হৃদয়ে লাগিল দোলা পর্ব-০৫

0
205

#হৃদয়ে_লাগিল_দোলা 🫶
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব৫ [চড়ুইভাতি স্পেশাল(২)🕊️️]

রিসোর্টে নিজের জন্য বরাদ্দকৃত রুমটাতে এসে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিয়ে, এখন কিছুটা সতেজ লাগছে। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বিছানার দিকে চোখ পড়তেই নজরে এলো রিশতা আর অরনীকে। দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে সুখনিদ্রায় পাড়ি জমিয়েছে ইতোমধ্যে। আমিও আর ওদের বিরক্ত না করে বেলকনির পথে পা বাড়ালাম। এই রিসোর্টে আমাদের জন্য মোট চারটে রুম বুক করা হয়েছে। এখন যে যার রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিচ্ছে। একটুপর দুপুরের লাঞ্চটা সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে, বিকেলের দিকে ঘুরতে বের হবো।

বেলকনিতে এসে এমন শীতল হাওয়ায় আমার মনপ্রাণ জুড়িয়ে যায়। এই বেলকনি থেকে লেকের দিকটা বেশ ভালোভাবে দেখা যায়। হঠাৎ আমার নজর পড়ে শুভ্র রঙের স্যান্ডো গেঞ্জি পরিহিত স্নানরত অবস্থায় এক সুঠাম দেহের সুদর্শন পুরুষটির দিকে! হলদে গাত্রে বিন্দু বিন্দু জমে থাকা জলকণাগুলি যেন তার সৌন্দর্য বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে! পুরুষ মানুষ কি সত্যিই এতো বেশি সুন্দর হয়! তাকে এমন রূপে দেখে আমি যেন এক মুহুর্তের জন্য থমকে গেলাম। সেই সুপুরুষটি আর কেউ নন তিনি স্বয়ং আদ্রিশ ভাইয়া। আমি মনে মনে বললাম, “এই সুপুরুষটি শুধু আমারই হোক। আমার এই কিশোরী মনপ্রাণ জুড়ে তো শুধু তারই অবাধ আনাগোনা। তাঁহাকে এমন রূপে দেখিয়া যে আমার #হৃদয়ে_লাগিল_দোলা।”

-‘ ছিহ্ মেহু, তোর জন্য একটু গোসল করেও আমার শান্তি নেই রে। এই মেয়ে আমার সব ইজ্জত চোখ দিয়ে লুটে নিলো। এখন আমার কি হবে? এরপর তো আমার ইজ্জত নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে।

আদ্রিশ ভাইয়ার কথায় আমার ভাবনার সুঁতোয় টান পড়ে। উক্ত কথাটি তিনি আমার উদ্দেশ্যে ছুড়ে দিলেন। তার এহেন বাক্য চয়নে আমি প্রথমে কিছুটা বোকা বনে গেলাম। হা করে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলাম নিচে দাঁড়িয়ে থাকা আদ্রিশ ভাইয়ার দিকে। পরে বোধগম্য হতেই লজ্জায় আমার মুখশ্রী রক্তিম বর্ণ ধারণ করল। আরও বেশি লজ্জা পেলাম তার সাথে চোখাচোখি হতেই। তিনি যেন কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে দেখছেন আমায়! এই চোখের ভাষা বোঝার মতো ক্ষমতা হয়তো আমার মতো সদ্য এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া কিশোরীর হয়নি! তার বলা কথার পরিপ্রেক্ষিতে কোনো জবাব দেওয়ার আর সাহস হলোনা আমার। আমি মিইয়ে গেলাম। বেলকনিতে আর এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে নিজের রুমে চলে এলাম।

