#হৃদয়ে_প্রণয়ের_বাস
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#অন্তিম_পর্ব
লেখনীতেঃ রোদসী রঙ্গন
মাস দুয়েক পরই রাহির বিয়ের আনুষ্ঠানিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো। মৃধার এখন হিমশিম অবস্থা। প্র্যাগনেন্সির শুরুর দিকে ওর কোন সমস্যা না হলেও এখন শরীরটা খারাপ যাচ্ছে ওর। এই যেমন পায়ের গোড়ালির ব্যাথায় হাঁটতে অব্দি পারে না ভালো করে, পেট ফাঁপা লাগায় খাওয়া দাওয়া হয় না ঠিক করে আরো কত কি। চোখের নিচে কালি বসে গিয়েছে মেয়েটার। চেহারা আগের চাইতে ফ্যাকাসে লাগে। মৃধা নিজেকে আয়নায় পরখ করে লাল শাড়িটা জড়াল নিজের শরীরে। চুলগুলো পাতলা হয়ে যাওয়াতে ছাড়ল না। বরং শাড়ির সাথে মাথায় হিজাব পরে নিল। তারপর তৈরি হয়ে গেল রাহির কাছে। রাহিকে সুন্দর দেখাচ্ছে বউ সাঁজে। মুখি হাসি। যেন আজ সবচাইতে খুশি মেয়েটা। মৃধা হাসে। রাহির কয়েকটা ছবি তুলে লিয়নকে পাঠিয়ে ম্যাসেজে লিখল,
“ লিও? জিতেছিস ভাই। কি সুন্দর আমার ননদটা! ”
ওপাশ থেকে রিপ্লাই কি এল তা আর চ্যাক করল না মৃধা।রাহির সাথে দুয়েকটা কথা বলে আশপাশ জুড়ে খুুঁজল নিশীথাকে। পরমুহুর্তেই চাপা শ্বাস ফেলে। নিশীথ নিশ্চয় খুব ব্যস্ত আজ?বোনের বিয়ে বলে কথা! কত বড় অনুষ্ঠান। তাই তো নিশীথকে আজ দেখা গেল না তেমন। এমনকি যে নিশীথ মিনিটে মিনিটে মৃধার খোঁজ নেয় সে নিশীথ আজ খোঁজও করল না। মৃধার মন খারাপ হয়। অদৃশ্য অভিমানে মুখ কালো করে নিজের ঘরে যাওয়ার সময়ই দেখা হলো আবিরের সঙ্গে। আবির বিয়ে করেছে। সুন্দর সংসার হয়েছে। তবুও যেচে এসে মৃধার সাথে কথা বলল। মৃধাও উত্তর করল। তারপরই গিয়ে ঘরে দরজা লাগাল। এই যে রাহির কাছে যেতে যতটুকু পথ লাগল ততটুকু পথ হাঁটতেও যেন মৃধার অনেকটাই কষ্ট হলো। শারিরীক ক্লান্তি অনুভব হলো। তাই তো বিছানায় শরীর এলিয়ে দিল সঙ্গে সঙ্গেই। চোখ বুঝে নিয়ে ভাবল সামনের সময়টুকু। অথচ ভাবনা সমাপ্ত হতে পারল না, তার আগেই দরজায় কড়া নাড়ল কেউ। ওপাশ থেকে ভেসে এল গম্ভীর কন্ঠ,
“ মৃধা? দরজা আটকালি কেন? খোল..”
