হৃদয়ে লাগিল দোলা পর্ব-১৬+১৭

0
285

#হৃদয়ে_লাগিল_দোলা 🫶
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব১৬

ছাঁদের মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে, পুরো কাজিনমহল মিলে একত্রে গোল হয়ে বসে গল্প করছি। সময়টা এখন সন্ধ্যা সাতটা ছুঁই ছুঁই। ধরনীর বুকে সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসার পর পরই আমরা সবাই মিলো ছাঁদে চলে এলাম আড্ডা দেওয়ার জন্যে। ছাঁদে আসতেই এক শীতল হাওয়া এসে যেন শরীরে দোলা দিয়ে যায়। আকাশে আজ তারা নক্ষত্রের ছিটেফোঁটাও যেন নজরে আসছে না! ঘন কালো মেঘে ছেয়ে আছে আকাশটা। হয়তো একটুপর বৃষ্টি হতে পারে আবার নাও হতে পারে! যা গরম পড়েছে তাতে করে একটু বৃষ্টি হলে কিন্তু খুব একটা মন্দ হতো না! তবে সারাদিন কাঠপোড়া গরম পড়লেও সন্ধ্যের পর থেকে ঠান্ডা হাওয়া বইতে শুরু করেছে। আমরাও আর তাই দেরি না করে চলে এলাম। এমন ফুরফুরে আমেজে গল্পের আসর জমে একেবারে ক্ষীর হয়ে যাবে!

আমরা সবাই এখানে উপস্থিত থাকলেও আদ্রিশ ভাইয়ার কোনো দেখা নেই। আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে বারবার আমার অবাধ্য দুই নয়ন শুধু আদ্রিশ ভাইয়াকেই খুঁজে চলেছে। কিন্তু তার দেখা আমার আর নজরে এলো না। রাগ করে তাই আহিরের পাশে গিয়ে বসে পড়লাম আমি। আমায় দেখে আহির সূক্ষ্ম হাসল। আমিও বিনিময়ে শুধু হাসলাম। এটা নতুন নয়। আমি, রিশতা, আহির আমরা সমবয়সী হওয়ায় ছোটবেলা থেকেই এভাবেই মিশি। আমার কাজিনদের মধ্যে আহির এবং রিশতার সাথে আমার বন্ডিংটা অনেক বেশি জোরালো বলা চলে।

রিশতা, অরিন আপু আর সাবা আপু আড্ডা ভালোই জমিয়ে ফেলেছে। আমিও তাদের সাথে আড্ডায় যোগ দিলাম। আড্ডার এক ফাঁকে খেয়াল করলাম অরনী ফোন হাতে নিয়ে উঠে চলে গেছে। আমার কৌতুহলী মনে সন্দেহের উদ্রেক জন্মায়। আমিও তাই ওর পিছু নিলাম।

ছাঁদের এককোণে চলে এলো অরনী। আমিও আড়ালে দাঁড়িয়ে রইলাম, যাতে আমায় দেখা না যায়। এদিক ওদিক চোরা চোখে দেখে নিয়ে এবার ফোন কানে দিয়ে সতর্কমিশ্রিত স্বরে অরনী বলল

-‘ হ্যালো আরাভ! এখন একটু ব্যস্ত আছি আমি। পরে ফোন দেই তোমাকে।

লাউড স্পিকারে না থাকায়, অপর প্রান্ত হতে কি বলল, তা আর শুনতে পেলাম না আমি। অরনী আবারও আশেপাশে তাকিয়ে কন্ঠ কিছুটা খাদে নামিয়ে নিয়ে বলল

-‘ জান, আমিও তোমায় ভীষণ ভালোবাসি তবে তোমার সাথে আমার পক্ষে এখন দেখা করা পসিবল না। মামারা কিংবা ভাইরা কোনমতে দেখে ফেললে আমাকে মাটিতে পুঁতে ফেলবে।

-‘….

