হৃদয়ে প্রণয়ের বাস ২ পর্ব-০৮

0
1003

#হৃদয়ে_প্রণয়ের_বাস
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_০৮
লেখনীতেঃ রোদসী রঙ্গন

দীর্ঘ পনেরোদিন যাবৎ লিয়ন রাহির সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা চালিয়েছেে।ফলস্বরূপ ব্যর্থ হয়ে নিজের চুল নিজেই টেনে হিঁচড়ে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে তার। মেয়েটা ইচ্ছে করেই তাকে ভুল বুঝছে। ইচ্ছেই করেই সত্যিটা বুঝতে চাইছে না অথবা হতে পারে না বুঝার ভান করছে। লিয়নের আপসোস হয়। দীর্ঘ এই জীবন একলা একলা কাঁটানোর পর তার হঠাৎই মনে হলো তার জীবনে বউয়ের ভালোবাসার পাওয়ার সময়টুকু বড্ড কমে যাচ্ছে। এবং দোষটা সম্পূর্ণ বোধহয় তারই।সেই যদি রাহিকে আর পাঁচটা বছর আগে সবটা জানাত তাহলে কি এত দেরি হতো রাহিকে বউ বানাতে? লিয়ন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। পরিপাটি হয়ে তৈরি হয়ে অফিসে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হতে নিবেই ঠিক তখনই কল এল। তাও রাহির নাম্বার থেকে। লিয়ন এক সমুদ্র আনন্দ আর আশা নিয়ে কল তুলল। দ্রুত বলল,

“ রাহি? তুমি বুঝতে পেরেছ তো? তাই কল দিয়েছো?”

ওপাশে বসে থাকা রাহি হালকা হাসল এবারে। বলল,

“ আমি কল দিয়েছি অন্য কারণে। আপনি কি আজ একটু সময় দিতে পারবেন লিয়ন ভাই? ঘন্টাখানেক গল্প করবেন? ”

লিয়ন বিস্ময় নিয়ে তাকাল। কাজের ব্যস্ততা আর অফিস থাকা সত্ত্বেও মুহুর্তেই জবাবে বলে উঠল,

“ অবশ্য,অবশ্যই। কোথায় দেখা করবে? রাহি? শুনতে পাচ্ছো? ”

লিয়নের কন্ঠে স্পষ্ট অস্থিরতা! রাহি হালকা হাসে। পরমুহুর্তেই বলে,

“ রিক্সায় করে সেবার আমরা যেখানে গেলাম? সেখানে যাব। নিয়ে যাবেন লিয়ন ভাই? ”

“ কেন নয়? ”

এটুকু কথা বলেই লিয়ন কল রাখল। অফিসে কল করে বলল তার ছুটি লাগবে। অথচ ছুটি পাওয়া গেল না।উল্টে ছুটির জন্য অগ্রিম বলেনি কেন এই নিয়েই বকা খেল সে। লিয়নের মেজাজ চটল। অগত্যা আজ ইচ্ছে করেই অফিসে গেল না সে। ছুটি না দিলে নাই! তার অবশ্যই অবশ্যই প্রিয়তমার সাথে দেখা করতে হবে, বুঝাতে হবে সবটা। এতসব ভাবনা নিয়েই লিয়ন পৌঁছাল সেখানে। অথচ সেখানে পৌঁছেই মাথা দ্বিগুণ চটল। রাহিকে নদীর ধারে কারোর সাথে ফোনে কথা বলতে দেখা গেল। এবং বলতে শোনা গেল, “ আই লাভ ইউ টু। ওকে বাই।হু?”
ব্যস! এই বাক্য দুটো শুনেই লিয়নের সব ভাবনা ফাটা বেলুনের মতো চুপসে এল। রাহির পেছনে গিয়ে দাঁড়াতেই রাহি হাসল। শুধাল,

“ আপনি আমার প্রেমিক হলে এই পাঁচবছরে আমরা বহুবার এখানে আসতাম তাই না লিয়ন ভাই? দুর্ভাগ্য! আপনি তো প্রেমিক হলেন না। ঘোরাও হলো না আপনার সাথে।”

লিয়ন ভ্রু বাকিয়ে বলল,

“ এখন কি অন্য কাউকে প্রেমিক বানিয়ে নিয়েছো নাকি? তাই এখন আর আমাকে ভালোবাসো না? ”

“ না বানালেই কি খুশি হবেন? ”

“ তার মানে সত্যিই কাউকে প্রেমিক বানিয়েছো? তুমি এখন অন্য কারোর প্রেমিকা তাই তো? গুড! আমিই বোকা! আশাই বা করলাম কিভাবে একটা মেয়ে এতবছর আমার জন্য বসে থাকবে। তাও আবার দেশের বাইরে গিয়েও এতবছর থেকে.. ”

