হৃদয়ে প্রণয়ের বাস ২ পর্ব-০৩

0
1739

#হৃদয়ে_প্রণয়ের_বাস
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_০৩
লেখনীতেঃ রোদসী রঙ্গন

প্রেগনেন্সি কিটের রেজাল্ট এবারেও আশানুরূপ হয়নি। এই নিয়ে অনেকবার মৃধা পরীক্ষা করেছে। যতবারই পিরিয়ড মিস হয়েছে ততবারই! অথচ ফলাফল তার আশানুযায়ী আসে না৷ মৃধা হতাশ হয়ে চেয়ে থাকল প্র্যাগনেন্সি কিটটার দিকে। পরমুহুর্তেই রাগে দুঃখে এক হাতে ছুড়ে মারল ওয়াশরুমের ফ্লোরে। কান্না পেল তার। কান্না আটকানোর চেষ্টাও চালাল না। নিরবে কাঁদতে কাঁদতে যখন অনেকটা সময় কেটে গেলে ঠিক তখনই ওয়াশরুমের দরজায় নক করা হলো। ওপাশ থেকে শোনা গেল,

“ কিরে মৃধার বাচ্চা মৃধা? ওয়াশরুমে গিয়ে কি ম’রে টরে গেছিস নাকি? পাঁচ মিনিটে জামাকাপড় গুঁছিয়ে রাহির কাছে যাওয়ার কথা তোর অথচ আধঘন্টা হয়ে গেল। ”

নিশীথের কথা শুনে মৃধা কান্না থামানোর চেষ্টা করল এবারে। রাহিকে সে বাসায় রেখে সন্ধ্যার একটু আগেই এসেছিল। যেহেতু রাহি একা তাই মৃধাই থাকার সিদ্ধান্ত নিল কয়েকটাদিন ওখানে। তাই বিকালে এসেছিল জামাকাপড় নিতে৷ আর জামাকাপড় নিতে গিয়েই দুয়েকমাস আগে কেনা প্র্যাগনেন্সি কিটটাও চোখে পড়েছিল ড্রয়ারের কোণায়৷ তারপরই নিজেকে আর না সামলে ওয়াশরুমে গেল। মনে মনে কত করে সৃষ্টিকর্তাকে বলল যাতে এবারটায় রেজাল্ট পজেটিভ আসে। অথচ তার আশায় এক বালতি জল ঢেলে রেজাল্ট আসল নেগেটিভ। মৃধা মুখে সমানে পানির ঝাপটা দিল। কান্না থামিয়ে বলল,

“ আসছি। ”

কথাটা বলেও অনেকটা সময় পর বের হলো সে। নিশীথ ততক্ষন দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল। মৃধাকে বের হতে দেখে মুখপানে তাকিয়ে বুক ধক করে উঠল। চোখজোড়া লাল হয়ে ফুলে আছে, নাকটাও লালচে দেখাচ্ছে। নিশীথ যা বুঝার বুঝে নিল। দুই হাতে মৃধার মুখটা আগলে নিয়ে পাগলের মতো চুমু দিল গালে, নাকে, মুখে।অস্থির গলায় বলল,

“ কান্না করেছিস কেন হু? ”

মৃধা চমকে তাকাল।কোনরকমে বলল,

“হু? না তো, কই?”

“ কান্না করেছো। মিথ্যে বলবে না। ”

মৃধা এবারর উত্তর করল না। ফের কান্না আসছে তার। কিন্তু এবারে কান্না দমাল। নিশীথ বলল,

“ কেন কান্না করেছো? বলো। ”

মৃধা হালকা হেসে বলল,

“ তেমন কিছু নয়। ”

নিশীথ মানল না। ত্যাড়া স্বরে জানাল,

“ তেমন কিছুই! বলো। ”

পরমুহুর্তেই আবার অস্থির গলায় বলে উঠল,

“ওয়ান মিনিট, আমি কাল ফিমেইল কলিগের বাসায় গিয়েছি বলে কান্না করেছো? নাকি দুপুরে ঐ মেয়েটাকে নিয়ে কথা বললাম বলে? কোনটা? কোনটা জান?”

