃধা? রিক্সা পেলি না?”

মৃধার রাগ হলো। তখন এভাবে রেখে চলে গেল। এখন আবার এভাবে এসে ঢং করে জিজ্ঞেস করার মানে কি? মৃধা নাক ফুলিয়ে জবাব দিল,

“ পেলে কি সুখে এখানে দাঁড়িয়ে আছি আমি? ”

নিশীথ চাপা হাসল। পরমুহুর্তেই শাসানোর সুরে বলল,

“ উঠ! এবারে না উঠলে আমি সত্যি সত্যিই তোরে উপরে তুলে রাস্তায় ছুড়ে মারব বেয়াদব। ”

মৃধা বিস্ময় নিয়ে চাইল। কি আশ্চর্য!নিশীথ তাকে হুমকি দিচ্ছে? তাও রাস্তায় ছুড়ে ফেলার। মৃধা ভয় পায় নাকি এই নিশীথকে? তাইতো আঙ্গুল উঁচিয়ে বলল,

“ কি সাংঘাতিক!তুই আমায় হুমকি দিচ্ছিস নিশীথ? ”

“ রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝগড়া করবি না। উঠ। দেখ মানুষ কেমনে দেখছে তোকে। নিশ্চয় মনে মনে ভাবছে এই মেয়েটা এত ঝগড়ুটে কিভাবে! ”

মৃধা মুহুর্তেই আশপাশে তাকাল। আসলেই তো! কয়েকজন তাকিয়ে আছে। তার চেয়েও বিস্ময়কর বিষয় রিক্সাওয়ালা মামাও তাকিয়ে তাকিয়ে তাদের ঝগড়া দেখছে আর হাসছে।মৃধা লজ্জা পেল যেন নিজের এহেন রূপে।অপর দিকে নিশীথের উপর রাগও হলো। তবুও চুপচাপ উঠে বসল রিক্সায়। এমনভাবে নিজের দিকে চেপে বসল যে দুইজনের মাঝখানে আর দুই ইঞ্চি জায়গা খালি থাকল। নিশীথ তা ভ্রু কুঁচকে চাইল। যেন তার সাথে লাগলেই অপরাধ হয়ে যাবে। মহা অপরাধ। চাপা স্বরে বলল,

”ঠিকভাবে বস। এখন রিক্সা থেকে পরার ভয় হচ্ছে না? ”

মৃধা উত্তর করল না। নাক ফুলিয়ে আগের মতোই বসে থাকল এককোণে। নিশীথ এবারে দাঁতে দাঁত চেপেই গম্ভীর স্বরে শুধাল,

“ঠিকভাবে না বসলে আমি নিজেই তোরে লা’থি দিয়ে ফেলে দিব মৃধার বাচ্চা মৃধা!”

মৃধা অবাক হয়ে চাইল পুণরায়। আরেকটু এদিক ঘেষে বসল এবারে তবে নিশীথের শরীর ঘেষে না। একটু জায়গা খালি রেখেই। তারপর বলল,

“ মনে হচ্ছে তুই নতুন নতুন গু’ন্ডা’মি শিখছিস। তবে পাকাপোক্ত হসনি। পাকাপোক্ত হলে আমি ভয় পেতাম।দোয়া করি তুই গু’ন্ডা’মিতে পাকাপোক্ত হয়ে সফলভাবে গু’ন্ডা’মি কর।”

নিশীথ বাঁকা হাসল।ঠোঁট বাঁকিয়ে শুধাল,

“ পাকাপোক্ত হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি তো তোরই হবে মনে হচ্ছে। আহারে অসহায় মেয়েটা! তোর ভবিষ্যৎ ভেবে আমার নিজেরই মায়া হচ্ছে! ”

মৃধা পাত্তা দিল না। বরং দ্বিগুণ সাহস দেখিয়ে বলে উঠল,

“ হুররর! আমি সাহসী নারী! ”

নিশীথ ফের ঠোঁট বাঁকিয়ে উত্তর করল,

“ আমিও দেখব কতোটা সাহস তোর থাকে তখন। অপেক্ষায় থাকলাম। কেমন?”

মৃধাও বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে উত্তর দিল,

“ ওকে ওকে!”

.

নিশীথ রিক্সা ছেড়ে নেমে পড়ল ভার্সিটির একটু আগে আগেই৷ মৃধা প্রথমে বুঝে না উঠলেও পরমুহুর্তে ভেবে নিল নিশীথ হয়তো তার সাথে একসাথে যেতে চায় না ভার্সিটি পর্যন্ত। কারণ সবাই তাদের একসাথে দেখলে হয়তো অনেককিছু জিজ্ঞেস করবে। বিষয়টা হয়তো নিশীথের জন্য স্বস্তিকর নাও হতে পারে। আবার অন্য কারণও হতে পারে। ভার্সিটিতে তো ওদের জুনিয়র রাহিও আছেে। নিশীথের মাঝরাতের কথা বলার সঙ্গী বলে কথা! হয়তো বেচারী নিশীথের সাথে অন্য কোন মেয়েকে দেখলে কষ্ট পেতে পারে এই ভেবেই নিশীথ আগে আগে নেমে পড়েছে। বাহ! মৃধা দীর্ঘশ্বাস ফেলল এই ভেবে। পরমুহুর্তে রিক্সা ছেড়ে নেমে পড়তেই দৌড়ে এল বান্ধবী হৃদি। উচ্ছাস নিয়ে বলল,

“ দোস্ত, দোস্ত? জানিস? নিশীথ আজ ডেইটে গেছে। মেয়েটা আমাদের ভার্সিটিরই। রাহি? চিনিস তুই? ওমাই গড! আমি তো শুনেই লাফাচ্ছি!”

মৃধা শুনল পুরোটায়। বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হলেও মুখে টানল মৃদু হাসি। ওহ! তাহলে ডেইটে যাবে বলেই সকাল থেকে এত তাড়া ছিল নিশীথের? বাহ!দারুণ তো! মাঝখানে সেই বোঝা হয়ে গেল।সে তো কেবল নিশীথের দায়িত্বস্বরূপ। তাইতো দায়িত্ব নিয়ে তাকে ভার্সিটি এগিয়ে দিয়েই দৌড় লাগাল প্রেমিকার সাথে দেখা করতে।দারুণ!

#চলবে….