#হৃদয়ে_লাগিল_দোলা 🫶
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব২২
নিকষ কালো রাত্রির পর পৃথিবীর বুকেতে ঘটেছে আলোর সঞ্চার! অন্তরীক্ষে এখন আর মেঘমেলার দেখা নেই। সারারাত বৃষ্টির পর স্বচ্ছ অন্তরীক্ষে সূর্যের উজ্জ্বল কিরণ ঠিকরে পড়ছে যেন এখন! জানালার কাঁচ ভেদ করে এক ফালি রোদ্দুর এসে আছড়ে পড়ল আমার মুখশ্রীতে। ফলশ্রুতিতে আমার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটল। আড়মোড়া ভেঙে তাই পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালাম আমি। জ্বর বোধহয় কমেছে খানিকটা। তবে শরীরের অসার ভাবটা যায়নি এখনো। তবুও কষ্ট করে একটু উঠে, বালিশে হেলান দিয়ে বসলাম। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে! তাই চোখ বুঁজে রইলাম খানিক সময়।
-‘ উঠে পড়েছিস মেহু! কেমন লাগছে এখন? কাল সারারাত তোর যা জ্বর ছিল, আমরা তো ঘুমাতেই পারিনি তোর চিন্তায়!
রিনরিনে গলায় কথাগুলো বলতে বলতে স্যুপের বাটি হাতে নিয়ে আমার কক্ষে প্রবেশ করল রিশতা। আমি একবার চাইলাম রিশতার পানে। তবে কিছু বললাম না। মনটা হুট করেই কেমন বিষন্নতায় ছেয়ে গেল আমার। সত্যি বলতে কি রিশতাকে এ মুহুর্তে আশা করিনি আমি। রিশতা এগিয়ে এসে বেড সাইড টেবিলে স্যুপের বাটিটা রেখে, আমি দিকে ফিরে কপালে হাত ঠেকাল। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে রিশতা বলল
-‘ যাক বাবা, অবশেষে তোর জ্বরটা তো কমেছে। রাতে অনেক বেশি জ্বর ছিল তোর।
আমার মাথা থেকে রিশতার হাতটা সরিয়ে দিয়ে, উদাস গলায় ওর উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলাম
-‘ আদ্রিশ ভাইয়া কোথায়? ওনাকে কোথাও দেখছি না যে।
আমার পাশে বসে এক চামচ স্যুপ উঠিয়ে ফুঁ দিতে দিতে তাড়া দিয়ে রিশতা বলে উঠল
-‘ জলদি জলদি স্যুপটা খেয়ে নে তো। এরপরে তোকে আবার ওষুধ খাওয়াতে হবে।
রিশতা সম্পূর্ণরূপে আমার প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়েছে বলে আমার কিছুটা রাগই হয়। জেদ ধরে তাই চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম
-‘ আমি এখন খাবনা। আগে আমি যা জিজ্ঞেস করেছি তার জবাব চাই, তারপরে খাব আমি।
রিশতা বিরক্ত হয়ে পড়ে। চোখমুখ কুচকে ফেলে বলল
-‘ মেহু এতো জেদ করিস না তো। যাওয়ার আগে আদ্রিশ ভাইয়া আমায় বলে গিয়েছে, তোকে তাড়াতাড়ি খাইয়ে দিতে।
আমি বিচলিত হয়ে বললাম
-‘ কোথায় গিয়েছে ভাইয়া? আমায় একবার দেখতেও এলোনা যে!
