হৃদয়ে প্রণয়ের বাস ২ পর্ব-০৪

0
1380

#হৃদয়ে_প্রণয়ের_বাস
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_০৪
লেখনীতেঃ রোদসী রঙ্গন

নিশীথ মৃধার সাথে সাথে এল লিয়নও। রাহি প্রথম দফায় অবাক হলেও পরমুহুর্ত থেকেই নিঁখুত ভাবে এড়িয়ে গেল। সন্ধ্যা থেকে রাত অব্দি সে একবারও লিয়নের দিকে তাকায়নি৷ একটাবার কথা বলেনি। লিয়নের মনে মনে আপসোস হয়। রাহির এড়িয়ে যাওয়া মেনে নিতে না পেরে সূক্ষ্ম এক জেদ নিয়েই রাহির মুখোমুখি হলো। পকেটে হাত রেখে যখন কিছু বলতে নিবে ঠিক তখনই রাহি তাকে এড়িয়ে গিয়ে চলে যেতে নিল নিজের রুমে। এবারে লিয়নের জেদ বাড়ল। শক্ত করে চেপে ধরল রাহির হাতটা। গম্ভীর অথন কি ভীষণ দৃঢ় স্বরে বলে উঠল,

“ এসেছি প্রায় চার ঘন্টা রাহি। এই চার ঘন্টা সময়ের সবটুকু সময়ই আমায় এভাবে এড়িয়ে যাওয়ার মানে কি বলো ? বিকালে তে হেসে হেসেই কথা বলেছিলে। ”

রাহি এবারেও তাকাল না। যে পুরুষকে দীর্ঘ আটবছর ভালোবেসেও সে পুরুষটির ভালোবাসা পেল না তাকে এড়িয়ে যাওয়ায় শ্রেয় নয় কি?রাহি চাপাশ্বাস ফেলে টানটান গলায় শুধাল,

“ লিয়ন ভাই?পাঁচ বছর আগে আপনি নিজেই আমায় ভুলে যাওয়ার শর্ত দিয়েছিলেন। আপনার সাথে যোগাযোগ না করার শর্ত দিয়েছিলেন। বিনিময়ে একটা দিন চেয়েছিলাম তখন। আমি আসলে আপনাকে এতোটাই ভুলে গিয়েছিলাম যে যোগাযোগ না করার শর্তটা ভুলেই গিয়েছিলাম। তাই বিকালে কথা বলেছি। এখন মনে পড়ল, তাই এড়িয়ে যাচ্ছি। ”

লিয়নের রাগ যেন এবার শীতল হলো।মনে পগল আগেকার স্মৃতি, আগেকার রাহিকে। কতোটা আদুরে ছিল আগের রাহি। ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকত আকুল নয়নে৷ যেন লিয়নের কাছে তার কত চাওয়া পাওয়া৷ লিয়ন নরম হলো। তবুও কন্ঠ দৃঢ় রেখে শুধাল,

“ ভুলে গিয়েছিলে আমায়? এতোটা সাহস কি করে হলো তোমার? ”

রাহি তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসল। উত্তরে বলল,

“ মনে রাখার তো কথা ছিল না লিয়ন ভাই৷ ছিল? ”

লিয়ন দৃঢ়তার সঙ্গে বলল,

“ যদি বলি ছিল? ”

“ ছিল না। বলেছিলাম না পাঁচ বছর পর আপনিও বদলাতে পারেন, আমিও বদলাতে পারি? ”

” তাই বলে বদলে যাবে? ”

রাহির ইচ্ছে হলো আগের মতো করে লিয়নের কাছে ভালোবাসা চাইতে। মনে হলো লিয়ন ভাই তাকে ভালোবাসে। মনে হলো লিয়নের তাকানোতে কতোটা অভিযোগ৷ ঠোঁট এলিয়ে শুধাল,

“ লিয়ন ভাই? আপনি এখন অন্য কারোর। দয়া করে এমন ভাবে কথা বলবেন না যাতে আমি নিজেকে বদলে নিয়েও আবার দুর্বল হয়ে যাই। প্লিজ!”

“ আমার প্রতি তোমার দুর্বলতা নিঃশেষ হতে পারে না রাহি। অস্বীকার করতে পারবে যে তুমি এখনও আমার প্রতি দুর্বল? ”

রাহি ভ্রু উঁচিয়ে তাকাল। বলল,

“ এটাকে কি সুযোগ হিসেবে অবলম্বন করতে চাইছেন? ”

লিয়ন হাত ছেড়ে বলল,

“ আগের রাহি নরম গলায় কথা বলত। এখনকার রাহি আমার চোখে চোখ রেখে দৃঢ় গলায়ও কথা বলে। বাহ!আ’ম ইম্প্রেসড! ”

রাহি এবারে লিয়নের কথাটাকে মজা হিসেবেই নিল। বলল,

“ আগের রাহি তো আপনাকে ভালোবাসত, এখনকার রাহি আপনাকে ভালোবাসে ন..”

