হৃদয়ে প্রণয়ের বাস ২ পর্ব-১২

0
856

#হৃদয়ে_প্রণয়ের_বাস
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_১২
লেখনীতেঃ রোদসী রঙ্গন

পুরো একটা বছর নিশীথ মৃধাকে বুঝানোর চেষ্টা চালাল। একটা বছর যাবৎ শুধু বাচ্চা না নেওয়ার বিভিন্ন অযুহাতই দেখাল মৃধাকে। অথচ মৃধা মানতে নারাজ। নিজের একটা জেদেই সে দৃঢ়। বছরের ৩৬৫ দিনে তাদের হাজার বারের উপরে ঝগড়া হয়েছে শুধু একটা বিষয়ের মতবিরোধ নিয়েই। মাঝে একবার মৃধা রাগ করে বাবার বাড়িতেও চলে শুধু এই একটা বিষয় নিয়েই। অবশেষে নিশীথ মেনে নিল। এত কোলাহল, ঝগড়া সব ছেড়ে আচমকাই বাবা হতে রাজি হয়ে গেল। যার ফলস্বরূপ প্র্যাগনেন্সি কিটটায় প্রেগন্যান্সি রেজাল্ট আসল পজিটিভ। মৃধা খুশিতে কেঁদেই ফেলবে যেন। আনন্দে উত্তেজনায় তার হাত পা কাঁপছে। ওয়াশরুম ছেড়ে রুমে এসেই ফোন হাতে নিশীথকে কল লাগাল। ওপাশ থেকে নিশীথ কল তুলতেই আওয়াজ তুলে কেঁদে উঠল মৃধা৷ কান্না স্বরে বলে উঠল,

“ নি্ নিশীথ.. ”

নিশীথ অস্থির হয়ে উঠল। ওপাশ থেকে মৃধার এমন স্বর শুনার জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। চিন্তায় বুক মোচড় দিয়ে উঠল তার। ব্যস্ত কন্ঠে বলে উঠল,

“ কি হয়েছে? কান্না করছিস সুখ? কেন কান্না করছিস? কি হয়েছে বল না। কেউ কিছু বলেছে তোকে? বল না সুখ..”

মৃধা তখনো এক নাগাড়ে কাঁদছিলই। নিশীথ ঘন ঘন শ্বাস টানে। ব্যস্ত হয়ে বলে,

“ সুখ? সুখ শুনতে পাচ্ছিস তুই? এই…”

মৃধা এতক্ষনে মুখ খুলল। কান্নারত ভেজা স্বরে জানাল,

“ নিশীথ? অবশেষে সে আসবে। ”

নিশীথ বুঝে উঠল না। মুহুর্তেই প্রশ্ন ছুড়ল,

” কে আসবে? ”

মৃধা এই পর্যায়ে মুখ টিপে হাসল। ঠোঁট নাড়িয়ে শুধাল,

” যার জন্য অপেক্ষায় ছিলাম সে। আমার কেবল কান্না পাচ্ছে নিশীথ। হাত পা কাঁপছেে।শরীর কাঁপছে।”

নিশীথ এই পর্যায়ে বুঝে উঠল যেন। খবরটা আনন্দের খবর নিশ্চয়ই। অথচ নিশীথ খুশি হতে পারল না যেন৷ বুকের ভেতর অজানা অস্থিরতা জানান দিল যেন। ভয় হলো নিজের প্রিয়তমাকে হারানোর৷ অথচ পরিস্থিতিটা ভিন্ন হলে আজ পৃথিবীতে সেই হতো সবচেয়ে সুখী মানুষের স্থান পেত৷ নিশীথ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। গম্ভীর স্বরে বলে উঠে,

” অতিরিক্ত খুশিতে এমন হচ্ছে। ”

“হু, আমি অনেক বেশি খুশি নিশীথ। ”