মৃধার হাসি পেল এবারে। নিশীথটা তাকে কতোটা ভালোবাসে ভাবলেই তার সুখ সুখ লাগে। সুখে সমুদ্রে ভেসে যায় সে ভাবলেই। এড়িয়ে গিয়ে বলল,

“ কিছুই না নিশীথ। এমনিই কাঁদতে মন চেয়েছে। পথ ছাড়। ”

“ ছাড়ব না।বলো। ”

মৃধা কান্না চলে এল। চোখ টলমল করল। নিশীথের দিকে এবারে অসহায়ের মতো তাকাল। আওড়াল,

“ নিশীথ.. ”

“ হু বলো.. ”

“ তুই আমায় কখনো ছেড়ে দিবি না তো নিশীথ? ”

কথাটা বলেই জড়িয়ে ধরল নিশীথকে। কান্নায় টলমল করা চোখ জোড়া নিশীথের বুকে ঠাঁই হতেই ভিজে উঠল। নিশীথের এবারে নিজেকে অসহায় লাগল। মেয়েটার কান্নারত মুখ তার সহ্য হয় না। শূণ্য লাগে নিজেকে। আকড়ে ধরে মৃধার চুলে চুমু খেল নিশীথ। এক হাত চুলে বুলিয়ে বলল,

” তোর এমন কেন মনে হলো সুখ? আমি দুপুরে ঐ মেয়েটাকে নিলুদের ভাবি বানানোর কথাটা শুধুই মজা করে বলেছি সুখ। সত্যিই মজা৷ আর, আর কালকের ফাইলটা খুব ইম্পোর্টেন্ট ছিল। আজ রাহি আসবে আগেই জানতাম।রাহি না বললেও নিবির জানিয়েছিল। তাই আজকের দিনটা ছুটিতে থাকব বলে সব কাজ কাল রাতেই কম্প্লিট করতে চেয়েছিলাম। তাই তো ফাইলটা আনতে গিয়েছিলাম। এছাড়া কিছু নয়। সত্যি বলছি সুখ। এই নিশীথ তোকে ছাড়া দ্বিতীয় কোন নারীকে জীবনে সহ্য করতে পারবে না। আর তোকে ছেড়ে দেওয়া তো আমার মৃত্যু সমান সুখ! তোকে ছাড়া থাকার কথা আমি ভাবতেই পারি না। ”

মৃধা কেঁদে ফেলল। নিশীথের টিশার্টটা কান্নায় ভিজিয়ে দিয়ে অনেকটা সময় পর বলল,

“ নিশীথ? আমরা সেই চারবছর আগে একটা রিলেটিভের বাচ্চাকে আদর করে বেবি নেওয়ার প্ল্যান করেছিলাম।মনে আছে তোর? অথচ চার বছর চেষ্টা করেও আমি তোকে বাবা হওয়ার সংবাদ দিতে পারিনি। আমি, আমি ব্যর্থ….. ”

নিশীথ কপাল কুঁচকাল। খুবই বিরক্ত এমন করে বলল,

“ আবার ও? নতুন করে আবারো ওসব ভেবেছিস মৃধা? কে কি বলেছে বল? কে বলেছে?”

“ কেউ বলেনি। আমি একবার ডক্টর দেখিয়ে আসি নিশীথ? আমার কোন ত্রুটি থাকলে চিকিৎসা করা উচিত তো নিশীথ। তাহলে হয়তো কনসিভ করব। প্লিজ ডক্টর দেখাই না? ”

নিশীথ ঠোঁট গোল করে শ্বাস ফেলল। মৃধার মুখটা নিজের হাতের আজলায় নিয়ে চুমু খেল গালে। মৃদু গলায় বলল,

” কখনোই না। মৃধা? সন্তান জম্ম দিতে বউয়ের ত্রুটি আছে কিনা এর জন্য বউকে ডক্টর দেখানো মানে আমার কাছে খুবই কুৎসিত একটা কাজ। আর শোন, নিশীথ এতোটা নিচু মনের মানুষ নয় যে একটা বাচ্চার জন্য তোকে ছেড়ে দিবে মৃধা। আমার শুধু তুই হলেই চলবে। তুই সাথে থাকলেই হবে। আমি শুধু তোকেই চাই মৃধা। ”

কথাগুলো বলেই মৃধার নাকে চুমু দিল। ফিসফিসিয়ে বলল,

“ তোকে সবটুকু দিয়ে ভালোবাসি সুখ!আমার শুধু তোকেই চাই আমার পাশে। তুইই আমার জন্য সব। আর কাউকে চাই না। কাউকেই লাগবে না। ”

.

