#হৃদয়ে_প্রণয়ের_বাস
#পর্ব_০৮
লেখনীতেঃ রোদসী রঙ্গন
“ বিয়েটা করেছি কত পরিশ্রম করে লিও। ভেবেছিলাম সময় নিয়ে ধীরে ধীরে বউয়ের বন্ধু থেকে প্রেমিক হয়ে উঠব। তার মনে প্রেম আনব! কিন্তু আমার শা’লার ভাগ্যটাই খারাপ লিও। সকালে আব্বা আমার বউকে তার বাসায় রেখে আসতে যায় আবার রাতে শ্বাশুড়ি এসে বউ নিয়ে যেতে চায়। আর আমি এখনো ভালোবাসি এটাই বলে উঠতে পারি নাই। দিনরাত শুধু ঝগড়াই করতেছি! ”
নিশীথের কথাগুলো শুনে অপরপ্রান্তে থাকা লিয়ন হেসে উঠল হো হো করে। যেন হাসি দমানো যাচ্ছেই না। এই প্রান্তে বসে থাকা নিশীথের সে হাসি শুনে গা জ্বলে উঠার অবস্থা হলো। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলে উঠল,
“ হাসবি না লিও। হাসলে বোন দিব না তোকে।তখন বুঝবি আমার কষ্টটা যে কি কষ্ট। ”
লিয়ন এই পর্যায়ে বহু কষ্টে হাসি থামাল। পেটে চেপে রাখা হাসি নিয়ে ঠাট্টা করে শুধাল,
“ সেইম এইজের মেয়ে তাও বন্ধু সম্পর্কীয় মেয়ে বিয়ে করেছো বন্ধু। সংসারে প্রেমের বিপরীতে ঝগড়া তো হবেই৷ ”
নিশীথ দাঁতে দাঁত চিবিয়ে শুধাল,
“ বেশি কথা বললে নিশীথের বোনকে বিয়ে করলে যে কি মজা তাও তোকে বুঝিয়ে ছাড়ব হা’রামি। ”
ওপাশে লিয়ন কপাল চাপডিয়ে বলে উঠল,
“ বিয়েই করব না ভাই।এমনিতেই আমায় জ্বালাচ্ছে দিনরাত। তোরা ভাইবোন পেয়েছিস টা কি আমায়? তোর বোনকে বলে দিবি আমি এই পর্যায়ে বিরক্ত তোর বোনের প্রতি। আমার পিছু পিছু ঘুরতে বারণ কর ওকে। ”
“ করব না বারণ। কিন্তু নতুন করে কি করেছে ও?”
লিয়ন চাপাশ্বাস ফেলল এবারে। একবার মেয়েটার মুখ কল্পনা করে বলে উঠল,
“ প্রতিবারের মতো খুব মহান ভাবে আমায় বলেছেন উনি আমায় ভালোবাসেন। আমি তার প্রথম অনুভূতি। ”
“ এটা আমি জানি। বাকিটা বল। ”
লিয়ন এবারে আরো নিরস স্বরে শুধাল,
“ উনি এদেশে পড়ালেখা করবেন না। ভার্সিটিতে ফার্স্ট ইয়্যারে ভর্তি হয়েছিল ঠিক।কিন্তু বাইরে পড়ার সুযোগ পাওয়ার ট্রাই করেছে এতদিন যাবৎ। এবং পেয়েছেও সুযোগ।ভার্সিটিতে ভর্তি ক্যান্সেল করে ওখানে চলে যাচ্ছে। সম্ভবত পরের মাসে সে চলে যাবে। এটাই জানালেন গতকাল। ”
নিশীথ উত্তরে বলল,
“ হ্যাঁ, এটাও জানি। সমস্তটাই ও আমার মতামত নিয়ে করেছে। ”
লিয়ন এবার একটু রাগল বোধহয়। এদের ভাইবোনকে বুঝে উঠা দায়। বলল,
“ তো তাকে জিজ্ঞেস করবি আমার খোঁজখবর নেওয়ার মানে কি মাঝে মাঝে?এসব আমায় জানানোরই বা মানে কি? আমায় ভালোবাসে এটা বলারই বা মানে কি? আমাদের মাঝে তো এমনিতেও কিছু হওয়া পসিবল না। ”
নিশীথ ভ্রু বাঁকিয়ে শুধাল,
“কে বলল পসিবল না? আমার বোন তোকে পছন্দ করেছে মানে তোকেই বিয়ে করবে৷ এটাই ফাইনাল! ”
“ তুই বললেই হলো নাকি? আমি বিয়ে করব না ওকে।”
নিশীথ কিছুটা সময় চুপ থাকল এবারে। পরক্ষণে বলে উঠল,
“ তোকে ভালোবাসে ও।আমার বোন ছোট থেকে কিছু পায়নি লিও। বাবাকে পায়নি, আমাকে পায়নি।একটা পরিবার পায়নি পর্যন্ত। কাজেই তুই যদি ওকে কষ্ট দেওয়ার চেষ্টা করিস তো আমার চেয়ে খারাপ কিন্তু কেউ হবে না লিও!প্রমিজ! তোকে মে’রেধরে হলেও আমি ওর নামে করে দিব। মাইন্ড ইট লিও।”
