#হৃদয়ে_প্রণয়ের_বাস
#পর্ব_০৯
লেখনীতেঃ রোদসী রঙ্গন
মাঝরাত্রিতে ঘুম ভেঙ্গে নিজেকে নিশীথের কোমড় জড়িয়ে ঘুমানো অবস্থায় আবিষ্কার করে চমকাল মৃধা। হালকা হলদে আলোতে ফ্যালফ্যাল করে তাকাল নিশীথের মুখ পানে। চোখজোড়া বুঝে হেলান দিয়ে আছে ছেলেটা। মৃধা বিস্ময় নিয়ে চাইল। নিশীথ ঘুমোচ্ছে কি ঘুমোচ্ছে না বুঝে না উঠে হালকা সরতে নিতেই টের পেল নিশীথের একটা হাত তার চুলের ভাজে৷ মৃধা ছোট শ্বাস ফেলল। সরে গিয়ে অস্বস্তিতে দ্রুত শোয়া ছেড়ে উঠে বসল। মনে মনে নিজেকে হাজারটা কথাও শোনাল। ছিঃ ছিঃ! এমনটা জানলে সে কখনোই অতোটা সময় নিয়ে গোসল করত না, আর না তো তার জ্বর হতো। আর না তে ঘুমের ঘোরে নিশীথকে এভাবে আষ্ঠেপৃষ্ঠে ধরে ঘুমাত। নিশীথ কি ভাববে বিষয়টা ভেবে অস্বস্তিতে উশখুশ করতে লাগল মৃধা। ঠিক তখনই কানে এল নিশীথের গলা,
“ এমন ব্যাঙ এর মতো বসে আছিস কেন? শীত করছে না এখন? ”
মৃধা মনে প্রাণে চাইছিল নিশীথের মুখোমুখি না হতে। তবুও না চাইতেও যে নিশীথ এই মুহুর্তে কথা বলে উঠবে তা কি জানা ছিল মৃধার। উফফ! অস্বস্তিতে না তাকিয়েই শুধাল,
“ ব্যাঙদের শীত করে না। ”
“ তারমানে স্বীকার করলি তুই সত্যি সত্যিই ব্যাঙ মৃধা? বাহ! তোকে তো মিউজিয়ামে রাখা উচিত। ”
“ মিউজিয়ামে অতি মূল্যবান জিনিসই রাখে। আমি জানি, আমি অতি মূল্যবান!”
নিশীথ হাসল। উঠে বসে তৎক্ষনাৎ হাত রাখল মৃধার কপালে। তাপমাত্রার বুঝার চেষ্টা চালিয়ে তাকাল মৃধার মুখপানে। মৃধার চাহনি তখন চোরা চাহনির ন্যায়। অস্বস্তিতে নিশীথের দিকে না চেয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে আছেে।নিশীথ বোধ হয় বুঝল কারণটা। হেসে বলে উঠল,
“ বাহ! এত তাড়াতাড়ি জ্বর গায়েব। ”
মৃধা এবারে চাইল নিশীথের দিকে। বলল,
“ তো কি? জ্বরে আমি মরে গেলে খুশি হতি তুই? ”
বিপরীতে উত্তর এল,
“ না, হ্যাপি হতাম। ”
মৃধার মন খারাপ হলো। মরে গেলে নিশীথের উচিত তার জন্য দুঃখ করা। অন্তত বন্ধু হিসেবে হলেও। তা না করে হ্যাপি হবে কেন? মৃধা মৃদু স্বরে শুধাল,
“ জানি, এখন ঘুমোতে দে। ”
“ ঘুমা বারণ করল কে? ”
মৃধা তৎক্ষনাৎ জিজ্ঞেস করতে লাগল,“একসাথে?”। পরক্ষণেই আবার প্রশ্নটা ভেবেই লজ্জা পেল। ঘুরিয়ে প্রশ্ন করল,
“ তুই কোথায় ঘুমাবি তাহলে? ”
নিশীথ ভ্রু বাঁকিয়ে উত্তর দিল,
“ কেন? এখানেই। ”
মৃধা তাও ইনিবিনিয়ে শুধাল,
“ তোর তো সমস্যা হবে। রাহি কিছু বলবে না? ”
নিশীথের মেজাজ খারাপ হলো যেন রাহিকে টানায়। ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“ কি বলবে? ”
মৃধা আর কথা বাড়াল না। বুঝল কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। মৃধা মৃদু শ্বাস ফেলে কম্বল জড়িয়ে শুঁয়ে পড়ল বিছানার এককোণে। মাঝখানে অনেকখানি জায়গাই খালি থাকল। সে খালি জায়গাটায় অবশ্য মৃধা একটা বালিশ রাখল। শান্তস্বরে জানাল