শেষোক্ত কথাটা বলার সময় বারবার আমার গলা ধরে আসছিল কেমন। আমি অসুস্থ তবুও একটা বার খোঁজ খবরও নিতে এলো না? আমি কোনোভাবে অসুস্থ হলে তো সে পাগলপ্রায় হয়ে পড়ত, অথচ আজ তার দেখা নেই! ব্যাপারটা আমায় ভাবাচ্ছে খুব।
তপ্ত শ্বাস ফেলে রিশতা বলল
-‘ তোর ওষুধ শেষ হয়ে গেছে তাই আদ্রিশ ভাইয়া আনতে গেছে সেগুলো। এখন আর কোনো কথা নয়, চুপচাপ খেয়ে নে তো।
না খেয়ে আমি আগের মতো নির্বিকার বসে রইলাম। আদ্রিশ ভাইয়ার কথা উঠতেই রিশতা এড়িয়ে যাচ্ছে কেন বারবার? আজকে রিশতার আচরণটা সুবিধার ঠেকছে না। আর তাছাড়াও ও একবারও আমার চোখে চোখ রেখে কথা বলছে না, অথচ ও সবসময় আমার চোখের দিকে তাকিয়েই কথা বলত! কিছু সময় অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পর নিরবতা ভেঙে থমথমে গলায় বললাম
-‘ একটা সত্যি কথা বল তো রিশু। কিছু কি হয়েছে? আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে তুই কিছু লুকাতে চাইছিস আমার থেকে!
থতমত খেয়ে যায় রিশতা। আমতা আমতা করে বলল
-‘ মেহু, তোকে সব পরে বলব না হয়। এখন প্লিজ এমন করিস না। আদ্রিশ ভাইয়ার যে বারণ..।
এতোটুকু বলতে বলতে থেমে যায় রিশতা। মুখ ফঁসকে সে কি বলে ফেলেছে!
আপনাআপনিই আমার কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ চলে এলো। ওর হাত ধরে আশ্বাস দিয়ে বললাম
-‘ কি নিষেধ করেছে বল আমায়। তুই যে আমায় বলেছিস তা কখনো জানবে না আদ্রিশ ভাইয়া। এটুকু বিশ্বাস রাখতে পারিস আমার প্রতি।
-‘ সব বলব তোকে। তার আগে খাবারটা তো খেয়ে নে।
-‘ তুই না বলা অবধি আমি কিছুতেই খাব না। আই থিংক আমার জেদ সম্পর্কে ভালোই ধারণা আছে তোর?
বাঁকা হেসে রিশতার দিকে তাকাই আমি। রিশতা ফোঁস করে একটা শ্বাস ছেড়ে বলতে থাকে। গতরাতের সব কথাই বলে দেয় রিশতা।
সব শুনে চোখ বুঁজে হেলান দিয়ে বসে রইলাম আমি। একটা মানুষ এতোকিছু নিজের মাঝে চেপে রাখতে পারে কিভাবে? আদ্রিশ ভাইয়ার জায়গায় আমি হলে তো কান্নাকাটি জুড়ে দিতাম। অথচ তিনি কি নিদারুণ অভিনেতা! এমন একটা ভান ধরবে যেন কিছুই হয়নি।
আমায় চোখ বন্ধ করে থাকতে দেখে রিশতা বিচলিত হয়ে বলল
-‘ মেহু, তোর কি শরীর খারাপ লাগছে আবার? এজন্যই আদ্রিশ ভাইয়া আমায় বারবার করে নিষেধ করছিল তোকে বলতে।
পুনরায় চোখ মেলে ভারী গলায় বললাম
-‘ কিছু হয়নি আমার। শুধু ভাবছি একটা মানুষ এমন হয় কিভাবে? কোন ধাতু দিয়ে আসলে তৈরি আদ্রিশ ভাইয়া, বল তো?
রিশতা আমার একটা হাত ধরে অনুনয়ের সুরে বলল
-‘ তোর কাছে আমার একটা অনুরোধ, আদ্রিশ ভাইয়াকে কষ্ট দিস না কখনো। ভাইয়া তোকে নিজের চাইতেও বেশি ভালোবাসে মেহু।
আমি মলিন হাসলাম। আমার অজান্তেই চোখ থেকে কখন বারিরূপ ধারা নেমেছে তা জানা নেই আমার। মেয়ে মানুষের এই এক সুবিধে, কিছু হলেই তারা কেঁদে বুক ভাসাতে পারে! অথচ পুরুষ জাতি হাজার আঘাত পেয়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেলেও তাদের কাঁদতে মানা! এর চাইতে বড় কষ্ট আর কি হতে পারে!
.
-‘ তুই এখনো খাসনি মেহু? আমি আসলে কিন্তু খবর আছে তোর!
গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠস্বরে উক্ত কথাটি আমার কর্ণকুহুরে ঠেকতেই আমার ভাবনার ছেদ ঘটে। আমি চকিত ফিরে চাইলাম সেদিক পানে। দরজার ধারে হেলান দিয়ে থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছে আদ্রিশ ভাইয়া। তাকে দেখে মনটা ফুরফুরে হয়ে গেলেও পরক্ষণে তা আবার মিলিয়ে যায়। তার চোখমুখ কেমন রক্তিম বর্ণ ধারণ করে আছে! দেখলে বোঝা যাচ্ছে রাতে সে ঘুমায়নি, মুখটাও কেমন শুকনো শুকনো লাগছে তার মানে সে হয়তো এখনো খায়নি। তাকে এমনভাবে দেখে বুকটা ধক করে ওঠে আমার! আরও রিশতার কাছ থেকে সবটা জেনে আবারও খারাপ লাগতে শুরু করে আমার।
-‘ হা করে দেখছিস কি? আমায় দেখার সময় পরেও পাবি। এখন আগে খেয়ে তো নে, এরপরে স্যুপ ঠান্ডা হয়ে গেলে খাবি কিভাবে?
আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে উক্ত কথাটি বলে ওঠে আদ্রিশ ভাইয়া। আমি ইশারায় সরে যেতে বলি রিশতাকে। রিশতাও বাধ্য মেয়ের ন্যায় সরে পড়ে। আদ্রিশ ভাইয়া এসে ধপ করে বসে পড়ে আমার পাশে। সে নিজেকে স্বাভাবিক রাখলেও তাকে ঠিক লাগছে না আমার।
স্যুপের বাটিটা হাতে নিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল
-‘ আর কতোদিন এমন বাচ্চা থাকবি মেহু? সবসময় এভাবে খাইয়ে দেওয়ার জন্য কি আমি থাকবো?
আদ্রিশ ভাইয়া হয়তো স্বাভাবিক ভাবেই কথাটা বলেছে তবে আমার বুকে তা তীরের মতো বিঁধেছে। মনের সাথে সাথে আমার মুখটাও ভার হয়ে যায়। চোখটা আবারও ছলছল করে উঠল আমার। আদ্রিশ ভাইয়া হয়তো বুঝেছে, তাই হালকা হেসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
-‘ আরে কুল কুল! আমি ম’রে যাওয়ার কথা বলছি না। বোঝাতে চাইছি যে এরপর পড়াশোনার জন্য আমার মতো যদি হোস্টেলে থাকতে হয় তখন তোকে খাইয়ে দিবে কে? তখন তো তোর নিজের কাজ নিজেরই করতে হবে। অন্য কেউ তো আর করে দিয়ে যাবেনা।
আমি আর কোনো কথা বললাম না। হুট করে আদ্রিশ ভাইয়ার কাছ থেকে স্যুপের বাটিটা কেড়ে নিলাম আমি। আচমকা এমন হওয়াতে, হা হয়ে যায় আদ্রিশ ভাইয়া। এই সুযোগে আদ্রিশ ভাইয়াকে স্যুপ খাইয়ে দিলাম আমি। হতভম্ব হয়ে যায় আমার এহেন কর্মকাণ্ডে আদ্রিশ ভাইয়া। ঠোঁট চেপে হাসলাম আমি। রিশতাও খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। আদ্রিশ ভাইয়া হঠাৎ বিষম খেয়ে যায়। রিশতা দ্রুত পানি ঢেলে দেয়। আদ্রিশ ভাইয়া পানি পান করে নিল। তবুও তার কাশি থামছে না। আমি হাত বুলিয়ে দিলাম আদ্রিশ ভাইয়ার পিঠে। তারপর কিছুটা শান্ত হয় আদ্রিশ ভাইয়া। থম মেরে বসে রইল কিছুক্ষণ। নিরবতা ভেঙে থমথমে গলায় সে বলল
-‘ এসবের মানে কি মেহু? স্যুপটা তোর জন্য, আমার জন্য নয়। তু..।
আদ্রিশ ভাইয়ার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে আমি বললাম
-‘ কাল রাত থেকে কিছু খাওনি তুমি। এমন চলতে থাকলে তো অসুস্থ হয়ে পড়বে ভাইয়া। সবসময় আমার খেয়াল রাখলে চলবে, নিজেরও তো খেয়াল রাখতে হবে।
চোখ ছোট ছোট করে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল আদ্রিশ ভাইয়া। গাম্ভীর্যতা বজায় রেখে বলল
-‘ তুই কিভাবে জানলি?