লজ্জায় আমি ঠিক কতক্ষণ নিজের মুখে হাত ঠেকিয়ে বসে ছিলাম তা আমার জানা নেই। ইশ আদ্রিশ ভাইয়া কি ভাবল আমায় নিয়ে? এসব ভাবতেই একরাশ লজ্জারা এসে ঘিরে ফেলল আমায়। মায়ের ডাকে আমার ভাবনাগুলোকে মাটিচাপা দিয়ে দরজা খুলতে যেতে হলো। বুঝলাম মা খাওয়ার জন্য ডাকতে এসেছেন। আমিও আর দেরি না করে রিশতা, অরনীকে ডাকলাম। ওরা ঘুম থেকে উঠে পড়লো। আড়মোড়া ভেঙে ফ্রেশ হয়ে তড়িঘড়ি করে নিচে চলে এলাম।

লেকের ধারে আমাদের খাবারের আয়োজন করা হয়েছে। বাবুর্চিদের রান্না প্রায় শেষের পথে। কি আশ্চর্য সামান্য এক চড়ুইভাতিকে এমন বিরাট খানদানি আয়োজন বানিয়ে ফেলল দেখছি এরা! এটাকে তো তাহলে আর চড়ুইভাতি বলা যায়না, বড়লোকদের বিশাল খানদানি খানাপিনা বলা উচিত! আমার আর বুঝতে একটুও বেগ পেতে হলো না, এসব এলাহি কান্ড কার কারসাজি। চড়ুইভাতি নামে এমন এলাহি কাণ্ড কারখানা একমাত্র আদ্রিশ পাগলা দ্বারাই সম্ভব!

আমরা যে যার মতো একেবারে গোল হয়ে বসে পড়লাম। খাওয়ার মাঝে একবার আদ্রিশ ভাইয়ার সাথে আমার চোখাচোখি হতেই আমি আবারও লজ্জায় কুঁকড়ে গেলাম। ইশ তখন আমি কেন নিজের বেহায়া মনটাকে নিয়ন্ত্রণ করলাম না? আর ঠিকই আদ্রিশ ভাইয়ার শকুনের মতো দৃষ্টির কাছে ধরাও পড়ে গেলাম আমি!

খাওয়া দাওয়ার পর্ব চুকিয়ে আমরা যে যার মতো রুমে গিয়ে বিশ্রাম নিয়ে নিলাম। এরপর বিকেলের দিকে বের হলাম একটু ঘুরাঘুরির জন্য।

আদ্রিশ ভাইয়া আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল

-‘ চল ঐদিকটা থেকে ঘুরে আসি।

আমি কিছু বলার পূর্বেই পাশ থেকে রিশতা মলিন কণ্ঠে বলে উঠল

-‘ শুধু মেহুকেই নিয়ে যাবেন, আমাদের নিবেন না ভাইয়া?

আদ্রিশ ভাইয়া আলতো হেসে বলল

-‘ চল তবে..।

আমরা একটা পার্কে এসেছি ঘুরতে। এই সাইডটাতে যে পার্ক আছে খেয়াল করিনি আমি। আমাদের সাথে আলভি ভাইয়াও এসেছিল, তবে কি একটা কাজের কথা বলে সরে পড়ল।

আদ্রিশ ভাইয়া হুট করে এসে আমায় বলল

-‘ ফুচকা খাবি মেহু?

আমি মাথা নাড়িয়ে সায় জানাই। আমার ফুরফুরে মেজাজটা আরও ফুরফুরে হয়ে গেল। আদ্রিশ ভাইয়া এতো ভালো কেন তুমি? আমি মুখ কোনো কথা বলার আগেই আমার মনের কথা ঠিকি বুঝে ফেলে মানুষটা! আমার সাথে সাথে আদ্রিশ ভাইয়ারও ফুচকা ভীষণ প্রিয়। ছেলে মানুষেরও যে ফুচকা পছন্দ তা আদ্রিশ ভাইয়াকে না দেখলে হয়তো জানতামই না।

এক, দুই, তিন,…., এই নিয়ে গুনে গুনে দশ প্লেট ফুচকা খেয়েছি। আর এটা শুধু ফুচকা নয়, এর মধ্যে লঙ্কা কুচি, গুড়ো মেশানো ছিল। ঝালে আমার চোখমুখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে ইতোমধ্যে। আদ্রিশ ভাইয়া দ্রুত পানি নিয়ে এসে আমার দিকে এগিয়ে দেয়। আমি এক নিঃশ্বাসে ঢকঢক করে পানি গিললাম। উফফ এবার যেন একটু স্বস্তি পাওয়া গেল।

আদ্রিশ ভাইয়া গম্ভীর কণ্ঠে বলল

-‘ একটু দেখেশুনে খেতে পারিস না মেহু? জানিস যে খুব বেশি ঝাল সহ্য হয়না তোর। তাও কেন এতো ঝাল খেতে গেলি, বল তো?