“ ঠিকাছে। তাহলে এখানেই ঘুমাচ্ছি। ”
নিশীথ মনে মনে হাসল। একটু আগেও যে মেয়েটা ঘুমের ঘোরে তাকে জড়িয়ে রেখেছিল এখন ঘুম ছেড়ে উঠতেই মাঝখানে বালিশ রেখে ঘুমোচ্ছে। বাহ!মৃধা কি জানে একটু আগে শুধু নিশীথকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ঘুমিয়ে এটাই নয়,বরং নিশীথ এই মেয়েটাকে কয়েকবার চুমুও দিয়েছেে।তাও এই মেয়েটার অজান্তে, ঘুমের ঘোরে। নিশীথ হাসল আর দেখল। মৃধা কম্বল জড়িয়ে ওভাবে থেকেই তাকাল উপরে দেওয়ালের পানে। মৃদু স্বরে বলল,
“ তুই আজ কথা বলবি না রাহির সাথে? ”
নিশীথ গম্ভীর গলায় উত্তর দিল,
“ বলেছি। ”
মৃধার মনটা আবারও খারাপ হলো। অতি বিষন্নতায় মনজুড়ে ছেয়ে গেল কালো মেঘের ছোঁয়া। মৃদু স্বরে বলল কেবল,
“ ওহ। ”
তারপর! তারপর আর কোন কথা হলো দুইজনের মাঝে। নিশীথও ততক্ষনে দূরত্ব রেখে শুঁয়ে পড়ল বিছানার আরেক কোণে। চোখ বুঝে ঘুমোতে ঘুমোতে বলল,
“ গুড নাইট! ”
মৃধা হাসল। অস্পষ্ট চাহনিতে নিশীথের ঘুমানো দেখল। নিশীথ ততক্ষনে ঘুমে কাঁদা। অথচ মৃধার চোখে ঘুম মিলল না। অনেকটা সময় ঘুমানোর দরূণ নাকি কে জানি বাকিটা রাত মৃধা জেগেই কাঁটাল।আর জেগে থাকা রাতটা জুড়ে সে কেবল ভেবে গেল রাহি আর নিশীথের সম্পর্কের সমীকরণ! সেদিনকার দুজনকে একসঙ্গে দেখা, চুল টেনে দেওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি।
.
লিয়নের চোখে ঘুম নেই৷ না চাইতেও মস্তিষ্ক কেবল একজনকেই ভেবে যাচ্ছে। একজনকেই কল্পনা করছে। সে একজনটা রাহি। লিয়ন না চাইতেও রাহির প্রতি তার অদৃশ্য এক দুর্বলতা তৈরি করে নিয়েছে মেয়েটা। আর সেই দুর্বলতাটা লিয়ন এই মাঝরাত্রিরেই টের পায়। কি ভীষণ হৃদয় পুড়ে তার। মেয়েটা কেন এল তার জীবনে?কেন এতোটা ভালোবাসল তার মতো একটা বোকা, দরিদ্র পরিবারের ছেলেকে? কি দরকার ছিল? লিয়নের বুক ভার হয়ে আসে। ছটফট করতে করতে উঠে বসল শোয়া ছেড়ে। সিদ্ধান্ত নিল সে আজকের পর আর কখনো রাহির সাথে যোগাযোগ করবে না, আর কখনো না। কখনো রাহির মুখোমুখিও হবে না। যা তার হবার নয় তার দিকে পা এগিয়ে লাভ নেই। সুতারাং যতটুকু সম্ভব নিজেকে সামলে নেওয়াই উচিত কাজ লিয়নের জন্য। লিয়ন ও তাই স্থির করল মনপ্রাণে। পরমুহুর্তেই কি ভীষণ অস্থিরতায় বুক খা খা করল। অন্তত শেষবারের জন্য হলেও একটিবার মেয়েটার সাথে যোগাযোগ করার৷ অবশেষে মনকে প্রশ্রয় দিল সে। উঠে দাঁড়াল ও। হলে থাকে সে। একই রুমে আরো তিনজন ছেলে। লিয়নের কোনকালে সাহস হয় না এই তিনজন থাকা অবস্থায় একবার রাহিকে কল করে নিজের অস্থিরতার কথা জানানোর। তবুও এই প্রথম লিয়ন সাহস করল। ধীরে ধীরে পা ফেলে এগিয়ে গেল রুমের সাথে লাগোয়া লম্বা বারান্দায়। তারপর সাহস করে কল লাগাল রাহিকে। অদ্ভুত ভাবে কল দেওয়া মাত্রই অপরপ্রান্তে থাকা রাহি কল তুলল। সুন্দরভাবে সালামও জানাল। লিয়নের সালামের উত্তর দিয়ে শুধাল,
“ রাহি?”