-‘ আরাভ, তুমি কেন বুঝতে চাইছো না? আচ্ছা শোনো, আমি তোমার সাথে এখন আর কোনো কথা বলতে চাইছি না! রাখি তাহলে। সাবধানে থেকো।

এটুকু বলেই ফোনটা কেটে দিল অরনী। আমি হতভম্ব বনে গেলাম। কথাগুলো শুনে আমার আর বুঝতে বাকি রইল না যে, ‘আরাভ’ নামের ঐ ছেলেটা অরনীর বয়ফ্রেন্ড। আজকাল অরনীর মতো মেয়েরাও প্রেম করে তাহলে? কিন্তু ও সুযোগ পেল কিভাবে? আমি বা রিশতা কেউ তো জানিনা এই ব্যাপারে। ওকে দেখলে সত্যিই বোঝার জো নেই, ও এমন। আমার ধারণামতে, যারা প্রেম করে তারা খারাপ হয়। যদিও এটা হয়তো পুরোপুরি সত্য নয়, তবে বেশিরভাগই ভালো না।

হঠাৎ পেছন থেকে আমার কাঁধে হাত রাখল কেউ। আমি চমকে পেছনে ফিরে রিশতাকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। এই মেয়েটা হুটহাট পেছন থেকে এসে আমায় ভয় পাইয়ে দেয়। বিচ্ছু একটা!

রিশতা আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলল

-‘ কি করছিস এখানে দাঁড়িয়ে? আড্ডার মাঝখান থেকে ওভাবে চলে এলি যে?

আমি নির্বিকার দাঁড়িয়ে রইলাম। এই মুহুর্তে কি রিশতাকে বলাটা ঠিক হবে, অরনী সম্মন্ধে? আমায় চুপ থাকতে দেখে রিশতা আমার হাত ঝাকিয়ে বলল

-‘ কি হলো উত্তর দিচ্ছিস না কেন?

রিশতার কথায় সংবিৎ ফিরে এলো আমার। অরনীকে এদিকে আসতে দেখে রিশতা কিছুটা চেঁচিয়ে বলে উঠল

-‘ কিরে তুই এখানে কি করছিস অরু?

অরনী আমাকে আর রিশতাকে এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভুত দেখার মতো চমকে ওঠে। আমতা আমতা করে বলে উঠল

-‘ তোরা দুটো এখানে কি করছিস?

-‘ সেটা তো আমারও প্রশ্ন তুই কি করছিস এখানে?

আমার কথায় অরনী অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। কানের পিঠে চুল গুঁজে মিথ্যে হাসির অভিনয় করে বলল

-‘ ঐ আমার এক ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছিলাম আরকি!

আমি কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ ফেলে সন্দিহান চিত্তে বললাম

-‘ শুধুই কি বন্ধু নাকি অন্যকিছু?

অরনী আমার হাত ধরে ফেলে। এদিক ওদিক সতর্কতামিশ্রিত চাহনিতে তাকিয়ে আকুতি ভরা কন্ঠে বলল

-‘ মেহরুন, বোন আমার। কাউকে কিচ্ছুটি বলিস না এ ব্যাপারে। বিশেষ করে মামারা যেন কেউ জানতে না পারে। জানলে হয়তো আমায় মেরেই ফেলবে রে।

আমি আশস্ত করলাম অরনীকে। এতে যেন অরনী কিছুটা স্বস্তি ফিরে পায়। ওর চোখমুখ চিকচিক করে ওঠে। আমার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে উৎফুল্লতার সহিত বলে উঠল

-‘ জানিস, আরাভ ছেলেটা না ভীষণ অমায়িক একটা ছেলে। ওর সাথে আমার প্রায় দুই মাসের প্রেম। ওকে আমি সত্যিই অনেক বেশি ভালোবাসি রে। ওকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না।

