#হৃদয়ে_প্রণয়ের_বাস
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_০৬
লেখনীতেঃ রোদসী রঙ্গন
অন্ধকার ছাদে হুট করেই রাহি একলা হয়ে গেল। আকাশে উজ্জ্বল পূর্ণ চাঁদ! যার ধরুন কিছুটা আলো এসে আবছায়ায় আলোকিত রেখেছে ছাদটাকে। রাহি হালকা ঘাবড়ে গিয়ে যখন পিছু ঘুরে মৃধাকে খুঁজতে ব্যস্ত ঠিক তখনই হাতে অনুভব করল টান। রাহি প্রথম দফায় ভয় পেয়ে যায় রাহি। কলিজাটা ভয়ে উড়ু উড়ু করতে করতে যখন বিস্ময় নিয়ে চাইল তখনই চোখে পড়ল আবছায়ায় লিয়নের মুখচ্ছবি। রাহি ভয়ে বুকে থুতু ছেটায়। বলে,
“ আপনি? আপনি এখানে কেন লিয়ন ভাই? এভাবে হাত টান দিয়েছেন কেন? আর ভাবি
ভাবিই বা কোথায়? দেখেছেন ভাবিকে? ”
লিয়ন এসেছিল প্রোপোজ করতে। অথচ বিপরীতে এত এত প্রশ্নে হতাশ হয়ে চোখ ছোটছোট করে চেয়ে থাকল। ঠোঁট চেপে হতাশার শ্বাস টেনে বলল,
“ যাকে দেখতে এসেছি তাকে আগে দেখে নিই রাহি? তারপর নাহয় তোমার ভাবি কোথায় তা দেখব। ”
রাহি অবাক হয়ে তাকাল। বলল,
“ কাকে দেখতে এসেছেন? এই বিল্ডিংয়ে কেউ পরিচিত আছে আপনার? ”
“ হু, আমার প্রাণটাই তো থাকে এই বিল্ডিংয়ে! ”
রাহি অবাক হয়ে শুধাল সঙ্গে সঙ্গে,
“ প্রাণ? আপনার প্রাণ আপনার শরীরে না থেকে বিল্ডিংয়ে থাকবে কি করে লিয়ন ভাই? কিসব আবোল তাবোল বলছেন আপনি?”
লিয়ন চোখ ছোট করে উত্তর দিল,
“ আমরা যাকে ভালোবাসি তাকে প্রাণের অংশই ভাবি তাই না রাহি? ”
রাহি ভাবল। পরমুহুর্তেই কিছু মনে পড়েছে এমন ভাবে বলল,
“ আপ, আপনার বউ এই বিল্ডিংয়েরই? কে সে? কোন ফ্লোরে থাকে লিয়ন ভাই? নাম কি তার? সে কি এখন আসবে এখানে?”
লিয়ন ফের এত প্রশ্নে মুখ কুঁচকায়। বিরক্তি সহিত বলে উঠে,
“ এই মেয়ে চুপ!এত প্রশ্ন করো কেন? এসেছো পর্যন্ত প্রশ্ন করে করে মাথা খেয়ে নিচ্ছো! ”
রাহি আচমকা ধমকে বিস্মিত চোখে চাইল। বলল,
“আপনি আমায় বকলেন লিয়ন ভাই? ”
লিয়ন টানটান স্বরে উত্তর করল,
“ হ্যাঁ, বকলাম! আমি এখানে প্রোপোজ করতে এসেছি, এত এত প্রশ্ন শুনতে না। সো এরপর চুপ থাকবে বাকিটা সময়। ”
রাহির মন খারাপ হলো। একেই প্রিয় মানুষ, অথবা হবু বউয়ের সাথে দেখা করতে ছাদে এসেছে। আবার তার উপর বিরক্ক হয়ে বকলোও? রাহি মন খারাপ স্বরে বলে উঠল,
“ হু? আমি বাসায় ফিরে যাচ্ছি। হাত ছাড়ুন লিয়ন ভাই। আপনি আপনার বউয়ের সাথে একান্ত সময় কাটান, বিরক্ত করব না। ”
কথা টুকু বলেই চলে যেতে নিল হাত ছাড়িয়ে। অথচ লিয়ন ছাড়ল। হাতটা চেপে ধরে টেনে নিল নিজের সাথে। রাহি সামলে উঠতে না পেরে গিয়ে পড়ল লিয়নের বিকের উপর। ফ্যালফ্যাল করে তাকাতেই লিয়ন বাঁকা হাসল। বলল,
“ বউ চলে গেলে বউয়ের সাথে একান্ত সময় কি করে কাটাব? আর আর তাছাড়া বউও তো হওনি এখনো। বউ হবে? তারপর দিনরাত একান্ত সময় কাটাব। একটুও ছাড় দিব না প্রমিজ! ”
রাহি সরে দাঁড়ায় দ্রুত। মুখচোখ কুঁচকে নেয় সঙ্গে সঙ্গেই। ছিঃ! লিয়ন ভাই তাকে এভাবে বলছে? এতোটা নিচে নেমে গেছে? শুধাল,
“ ছিঃ! এতোটা নিচে নেমে গেছেন লিয়ন ভাই? একজনকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে অন্য একজনের সাথে এসব ব্যবহার করছেন? ”
লিয়ন ফাটা বেলুনের মতো মুখ করে বলল,
” একজন-অন্যজন কোথায় থেকে? শুরু থেকেই তো একজনকেই চাইলাম। এখনও পেলাম না। ”
রাহি বুঝে উঠল না। প্রশ্ন ছুড়ল
“ হু? কাকে?”