আকাশে অর্ধাকৃতির চাঁদ। বাহিরে মৃদুমন্দ শীতল হাওয়া। আর দোতালার রাহির বেলকনিটায় মৃদু হলদেটে আলো। রাহি যখন হাজারটা মন খারাপ নিয়ে মনোযোগ দিয়ে আকাশের চাঁদটা দেখছিল ঠিক সেসময়ই রাস্তায় গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা লিয়ন পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে দেখছিল তার নিজস্ব চাঁদিটেকে। বেলকনির মৃদু আলোয় দেখা যাচ্ছে মেয়েটাকে। লিয়ন মৃদু হাসে। মোবাইলটা বের করে কল দিল রাহির নাম্বারর যেটা সে একটু আগেই নিশীথ থেকে সংগ্রহ করেছিল। অপর দিকে রাহি কে কল দিয়েছে তা দেখার জন্য ফোন তুলতেই চোখে পড়ল আননোন নাম্বার। রাহি কপাল কুঁচকাল। কল তুলবে কি তুলবে না ভাবতে ভাবতেই কলটা কেটে গেল।কিন্তু পরমুহুর্তেই আবার বেজে উঠল। রাহি এবারে কল তুলল। মিহি স্বরে জানাল,

“ আসসালামুআলাইকুম, কে বলছেন? ”

ওপাশ থেকে প্রথমে উত্তর এল না। পরে অনেকটা সময় পরই উত্তর এল,

“ আপনার খুব প্রিয় কেউ ম্যাম। ”

রাহি ঘাবড়াল। লিয়ন মুখে রুমাল চেপে কথা বলায় কন্ঠও চিনতে পারল না। তবে এমন একটা কথাকে প্রথমে সিরিয়াসলি না নিয়েই আবার জিজ্ঞেস করল,

“ স্যরি, কে বলছেন জানতে পারি? ”

লিয়ন এবারে হাসল। উত্তর দিল,

“ আপনার ফিউচার হাজব্যান্ড বলছি। এভাবে বেলকনিতে আলো জ্বালিয়ে বসে থাকবেন না প্লিজ৷ পৃথিবীর কোন না কোন কোণে কারো হৃদয় থমকে যায় আপনার স্নিগ্ধ মুখটা দেখলে মিস রাহি। ”

এই পর্যায়ে রাহি আরো অবাক হলো। তার নামটাও জানে এই লোক? কিন্তু কে এই লোক? আশ্চর্য! আর নাম্বারটা? এটাই বা পেল কিভাবে? এই সিমকার্ডটাতো সে আজ বিকালেই কিনেছে। আর বেলকনিতে বসে আছে এটাই বা জানল কিভাবে? আশ্চর্য! রাহি বারকয়েক নজর ঘুরাল রাস্তার এপাশ ওপাশ। কাউকেই চোখে পড়ল না। শুধাল,

“ ফাজলামো করছেন? কে আপনি? কোথায় কল করেছেন হুহ? ”

“ আপনার কাছেই মিস রাহি! আমার প্রেমমানবীর কাছেই। ”

রাহির মাথা তখন ওলোটপালট ঠেকল। মানুষটা কে হতে পারে আকাশ পাতাল চিন্তা করতে করতে জিজ্ঞেস করল,

“ আমার নাম কি করে জানেন? কে আপনি? সত্যি করে বলুন বলছি। ”

লিয়ন উত্তর দিল না। বরং এড়িয়ে গিয়ে বলল,

“ আচ্ছা? আপনার কি মন খারাপ? কার জন্য মন খারাপ জানতে পারি? ”

রাহি নিজেই বিস্মিত হলো। হ্যাঁ! তার তো মন খারাপ! প্রিয় পুরুষের জন্যই মন খারাপ। কিন্তু উত্তরে বলল,

“ না! ”

” আপনার বালিশের নিচে একটা চিরকুট তুলে দেখেছেন রাহি? ”