“ বলুন লিয়ন ভাই। এই মাঝরাতে হঠাৎ কল দিলেন? কোন দরকারে? ”
লিয়ন এবারে থেমে গেল। কি বলবে বুঝে উঠল না। তবুও শুধাল,
“ রাহি? শুভ কামনা তোমার ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য। ভালো থেকো। নিজের যত্ন নিও। ”
রাহি অবাক হলো।শুধাল,
“ এমন করে কেন বলছেন লিয়ন ভাই? ”
“ যদি আর কখনো যোগাযোগ না হয় সেজন্যই বললাম।”
ফের বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন আসল,
“ যোগাযোগ হবে না কেন? ”
“ জানি না। ওদেশে গেলে তোমার প্রথম অনুভূতিকে ভুলে নতুন কাউকে জীবনে জড়িয়ে নিও রাহি। ভালো থেকো। ”
“ ভালোবাসি আপনাকে। ভুলে যাওয়া অতো সহজ নাকি। ”
লিয়নের বুকের ব্যাথা সতেজ হলো। কি এক বিষাক্ত অনুভূতি মস্তিষ্ক জুড়ে বয়ে গেল ধারালো ভাবে। মুহুর্তেই লিয়ন শক্ত স্বরে শোনাল,
” কিন্তু আমি ভালোবাসি না। আর না তো বাসব। আজকের পর আর কখনো যোগাযোগ করো না রাহি। আমি খুশি হবো। ”
কথাগুলো অনেকটা শক্ত গলাতেই বলেই কল রাখল লিয়ন। তারপর বুকের ভেতর জমাট বাঁধা ব্যাথাদের মুক্ত করল সিগারেটের ধূসর ধোঁয়ায়। ইশশ! মেয়েটার স্মৃতিও যদি সে ধোঁয়ার মতো তাকে ছেড়ে যেত?
.
যখন সকাল হলো মৃধা টের পেল আবারও জ্বরটা মাথাচড়া দিয়ে উঠছে। শরীর উষ্ণ ঠেকছে। চোখ জ্বালা করছে। ঠিক তখনই আবারও কপালের নিশীথের হাতের অস্তিত্ব পাওয়া গেল। কানে এল,
“ বাহ! জ্বর তো তোকে খুব ভালোবেসে রে। ছেড়েও ছাড়েনি।এক্কেবারে আঁকড়ে আছে। ”
মৃধা তাকাল। নিশীথের কথার বিপরীতে হেসে বলল,
“ যাক! অবশেষে কেউ তো ভালোবেসে আঁকড়ে থাকল।”
পরমুহুর্তেই আবার কিছু মনে পড়ে গেছে এমন ভঙ্গিতে বলে উঠল,
“ নিশীথ, নিশীথ।তোকে তো কংগ্রাচুলেশন জানানো হয়নি।”
নিশীথ ভ্রু কুঁচকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল,
“ কেন?”