“ তোমাকে। আমার হয়ে যাও রাহি, কথা দিচ্ছি আজীবন ভালোবাসার কমতি রাখব না। প্লিজ! ”
রাহি অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে থাকল। পরমুহুর্তেই সম্পূর্ণ কথাটাকে লিয়নের মিথ্যে হিসেবে ধরে নিয়ে বলল,
“ অসম্ভব! ”
দৃঢ় স্বরে উত্তর এল,
“ সম্ভব! ”
রাহি তাচ্ছিল্য করে বললেন,
“ ফ্লার্টিং স্কিল এতোটায় উচ্চতায় নিয়ে গেছেন যে নির্দ্বিধায় মিথ্যেও বলছেন। ”
“ মিথ্যে নয় রাহি। আমি সত্যিই… ”
রাহির এই পর্যায়ে অসহ্য লাগল। কান্না পেল। কেন তাকেই মিথ্যে বলতে হবে? কেন তার দুর্বলতায় আঘাত করতে হবে। দাঁতে দাঁত চেপে নিজের হাতটা লিয়নের হাতের বাঁধন থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“ দূরে সরুন, দূরে সরুন বলছি লিয়ন ভাই। একবার কষ্ট সহ্য করে নিয়েছি, নিজেকে শক্ত করে নিয়েছি। এখন আর মিথ্যে মায়া দেখিয়ে ভাঙ্গবেন না আমায়। ”
লিয়নের দুঃখ হলো। নিজের আগের করক ভুলের পরিমাণ বুঝতে পেরে শুকনো স্বরে বলল,
“ এটা সত্যিই রাহি। তোমায় ততটুকু ভালোবাসি যতটু…”
রাহি এবারেও শুনতে পারল না। চোখ টলমল করছে তার৷ কান্না চলে আসছে যেন। চিৎকার করে বলল,
“ চুপ! একদম চুপ! আপনি যে মিথ্যে বলছেন তা আমি জানি লিয়ন ভাই। মিথ্যে বলবেন না। দুর্বলতা জেনে এভাবে আঘাত করবেন না। আমি আমি সহ্য করে নিতে পারব না প্রতিবারের মতো! তাছাড়া যে ভালোবাসা পাঁচবছর আগে তৈরি হলো না, এতগুলো দিনে তৈরি হলো না সে ভালোবাসা পাঁচবছর পর দু তিন বার দেখা হওয়ার পরই তৈরি হয়ে গেল? আমি কি এতোটাই বোকা লিয়ন ভাই? ”
কথাগুলো বলেই রাহি ছুট লাগাল উল্টো ঘুরে। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে তার। কেন জানি না নিজেকে তার পৃথিবীর সবচাইতে অসহ্যকর মানুষটাই লাগছে৷ এক দৌড়ে বাসায় পৌঁছিয়েই সর্বপ্রথম সম্মুখীন হলো মৃধার সাথে। চাপা রাগ নিয়ে বলল,
“ তুমি আমায় বোকা বানালে তাই না ভাবি? সবাই আমায় বোকা বানায়। আমি কি এতোটা বোকা? এতোটা অবহেলিত? তুমি? তুমি আমায় মিথ্যে বললে কেন? ছাদে ছেড়ে এল কেন তুমি? আমি বলেছিলাম তোমায় আমি ছাদে যাব? ”
মৃধা ঘাবড়ে গেল হঠাৎ এতগুলা আক্রমনাত্মক কথা শুনে। শুকনো ঢোক গিলে রাহিকে কাঁদতে দেখে বলল,
“ কাঁদছো কেন রাহি? এদিকে এসো। ভয় পেয়েছো? কাঁদছো কেন? লিও কি খারাপ কিছু বলেছে? ”
কথাগুলো বলতে বলতেই রাহির মাথায় হাত বুলিয়ে জড়িয়ে ধরতে চাইল। অথচ রাহি তা হতে দিল না। আচমকাই দূরে সরে গিয়ে বলে উঠল,
” ওহ! বাহ বাহ! তাহলে সব আগে থেকেই জানতে? প্ল্যানই ছিল ওসব তাই তো? বন্ধুুর সাথে একত্রিত হয়ে আমার এমন একটা সাইটে আঘাত করলে ভাবি যে আমি আজীবন তোমায় খারাপ ভাবব এবার থেকে। আসলে তুমি আমায় ভালোইবাসোনি, কখনো আপনই ভাবলে না ভাবি! ভাবলে কি আর এসব করতে নাকি? ”