মৃধা দীর্ঘশ্বাস টেনে উঠে দাঁড়ায়। ধীর পায়ে গিয়ে দরজাও খুলে। তারপর দেখতে পায় নিশীথকে। ক্লান্ত ঘামে ভেজা মুখ তার। পরনের পাঞ্জাবিটায় সুন্দর মানাচ্ছে তাকে। মৃধা হাসে। বলে,
“ খুব ব্যস্ত নাকি?তো কি কি কাজ করলেন ভাই? ”
নিশীথ রুমে ডুকে দরজা আটকায়। মৃধার দিকে ভ্রু উঁচিয়ে বলে উঠে,
“ ভাই? অলরেডি আমার বাচ্চার আম্মু হচ্ছেন ম্যাম। ”
“ তো? ”
নিশীত মৃধার পানে তাকায়। ফের বলে,
” তো কিছু না। এভাবে সেঁজেছিস কেন? কে বলেছে সাঁজতে? আর ঐ ভীড়ের মধ্যে ওখানে কষ্ট করে যাওয়ারই বা কি প্রয়োজন ছিল? বল।”
মৃধা গম্ভীর ভাবে বলা কথা গুলো শুনে বলল,
“ তুই রেগে আছিস?”
” রেগে থাকব কেন? ”
” মনে হচ্ছে তো। ”
নিশীথ ক্লান্ত শ্বাস টানে। বলে,
” বাইরে আমায় খুঁজছিলি? ”
“ কে বলল? ”
”বলার মানুষের অভাব আছে? ”
“ ওহ। ”
“ কেন খুঁজলি? ”
মৃধা অভিমানি স্বরে বলল,
” খুঁজতে কারণ লাগবে এখন?”
নিশীথ অন্য দিকে ফিরে বলে,
“ তোর আবিরের সাথেই কথা বলতি। আমায় খোঁজার কারণই বা কি বল? ”
মৃধা অবাক হয় বিস্ময় নিয়ে বলে,
“এতবছর আগের জ্বেলাসি এখনো?”
নিশীথ খুব রাগ নিয়েই বলল,
“ হ্যাঁ এখনও। ঐ আবিরকে আমি আজীবন ঘৃণা করব। আজীবন ইনসিকিউরিটিতে ভুগব। কারণ ও শা’লা মানুষটাই লোভী!”
মৃধার মুখ ভার হলো। কোন জবাব না দিয়ে কিছুক্ষন চুপ হয়ে রইল। নিশীথ ভ্রু উঁচু করল। মৃধার দিকে চেয়ে বলল,
“ চুপ কেন? বিয়েবাড়িতে সুন্দর সুন্দর মেয়েও আছে। আমি সুন্দরী মেয়েদের সাথে গিয়ে কথা বলব,আড্ডা জমাব। সুন্দর হবে না বিষয়টা? ”
মৃধা তাকাল। ছোট শ্বাস টেনে এগিয়ে এল নিশীথের দিকে। পরক্ষণে বলল,
“ মূলত এই কারণেই খুঁজছিলাম তোকে। কারণ তুই তো ছেলেমানুষ। বিয়ে বাড়িতে মেয়ে দেখেই নিশ্চয় গলে টলে যাবি এই ভেবে খোঁজ করছিলাম। এখন তো দেখি সত্যিই তুই এই সুযোগ খুঁজছিস। ভালো! যদি মরে টরে যাই তাহলে তোর সুবিধাই হবে। যাক শান্তি ফেলাম এটুকু ভেবে। ”
নিশীথ হাসল এবারে। আচমকা মৃধাকে কাছে টেনে নিয়ে কোমড় জড়িয়ে ধরল। কপালে চুম্বন এঁকে ফিসফিস স্বরে বলল,
“ আমার একটা আপনি হলে আর কিচ্ছু লাগে না। আমি শুধু আপনাতেই গলে যাই। অন্য কারোর সাধ্য নেই আমায় গলানোর। ”
মৃধা তবুও মুখ ভার করে জবাব দিল,
“ বাহ! সাধুপুরুষ! ”
নিশীথ হেসে মুখ ডুবায় মৃধার গলায়। বলে,
“ আমি তো অলওয়েজই সাধুপুরুষ! ”
.