আমি কোনোরকম নাক টেনে আলতো হেসে বললাম

-‘ এটাই তো ফুচকা খাওয়ার আসল মজা।

আদ্রিশ ভাইয়া অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল

-‘ মজা না ছাঁই! গায়ে পায়েই বড় হয়েছিস শুধু। বুদ্ধি জ্ঞান এখনো হয়নি কিছু। আমি কি সবসময় তোর সাথে থাকবো?

আদ্রিশ ভাইয়ার কথা শুনে আমি ফিক করে হেসে ফেললাম। পাশে থাকা অরনী আর রিশতাও হেসে ফেলল। তবে আমার এই হাসি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না আর।

হঠাৎ পেছন থেকে এক অজ্ঞাত পরিচয়ের মেয়ে এসে আদ্রিশ ভাইয়াকে ডাক দেয়। সে পেছন ফিরে মেয়েটাকে দেখতেই অধরের কোণে হাসি ফুটিয়ে উচ্ছাসের সহিত বলে উঠল

-‘ আরে তুমি এখানে? এতোক্ষণে আসার সময় হলো তবে?

মেয়েটা হালকা হেসে আদ্রিশ ভাইয়ার পাশে এসে দাঁড়ায়। আমি ভ্রু কুচকে তাকালাম মেয়েটার দিকে। মেয়েটা যথেষ্ট সুন্দরী, তার বেশভুষাও বেশ ভালো। তাকে দেখে বেশ ভালো পরিবারেরই মেয়ে বলে মনে হচ্ছে। তবে মেয়েটাকে আদ্রিশ ভাইয়ার পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমার ভেতরটা কেমন মোচর দিয়ে উঠল। আমি আদ্রিশ ভাইয়ার পাশে কাওকেই সহ্য করতে পারিনা।

আদ্রিশ ভাইয়া একগাল হেসে আমাদের সাথে মেয়েটার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল

-‘ এই যে কাজিন সিস্টারস্, আমার পাশে এখন যে মেয়েটাকে তোরা দেখছিস, এই মেয়েটা কিন্তু তোদের ভাবি হয়, বুঝলি? পছন্দ হয়েছে তো তোদের ভাবিকে?

আদ্রিশ ভাইয়ার থেকে এমন কথা শুনতে হবে তা আমি কস্মিনকালেও কল্পনা করিনি। আমার নিজের অজান্তেই চোখ ছাপিয়ে অশ্রু গরিয়ে পড়ছে। আমার এতোক্ষণের আনন্দ সব বন্যায় পরিণত হলো! আমি অশ্রু সিক্ত নয়নে চেয়ে রইলাম আমার আদ্রিশ ভাইয়ার দিকে। আমার আদ্রিশ ভাইয়া আর আমার রইল না। সে তবে সত্যিই অন্য কারো হয়ে গেল? এতোদিন আমার জন্যে যা যা করতো সব মিথ্যে, সব অভিনয় ছিল, তার মানে!

হুট করে আদ্রিশ হতে এমন কথা শুনে রিশতা আর অরনীও বোকা বনে যায়। ওরা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল আদ্রিশের দিকে।

আমি সেখানে আর এক মুহূর্তও দাঁড়িয়ে না থেকে ছুটে চলে গেলাম। আমার এতোদিনের সব স্বপ্ন সব ভেঙে একেবারে চুরমার করে দিল আদ্রিশ ভাইয়া।

মেহরুনের চলে যাওয়ার পানে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল আদ্রিশ। মনে মনে সে আওড়াল, “মেহু, হঠাৎ এমনভাবে চলে গেল কেন? ওর কি পছন্দ হয়নি ওর ভাবিকে?”

#চলবে ~