কথাটুকি বলেই পরমুহুর্তেই ভ্রু বাঁকাল। এত বড় একটা খবর শুনে নিশীথ খুশি হলো না? এমন গম্ভীর স্বরেই বা কথা বলল কেন? নিশীথ কি অখুশি এতে? মৃধা দ্রুত জিজ্ঞেস করল,

” তুই খুশি না নিশীথ? তোর কন্ঠে সে খুশি খুশি ভাবটা নেই কেন?খুশি না তুই? বল।”

নিশীথ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। কিছুটা সময় চুপ থেকে বলে উঠে,

”যদি এমন পরিস্থিতিতে তুই থাকতি মৃধা? হয় প্রিয় মানুষটা নয়তো ভবিষ্যৎ অনাগত বাচ্চাটা? কোনটা চুজ করতি? তখন কি আমার লাইফ রিস্ক আছে জেনেও কি বাচ্চার আনন্দে আত্মহারা হতি তুই?”

মৃধা আকস্মিক বিষয়টা ভাবলই না। বরং রাগ হয়ে বলল,

” তার মানে তুই খুশি না? অথচ আমি এতোটা জেদ শুধু তোকে খুশি করার জ…”

নিশীথ ঠোঁট গোল করে শ্বাস ছাড়ে। মৃধাকে পুরোটা কথা বলতে না দিয়ে বলে উঠল,

” খুশি। ভবিষ্যৎ বাবা হিসেবে খুশি আমি মৃধা। ”

” তাহলে? ”

নিশীথ অসহায় বোধ করে। নিজের পরিস্থিতির কথাটা কি করে বুঝাবে সে? কি করে বুঝাবে তার বুকের ভেতর কতটুকু অস্থিরতা? চোখ টলমল করে তার। ছেলে সে। তবুও মেয়েদের মতো কান্না পাচ্ছে যেন তার। অসহায় কন্ঠে বলল,

” একজন প্রেমিক কিংবা একজন ভালোবাসার মানুষ হিসেবে খুশি হতে পারছি না সুখ। তুই আমার পরিস্থিতিতে থাকলে বুঝতে পারতি।আমার এই মুহুর্তে বাবা হবো ভেবে যতোটা আনন্দ হওয়ার কথা ঠিক ততোটা ভয় হচ্ছে এটা ভেবে যে তোকে যদি হারিয়ে ফেলি আমি? কি করে বাঁচব বল? যদি তোর কিছু হয়ে যায়? ”

মৃধা এতক্ষনে আনন্দে ভাসলেও এই পর্যায়ে এসে যেন বুক চিনচিন করল তার। সত্যিই তো! যে বাচ্চাটার তার এত আহ্লাদ সে বাচ্চাটাকেই যদি সে কখনো ছুঁতে না পারে? যদি বাচ্চাটা জম্মের সময়ই সে ওপারে চলে যায়? নিশীথকে যদি সেবারই শেষ দেখা হয়? ইশশ! তার কতো স্বপ্ন ছিল। নিশীথ সহ, বাচ্চা সহ সে কতোটা সময় কাঁটাবে, খনসুটি করবে। যদি সে স্বপ্ন গুলোর কোনটাই আর পূরণ করা না হয়? মৃধা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নিশীথকে চিন্তামুক্ত করতে হেসে বলে,

” দূররর! ওসব তো ডক্টররা কত কথাই বলে। সব সত্যি হয় নাকি? আমি ঠিক বেঁচে ফিরব। তোকে জ্বালানোর জন্য হলেও তো বেঁচে থাকতে হবে বল? ”

নিশীথ দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

“ না ফিরলে কিন্তু আমি নিজেই তোর সাথে যাওয়ার পথ তৈরি করে নিব। ”

মৃধা মুহুর্তেই রাগ রাগ কন্ঠে বলে উঠল,

” উহু, এটা কেমন কথা? আমার বাচ্চা কি পৃথিবীতে একা একা অনাথের মতো বাঁচবে ফাজিল? যদি এমনটা হয় তো মরে গিয়েও তোর ঘাড় মঁচকাব বলে দিলাম নিশীথের বাচ্চা নিশীথ!”