অরনীর এমন লুতুপুতু টাইপ কথাবার্তা শুনে আমি বিরক্তই হলাম কিছুটা। এমনিতেই আমি এসবের ধারেকাছেও যাইনা, আর আমার না এসব পছন্দ। তাই বিরক্ত হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমি ভাই বিয়ের পর প্রেমের পক্ষপাতী কিন্তু বিয়ের আগে এসব ছাইপাঁশে না। অরনীর কথা শুনে রিশতা মাথায় হাত দিয়ে হতাশ কন্ঠে বলল

-‘ ভাই, সবার-ই প্রেম ভালোবাসা হয়ে যাচ্ছে। ইভেন, অরনীর মতো ঢেপশীটাও প্রেমে মজেছে। আর এদিকে আমার আর প্রেম টেম হবে না বোধহয় এ জন্মে! হায় ম্যা মার যাওয়া!

কথাটা বলেই রিশতা মরা কান্না জুড়ে দিল। ওর এমন প্যানপ্যানানি শুনে আমি বিরক্ত হলাম কিছুটা। ওকে তাই ধমক দিয়ে আমি বলে উঠলাম

-‘ থাম তুই! এমন একটা ভাব ধরেছে যে মনে হচ্ছে আমিও প্রেম করে একেবারে দুনিয়া উল্টে ফেলছি। তোর দলে আমিও রয়েছি। তাই বলে এমন মরা কান্না কাঁদিনি কখনো।

রিশতা এবার কিছুটা রাগ দেখিয়ে বলল

-‘ তুই তো মোটেও কথা বলবি না। তুই কি প্রেম করবি, তোর তো আগের থেকেই বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। তোর তো তাও আদ্রিশ ভাইয়া আছে আর আমার তো কেউ নেই। যেদিকে তাকাই সেদিকেই শুধু আন্ধার আর আন্ধার। কোনো পোলা আমার দিকে ফিরেও তাকায় না। শালার পোড়া কপালে একটা কাজিনও জুটল না! মাঝে মধ্যে তো কচু গাছে ঝুলে পড়তে মন চায় আমার।

রিশতাকে এমন হা হুতাশ করতে দেখে আমি, অরনী দুজনেই হেসে ফেললাম। পরক্ষণেই আমার হাসি মিলিয়ে গেল। আমি কিছুটা রাগ নিয়ে বললাম

-‘ একদিন না বলেছি, আমার সাথে ঐ নিরামিষ ঢেড়ষটাকে জড়িয়ে কোনো কথা বলবি না। তারপরও কেন?

রিশতা নাকের পানি মুছে থমথমে গলায় বলল

-‘ নাটক কম কর, তোমরা লাইলি মজনু যে একে অপরকে ছাড়া থাকতে পারো না, তা আমি জানি। ইভেন প্রায় সবাই জানে, তোমরা একে অপরকে ভীষন রকমের ভালোবাসো। কিন্তু ভাব দেখিয়ে কেউ কাউকে কিছু বলছো না। মানে সিরিয়াসলি তোদের ভাব দেখে আর বাঁচি না বাপু!

কথায় কথা বাড়ে, তাই আমি আর কথা না বাড়িয়ে চলে এলাম। ওরাও আমার পেছন পেছন চলে এলো।

আমি আসতেই সবার মাঝ থেকে আহির শব্দ করে বলে উঠল

-‘ আরে সুইট লেডি যে! কোথায় ছিলে এতোক্ষণ? তোমায় ছাড়া আড্ডায় মন বসে না যে আমার।

আহিরের কথায় সবাই সম্মতি জানায়। ইতোমধ্যে সেখানে আদ্রিশ ভাইয়া এসেও উপস্থিত হয়েছে। আহিরের দিকে সে ভ্রু কুটি করে তাকিয়ে রয়েছে।

আমি আলতো হেসে আহিরের পাশে গিয়ে বসলাম। তারপর ওর দিকে ফিরে মিষ্টি করে বললাম

-‘ এই তো আমি এসে গিয়েছি। নাও স্ট্রাট।

আদ্রিশ ভাইয়ার দিকে নজর পড়তেই আমি এক গাল হাসলাম। ওনার অবস্থা দেখে আমার ভীষণ হাসি পাচ্ছে। আমায় ইশারা করে আহিরের থেকে দূরে সরে বসতে বলল। কিন্তু আমি বুঝেও না বোঝার ভান ধরলাম। আর আহির-ও না সেই। একদম আমার মনের মতো। ওকে আমি কোণ আইসক্রিম ট্রিট দিব!