লিয়ন রাগে ফুসফুস করে শুধাল কেবল,
“ হ্যাঁ। আমি তো কোন জিনিস যে কেউ চাইল আর তুই দিয়ে দিলি। ”
কথাটুকু বলেই কল রাখল। নিশীথ স্ক্রিনে চেয়ে পকেটে মোবাইল নিয়ে বেলকনি ছেড়ে রুমে এল। তখনও মৃধার মাথাটা মৃধার মায়ের কোলেই রাখা। অনেকটাক্ষন হলো মৃধার মা এসেছে। এখন ঘড়িতে প্রায় একটা। এসে মৃধাকে গরম গরম চা খাইয়েছে, ভাত খাইয়ে দিয়েছে, ঔষুধ দিয়েছে এবং অবশেষে মাথা টিপে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। নিশীথ এতক্ষন যাবৎ সবই দেখে যাচ্ছিল বেলকনি থেকে। মাঝেমাঝে নিজের মায়ের চিন্তারত মুখটাও দেখছিল মৃধার জন্য। নতুন শ্বাশুড়ি বলে কথা! নিশীথ মনে মনে হাসল মৃধার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে। কিছু জিজ্ঞেস করবে তখনই মৃধার মা আস্তে ধীরে মৃধার মাথাটা বালিশে রেখে তার সামনে এসে দাঁড়ালেন। বললেন,
“ নিশীথ? ”
নিশীথ তাকাল। উত্তরে বলল,
“ হু, বলুন আন্টি। ”
মৃধার মা মৃধার দিকে পুণরায় তাকালেন।কপালে চিন্তার ভাজ ফেলে শুধালেন,
“ মৃধার জ্বর হলে একটু বেশিই ভুগে মেয়েটা। গলা ব্যাথায় মাথা ব্যাথায় অসহ্য লাগে ওর। এখন তো ঘুমিয়ে গিয়েছে। যদি রাতে উঠে ওর খারাপ লাগে একটু যত্ন নিও। আমি কাল সকালে এসে ওকে নিয়ে যাব। ”
নিশীথ মৃধার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল,
“আচ্ছা, ঘুমিয়ে গেছে? ”
“ হুম। ঘুমিয়েছে এখন। ”
কথাটা বলে দু পা বাড়িয়ে নিশীথের মায়ের দিকে যেতে নিতেই আবারও পিছু ঘুরে নিশীথকে উদ্দেশ্য করে শুধাল,
“ খাবার খাইয়েছি জোর করে। জোর করে খাওয়ালে অনেকসময় আবার বমি করে ভাসিয়ে দেয় মেয়েটা।”
নিশীথ এবারে মৃদু হেসে উত্তর দিল,
” সমস্যা নেই আন্টি। দেখব আমি৷ ওর কষ্ট হবে না আশা করি। আপনি চিন্তা করবেন না। ”
মৃধার মায়ের মন স্বস্তি পেল কিনা কিজানি। তবে এবারে নিশীথের মায়ের হাত ধরে বলল,
“ আমার যেতে ইচ্ছে করছে না ভাবি। আবার মেয়ের ঘরে থেকে যেতেও এভাবে কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে। একটু দেখে রাখবেন আমার মেয়েটাকে ভাবি। যদি বেশি জ্বালায় একটু খবর দিবেন, আমি চলে আসব। ”
নিশীথের মা হাসল। বলল,
“ আপনার মেয়ে অতোটা জ্বালানোর কথা নয় ভাবি। ছোট থেকে দেখছি তো। তাকে প্রতিবেশির মেয়ে হিসেবে খুব ভালোভাবে জানি আমি। চিন্তা করবেন না। ”
মৃধার মা উশখুশ করে জানাল,
“ তবুও..”
“ উহহ! চিন্তা করবেন না তো। ঠিক হয়ে যাবে। আপনি আজ এইবাসা ছেড়ে যেতে পারছেন না কিন্তু বলর দিলাম। ”
” না, ভাবি। আমি মৃধার ফোন পেয়েই চলে এসেছিলাম তখন।যদিও পরে জানিয়েছি। কিন্তু যাওয়া উচিত আমার। কাল সকাল সকাল আবার চলে আসব। ”
“ যা ভালো বুঝেন।”
“যাই তাহলে ভাবি? দেখে রাখবেন ওকে একটু। ”
নিশীথের মা হাত ধরে আশ্বস্ত করে জানাল,
“ আপনি নিশ্চিন্তে গিয়ে ঘুমান ভাবি। মেয়ের কিচ্ছু হবে না।”
.