-‘ কোনো কিছুই আমার অজানা নয়, ভাইয়া। আমি সবই জানি। আর কতো কষ্ট লুকিয়ে রাখবে নিজের মাঝে? সুখের সাথে সাথে নিজের দুঃখগুলোও শেয়ার করো, এতে তোমার দুঃখ কমবে বইকি বাড়বে না।
আদ্রিশ ভাইয়া থম মেরে বসে রইল। তার মুখে রা টিও নেই। আমি পুনরায় বললাম
-‘ আমি জানি তুমি চাচ্চুর উপর রাগ করে রাতে খাওনি। রাগ করো না নিজের বাবার প্রতি। ভালো হোক বা খারাপ, তিনি তো তোমার বাবা হোন।
-‘ তাই বলে উনি জোর করে সবকিছু চাপিয়ে দিবেন আমার উপর? আমার স্বপ্ন আমি ডাক্তার হবো। সে প্রথম থেকেই আমার লক্ষ্যে বাঁধা দিয়েছে। তিনি কখনো চাননি যে ডাক্তার হই আমি, সে শুধু নিজের কাজে ব্যবহার করতে চেয়েছিল আমায়। আম্মু আর ছোট চাচ্চু না থাকলে হয়তো আমার স্বপ্ন পূরণই হতো না। কাল রাতে তিনি আমায় দোষারোপ করে বলেছেন, তার ব্যবসায় ক্ষতি হয়েছে নাকি আমার জন্যে, আমিই তার ব্যবসার হাল ধরিনি বলে এমনটা হয়েছে।
এলোমেলো ভাবে এতোটুকু কথা বলে থামল আদ্রিশ ভাইয়া। রাগে এখনো ফুঁসছে সে। পরপর কয়েকটা লম্বা শ্বাস টেনে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে সে।
আমি ইশারায় রিশতাকে বললাম আমার জন্যে আরেক বাটি স্যুপ আনতে। ও চলে যায়।
আদ্রিশ ভাইয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে শান্ত করলাম তাকে। এরপর স্যুপের বাকিটুকু খাইয়ে দিলাম। বাধ্য ছেলের মতো খেয়ে নিল সে। খাওয়া শেষ হতেই আচমকা সে আমায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। তার এহেন কান্ডে আমি হতভম্ব বনে যাই। কিছুক্ষণ পর আমায় ছেড়ে ছিটকে দূরে সরে যায় আদ্রিশ ভাইয়া। মেঝের দিকে তাকিয়ে করুণ সুরে একনাগারে বলে ফেলল
-‘ আ’ম সো সরি। আমি ইচ্ছে করে করিনি এসব। আমি আসলে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি তখন। আই সয়ার, আমি আর এমন ভুল করব না। আ’ম এক্সট্রেইমলি সরি ফর দ্যাট।
কথাটা বলেই টলমলে পায়ে চলে যায় সে। আমি হা করে চেয়ে রইলাম তার যাওয়ার পানে। আমি কি স্বপ্ন দেখছিলাম এতোক্ষণ নাকি সবটাই বাস্তব ছিল!
