হৃদয়ে প্রণয়ের বাস ২ পর্ব-১০

0
828

#হৃদয়ে_প্রণয়ের_বাস
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_১০
লেখনীতেঃ রোদসী রঙ্গন

মৃধার পরণে লাল টকটকে একটা শাড়ি। বউ বউ চাহনি যেন। নিশীথ যখন হুড়মুড় করে লিয়ন সহ লিয়নদের বাসায় ডুকছিল ঠিক তখনই চোখে পড়ল তার লাল টুকটুকে বউটাকে।এক দেখাতেই চাহনি থমকে গেল যেন৷ ইচ্ছে হলো কাছে টেনে চুমু দিতে। অথচ তা সম্ভব নয় লোকসম্মুখে। নিশীথ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বোনের বিয়ের কথা বলতে এসে বউয়ের প্রতি প্রেম প্রেম অনুভূতি জেগে উঠাটা এই মুহুর্তে সবচোয়ে দুঃখের বিষয় বোধ হলো তার কাছে। দু পা বাড়িয়ে নিশীথ কোলে তুলল লিয়নের বোনের পিচ্চি ছেলেটাকে। হাত দিয়ে আদর করল নরম গালে। মৃধা তা একধ্যানে দেখল। নিশীথটা বাচ্চা কতোটাই না পছন্দ করে। বাচ্চাদের আশেপাশে থাকলেই হাত টেনে কোলে তুলে, হাস্যোজ্জ্বল দেখায় মুখচাহনি। অথচ তাদের একটা বাচ্চা আসছে না। মৃধার মন খারাপ হয়। এই যে একটু আগেও লিয়নের বোনের শ্বাশুড়ি তাকে জিজ্ঞেস করল ছেলেমেয়ে আছে কিনা, কেন বেবি হচ্ছে না এইসেই। শুনাল উনাদের পরিচিত এক লোকের কথাও যে কিনা প্রথম বিয়েতে বাচ্চা হয়নি বলে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছে।মৃধা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নিশীথের দিকে এগিয়ে যেতেই নিশীথ ফিসফিস স্বরে বলল,

“ কোলে নিবি? বাচ্চাটা কিউট না সুখ? ”

মৃধা হাসল। হাত বাড়িয়ে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিয়ে নিবিরকে বলল সেভাবেই তার আর নিশীথের সাথে বাচ্চাটার একটা ছবি তুলে দিতে। যেন একটা পরিবার.! নিবির যখন ছবিটা তুলে দিয়ে চলে গেল তখনই নিশীথ ফিসফিসি স্বরে ফের বলল,

“ এতোটা সুন্দর দেখাচ্ছে কেন তোমায়? ইচ্ছে হচ্ছে আবার বিয়ে করে নিই৷ ”

মৃধা ভ্রু উঁচিয়ে তাকাল।আবার বিয়ে করার কথাটুকু তার একদমই পছন্দ হলো না যেন। মনে পড়ল একটু আগেই লিয়নের বোনের শ্বাশুড়ির বলা কথাগুলো। ঐ যে শুধু বাচ্চা হয়নি বলেই প্রথম স্ত্রীকে দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন? মৃধা মুখ কালো করল। নিচু স্বরে বলল,

“ আবার বিয়ে করার ইচ্ছে আছে? পাত্রী দেখব নাকি তোর জন্য? ”

নিশীথ বড্ড অসন্তুষ্ট স্বরে বলল,

“ দূরে যা। দুটো রোমান্টিক কথা বলেও তোর কাছে শান্তি নেই। ”

মৃধা কথা অনুসারে দূরেই গেল। দুই হাত দূরে দাঁড়াল।মনযোগ দিয়ে শুনল বড়দের কথোপকোতন। রাহির বিয়ের কথা বলতেই মূলত লিয়নদের বাসাতে আসা তাদের। অথচ লিয়ন আর নিশীথই এতক্ষন হাওয়া ছিল। অবশেষে যখন এল তখনই কথোপকোতন শুরু হলে মূল পর্যায়ে। মৃধার কেমন হাসি পেল লিয়নকে বাধ্যগত ছেলের মতো বসে থাকতে দেখে। পরমুহুর্তেই হাসি চেপে নিল। ভাব দেখাল এমন যেন সে লিয়নের বন্ধু নয় কেবলই রাহির বড়ভাবি।

.