সবাই যেতেই নিশীথ রুমের দরজা লাগিয়ে এল। ঘুমন্ত মৃধার মুখ মলিন ঠেকাল। তবুও গোলগোল মুখটায় নিশীথ অনেকটাক্ষন তাকিয়ে থাকল। যেন বাচ্চামতো একটা মেয়ে ঘুমিয়ে আছে। যাকে এই মুহুর্তে বড্ড আদুরে লাগছে। নিশীথ ঠোঁটজোড়া অল্প বাঁকিয়ে হাসল। মাথা ঝুকিয়ে পুরু ঠোঁটজোড়া মৃধার কপালে ছুঁইয়ে দিয়ে বিরবির করে শুধাল,
“ তুই নিজেও জানিস না সুখ, তোকে আমি কতোটা চেয়ে তারপর পেয়েছি। অতো সহজেই যেতে দিতাম নাকি? ”
মৃধা তখন ঘুমে। কপালের কারোর স্পর্শ টের পেল কি পেল না কি জানি। তবে ঘুমের ঘোরেই অস্ফুট স্বরে ডাকল,
“ আম্মু! ”
নিশীথ কপাল চাপড়াল। চুমু দেওয়ার পরিবর্তে হতাশ স্বরে শুধাল,
“ প্রথমে ভাই, এখন আম্মু! কি শুরু করেছে কি এই মেয়ে?”
মৃধা এটাও শুনল না। ঘুমের মধ্যেই মাথায় ইঙ্গিদ করে অস্ফুট স্বরে ফের জানাল,
”তোমার হাত কই আম্মু?মাথাটা টিপে দাও না। মাথা ব্যাথা করে তো আমার।”
নিশীথ চাপাশ্বাস ফেলল। মৃধার পাশে এককোণে বসে হাত জোড়া রাখল মৃধার মাথায়। তারপর নরমভাবে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতেই বলল,
“ ঘুমা। হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।”
মৃধা তারপর চুপ হয়ে গেল। বোধহয় আরাম পেল মাথা ব্যাথায়। এরপর অনেকটাক্ষন কাঁটল। মৃধার আর কোন সাড়াশব্দ এল না। নিশীথ তখনও মৃধার পানে তাকিয়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। এর একটু মৃধার ঠোঁট উল্টে কম্বল টানতে টানতে ঘুমের মধ্যে বলল,
“ শীত করছে। ”
নিশীথ মিনমিনে চোখে চেয়ে কপালে হাত রাখল। জ্বর এখনো পড়েনি বোধহয় এই কারণেই শীত করছে। বিরবির করে বলল,
“ কম্বল পরেছিস শরীর চাপিয়ে, স্যোয়েটার পরেছিস। তবুও শীত করছে? ”
” হু। ”
নিশীথ অসহায়ের মতো চাইল প্রথমে। পরমুহুর্তেই ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল হালকা। জ্বরের ঘোরে মৃধা ঘুমাচ্ছে এইটুকু ভেবে বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে পড়ল। এক হাতে ঘুমন্ত মৃধাকেও টেনে নিল নিজের সাথে। আলতো করে জড়িয়ে কপালে পুণরায় চুমু আঁকল। পরমুহুর্তে ভালোভাবে কম্বল জড়িয়ে দিয়ে নিজের সাথে জড়িয়ে নিল মেয়েটার জ্বরে উষ্ণ হওয়া শরীর। একহাতে চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
” এখন শীত লাগবে না। ঘুমা ”
মৃধা অবশ্য জ্বরের ঘোরে আর শুনল না। শীত কাঁটাতে আষ্ঠেপৃষ্ঠে নিশীথকে জড়িয়ে ঘুমাল। নিশীথ তা দেখে হাসল। তাকিয়ে থাকল একাধারে মৃধার মুখপানে। মাথা নুঁইয়ে আবারও ঠোঁট ছোঁয়াল মৃধার আলুথালু গাল দুটোতে। চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিল অতি যত্নে। ফিসফিস করে শুধাল,
“ উহহ! দুদিন আগেও তোকে পাব না ভাবলে যে দমবন্ধকর কষ্টটা হতো তা আজ প্রশান্তিতে পরিণত হয়েছে । আজ আমার বুকে অদ্ভুত শান্তি। কত প্রার্থনার ফল তুই আমার সুখ। ”
#চলবে….