হৃদয়ে প্রণয়ের বাস ২ পর্ব-১১

0
841

#হৃদয়ে_প্রণয়ের_বাস
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_১১
লেখনীতেঃ রোদসী রঙ্গন

রাতের আকাশটা সুন্দর।ব্যস্ত শহরের কোলাহল কানে ভাসছেে।অথচ এই কোলাহল মুখর পরিবেশেই দুই কপোত-কপোতির নিরবতার প্রেমকথন। রাহি অনেকটা সময় আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে থেকেই চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতে নিল। লিয়ন এই পর্যায়ে মুখ খুলল। রাহির হাত আঁকড়ে ধরর শুধাল,

” রাহি? রেগে আছো তুমি? ”

রাহি ফ্যালফ্যাল করে তাকাল এইবারে। রেগে আছে অথবা রেগে নেই কোন উত্তর দেওয়ার আগেই লিয়ন ফের বলল,

” রাহি? আগের মতো ভালোবাসো না আমায়? আগের মতো ভালোবাসি বলো না কেন? আমি আগের রাহিকেই চাইছিলাম। অথচ আমার সেই রাহি কেমন জানি পাল্টে গেল। কি করলে আগের মতো চাইবে আমায় তুমি? ”

রাহি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে উঠল,

” ভালো না বাসলে তো বাসা থেকে নেমে এসে আপনার সামনে দাঁড়াতাম না লিয়ন ভাই। আপনাকে না চাইলে এতক্ষনে বিয়ের প্রস্তাবে নিরব সম্মতি দেওয়া তো দূর বরং তুলকালাম কান্ড ঘটাতাম। আপনার কি মনে হয়? রাহি আপনাকে আর চায় না লিয়ন ভাই? ”

লিয়ন হালকা হাসে তবে আড়ালে। এই যে এতগুলা কথা শুনল এখন তার হৃদয় শান্ত লাগছে। নিশ্চিন্ত মনে হচ্ছে নিজেকে। গম্ভীর স্বরে বলল,

“ চাও? ”

রাহি কপাল কুঁচকাল। সব বুঝিয়ে বলার পর ও যদি কেউ অবুঝ বাচ্চার মতো এমন প্রশ্ন করে তাহলে রাহ হওয়ারই কথা। কিঞ্চিৎ রাগ দেখিয়ে শুধাল,

” কি মনে হয় আপনার? ”

” কিছুই না। কখনো মনে হয় চাও, কখনো মনে হয় আমি সে ভালোবাসাটুকু নিজ দোষেই হারিয়ে ফেলেছি। ”

রাহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কিয়ৎক্ষন চুপ থেকে লিয়নের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল,

“ ভালোবাসা কখনো হারায় না লিয়ন ভাই। সময়ের সাথে সাথে মানুষ পরিবর্তন হলেও হৃদয়ের সেই অনুভূতি টুকু থেকে যায় সবসময়। হয়তো প্রত্যক্ষ ভাবে এক সময়ে প্রকাশ করা হতো, এখন হয়তো প্রত্যক্ষ ভাবে প্রকাশ করা হয়না। তা বলে পরোক্ষ ভাবে আমি ভালোবাসতে পারি না ? ”

লিয়ন এবারেও ইচ্ছে করেই শুধাল,

“ পারো? ”

রাহি এই পর্যায়ে দাঁতে দাঁত চাপে। অল্প রাগ দেখিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

“ লিয়ন ভাই! আর কিভাবে বুঝাব আমি? এখন কি আপনাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে বুঝাব যে আমি আপনাকে আগের মতোই ভালোবাসি? ”

লিয়ন এবারে বাঁকা হাসে। ঠোঁট বাঁকিয়ে শুধায়,

” বুঝাতেই পারো। আমি নিষেধ করব না। ”

রাহি মুখচোখ কুঁচকে নিয়ে বলে উঠে,

“ ছিঃ! ”

লিয়ন হেসে বলে,

“ কি ছিঃ? তুমি যে বললে? সে বেলায় ছিঃ হলো না? ভাইয়ের বন্ধুর সামনে এরকম একটা কথা বলাও ছিঃ মূলক কাজ রাহি!”