লিয়ন এবারে রহস্যময় হাসল। ফু দিয়ে রাহির কপালের চুল উড়িয়ে বলল,

“ উহম! বাসে! এই রাহিও আমায় ভালোবাসে। বরং আগের চেয়ে বেশি। ”

কথাটায় বলেই লিয়ন চলে গেল। রাহি অদ্ভুত নয়নে চেয়ে থাকল। কি বলে গেল? কেন বলল? লিয়ন ভাই অন্য ছেলেদের মতো হয়ে গেছে? এক মেয়েকে জীবনে রেখে অন্য মেয়র সাথে ফ্লার্ট করে?ছিঃ ছিঃ!

.

রাতে রাহি আর মৃধা ঘুমাল একসাথেই। রাহির চোখে তখনো ঘুম নেই। মাথায় কেবল ঘুরল লিয়নের কথাগুলোই। অবশেষে মাথার ভাবনাকে মুখে এনে মৃধাকে ডাক দিল,

“ ভাবি? ”

“ বলো।”

“ লিয়ন ভাই আগের চেয়ে পাল্টে গেছে? ”

মৃধা ভ্রু কুঁচকাল। বলল,

“কেন? এমন কেন মনে হলো তোমার? ”

রাহি কিছুটা সময় চুপ থেকে বলল,

“আগের লিয়ন ভাই মেয়েদের ধারেকাছে ঘেষত না। আই মিন তার চরিত্রে মেয়েঘটিত কোন কাজ তো চোখে পড়ে নি। কিন্তু এখনকার লিয়ন ভাই… ”

মৃধা কৌতুহল নিয়ে বলল,

“ এখনকার লিয়ন ভাই? কি?”

“ কিছু না। ”

মৃধা কৌতুহল দমাল। পরমুহুর্তেই আবার জিজ্ঞেস করে উঠল,

“ এক মিনিট, তোমার সাথে কিছু করেনি তো লিও? কি করেছে কি করেছে রাহি? আমায় বলো। ”

রাহি আচমকা চমকে উঠল। কি করবে তার সাথে? বলল,

“ হু? না, কিছু করে নি। ”

মৃধা হতাশ হয়ে বলল,

“ কিছুই করে নি? ”

“ না, নাহ তো। কি করবে? ”

মৃধা নিরাশ স্বরে বলল,

“ ধুরর, আমি ভেবেছি কিছু করেছে।কিছু করা উচিত ছিল তো হুহ? এতদিন পর দেখা হলো তোমাদের..”

রাহি বুঝে উঠল না। বলল,

“ কি করা উচিত ছিল? ”

মৃধা কথা এড়িয়ে বলল,

“ কিছু না, ঘুমাও রাহি। আমার ঘুম পাচ্ছে। ”

.

নিশীথ একা বিছানায় চিত হয়ে শুঁয়ে আছে। মনে মনে লিয়নটাকে গা’লি দিয়ে কল করল।কল রিসিভড হতেই শুধাল,

“ যে কাজটা পাঁচ বছর আগে করার ছিল শা’লা সে কাজটা করতে এসেছিস পাঁচ বছর পর। তোর জন্য এখন আমিও বউছাড়া।”

ওপাশ থেকে লিয়ন শুধাল,

“ পাঁচবছর আগেই বউ পেয়েছিস তুই। আর আমার ভাগ্যে এখনো বউই জুটেনি। ”

নিশীথ রাগ দেখিয়ে বলল,

“তো দোষ কার? আমার নাকি তোর? ”

লিয়ন নিরস গলায় বলল,

“ তোর বোন নাকি আমায় ভুলে গেছে। কি নিষ্ঠুর মেয়ে। ”

“ ভালো করেছে। আমি হলে তো স্মৃতি ভুলার ন্যায় ভুলে যেতাম।যে ঢংটা করছিলি বেয়াদব। ”

লিয়ন চাপাস্বরে জানাল,

“ ঢং?ওটা পরিস্থিতির দোষ ছিল। ”

নিশীথ রাগ রাগ গলায় বলল,

“ পরিস্থিতি তো আমারও খারাপ ছিল। সেদিন ঐ আবির শা’লার সাথে বিয়ে হয়ে যাচ্ছিল মৃধার। আমিও তো পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে ওকে ছাড়া জীবন কাঁটাতে পারতাম। ভালোবাসলে তাকে যে কোন পরিস্থিতিতে নিজের করে রাখতে হয় বুঝলি? আমি তো তোকে বোন দিচ্ছি কিভাবে এটাই ভাবি। যদি তুই আবারও খারাপ পরিস্থিতি এলে আমার বোনকে ছেড়ে দিস?”