মৃধা দুঃখ পেল। বিস্ময় নিয়ে বলল,
“ আমি তোমায় আপন ভাবি না রাহি? ”
“ ভাবলে তো এভাবে নিজের বন্ধুর কাছে রাতের আঁধারে ছেড়ে দিয়ে আসতে না ভাবি! ”
কথাটা বলেই দৌড়ে নিজের রুমে গেল। পিছু পিছু গেল মৃধাও। রাহি কাঁদতেই থাকল। মৃধার মুখের উপর দরজা লাগাতে লাগাতে বলল,
“আমায় একটু একা থাকতে দাও ভাবি। আজকের রাতটা আমি একাই ঘুমাই? ঘুম পাচ্ছে ভীষণ। ধন্যবাদ। ”
মৃধার মুখ চুপসে গেল। লিয়ন কি খারাপ কিছু বলেছে রাহিকে? খারাপ কিছু করেছে? রাহি এমন কেন করল ? মৃধা এসবই ভেবে গেল। গিয়ে বসল বসার ঘরে সোফাটায়। ঠিক তখনই বাইরে থেকে এল নিশীথ৷ গাড়ি আনতে গিয়েছিল এত রাতে। এসে মৃধাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে সামনে গেল। মুখ আগলে ধরে জিজ্ঞেস করল
“ কি হয়েছে? মুড অফ? ”
মৃধা অন্যমনস্ক গলায় বলল,
“ হু? না তো! ”
“ ওহ, বাসায় যাব তো। বাসায় গেলে মন ভালো করে দিব। এখন বল, রাহি কোথায়? গাড়ি নিচে আছে তো। ”
মৃধা হতাশ হয়ে চাইল। নিশীথ যদি জানে তার আদরের বোনটা আজকের দিনেও কাঁদছে কেবল মৃধার জন্য ? কি বলবে? মৃধা শুকনো স্বরে বলল,
“ রাহি? রাহি তো… ”
“ কী? ”
মৃধা টলমল করে চাইল। বলল,
“ নিশীথ? স্যরি, আ’ম স্যরি নিশীথ। আমি, আমি সত্যিই বুঝেই উঠিনি… ”
নিশীথ ভ্রু উঁচাল। বলল,
“ কি বুঝে উঠিস নি? কি হয়েছে বল? ”
মৃধা শুকনো ঢোক গিলে উত্তর করল,
“ রাহি কান্না করছে, আমার জন্য। আজকে এই দিনটাতে ও ওকে কাঁদতে হচ্ছে আমার কারণেই। আমি, আমি খুবই খারাপ নিশীথ। তোর বোনকে কাঁদালাম।রাগ করিস না নিশীথ।”
নিশীথের হাসি পেল। এই মেয়েটাই তাকে পাত্তা দেয় না, একটু থেকে একটুতেই রেগে নাক ফুলায়। আবার কিছু কিছু সময় এমনভাবে বলে যে নিশীথ কে ছাড়া সে সত্যিই কিছু বুঝে না। নিশীথ হাসল। নিজের নাকটা মৃধার নাকে ঘষে বলল,
”উহুম! আপনার উপর রাগ করার প্রশ্নই আসে না ম্যাম। আপনি খুবই ভালো।এবার কি হয়েছে খুলে বলুন আমায়।”
মৃধা সংক্ষেপে বুঝাল সবটা। নিশীথ হাসল। বলল,
“ উহু! রাহি কাঁদছে, কিন্তু এটার পেছনে তুই দায়ি নয় সুখ, লিও দায়ী। ও লিওর উপর রাগ দেখাতে পারেনি তাই হয়তো তোর উপর রাগ দেখিয়েছে। এর জন্য মন খারাপ হলে চলে? এই তুই না ওদের সম্পর্ক জোড়া লাগাবি? কিভাবে? ”
মৃধা টলমল চোখে তাকাল। নিশীথকে ঝাপটে জড়িয়ে বলল,
“ নিশীথ? ”
“ বলুন ম্যাম! ”
মৃধা নিশীথের গলা আঁকড়ে ধরে বলল,
“ আমাকে এত কেন বুঝিস নিশীথ? ”
নিশীথ হাসে। উত্তরে বলে,
“ কারণ ভালোবাসি আপনাকে। না বুঝলে কিভাবেই বা ভালোবাসতাম বলুন? ”
#চলবে…..