রাহিকে ফুলে সজ্জ্বিত ঘরে বসিয়ে রাখা হয়েছে অনেকটা ক্ষন। অথচ লিয়নের খবর নেই। ভারি সাঁজে হাঁপিয়ে উঠে মেয়েটা । ভাবে লিয়ন বোধহয় ব্যস্ত কারণ লিয়ন নিজের বিয়েতে নিজেই ব্যস্ত বেচারা। রাহি লিয়নকে পেলে তো! অবশেষে যখন রাহি ভারী শাড়িটা খুলে রেখে ব্যাগে শাড়ি খুঁজতে লাগল ঠিক তখনই লিয়নের দেখা মিলল। রাহি সর্বপ্রথম ঠোঁট উল্টাল।বিব্রত না হয়ে পরমুহুর্তেই বলল,
“ নিজের বিয়েতে নিজেই ব্যস্ততায় হাওয়া হয়ে যাচ্ছেন। দারুণ তো বিষয়টা লিয়ন ভাই!”
লিয়ন হাসতে নিয়েও হাসল না। বাসর রাতে কোন বউ তার বরকে ভাই বলে? লিয়ন দরজা লাগিয়ে এগিয়ে এল। রাহির দিকে চেয়ে শুকনো ঢোক গিলল সঙ্গে সঙ্গেই৷ পরনে শাড়ি নেই মেয়েটা। অনাবৃত পেট পুরুষ সত্ত্বায় উস্কে দিচ্ছে যেন। তবুও গম্ভীর স্বরে বলল,
“ ভাই হই আমি তোমার? ”
রাহি পাল্টা উত্তরে বলল,
”জামাই হোন? কই, জামাই হয়ে তো সারাদিনে একটাবার খোঁজও করতে দেখলাম না। ”
লিয়ন ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বলল,
“ নিজের বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য নিজেকেই দৌড়াতে হচ্ছে। সে কারণেই ব্যস্ত ছিলাম রাহি। ”
রাহি জানে কারণটা। তবুও শুনে বলল,
” আপনাকে এমন গম্ভীর শোনাচ্ছে কেন? আপনি কি খুশি হননি বিয়েতে? ”
লিয়র এবারে তাকাল কেমন করে। বলল
“ আমি বোধহয় নার্ভাস আবার বোধহয় একটু একটু কন্ট্রোল ও হারাচ্ছি। তোমায় সুন্দর দেখাচ্ছে রাহি। ”
রাহি অবাক হয়ে বলল,
“ আমায় সুন্দর দেখাচ্ছে এই জন্য নার্ভাস আপনি? ”
লিয়ন বোধ হয় আর দূরত্ব বজায় রাখতে পারল না। বউকে জড়িয়ে নিয়ে বলে,
” উহম না। আমি চেয়েছিলাম তোমার সাথে আজ রাতটা গল্পই করব কেবল রাহি। কিন্তু এখন দেখছি আজ রাতেই বাসর সেরে ফেলতে হবে। এই কারণে জান। তুমি তৈরি তো?”
লিয়ন জিজ্ঞেস করল ঠিক। তবে উত্তর নিল না৷ তার আগেই মেয়েটার ঠোঁট দখলে নিল। মুখ ভরে অজস্র চুম্বন আঁকল।
.