লিয়নের বাসায় সে কথোপকোতন টুকুর পরই মৃধা পুরোটুরি ইগ্নোর করেছে নিশীথকে। এমনকি সে বাসা থেকে রাতের খাওয়া দাওয়া করে বাসায় ফেরার পরও মৃধা একটাও কথা বলল না। নিশীথ খেয়াল করে পুরোটাই। অথচ কিছুই বলে না এতক্ষন। কিন্তু অবশেষে যখন রুমের ভেতর বউকে একা পেল দেখতে পেল মৃধা ব্যাগ গুঁছিয়ে নিচ্ছে। যেন কোথাও যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেে।নিশীথ হতাশ হয়ে তাকায়।দু পা বাড়িয়ে পথ আগলে দাঁড়াল মৃধার সামনে। টানটান স্বরে বলল,

“ ইগ্নোর করছিস আমায়? ”

মৃধা তাকাল। কাজ থামিয়ে। কিয়ৎক্ষন চুপও থাকল। উত্তর দেওয়ার আগেই নিশীথ ফের বলল,

“এতোটা সময়ে আমার দিকে একবার তাকাসনি পর্যন্ত। এই নিরব এড়িয়ে চলার কারণটা কি? ”

মৃধা জানে কারণটা কি। কারণটা সে কিছুক্ষন আগেই উদ্ঘাটন করেছে তাও বান্ধবী হৃদির মাধ্যমে। অথচ নিশীথকে প্রকাশ করল না। বলল,

“ কোন কারণ নেই নিশীথ। ঘুমাব। পথ ছাড়।”

নিশীথ পথ ছাড়ল না। মৃখ আগলে ধরে দৃঢ় চুমু এঁকে বলে,

“ মন খারাপ তোর? ”

“ এমন কেন মনে হলো? ”

নিশীথ নাকে নাক ছোঁয়াল। দুইহাত মৃধাে গালে রেখে নরম গলায় বলল,

“ তোকে খুব সূক্ষ ভাবে পর্যবেক্ষন করি আমি সুখ ”

মৃধা কিয়ৎক্ষন চুপ থাকে। তারপর হঠাৎই বলে,

“ তোর সাথে ডক্টর আয়রার কথা হয়েছে গতকাল। জানতে পারলাম উনার সাথে তোর আগেও কথা হয়েছে। আলাপ আছে। ”

নিশীথের মুখভঙ্গি মুহুর্তেই বদলে এল। বলল,

“ তো? ”

“ উনি একজন গাইনোলোজিস্ট নিশীথ। আমি নিশ্চয় এত বোকা নই যে বাকিটুকু বুঝতে পারব না নিশীথ। ”

“ কি বুঝতে পেরেছিস? ”

“ এই যে আমি মা হতে পারব না এই বিষয়টা তুই আমার থেকে লুকিয়ে যাচ্ছিস। এতোটা দয়া তো আমার উপর না করলেও চলত নিশীথ। ”

“ দয়া? ”

মৃধা তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসল। বলল,

“ তুই জানিস না? ”

“কি করে জানব? তোর সাথে তো আমার দয়ার সম্পর্ক নয় তাই না? ”

মৃধা তাকাল। বলল,

“ তাহলে? ভিক্ষা? আমাকে বউ হিসেবে রেখে সবাইকে বুঝাতে চাচ্ছিস যে তুই কত দয়ালু? আসলে তো মনে মনে তুই নিজেও বাচ্চা চাস নিশীথ। তাহলে এটা দয়া হিসেবে দেখব না আমি? ”

“ একটা বাচ্চা কি এমন প্রয়োজনীয় মৃধা?আমি তো তুই হলেই খুশি কতবার বলব। ”

মৃধা কাঠকাঠ স্বরে বলল,

“ কিন্তু আমি খুশি না। এত বড় একটা সত্য বুঝে উঠার পর থেকে আমি খুশি হতে পারছি না। আমার মনে হচ্ছে আমার একা বেঁচে থাকাটাই সুন্দর নিশীথ। তোর আরেকটা বিয়ে করা উচিত। তোর অধিকার আছে এতে। আর হ্যাঁ, চিন্তা নেই।আমি কাল চলে যাব সকালে। তবে একটা অনুরোধ, আবার বিয়ে করলেও ডিভোর্সটা চাস না নিশীথ প্লিজ। আমি এই পরিচয়টা সবসময় রাখতে চাই। তবে অধিকার চাইব না কখনো, প্রমিজ। ”