রাহি সরু চোখে তাকায়। বলে,

“ তাই নাকি? তাহলে আমার সামনে আর আসবেন না। আপনার সামনে বলবও না এসব আর। ব্যস, সমস্যার সমাধাণ! ”

কথাটুকু বলেই রাহি পা বাড়াতে নিল। লিয়ন এবারেও হাত আঁকড়ে ধরে। বলে,

“ দাঁড়াও রাহি। ”

“ বলুন। ”

লিয়ন জানতে চায়,

“ এই বিয়েতে তুমি খুশি? ”

” যাকে ভালোবাসি তাকে পাওয়ার ক্ষেত্রে অখুশি হওয়ার তো কথা নয় লিয়ন ভাই। ”

লিয়ন যেন খুশি হয় উত্তরটায়। রাহির হাতটা উঁচু করে হাতের উপর পিঠে আলতো চুমু দিয়ে বলে,

“ আ’ম স্যরি রাহি। আগে দেওয়া সব কষ্টের জন্যই স্যরি। ”

রাহি চোখ নামিয়ে নেয় লজ্জায়। আশপাশ চেয়ে সতর্ক হয়ে বলে,

“ হাত ছাড়ুন লিয়ন ভাই। মানুষ বাজে ভাববে। ”

“ এখনও? এখন তো মানুষ জানে আমি তোমার হবু বর। ”

রাহি গম্ভীর গলায় উত্তর করে,

” মানুষ জানে না, পরিবার জানে শুধু। বাসায় যান। সুন্দর করে ঘুম দিন। ”

লিয়ন হতাশ হয়ে হাত ছাড়ে। বলে,

“ আজকাল বউ শূণ্যতায় ঘুম হয় না রাহি। বিরাট সমস্যায় ভুগছি।”

রাহি চাপা হাসে। উত্তরে বলে,

“ বন্ধুর বোনের সামনে এসব কি কথাবার্তা বলছেন লিয়ন ভাই? এখন আপনাকে ছিঃ বলবে না মানুষজন? ”

কথাটুকু বলেই রাহি পিঁছু ঘুরল। চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ানোর আগেই লিয়ন বলল,

” দুদিন পর বউ বানাব, তারপর সযত্নে বাচ্চার আম্মু বানাব। আর আমাকে নাকি ছিঃ বলবে মানুষ! যে বলবে তাকে আমার সামনে আসতে বলবে তখন। ”

.

মৃধার নাক লালচে হয়ে আছে, চোখজোড়া অল্প অল্প ফোলা দেখাচ্ছে। এখনও নিশীথের উপর রেগে কেঁদেই যাচ্ছে মেয়েটা। নিশীথ হতাশ হয়। মেয়েটাকে আগলে নিয়ে ঠোঁট ছোঁয়ায় নরম গালে। শুধায়,

“ সুখ? বাচ্চার মা হওয়াটা তোর কাছে অনেকটাই জরুরী? আমি কি করে তোকে নিয়ে রিস্ক নিব বল? কি করে তোকে হারানোর রিস্ক নিব? ”

মৃধা সত্যটা জানে না বলেই স্বাভাবিক স্বরে বলে উঠল,

“ দুনিয়াতে সবাই মা হয় নিশীথ। তাই বলে হারানোর রিস্ক বলে কেউ বাচ্চা নিতে ভয় পায় না। ”

নিশীথ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মৃধাকে দুই হাতে জড়িয়ে নিয়ে বিছানায় বসে৷চুলে হাত বুলিয়ে বুঝানোর স্বরে বলে,

“ সবাই আর তুই তো একই না সুখ। মনে আছে? একবার বাইকে করে যাওয়র সময় তোর আর আমার একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিল? আমার খুব একটা কিছু না হলেও তুই পেটে আঘাত পেয়েছিলি। সেবারই জানতে পেরেছিলাম তোর প্রেগ্নেন্সির সময়টা রিস্ক হবে। ডক্টরই বলেছিল সময় কম্প্লিকেটেড চলবে।এমন কি লাইফ রিস্ক ও হতে পারে। তারপর থেকে আমি বাচ্চার স্বপ্ন ভুলে গিয়েছি সুখ। তোকে ছাড়া থাকতে হবে এমনটা আমি ভাবতেই পারি না।এবার তো একটু বুঝ।”

মৃধা সবই শুনল। নিশ্চুপ থাকল। নিশীথের উপর একের পর এক রাগ জমছে তার। এতকিছু কেন তার থেকে লুকিয়ে রেখেছিল? এই জন্যই নিশীথ বাচ্চা নেওয়ার বিষয়টা এড়িয়ে গিয়েছে? মৃধা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। পরমুহুর্তে আরো বেশি কান্না পায়। কেন তার জীবনটাই এমন হলো? কেন? অস্পষ্ট স্বরে বলল,

“ হ্হু? ”

নিশীথ শুধাল,

“অনেক দম্পতি আছে যাদের বাচ্চা নেই মৃধা। তাই বলে কি ওরা ওদের স্বামীকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে? তুই আমাকে ছাড়ার কথা কি করে বলতে পারিস? কি করে ভাবতে পারিস? আমি তো ভাবতেও পারি না। ”

মৃধা নিশীথ থেকে সরে বসে। অনেকটা সময় চুপ থেকে নিশীথের উপর রেগে থাকে। তারপর একটা সময় পর দৃঢ় স্বরে বলে উঠে,