#চলবে ~
#হৃদয়ে_লাগিল_দোলা 🫶
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব২৩
সকালের নাস্তা সেরে চোখ বুঁজে কপালে এক হাত ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে বিছানায় শুয়ে রইলাম খানিক সময়। পূর্বের তুলনায় এখন কিছুটা স্বস্তি বোধ করছি। এমন সময় মাথায় কারো শীতল স্পর্শে চোখ মেলে তাকালাম সেদিক পানে। মা অশ্রু সিক্ত নয়নে তাকিয়ে রয়েছেন আমার পানে, সাথে আলভি ভাইয়া আর আহিরও আছে।
আমার কাজিনদের বিদায়ের পর মা, আলভি ভাইয়া আর আহির গিয়েছিল আমার নানাবাড়িতে, অসুস্থ বৃদ্ধা নানীকে দেখতে। আমাকেও সঙ্গে নিতে চেয়েছিল তবে আমার ভালো লাগছিল না বিধায় আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি আমার। ওরাও আর তখন জোড়াজুড়ি করেনি আমায়। মা যাওয়ার আগে মামনিকে বলে গিয়েছিলেন আমার খেয়াল রাখতে। ফিরতে বেশ খানিক সময় লাগবে তাদের। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পরপরই আকাশ ভেঙে নেমে আসে বৃষ্টির বারিধারা। সারারাত মুষলধারে বৃষ্টির দরুন তাদের পক্ষে আর সেই রাতে রওয়ানা দেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে মামনির কাছ থেকে আমার অসুস্থতার খবর পেতেই হন্তদন্ত হয়ে ভোরের দিকেই রওয়ানা দেয় তারা। রাতের দিকে নাকি বাবা এসে আমার মাথার কাছে বসেছিল। যদিও তখন আমি ঘুমিয়েছিলাম। পরবর্তীতে রিশতার কাছ থেকে জানতে পারি সেসব।
আলভি ভাইয়া আমার দিকে এগিয়ে এসে উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করল
-‘ এখন কেমন আছিস বোন?
আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম, ‘আগের চাইতে কিছুটা ভালো।’
আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে মা বিচলিত হয়ে বললেন
-‘ হ্যাঁ রে মা, জ্বর এলো কিভাবে তোর? আলভি, আমি আর আহির একটু তোর নানাবাড়ি গিয়েছিলাম। আর সেখানে পৌছাতে না পৌছাতে শুনলাম, তোর নাকি জ্বর এসেছে। সারারাত তোর চিন্তায় ঘুমোতে অবধি পারিনি। মুহুর্তে মুহুর্তে ভাবির কাছে ফোন দিয়ে তোর খোঁজ খবর নিয়েছি।
এতোটুকু বলে থামলেন মা। দেখে বোঝা যাচ্ছে, গতরাতে ঘুম হয়নি মায়ের। মাকে এমন উদ্বিগ্ন হতে দেখে আমি শান্ত গলায় বললাম
-‘ মা শুধু শুধু এতো চিন্তা করো না তো আমার জন্য। আমি এখন ঠিক আছি তো।
-‘ তোর চিন্তায় আমার ঘুম হয়না আর তুই বলছিস চিন্তা না করতে। যখন মা হবি তখন বুঝবি, সন্তানের জন্যে মায়েদের চিন্তার কোনো শেষ নেই।
আমি আর কিছু বললাম না, মায়ের দিকে চেয়ে নির্বিকার বসে রইলাম।
-‘ তোমার মেয়ে জ্বর বাধিয়েছে কিভাবে শুনবে না, মামিমা?
থমথমে গলায় উক্ত কথাটি বলতে বলতে কক্ষে প্রবেশ করল অরনী। মা ফিরে তাকালেন ওর দিকে। আমি চোখের ইশারায় নিষেধ করলাম বলতে। তবুও আমাকে গুরুত্ব না দিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেলে অরনী বলল
-‘ জানে যে, বৃষ্টিতে ভিজলেই ওর জ্বর আসে। তবুও গিয়ে ওনার বৃষ্টিতে ভেজা চাই। ওর আর রিশতার পাল্লায় পড়ে আমারও ভিজতে হয়েছে। এখন আমার মাথা ধরেছে ভীষণ। মেহরুনের মতো আমার না আবার জ্বর চলে আসে, মামিমা!