রাহি ভ্রু কুুচকে নিল। হালকা রাগী স্বরে শুধাল,

“ দেশের বাইরে থেকেও মানে? দেশের বাইরে থাকলে কি মেয়েরা অবশ্যই ছেলেদের সাথে সম্পর্কে যায় লিয়ন ভাই? ”

লিয়ন নীভু নীভু চাহনি ফেলে বলল,

“ হ্যাঁ, অন্য দেশে এসব নর্মাল রাহি। তাছাড়া ফরেইনার ছেলেরা দেখতেও সুন্দর। তুমি ছেলেগুলোকে দেখে পছন্দ করেই ফেলতে পারো। ”

রাহি নিশ্চুপ! কিছুই বলবে না সে। এসেছিল সবটা মিটিয়ে নিতে। অথচ মিটানো তো দূর সব এলোমেলো হচ্ছেে।লিয়ন ডাকল,

“ রাহি? ”

“ বলুন! ”

বড্ড আক্ষেপ নিয়ে বলল লিয়ন,

“ সত্যিই তুমি কাউকে ভালোবাসো? আমি, আমি সত্যিই তোমায় চাই রাহি। এতগুলা দিন স্বপ্ন বুনছি আমি। এভাবে স্বপ্ন ভেঙ্গে যাবে জানলে আমি আগের মতোই প্রাচীর দিয়ে নিজের অনুভূতি আটকাতাম। আ’ম স্যরি। ”

রাহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর দিল,

“ লিয়ন ভাই? আমার জীবনের প্রথম প্রেম আপনি। এবং তারপর থেকে আর কোন প্রেমানুভূতি নতুন করে আমার হৃদয়ে জম্মায়নি লিয়ন ভাই। আপনি কেন ধরেই নিচ্ছেন যে আমি অন্য কাউকে ভালোবেসে ফেলেছি? ”

লিয়ন হেসে বলল,

“ একটু আগে যা শুনেছি তা নিশ্চয় মিথ্যে হবে না রাহি? ”

রাহি বোধহয় এবারে বুঝতে পারল সবটা। মুহুে্তেই বলল,

“ ও আমার ফ্রেন্ড। অ্যারি! মেয়ে ও। আপনাকে আজ সব অনুভূতি বলে দিব এটাই জানিয়েছি কলে ওকে। এবং শেষে ও আই লাভ ইউ বলাতে ওটা রিপ্লাইতে বলেছি লিয়ন ভাই। ”

লিয়ন মনে মনে আনন্দিত হলো। মিনিট দুয়েক চুপ থেকে বড় বড় শ্বাস ফেলে বলল,

“ শুনে শান্তি পাচ্ছি। ভাগ্যিস! আরেকটু হলেই এ্যাটাক হয়ে যেত রাহি। ”

“ আমি সবটা ব্যাখ্যা দিলাম। অথচ আপনি সমানে ভালোবাসি ভালোবাসি বলেই যাচ্ছেন কিন্তু এখনো কোন ব্যাখ্যাই দিলেন না লিয়ন ভাই। সুন্দর না? ”

লিয়ন তাকাল। বলল,

“ ব্যাখ্যা? হু। ভুলেই বসেছিলাম। রাহি? কষ্টকর হলেও এটা সত্য যে আমার বিয়েটা আমার এক কাজিনের সাথে ঠিক করা ছিল রাহি। আম্মু কষ্ট পেত। আব্বু মারা যাওয়ার পর থেকে মামা অনেকভাবে হেল্প করেছিল আমাদের। তাই মামার বড় মেয়েকে বিয়ে করতে চাই না এটা বলাও কষ্টসাধ্য ছিল।আর যে পথে এগিয়ে তোমায় নিজের করতে পারবই না সে পথে এগোনোর সাহসই বা কি করে করতাম? কি করে তোমায় ভালোবাসি বলতাম? ”

রাহি ভ্রু উঁচিয়ে বলে উঠল,

“ ওহ! তো আপনার সেই মামাতো বোন? এখন কি তার সঙ্গে বিয়েটা ভেঙ্গে গেছে আপনার? ”

“ না, ও পালিয়ে গিয়েছিল আরেকটা ছেলের সাথে। ”

রাহি বাহবা দিয়ে বলল,

“ বাহ! আর যদি না পালাত তখন? তাকেই তো বিয়ে করতেন তাই না? ”

লিয়ন বুঝল রাহি খোঁচা দিয়েই বলল। উত্তর দিল,

“ জানা নেই। ”

“ আপনার মামার আর কোন মেয়ে নেই? ”

“ আছে! ”

“ তাহলে আরকি। সে মেয়েকেই তো বিয়ে করতে পারেন। ”