আদ্রিশ ভাইয়াকে দেখিয়ে দেখিয়ে আমি আহিরের মাথার চুলগুলো ঠিক করে দিতে দিতে আদুরে কন্ঠে বললাম

-‘ ইশ এতো সুন্দর চুলগুলোকে কেউ এমন এলোমেলো করে রাখে নাকি? ঠিক মতো চুল আছড়াতে পারিস না?

আমার কথায় চমৎকার করে হাসল ছেলেটা। আমার চুল টেনে দিয়ে বলল

-‘ আপনি থাকতে কি আর আমার চুল আছড়ানোর কোনো প্রয়োজন আছে ম্যাম?

আহিরের কথায় আমি আলতো হেসে লজ্জা পাওয়ার ভান করলাম।

আদ্রিশ ভাইয়ার দিকে নজর পড়তেই দেখলাম বেচারা শুটকি মাছ একেবারে ফুলে ফেঁপে বোয়াল মাছ হয়ে গেছে। আমার দিকে সে এখন অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। যেন তার চোখ থেকে আগ্নেয়গিরির ফুলকি ঝরছে! কুমড়ো পটাশটা ছাঁদের দরজায় শব্দ করে বাড়ি মেরে গটগট করে নিজের কক্ষে চলে যায়। এ ব্যাটা ভাঙবে তবুও মচকাবে না। থাকো তুমি তোমার ইগো নিয়ে। আমার তো লাল টুকটুকে আহির আছে। অতঃপর আদ্রিশ ভাইয়া চলে যেতেই আমি আর আহির অট্টহাসিতে ফেটে পড়লাম।🧛🏻‍♀️

#চলবে~

#হৃদয়ে_লাগিল_দোলা 🫶
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব১৭

কাজিনদের সাথে আড্ডা দিতে দিতে রাত প্রায় দুইটা বেজে গিয়েছিল। বেশ অনেকটা রাত হয়ে যাওয়ায় আমরা কোনরকম খাওয়া দাওয়া সেরে, যে যার মতো কক্ষে এসে শুয়ে পড়েছিলাম। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই রাজ্যের ঘুম এসে ভর করেছিল নেত্রপল্লবে। সকালে ঘুম ভাঙল রিশতার হাঁকাহাঁকিতে। আড়মোড়া ভেঙে তাই আলসে ভঙ্গিতে বলে উঠলাম

-‘ কি রে, এতো সকালে এমন ষাড়ের মতো চেঁচাচ্ছিস কেন?

কোমড়ে হাত দিয়ে মৃদু চিৎকার করে রিশতা বলল

-‘ ক’টা বাজে খেয়াল আছে কোনো? মামিমা এসে তোকে ডেকে গেছে কতবার! আজ না আমাদের “ভুতের আড্ডায়” যাওয়ার কথা ছিল। তোর জন্যে আর যাওয়া হলো না আমার।

আমার কর্ণকুহরে রিশতার কথা ঠেকতে তড়িঘড়ি করে উঠে বসলাম আমি। দেয়াল ঘড়ির দিকে নজর পড়তেই দেখতে পেলাম, ঘড়িতে এখন বেলা বারোটা বাজতে চলেছে। এই রে আজ তো সব কাজিনরা মিলে “ভুতের আড্ডায়” যাওয়ার কথা ছিল, আমি তো বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম!