লিয়ন গম্ভীর গলায় জানাল,

“ ছাড়ব না।”

“ শিওর ? ”

“ হ্যাঁ! যদি কোন কঠিন পরিস্থিতি আসেও তবুও তোর বোনকেই ফার্স্ট প্রায়োরিটি দিব। এবার বোন দিতে সংশয় আছে? ”

নিশীথ এবারে হাসল। মজা করে বলল,

” না, কিন্তু আমার বউ নেই। দুঃখ হচ্ছে আমার। ”

লিয়ন হেসে উঠল উচ্চস্বরে। এভাবে দুইজনের কথোপকোতন চললই। একজনের বউ ছাড়া থাকার দুঃখ, অন্য জনের বউ না পাওয়ার দুঃখ!

.

মৃধার ঘুম ভাঙ্গল খুব ভোরেই। ঘুম ছেড়ে উঠে ফ্রেশ রাহিকে ওভাবেই ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে যখন বের হলো রুম ছেড়ে তখনই চোখে পড়ল সর্বপ্রথম নিশীথকে। বসার ঘরে সোফায় বসে আছে। দৃষ্টিটা এদিক পানেই আছে। যেন অপেক্ষা করছিল কবে দরজাটা খুলবে। নিশীথের কি ঘুম হয়নি? চোখগুলো এমন হয়ে আছে কেন? মৃধা চাপাশ্বাস ফেলল। নিশীথের দিকে এগোতে এগোতে বলল,

“ রাতে কি ঘুমাসনি? এত ভোরে উঠলি? ”

নিশীথ অন্যদিকে চাইল । বলল,

“ না, রাতে বউ ছাড়া ঘুম হয় না আমার।”

মৃধা হাসল। নিশীথের পাশে সোফায় বসে বলল,

“ তাই নাকি? ”

নিশীথ ভ্রু উঁচিয়ে বলল,

“ মিথ্যে বললে জেগে জেগে মশা মারতাম আমি? নাকি তোকে দেখার অপেক্ষা করতাম? ”

মৃধা চাপা হেসে শুধাল,

“ অথচ বিয়ের প্রথম রাতে কে জানি বলেছিল পাশে সুন্দরী মেয়ে ঘুমালে তার ঘুম আসে না? ”

“ সব দোষ তো তোর। কাছে থাকলেও কেমন কেমন লাগে, দূরে গেলেও কেমন কেমন লাগে।

মৃধার মজা করেই বলল এবারে,

“ আর যদি মরে টরে যাই? কি করবি তখন?”

নিশীথের মেজাজ খারাপ লাগল।আচমকা টানটান চাহনিতে চাইল মৃধার পানে। বলল,

“ আবার বল। ”

“ আমি যদি হুট করে মরে যাই কি করবি.. ”

নিশীথ এবারে হুট করেই টেনে নিল মৃধার কোমড়। আচমকা এক মুহুর্তেই দুজনের দূরত্ব ঘুঁচিয়ে একসাথে পাশে পাশ ঘেষে বসাল। বলল,

“ ঠিক এভাবেই পাশে থাকব। কবরেও পাশে থাকব। কারণ তুইছাড়া আমি বাঁচতে পারব না সুখ। ”

মৃধা ঘাবড়ে গেল। কোমড়ে তখনো নিশীথের শক্ত বাঁধন। বলল,

“ এত জোরে টানলি কেন? ”

নিশীথ গম্ভীর স্বরে বলল,

“ কারণ তোর কথাটা এত জোরেই আমায় আঘাত করেছে। দুর্বলতা পেয়ে আঘাত করতে শিখে গেছিস হুহ?”

কথাটা বলেই মৃধার কোমড় ছেড়ে দিয়ে উঠে গেল রুমে। মৃধা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকল। পা বাড়িয়ে ধীর গতিতে রুমে গিয়ে নিশীথের পেছনে যেতেই দেখল নিশীথ বিছানায় শুঁয়ে আছে। মৃধা বলল,

“ চলে এলি কেন? ”

নিশীথ শুধাল,

“ ঘুম হয়নি রাতে। সকালে এসব আজেবাজে কথা শুনে মাথা খারাপ করার চাইতে ঘুমানোর চেষ্টা করা ভালো নয়?”

মৃধা খাটের কিনারায় বসল। নিশীথের চুলে হাত ডুবিয়ে নরম গলায় বলল,

“ তুই কি রাগ করলি? আমি কথাটা..”

মৃধা কথাটক বলে উঠতে পারল না তার আগেই নিশীথ মৃধার কোমড় পেঁচিয়ে ধরল। দুইহাত দিয়ে শক্ত বাঁধনে মৃধার কোমড় ধরে মুখ গুঁজল মৃধার পেটে। বিড়বিড়য়ে বলল,

“ ঘুমাব। মাথায় হাত বুলিয়ে দে সুখ। ”

মৃধার ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলল,

” বালিশে মাথা রাখ, হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। ”

নিশীথ টানটান স্বরে বলল,

“এভাবেই। তোর কোলেই মাথা রাখব। ”

মৃধা হতাশ হয়ে বলল,

“ তাহলে কোমড় ছাড়। ”

নিশীথ একরোখা। মৃধার বেলাতে আরো একরোখা। বলল

“ ছাড়ব না। এভাবে মানে এভাবেই।”

#চলবে….