উত্তরে মৃধা হেসে বলল,
“ এইযে রাহির সাথে রিলেশনে গেলি তার জন্য। রাহি ভার্সিটিতে এডমিট হওয়ার পর থেকে তোর সাথে ওকে প্রায়সই দেখা যেত বলে সবাই বলত রাহি তোকে পছন্দ করে হয়তো। এখন জানলাম তোরা রিলেশনেও আছিস। ভার্সিটিতে বন্ধুবান্ধবরা কানাঘুষা করছিল তোরা ডেইটে গিয়েছিস। ফার্স্ট ডেইট৷ তাই বন্ধু হিসেবে কংগ্রাচুলেশন জানানো উচিত না? ”
মৃধার কন্ঠে স্পষ্ট টের পাওয়া গেল গহীন বিষাদের। মুখের হাসিতে দেখা গেল অকথিত ব্যাথার অস্তিত্ব। নিশীথের অসহায় লাগল প্রেয়সীর দুঃখ দেখে। আহত চাহনিতে চেয়ে ডাকল,
“ মৃধা? ”
“ হু।”
“ তোর কি কষ্ট হচ্ছে? ”
মৃধা এবারেও হাসল। বলল,
” কষ্ট কেন হবে পাগল। আচ্ছা? তুই রাহিকে খুব ভালোবাসিস তাই না নিশীথ? ”
নিশীথ ব্যাখ্যা করার উদ্দেশ্যে বলতে নিল,
“ হু। তবে,,”
বাকিটা বলা হলো না নিশীথের। তার আগেই মৃধা শুধাল,
“ ও জানে তোদের জীবনে আমি চলে আসলাম যে?”
নিশীথ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। উত্তরে বলল,
“ জানে।
“ কিছু বলল না?”
“ তোর সাথে দেখা করিয়ে দিব আজ৷ খুশি হবে ও। ”
মৃধার ফের দুঃখ হলো। জ্বরে,মাথা ব্যাথায় অসহ্য অনুভূতিতে যোগ হলো মনের ব্যাথাও। নিশীথের মুখ পানে এক দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,
“ ওর খুশিটা তোর কাছে অনেক ইম্পোর্টেন্ট তাই না নিশীথ?”
নিশীথ শুধু ছোট করে শুধাল,
“ হু।”
মৃধা কান্না গিলে নিল। দুঃখ লুকিয়ে অনেক টা ক্ষন চুপ থাকল। তারপর আবারও হঠাৎ বলে উঠল,
“ নিশীথ? আমরা অযথা চার দেওয়ালের ভেতর থাকছি কেন? আমরা তো জানি এর ভবিষ্যৎ৷ তাই না?”
ভ্রু বাঁকিয়ে বলল নিশীথ,
“ মানে?”
“ আমাদের উচিত না এই মিথ্যে সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে যাওয়া? ”
নিশীথের চোয়াল শক্ত হলো। বিয়ের দুদিন পার হলো এই মেয়ে কথাটক কয়বার বলল? নিশীথকেও তো সুযোগটা দিতে হবে। সবটা জানানোর সময়টক দিতে হবে। কিন্তু এই মেয়ে এমন করবে কেন? নিশীথ দাঁতে দাঁত চেপে ছোট করে বলল,
“ না।”
মৃধা মানল। জ্বরের মধ্যেই জেদ ধরে বলে উঠল,
“ অবশ্যই উচিত।”
নিশীথ ঠোঁট গোল করে শ্বাস ফেলল। রাগ হচ্ছে। তবুও মৃধার কপালে আসা চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিতে দিতে বলল,
“ জ্বরে পুড়ে আবোলতাবোল বকছিস মৃধা। চুপ কর এবার। ”
মৃধা ফের জেদ করে বলল,
“ আবোলতাবোল নয়, সত্যি। আমাদের ভাব উচিত ডিভোর্স নিয়ে। ”
নিশীথের নাক লাল হয়ে এল এবারে রাগে। একই কথা বারবার শুনলে রাগ হয় তার, তাও যদি হয় তা অপছন্দনীয় কথা। নিশীথ উঠে দাঁড়াল। রুম ছেড়ে যেতে যেতে বলে উঠল,
“ ফালতু কথাটা আরেকবার বললে খুব খারাপ হবে মৃধা। উঠে ফ্রেশ হয়ে আয়। নাস্তা করবি। ”
#চলবে…..
[ কেমন হয়েছে জানাবেন। ]