“ ডক্টর বলেছে প্র্যাগনেন্সির সময় জটিলতা সৃষ্টি হবে, বাচ্চার জম্মের সময় লাইফরিস্ক থাকতে তাই বলে ভয় পেয়ে আমি মা হওয়ার আশা ছেড়ে দেব? এটা বোকামো নয় নিশীথ? এমন অনেক পরিবার আছে যেখানে বাচ্চা জম্ম দিতে গিয়ে মা মা’রা যায়।”

আকস্মিক শেষ কথাটায় নিশীথ চমকে উঠে। কলিজায় মোচড় দেয় তার। মৃধাকে হারানোর কথা সে ভাবতেও পারে না স্বপ্নে৷ আকস্মিক বলে উঠে সে,

“ আমার বাচ্চার দরকার নেই মৃধা। আমরা বাচ্চা নিব না। ”

মৃধা হাসে। বলে,

” আজ বলছিস কিন্তু পারিপার্শ্বিক কথা শুনতে শুনতে একটা সময় তোরও মনে হবে তোর বাচ্চা প্রয়োজন নিশীথ। আর বাচ্চা তো সবারই স্বপ্নের থাকে। তুই তো বাচ্চা ভালোবাসিস তাই না ? শুধু মাত্র এই একটা কথা ভেবে বাচ্চার স্বপ্ন দেখা বাদ দিয়েছিস৷আমার জন্য তুই বাচ্চার স্বপ্ন দেখা বাদ দিবি এটা আমার খারাপ লাগবে। আর আমি নিজেও তো বাচ্চা ভালোবাসি নিশীথ। মেয়েরা মাতৃত্ব ভালোবাসে। সে মাতৃত্বের জন্য মৃ’ত্যু তেমন কোন ইস্যু না৷ আমার মনে হয় আমাদের এই রিস্কটা নেওয়া উচিত নিশীথ। যদি সৃষ্টিকর্তা চায় আমি অবশ্যই বেঁচে থাকব। ”

নিশীথ এই কথাগুলো শুনতে চাইছিল না। তবুও শুনল। ভয় হলো যেন। বুকের ভেতর কেমন করল। অথচ মৃধার স্বাভাবিক । কি সুন্দর দৃঢ় স্বরে কথাগুলো বলে গেল। একবারও ভাবল না ওর কিছু হলে নিশীথের কি হবে? নিশীথ কি করে থাকবে।নিশীথ মনে মনে মৃধাকে স্বার্থপর বলল। বুঝানোর ন্যায় বলতে লাগল,

“ মৃধা বুঝার চেষ্টা… ”

মৃধা শুনল না। বরং থামিয়ে দিয়ে বলল,

“ আমি বাচ্চা নই নিশীথ যে তুই বুঝাবি আর আমি বুঝে নিব এতকাল যা বুঝিয়েছিস মেনে এসেছি। বিশ্বাস করতাম। এই যে তুই এতকিছু আমার থেকে লুকিয়ে গেলি। বললি না অব্দি। অথচ আমি কষ্ট পেতাম এতদিন। মানুষ আমায় জিজ্ঞেস করত, তোকে না৷ আমি কান্না করতাম। তুই সব দেখেও কি সুন্দর লুকিয়ে গেলি সব ! আমাকে কষ্ট পেতে দেখে কি নিখুঁত অভিনয় করতি,সো কল্ড সান্ত্বনা দিতি, সো কল্ড ভালোবাসা দেখাতি। ”

নিশীথের রাগ হলো এবারে। নাক লাল হয়ে এল। তার ভালোবাসা সো কল্ড? মৃধা এটা বলতে পারল? নিশীথ রাগল ঠিক তবে প্রকাশ করল না। মৃধার কথা ভেবে বলল,

“ ঘুমা, আমরা কাল ডক্টরের সাথে কথা বলব হুহ? তারপর সবটা দেখা যাবে।”

” এখনও দেখা যাবে? আবার কোন মিথ্যে বলবি নিশ্চয় আমায়? এটা নিয়ে যদি পরবর্তীতে মিথ্যে বলে আমায় ভুলাতে চাস নিশীথ, আমি কিন্তু ফিরব না কোনদিন। ”

নিশীথ এই পর্যায়ে রাগ দমাতে পারল না যেন। মৃধার গাল চেপে বলে উঠল দাঁতে দাঁত চেপে,

“ আমি মিথ্যেবাদী? আমার ভালোবাসা সো কল্ড লাগে তোর কাছে? সো কল্ড সান্ত্বনা দিতাম আমি? বললাম তো তোর বাচ্চা চাই যেহেতু আমরা বাচ্চা নিব। তবুও এত কেন ছেড়ে যাওয়ার কথা বলিস। কথায় কথায় ছেড়ে যাওয়ার কথা বলে কি বুঝাতে চাস? তুই আমায় ভালোবাসিস না তাই তো? ”

#চলবে….