তিন বছর পর,
রাহির ছয় মাসের ফুলো পেট। পরনে কালো রংয়ের একটা কামিজ। অপেক্ষায় আছে প্রিয় পুরুষের বাসায় ফেরার। সে কারণেই বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক তখনই দৌড়ে এল ছোট্ট নিশু আর ছোট্ট মিহির।রাহির পেটে আলতো চুমু খেয়ে দুইজনেই বলে উঠল,
“ বাবু আমার! ”
রাহি হেসে উঠে। নিশু আর মিহির হলো নিশিথ আর মৃধারই বাচ্চা। মৃধার জমজ বাচ্চাই হয়েছিল। নাম রাখা হয়েছিল নিশু আর মিহির। রাহি হেসে বলে উঠে,
“ হু, বাবু তোমাদের দুইজনেরই সোনা। ”
মিহির মুহুর্তেই গাল ফুলিয়ে বলল,
“ না, ও আমাল। শুধু আমার সাথেই খেয়া কববে। ”
নিশু ও সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠে,
“ ও শুধুই আমাল। ”
ঠিক তখনই মৃধা এল। সঙ্গে অবশ্য লিয়নকেও দেখা গেল। মৃধা বাচ্চা দুটোকে নিয়ে লিয়ন আর রাহিকে স্পেস দিল। মৃধাদের যেতে দেরি অথচ লিয়নের বউকে জড়িয়ে ধরতে দেরি হলো না। কপালে চুমু দিয়ে বলল,
“ বউ ছাড়া থাকা খুবই কষ্টের! হারে হারে টের পাচ্ছি আমি এক সপ্তাহে। ”
রাহি হাসে। লিয়নকে জড়িয়ে নিয়ে বলে,
“ মাঝে মাঝে কষ্ট অনুভব করা ভালো তো।”
.
মৃধার শরীরের জ্বর। তবুও রান্না টান্না শেষ করে যখন নিজের রুমে এসে ডুকল ঠিক তখনই নিশীথ আর বাচ্চা দুটোর দেখা মিলল। নিশীথ টানটান স্বরেই বলল,
” এত তাড়াতাড়ি শেষ? সারা রাতভর কাজ করা উচিত তো তোর। যা, আরো রান্না কর। ”
“ রান্না শেষ, এখন আর কি রান্না করব? ”
নিশীথ রেগে ছিল। অথচ যখনই বউয়ের অসুস্থ মুখ পানে তাকায় তার মায়া হলে। এগিয়ে গিয়ে বলল,
“ অসুস্থ ছিলে তো৷ কাজ করার দরকার কি ছিল? সবাই ছিল তো তাই না? ”
মৃধা নাক ফুলিয়ে বলল,
” অসুস্থ হলে কথা বলছি কি করে তোর সাথে? ”
নিশীথ জ্বর মেপে বলে,
” গায়ে জ্বর এখনো। ”
“ জ্বর হলে মানুষ মরে যায়না। এটা আহামরি কিছু না৷”
” কিন্তু আপনি আমার জন্য আহামরি কিছুই।”
মৃধা গুরুত্ব দিল না যেন। হেয়ালি করে বলে,
“ ওহ। ”
“ সবসময় নিজেকে নিয়েই এত হেয়ালি কেন? এই যে দুটো বাচ্চা দিলেন মরতে মরতেও। আমার কলিজা তখন এক ফোঁটা পানি ছিল না। ঐ এক সপ্তাহ যখন তোর আশঙকাজনক অবস্থা তখন আমার মনে হচ্ছিল আমি প্রতিটা মুহুর্তে মারা যাচ্ছি। তুই, তুই জানিস তুই আমার দুর্বলতা। তাই এমন করিস? ”
মৃধা হাসে। বাচ্চা দুটোর সামনেই আচমকা নিশীথে জড়িয়ে ধরে বলে,
“ তুই আমার জীবনের সেরা প্রাপ্তি নিশীথে। হৃদয়ে প্রণয়ের অস্তিত্ব টুকু তোকে পেয়ে স্বার্থক আমার। এত কেন ভালো তুই?”
নিশীথ হেসে বলে,
” কারণ তোকে এতোটা ভালোবাসি সুখ! ”
নিশীথ মৃধার বাচ্চক দুটো তখন খিলখিলিয়ে হেসে উঠে। বিছানা ছেড়ে এসে বাবা মাকে জড়িয়ে ধরে একজন বলে,
“ এতা আমাল আম্মু! ”
আরেকজন বলে,
” এতা আমাল আব্বু!”
#সমাপ্তি…