আক্ষেপের সুরে রিশতা আবারও বলে উঠল

-‘ তুই আর আদ্রিশ ভাইয়া, দুইটাই যে এক গোয়ালের গরু, খালি খালি বলি না আমি। তুইও আজ এমন ভোস-ভোস করে ঘুমিয়েছিস। আর আদ্রিশ ভাইয়ার তো এখনও দরজা খোলার-ই কোন নাম গন্ধ নেই।

রিশতার কথায় আমার কপালে আপনাআপনিই কিঞ্চিৎ ভাঁজ চলে এলো। গতকাল আমাকে আর আহিরকে একসাথে দেখে সেই যে ঘরে গিয়ে দোর দিয়েছে, তারপর আর তার ছায়াও নজরে পড়েনি আমার। বেচারার জন্যে খারাপ লাগছে ভীষণ! এমন করতে তো আমার নিজেরই ভালো লাগছে না। পরক্ষণেই আবার চোয়াল শক্ত করে নিজেকে শান্ত করলাম। আমি আমার সিদ্ধান্তেই অটল রইলাম। ব্যাটা মুখ ফুটে যতদিন না কিছু বলছে, ততদিন আমি এমনই করব বলে মনে মনে পণ করলাম।

-‘ কি রে চুপ করে আছিস কেন? তোদের জন্য তো আমার ঘুরতে যাওয়াটাই ভেস্তে গেল।

করুন সুরে এতোটুকু বলে থামল রিশতা। আমি সরু চোখে ওর দিকে একবার চেয়ে বললাম

-‘ অন্যান্যরা সবাই গেছে?

-‘ তো কি ওরা বসে থাকবে আমাদের জন্য?

-‘ তা তুই গেলি না কেন?

-‘ তোকে ফেলে আমি আর অরনী কিভাবে যাই, বল তো? তোর খালাতো ভাই আহিরও তো যায়নি, তুই যাসনি বলে। শুধু আলভি ভাইয়াই গিয়েছে ওদের সাথে।

আমি আর কোন কথা না বলে হাই তুলতে তুলতে ওয়াশরুমে চলে গেলাম ফ্রেশ হতে। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখলাম, রিশতা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে গুনগুনিয়ে গান গাইছে আর স্নো পাউডারের বক্সটা হাতে নিয়ে পুরো গালে ঘষা মাজা করছে। বুঝলাম না ওর হঠাৎ এমন শুভ্র পেত্নি সাজার কি কারণ!

আমি ভ্রু কুচকে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম

-‘ কি ব্যাপার এমন ধলা বাঁদরের মতো সাজচ্ছিস যে?

রিশতা পেছন ফিরে আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে একটা হাসি দিয়ে বলল

-‘ দ্যাখ, দ্যাখ, আমাকে অনেক বেশি সুন্দর লাগছে তাই না? আমায় দেখলে তো চোখই ফেরাতে পারবে না ও। আচ্ছা তুই শাড়ি পরাতে পারিস, মেহু?

-‘ আমি নিজেই তো শাড়ি পরতে জানি না। তোকে কি পরাবো?

-‘ আচ্ছা যাক গে, বাদ দে। শাড়ি পরতে পারি না তা তে কি হয়েছে? আমারও কি বুদ্ধি কম নাকি! একটা স্কার্টের উপর একটা সর্ট গেঞ্জি আর তার উপর একটা ওড়না শাড়ির মতো করে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে পরব। এই তো ব্যাস হয়ে গেল আমার ঐতিহাসিক শাড়ি পরা! কি বুদ্ধি আমার তাই না বল?

রিশতার কথা শুনে আমি তাজ্জব বনে গেলাম। বাহ কি চমৎকার বুদ্ধি, নাইস! যে শাড়ি পরার ট্রাডিশন চালু করেছিল, সে জানতে পারলে নির্ঘাত মরার পর আবার নতুন করে পটল তুলে বসত! মনে মনে কথাটা ভেবে আমি আনমনেই হেসে ফেললাম। রিশতা এবার আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে বলল

-‘ শোন না আমার না একজনকে খুব ভাল লাগে! কি সুন্দর যে দেখতে। প্রথম দেখাতেই ওকে আমার ভীষণভাবে মনে ধরেছে। প্লিজ মেহু তুই কিছু একটা কর না।