এই পর্যায়ে নিশীথ হাসল। হুশিয়ারি দিয়ে বলল,

“ বাচ্চার সাথে আমার এখনো মায়া তৈরি হয়নি। কাজেই তাকে ছাড়া চলবেই না এমন অভ্যাস এখনও আমার তৈরি হয়নি। কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে আপনি আমার বদঅভ্যাসে পরিণত হয়েছেন ম্যাম। আপনাকে ছাড়া থাকা তো পসিবল না আমার পক্ষে। তাই। যায় হোক, আধ ঘন্টা অপেক্ষা করুন। বাসায় আসছি। বিকালে আমরা ডক্টরের কাছে যাব হুহ? ”

.

মাস এক পরই রাহি আর লিয়নের বিয়ের অনুষ্ঠান। দুইজনের সম্পর্ক বলা চলে অনেকটাই এগিয়েছে। রাহি ভাবে। সে শুরু থেকে সবটা ভাবে। একপাক্ষিক ভালোবাসা, এই মানুষটাকে এত করে চাওয়া, মানুষটার দেওয়া অবহেলা, কষ্ট! অবশেষে মানুষটাকে পাওয়া! রাহির ভাবতেই সুখ সুখ লাগে। চোখ বুঝে নেয় অসীম আনন্দে।মুহুর্তেই ফোন তুলে লিয়নকে কল দিল। কল রিসভড হতেই বিড়বিড় করে বলে,

“ লিয়ন ভাই? আপনি বলতেই আমি রাশি রাশি আনন্দকে বুঝি। আপনার মাঝে কি এত কি আছে লিয়ন ভাই? আপনার কথা ভাবলেই এত সুখ সুখ লাগে কেন বলুন না?”

লিয়ন হাসে।প্রেয়সীর প্রেমময় আলাপে হেসে শুধায়,

” কি আশ্চর্য! প্রেমে ট্রেমে পড়লে নাকি রাহি? কে এই লিয়ন ভাই? ”

রাহি ঠোঁট টিপে হাসে এবারে। বলে,

“ লিয়ন ভাই? আপনার প্রতি মাঝেমাঝে রাগ হয় আমার। কতগুলো বছর কাঁদালেন আমায়। কতোটা কষ্ট পেয়েছিলাম। ”

” কষ্ট পেয়েছিলে বলেই তো এখন সুখ সুখ লাগে জান। ”

“ আপনি চাইলে তখন আমায় কষ্টটা না দিতে পারতেন। ”

” তখন পরিস্থিতি ভিন্ন ছিল তো। তাছাড়া কষ্ট পেলেই তো সফলতা মেলে বলো? ”

রাহি ফুশ করে শ্বাস ছাড়ে। আচমকাই কোন উত্তর না দিয়ে লিয়নের মুখের উপরই কল রেখে দিল। বেচারা লিয়ন হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। করল টা কি সে? কেন কল রেখে দিল? হলো টা কি তার প্রিয়তমা নারীটির? লিয়ন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ব্যস্ততা থাকায় ম্যাসেজে টাইপ করে লিখি,

” যদি আমি কিছু করে থাকি তাও স্যরি। যদি না করি তাও স্যরি। রিস্ক নিতে চাই না বাবা!”

ওপাশ থেকে রিপ্লাই এল,

” কিসের রিস্ক? ”

লিয়ন হাসে। দ্রুত টাইপ করল,

“ না হওয়া বউটাকে নিজের বউ করার আগেই হারানোর রিস্ক নিতে চাই না বাবা!এইজন্য কিছু থেকে কিছু হলেই স্যরি স্যরি বলব তবুও বউ খুশি হোক,আমার হোক। স্যরি বলা তো আর কষ্টের না বলো? ”

রাহি এই পাশে হাসে এমন রিপ্লাই দেখে।

#চলবে…