নিশীথের রাগ এই পর্যায়ে আকাশ ছুঁয়ে গেল যেন। নাকের অগ্রভাগ দেখাল ভীষণ লালচে। চোয়াল শক্ত। নিশীথ হাত মুঠো করে নেয়। জোরে জোরে শ্বাস ফেলে চোখ বুঝে রাগ নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা চালিয়ে বলল,

“ অতিরিক্ত বকছিস না? আমার কিন্তু হাত কাঁপছে মৃধা। চড় উঠে যাবে৷ ”

মৃধার এই পর্যায় কান্না পেয়ে গেল। টলমলে চোখে কান্না বয়ে পড়তেই ঝাপটে জড়িয়ে ধরল নিশীথকে। ফুঁফিয়ে কেঁদে বলে উঠল,

“ নিশীথ! এমনটা না হলেই তো হতো বল? আমার কত স্বপ্ন ছিল নিশীথ। এমনটা কেন হলে নিশীথ? ”

নিশীথ চোখ বুঝে থাকে। প্রেয়সীর অশ্রু দেখে হৃদয় দহন অনুভব করে রাগ কমল বোধহয় তার কিছুটা। তবুও টানটান গলায় শুধাল,

“একটা বাচ্চা তোর কাছে এতোটা ইম্পোর্টেন্ট? ”

মৃধা তখনও কাঁদছে। আষ্ঠেপৃষ্ঠে নিশীতকে জড়িয়ে আছে৷ কেঁদে নিশীথের বুক ভাসিয়ো বলে উঠল,

“ তোর বাবা হওয়ার স্বপ্ন পূরণটা ইম্পোর্টেন্ট নিশীথ। বাট সেটা যেহেতু আমার মাধ্যমে সম্ভব হচ্ছে না তো অন্য কারোর মাধ্যমে হলেও হোক। ”

ফের একই কথাতে নিশীথ চোয়াল শক্ত করে জবাব দিল,

“ কে বলেছে তোর মাধ্যমে সম্ভব নয়? ”

মৃধা ফ্যালফ্যাল করে তাকায়।যেন আশার আলো আছে এমন ভাবে চেয়ে থেকে মিনমিনে স্বরে জিজ্ঞেস করে,

“ সম্ভব? ”

নিশীথ তাকাল। মুখ আগলে ধরে বলে,

“ সম্ভব হলে কখনো ছেড়ে যাওয়ার কথা বলবি না তো সুখ? কখনে ওসব বিচ্ছিরি কথা মুখে আনবি না তো? ”

অস্পষ্ট স্বরে মৃধা বলে,

“ হ্ হু?”

নিশীথ চুপ থাকে। অনেকটাক্ষন নিরবতার পর হঠাৎই বলে,
“ তোর বাচ্চা চাই তো? ”

” রেগে বলছিস ? ”

“ তুই বল,তোর বাচ্চা চাই তো? বল! ”

মৃধার মন খারাপ হয়। উত্তরে বলে,

“ চাইলে সব পাওয়া যায় না নিশীথ”

“ তুই ভুল টা বুঝে নিয়েছিস সুখ। তোকে কে বলেছে তুই মা হতে পারবি না? তুই চাইলেই পাবি কিন্তু আমি তোকে নিয়ে রিস্ক নিতে চাই না৷ তোকে হারানোর ভয় দেখতে পারি না সুখ। ”

“ হ্ হু? ”

নিশীথ চুমু দেয় কপালে। বলে,

“ তোকে বাচ্চা দিলে আর কখনো ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাববি না তে সুখ? কথা দে। ”

মৃধা বুঝে উঠে না। প্রশ্ন নিয়ে চেয় থাকে। বলে,

” দিবি মানে? আমরা তো এতদিন বেবি নেওয়ার চেষ্টা করেছিই নিশীথ তাই না? তুই,তুই আবারো কিছু লুকোচ্ছিস তাই না? ”

নিশীথ বুঝানোর ন্যায় বলল,

“ এতদিন আমরা চেষ্টা করিনি সুখ।আমি চাইনি তোকে নিয়ে রিস্ক নিতে। ”

“ মানে? ”

“ মানে জানলে কি বাচ্চার জন্য কাঁদবি না আর? ”

মৃধা যেন এতক্ষনে কিছুটা হলেও বুঝল।মুহুর্তেই নিশীথের প্রতি জম্মাল তীব্র রাগ। বলল,

“ কাঁদব। তুই, তুই এতদিন মিথ্যে বললি নিশীথ? কিভাবে পারলি! ”

#চলবে…