আমি কিছুক্ষণ রিশতার দিকে হা করে তাকিয়ে রইলাম। এই মেয়ে না গতকাল রাতেই মরা কান্না জুড়ে দিয়েছিল ওকে কেউ পাত্তা দেয় না বলে। আর আজ কিনা সে-ই এসব কথা বলছে। আমায় হা করে এভাবে চেয়ে থাকতে দেখে রিশতা আবারও বলল

-‘ কি হলো এমন হাবার মতো হা করে চেয়ে আছিস কেন? তুই একটু আমায় হেল্প কর না মেহু!

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম

-‘ তোকে বলে কেউ পাত্তা দেয়না? তা তোর মতো শুভ্র পেত্নিকে আবার কোন মামদোবাবাজি পাত্তা দিল?

-‘ হেয়ালি ছাড় মেহু, আমি সিরিয়াসলি বলছি। আমার একজনকে ভালো লেগেছে তাই আমার এমন সাঁজ!

-‘ তোর আবার কাকে ভালো লাগল শুনি?

রিশতা এবার লজ্জা মাখা এক হাসি দিয়ে লাজুক কন্ঠে বলল

-‘ কেন তোর খালাতো ভাই আহিরকে! ছেলেটা এত্তো ভালো কি বলব। ওর সাথে তো আজ সকালে খানিক সময় ব্যাপী কথা হলো। আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল এই ঠাডা পড়া গরম নিয়ে। এ থেকেই ছেলেটার কথার প্রেমে পড়ে গেলাম আমি।

কথা বলতে বলতেই রিশতা লজ্জায় দিল এক লাফ। আমি হতভম্ব বনে গেলাম ওর এহেন কথাবার্তা আর কর্মকান্ড দেখে। এ মুহুর্তে ঠিক কি রিয়াকশন দেওয়া উচিত তা বোধগম্য হলো না আমার। একটা মানুষ গরম নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে কিভাবে প্রেমে যায় রে ভাই? ও ভাই মারো মুঝে মারো! আমি মাথায় হাত দিয়ে তাই হা হুতাশ করে বলে উঠলাম

-‘ এই গরমে, মানুষের গরম নিয়ে আলোচনা করতে গিয়েও প্রেম হয়ে যাচ্ছে। আর আমি কিনা সেওরা গাছে ঝুলে রয়েছি এখনো! এমন চলতে থাকলে তো আমার লটকে যেতে দুদিনও সময় লাগবেনা!

আমার কথা শুনে ফিচালো হেসে রিশতা বলল

-‘ আরে এ নিয়ে চিন্তা করতে হবে না তোর। আমি আছি না ইয়ার? সো নো চিন্তা ডু ফুর্তি! তুই শুধু আমার আর আহিরের সেটিংটা করিয়ে দে। তারপর তোরটা আমি আর অরনী দেখে নিব।

আমি অবাকের উপর অবাক হচ্ছি। এ কোন পাগলের পাল্লায় পড়লাম আমি! অগত্যা রিশতার পাগলের প্রলাপ না শুনে আমি বেরিয়ে এলাম। ড্রয়িং রুমে যেতেই দেখলাম সোফার উপরে পা ভাঁজ করে, মোবাইল হাতে নিয়ে বসে আছে আহির। আমি আহিরের পাশে বসতে বসতে হাসিমাখা মুখে বলে উঠলাম

-‘ বাসায় বসে বসে মোবাইল চালাতে বোর লাগছে না আহির? শুধু শুধু ঘুরতে যাওয়া মিস দিলি কেন, বল তো?

আমার কথায় মোবাইলটা রেখে, পূর্ণ দৃষ্টিতে ফিরে তাকায় আমার দিকে আহির। অধরের কোণে মুচকি হাসির রেখা ঝুলিয়ে শান্ত স্বরে বলল

-‘ তোকে ছাড়া কোথাও যেতেও ভাল লাগে না মেহুবুড়ি। আর তাছাড়া আমি গেলে তোর খারাপ লাগতো। এজন্যই যাইনি।

আমি হালকা হেসে বললাম

-‘ তাই বুঝি?