অরনীর কথার বিপরীতে আমি প্রতিবাদের সহিত বললাম
-‘ এই আমি বা রিশুর কেউ কিন্তু তোকে বৃষ্টিতে ভিজতে বলিনি। তুই-ই তো নিজ থেকে আগ বাড়িয়ে এসে আমাদের সাথে যোগ দিয়েছিলি।
-‘ সে যাইহোক। আমরা কেউ তো আর তোর মতো জ্বরে পরিনি। তুই বৃষ্টিতে ভিজে তুই জ্বর বাধিয়েছিস, এটা তোর দোষ।
অরনীর কথার পিঠে আবারও কোনো কথা বলার জন্য উদ্যত হতেই, আমায় থামিয়ে দিয়ে ধমক দিয়ে মা বললেন
-‘ চুপ, আর কোনো ঝগড়া আমি শুনতে চাই না।
মায়ের ধমক খেয়ে চুপসে গেলাম আমরা। মা এবার আমার দিকে ফিরে মৃদু স্বরে কিছুটা চেঁচিয়ে বললেন
-‘ বাড়ির থেকে একদিন একটু বেরিয়েছি আর ওমনি শুরু হয়ে গেল বাঁদরের বাঁদরামি! কত করে বলেছি, বৃষ্টিতে ভিজবি না কিন্তু কে শোনে কার কথা। আল্লাহ আমার মেয়েটারে একটু সুবুদ্ধি দাও!
মায়ের সাথে সহমত পোষণ করে অরনী বলল
-‘ হ্যাঁ মামিমা ঠিকই বলেছ। রাতে না ঘুমিয়ে ওকে জ্বরপট্টি দিয়ে দিলাম, সকালের স্যুপটাও আমি বানিয়ে দিলাম। আর এতোকিছুর পর ও কেমন করছে আমার সাথে! দেখেছো মামিমা!
কাঁদো কাঁদো মুখ করে উক্ত কথাটা বলে ফেলল অরনী।আমি চোখ গরম করে তাকালাম ওর দিকে। মেয়েটা ইচ্ছে করে মায়ের কাছে নালিশ দিচ্ছে আমার নামে। বিচ্ছু একটা। ওকে শুধু একবার আমার বাগে পাই, তারপর দেখাচ্ছি ‘কত ধানে কত চাল!’
মা এবার প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বিচলিত হয়ে বললেন
-‘ বড় ভাবি কোথায় অরু? ওনাকে দেখছি না যে! যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিলাম আমার মেয়েটার একটু খেয়াল রাখতে, আর উনি? সেই তো বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাঁধাল মেয়েটা আমার। একদিন একটু সংসার ছেড়ে বাপের বাড়ি গিয়েছিলাম আর ওমনি শুরু হয়ে গেল। মানে আমি না থাকলে একটা না একটা অঘটন ঘটতেই হবে! এদের নিয়ে আর সত্যিই পারিনা বাপু!
কথাগুলো বলতে বলতেই আমার ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন মা। মায়ের পিছু পিছু অরনীও চলে যায়।
আলভি ভাইয়া আমার সাথে বেশ কিছু সময় কথাবার্তা বলে সেও বেরিয়ে পড়ল নিজের কাজে। দুদিন পর আলভি ভাইয়ার পরীক্ষা! পড়াশোনা বাদ দিয়ে ভবঘুরে হয়ে বেড়ানো, এটা কিন্তু মোটেও কাম্য নয়।
ঘরের মধ্যে এখন শুধু পড়ে রইল আহির। এতোক্ষণ যাবত নিরব দর্শকের ভুমিকা পালন করলেও এবার মুখ খুলল সে। আমার পাশে এসে বসে আহির বলল
-‘ এখন কেমন বোধ করছিস মেহুবুড়ি? নানাবাড়িতে দুদিন থাকব ভেবেছিলাম। কিন্তু তুই অসুস্থ শুনে আমিও চলে এলাম খালামণির সাথে!
-‘ আগের চাইতে বেটার। আচ্ছা শোন, নানিআপু কেমন আছে এখন?
তপ্ত শ্বাস ফেলে আহির বলল
-‘ ঐ আগের মতোই রে। বৃদ্ধ মানুষ, এই সুস্থ এই অসুস্থ!