লিয়নের মেজাজ ক্রমশই খারাপ হলো। উত্তর এল রুক্ষ গলায়,

“ পারলে তো আর তোমার পিছু পিছু ছটতাম না রাহি। ”

রাহি চুপ থাকল। কয়েক মুহুর্ত চুপ থেকে বলল,

“ পারবেন। এতকাল যেহেতু অন্য কাউকে বিয়ে করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন এখনও পারবেন। ধরুন ভবিষ্যৎয়ে আপনার আম্মু অথবা মামা আপনার হাতজোড় করে বলল তার ছোট মেয়েটিকে বিয়ে করতে। তখন তো আপনি না করতে পারবেন না তাই না? শুনুন লিয়ন ভাই? আমি লাইফে অনেক কিছু হারিয়েছি। আবেগের বয়সে আপনার সাথে আবেগ দেখিয়ে আচরণ করেছি। কিন্তু এখন তো বিবেক হয়েছে। আমার মস্তিষ্ক বলছে আপনি ভবিষ্যৎয়ে আমায় ছাড়া ভালো কাঁটিয়ে দিতেই পারবেন। আগের মতো। এমন কি আমার জন্য মনে একটুআধটু ভালোবাসা রেখেও অন্য কারোর সাথে দিব্যি সংসার করতে পারবেন। কোন সন্দেহ নেই!এবং…”

ব্যস আর গুলো বলা হলো না রাহির। তার আগেই ঠোঁটজোড়া দখলে নিল লিয়ন। রাহি চোখ বড়বগ করে তাকিয়ে থাকল। যখন ছাড়া পেল তখন নিশীথের কন্ঠে শুনতে পেল,

“ কতবার বলছি, ভালোবাসি।লাইফে তোকেই চাই, তোকেই । তবুও তোর ভাইয়র ও এক সন্দেহ, তোর ও এক সন্দেহ! ভালোই ভালো বলছি এখন। অথচ সুযোগই দিচ্ছো না তোমরা? যখন খারাপ হবো তখন আপসোস করবে না আর রাহি!”

রাহি চুপ। চোখ টলমল করছে তার। লিয়ন যে আকস্মিক এমন করবে সে ভাবেনি। অনেকটা সময় পর জিজ্ঞেস করল,

“ অনুমতি না নিয়ে এমন করেছেন কেন?”

লিয়ন দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“ মন চেয়েছে তাই। মনের শান্তি মিটাতে।”

“ বাসায় ফিরব। রিক্সা খুঁজো দিন আমায়। ”

লিয়ন বলল,

“ ফিরবে না এখন! ”

“ ফিরব! ”

লিয়ন হাসল এবারে। রাহির হাতের মুঠোয় নিজের হাত গলিয়ে বলল,

” তাহলে চলো বিয়ে করি৷ একেবারে বিয়ে করে তারপর ফিরবে। ”

“ কক্ষোনো না! ”

.

মৃধার কপাল কুঁচকানো। দুপুরের একটু পরপরই বাসায় ফিরেছে নিশীথ। কারণ অবশ্য জানা নেই মৃধার। তবে আজ মৃধার ডক্টরের কাছে যাওয়ার কথা। একটু পর বিকাল হলেই বের হতো সে। বিষয়টা অবশ্য সে নিশীথকে জানায়নি।মৃধা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকতেই নিশীথ বলল,

“ ওভাবে চেয়ে থেকে কি দেখছিস? ”

মৃধা ভ্রু শীথিল করল। বলল,

“ এত তাড়াতাড়ি ফিরলি কেন? কি কাজ? ”

“ কি কাজ? এমনিই এলাম। ”

মৃধা ফের ভ্রু কুঁচকে বলল,

“ মিথ্যে বলছিস? ”

“ একদম না। এমনিই এসেছি। ”

মৃধা মেনে নিল। উত্তর না করে চুপচাপ বসে থাকল অনেকটা সময়। নিশীথ হঠাৎ বলল,

“ বের হবো আমরা। ”

মৃধা ভ্রু কুঁচকে শুধাল সঙ্গে সঙ্গেই,

“ কোথায়? কোথায় যাব? ”

“ বাইরেই! ”

মৃধা নিরস স্বরে বলে উঠল,

“ যাব না, আমি। কাজ আছে। তুই যা। ”

“ কি কাজ এত? ”

” উমম, এমনিই। তুই যা না। আমি না গেলেও তো হবে। ”

নিশীথ সরু চোখে চেয়ে থাকল কিয়ৎক্ষন। পরমুহুর্তেই তাড়া আছে এমন ভেবে ঘড়ি দেখে চুমু দিল মৃধার কপালে। আলতো হেসে বলল,

“আসছি!”

#চলবে…