রাহি ভ্রু কুঁচকে নিয়ে বলল,

“ কিসের চিরকুট? ”

লিয়ন ঠোঁট টিপে হাসে। পকেটে হাত গুঁজে বলে,

“ আমার গোপন প্রণয়ের চিরকুট। ”

রাহি কৌতুহল দমাতে পারল না। তার বালিশের নিচে চিরকুটের হদিস অন্য কেউ কি করে পাবে? নিশ্চয় এই লোক বানোয়াট কথা বলছে ভেবে বালিশ উল্টাতে গেল রুমে। অথচ দ্বিগুণ বিস্মিত হয়ে সে একটা চিরকুট পেল সেখানে। যেখানে গুঁটি গুঁটি অক্ষরে লেখা আছে,

“তোমায় ঘুমন্ত অবস্থায় মিষ্টি লাগছে মেয়ে। তুমি জানো? কতোটা ভালোবাসা লুকিয়ে রেখেছি বুকের ভেতরে? কতোটা আদর জমানো আছে তোমার নামে? প্রেমমানবী?তুমি আমার সেই প্রিয় মানুষ যাকে আমি আমার করে পেয়েও আমার করে পাইনি। তুমি আমার সেই প্রিয় নারী যাকে আমার সাধ থাকতেও ভালোবাসতে পারিনি। আর কিছুদিন, অল্প কিছুদিন। তারপরই তুমি আমার। শুধুই আমার। কি প্রশান্তি!দোয়া করি, তোমার হৃদয়ে আমার জন্য রাখা ভালোবাসায় কখনো কমতি না আসুক, বরং ভবিষ্যৎ এ আরো আরো বেশি ভালোবাসো আমায়। আমি তোমার ভালোবাসা পাওয়ার অপেক্ষায় থাকলাম হুহ?”

এটা কে? তার লিয়ন ভাই? না না! কিসব ভাবছে রাহি! রাহি বিস্ময় নিয়ে ফের বেলকনিতে এল। কে হতে পারে এই চিন্তায় মাথা ফাঁটার জোগাড় হলো যেন। বারবার রাস্তায় চোখ বুলিয়ে সন্দেহী গলায় বলল,

“ আমার বিছানায় চিরকুট? আপনি কি করে জানলেন? কি করে? কে আপনি? কে রেখে গেল এটা? আশ্চর্য! আপনি কি আমার পরিচিত? প্লিজ, আপনার পরিচয়টা বলুন আমায়।”

অথচ রাহির এতোটা কৌতুহল, এতোটা আকুতিকে পাত্তা না দিয়ে ওপাশ থেকে উত্তর এল,

“ মনে হচ্ছে আপনি চিরকুট পড়েই আমার হতে রাজি হয়ে গিয়েছেন? ”

রাহির অনুভূতি প্রখর! সে অনুভূতি নিয়ে কেউই মজা করবে তা মেনে নিবে না সে। যদি এটা লিয়ন না হয় তাহলে অবশ্যই তার চেনাজানা কেউ ফাজলামো করছে এমনটা ভেবে নিয়েই দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“ মজা করবেন না। আমি সত্যিই জানতে চাইছি আপনি কে। আপনি রীতিমতো আমার ইমোশন নিয়ে খেলছেন। আমি জানতে চাইছি আপনি মানুষটা কে? সাহস থাকলে সামনে আসুন।”

লিয়ন এবারেও এড়িয়ে গেল রাহির প্রশ্নটা। বরং বলল,

“আপনাকে আগে কখনো রাগতে দেখিনি মিস রাহি। এই প্রথম দেখলাম।রেগে গিয়ে আপনাকে আরো বেশি সুন্দর লাগছে। ইচ্ছে হচ্ছে চুমু দিয়ে আপনার রাগ ভাঙ্গাতে। কিন্তু দুর্ভাগ্য। উপায় নেই! ”

কথাটুকু বলেই হা হুতাশ করে কল রেখে দিল লিয়ন। অপরদিকে রাহির মনে তখন হাজারটা প্রশ্ন। কে এই লোক? কে দিল এই চিরকুট? কিভাবেই বা এল চিরকুটটা?

#চলবে…..