আহিরের কথাটা শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আমার। শৈশবের স্মৃতি গুলো মনে পড়ে ভীষণ। আমাদের কাছে ডিসেম্বর মানেই ছিল আনন্দের একটা মাস। স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষা শেষে আমরা সবাই মিলে বেরাতে যেতাম নানাবাড়িতে। আমরা খালাতো মামাতো ভাইবোনেরা হৈ-হুল্লোড়ে মেতে উঠতাম আর তাতে নানাভাইও যোগ দিতেন। শীতের দিনে রান্নাঘরে বসে নানিআপু হাসিমুখে আমাদের জন্যে শীতের সুস্বাদু পিঠা বানাতেন! আর এখন সেসবই স্মৃতি! নানাভাই মারা গেলেন বছর খানিক হতে চলল। আর নানিআপু এখন শয্যাসায়ী। নানিআপুর মতো মামিমাও অবশ্য এই রেওয়াজটা ধরে রেখেছেন কিন্তু নানিআপুর মতো তো আর হয়না।
আহিরের ডাকে পুরোনো স্মৃতি থেকে বেরিয়ে এলাম আমি। আহির পুনরায় ডেকে উঠে বলল
-‘ কি রে কি এতো ভাবছিস মেহুবুড়ি?
হালকা হেসে মাথা নাড়ালাম আমি।
অনেকক্ষণ যাবত বিছানায় শুয়ে থাকায় বিরক্ত হয়ে পড়লাম আমি। আবার ওয়াশরুমেও যাওয়া প্রয়োজন।এজন্য কিছুটা বল প্রয়োগ করে তাই বিছানা থেকে উঠতে নিলেই আবারও ধপ করে বসে পড়লাম আমি। জ্বর সেরে গেলেও মাথা ঝিমঝিম ভাবটা মেলায়নি এখনো। এজন্যই এমনটা হয়েছে। আমায় এভাবে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়তে দেখে আহির বিচলিত হয়ে বলল
-‘ এনি প্রবলেম মেহরুন? তোর সমস্যা হলে, তুই আমার সাহায্য নিতে পারিস।
আমি মাথা নাড়ালাম। বলে ফেললাম
-‘ আমি একাই পারব আহির। ঐ একটু মাথাটা চক্কর দিচ্ছিল আরকি।
আহিরকে বলতে বলতে এবার উঠে দাঁড়ালাম আমি। কয়েক কদম পা ফেলতেই আবারও মাথাটা ঘুরে উঠল আমার। পড়ে যেতে নিলেই খপ করে আমার হাতটা ধরে ফেলল আহির। উদ্বিগ্ন হয়ে বলল
-‘ তুই ঠিক আছিস তো মেহরুন?
আমি নিজেকে সামলে নিয়ে কিছু বলতে যাওয়ার পূর্বেই কোথ থেকে আদ্রিশ ভাইয়া ছুটে এসে গম্ভীর গলায় বলল
-‘ শোনো আহির তুমি আমার ছোট ভাইয়ের মতো। তাই তোমাকে আমি যথেষ্ট স্নেহ করি। তবে এমন কিছু করো না যাতে আমি রেগে যেতে বাধ্য হই।
আদ্রিশ ভাইয়ার এহেন বাক্যে আমি আহির দুজনেই হতভম্ব বনে যাই। আদ্রিশ ভাইয়া এবার কিছুটা ধমকের সুরে আহিরকে বলল
-‘ হাতটা ছাড়ো মেহরুনের। নেক্সট টাইম আমার সম্পদের দিকে হাত বাড়ালে, তোমার কিন্তু খবর আছে আহির!
আদ্রিশ ভাইয়ার কথায় আহির দ্রুত হাতটা ছেড়ে দেয় আমার। আহির কিছু বলতে যাওয়ার পূর্বেই আদ্রিশ ভাইয়া ওকে থামিয়ে দিয়ে আমার উদ্দেশ্যে থমথমে গলায় বলে উঠল
-‘ ছোট থেকে কোলে পিঠে মানুষ করেছি কি এসব দেখার জন্য? খবরদার বলছি, এই আহিরকে যেন তোর আশেপাশেও না দেখি আমি। এর অন্যথায় হলে কিন্তু আমার চাইতে খারাপ আর কেউ হবেনা!
এতটুকু বলেই যেপথ দিয়ে এসেছিল সেপথেই আবার গটগট করে চলে যায় আদ্রিশ ভাইয়া। তার কথার ভাঁজে স্পষ্ট রাগের আঁচ পাওয়া যায়! তবে আচমকা ওনার এমন আচরণে আমি আর আহির দুজনেই একে অপরের দিকে হা হয়ে চেয়ে রইলাম কিছুক্ষণ।
#চলবে~