আহির মাথা চুলে ফিক করে হেসে ফেলল।

কি নিয়ে যেন রিশতা এক প্রকার হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতে লাগল আমার কাছে। কিন্তু বিপত্তি ঘটল, ছুটে আসতে গিয়ে পায়ের সাথে ওড়না জড়িয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যায় রিশতা। দুম করে শব্দ হতেই আমি গিয়ে দ্রুত ধরে ফেলি রিশতাকে। আর এ দিকে আহির বেচারা হাসি চেপে রাখতে না পেরে হো হো করে হেসে ফেলে বলে উঠল

-‘ আরে মিস চিংড়ি মাছ, তোমার এতো বেশি গরম লেগে গিয়েছিল যে এভাবে লাফালাফি করতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলে?

আহিরের কথায় লজ্জায়, অপমানে রিশতা যেদিক দিয়ে এসেছিল সেদিক দিয়ে আবার দৌড়ে চলে যায়। যেতে গিয়ে আবারও এক দফা শুকনো মাটিতে আছাড় খেল ও। কোথায় গেল তার ঐতিহাসিক শাড়ি! সব খুলে এখন মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে। পড়নে শুধু রয়েছে তার ঐতিহাসিক স্কার্ট আর গেঞ্জি।

আমি এবার নিজেও হাসি চেপে রাখতে পারলাম না। আহিরের পাশে গিয়ে বসে হে হে করে হেসে উঠলাম আমি। আমি আর আহির দুজনে হাতে হাত মিলিয়ে হেসেই চলেছি এক নাগারে। আমাদের হাসির তোড়ে পুরো ড্রয়িং রুম কেঁপে উঠল বোধহয়। কিন্তু আমাদের হাসি কিছুতেই থামছে না যেন।

এমন সময় আদ্রিশ ভাইয়ার আগমন ঘটল। সরু চোখে আমাদের একবার পরোখ করে নিয়ে, ডাইনিং টেবিলের উপর থাকা পাউরুটি মুখে পুড়তে পুড়তে আবার চলে যেতে নিয়ে কি মনে করে যেন আবার থেমে যায় সে। ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে ফিরে থমথমে গলায় বলে উঠল

-‘ মেহরুন, একবার আমার ঘরে আয় তো। তোর সাথে আমার কিছু হিসেব বাকি পড়ে রয়েছে।

কথাটা বলে আর এক মুহূর্তও দেরি না করে গটগট পায়ে নিজের ঘরে চলে যায় আদ্রিশ ভাইয়া। আমি পরপর কয়েকটা শুকনো ঢোক গিললাম। থমথমে গলায় বললেও তিনি যে বেজায় চটে আছেন, তা বুঝতে আমার একটুও বেগ পেতে হলো না।

আহির আমার হাত চেপে ভয়ার্ত গলায় বলে উঠল

-‘ আদ্রিশ ভাই হয়তো তোর উপর বেজায় চটে আছে রে মেহু। তুই শিগগিরই যা। নয়তো আমাদের পিঠের উপর তাল পড়তে বেশি সময় লাগবে না রে। আর তাছাড়া আমি এতো দ্রুত পটোল তুলতে চাইছিনা। আমার এখনও বিয়ে করা বাকি। এই বয়সে ওমন রামধোলাই খেলে শেষমেশ আমার কপালে আর বউ বাচ্চা জুটবে না রে বইন।

আমি মাথায় হাত দিয়ে থম মেরে আগের জায়গাতেই বসে রইলাম। মনে মনে শতবার আওড়ালাম, “আমার মতো যেন আর কারো কপালে এমন ঠেরষ মার্কা আদ্রিশ ভাইয়া না জোটে।”

#চলবে ~