#হৃদয়ে_লাগিল_দোলা 🫶
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব২৮ [মেহেন্দি স্পেশাল]
আমায় ঘিরে গোল হয়ে বসে রয়েছে সবাই। আর আমি দুহাত ভর্তি করে মেহেদি মেখে সঙ সেজে বসে আছি। আজ যে আমার মেহেন্দি অনুষ্ঠান! সেই সুবাদেই নামকরা মেহেদী আর্টিস্টদের মিলনমেলা বসেছে যেন আমাদের ‘খান মহলে’। বুঝতে আর বাকি নেই এসবই আদ্রিশের কারসাজি! ইতোমধ্যে আমার পুরো কাজিন মহল এসে হাজির হয়েছে। এই বাড়ির একমাত্র মেয়ের সাথে বাড়ির বড় ছেলের বিয়ে বলে কথা, তারা না এলে কি চলে! শুরু থেকেই আমায় আর আদ্রিশকে নিয়ে গুঞ্জন ছিল তবে আজ তা সত্যি সত্যিই বাস্তবে রূপান্তরিত হতে চলেছে! আর তাই আমার উপস্থিত কাজিনগণও নানাভাবে আমায় টিপ্পনী কেটে ঠাট্টা মশকরা করতে শুরু করে দিয়েছে, সেই সাথে উপরি পাওনা স্বরূপ যোগ দিয়েছে রিশতা আর অরনীও!
ওদের এমন টিটকারিতে লজ্জা পাওয়ার বদলে আমার রাগ হচ্ছে ভীষণ! আর এই রাগটা আরও একদফা চড়াও হয়ে বসল আদ্রিশ ভাইয়াকে দেখতেই। হাসি হাসি বদনে এগিয়ে এলো সে আমার পানে। এদিকে আমার হাতে মেহেদী দেওয়ারত মেয়েটা বিনয়ের সহিত আমার উদ্দেশ্যে বলে উঠল
-‘ ম্যাম, এখানে আপনার আর আপনার উডবি হাসবেন্ডের নাম দিবো?
আমি কিছু বলার পূর্বেই আদ্রিশ এসে অকপটে বলে দিল
-‘ হ্যাঁ সিওর! কেন নয়? তবে হ্যাঁ মেহরুন, আদ্রিশ আলাদা ভাবে না লিখে একটু ইউনিক, লাইক ❝মেহাদ্রিশ❞ এভাবে দিলে ভালো হবে।
আদ্রিশের কথামতো মেয়েটা তা-ই করল। আমি সরু চোখে ফিরে চাইলাম তার পানে। বিনিময়ে সে মুচকি হাসল শুধু। উনি চলে যেতেই ফোঁস করে একটা শ্বাস ছাড়লাম আমি।
..
সেদিন,
আদ্রিশ ভাইয়া আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো মামনির কক্ষে। সেখানে মা আর মামনি দুজনে বসে পান চিবোচ্ছিলেন আর খোসগল্প জুড়েছিলেন। এই অসময়ে আমাদের দুজনকে এভাবে দেখে তাদের আসরে ব্যাঘাত পড়ে। কপালে যৎকিঞ্চিৎ ভাঁজ ফেলে তাই মামনি বলে উঠলেন
-‘ কিরে তোরা এখন এই সময়ে! কোনো সমস্যা হয়েছে?
আদ্রিশ চোখ বন্ধ করে তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল
-‘ না কোনো সমস্যা হয়নি তবে হতে কতক্ষণ!
আদ্রিশের এমন হেয়ালিপনা দেখে তার কপালের ভাঁজ আরও খানিকটা প্রশস্ত হয়। গম্ভীর গলায় তাই তিনি সুধালেন
-‘ কি বলবে পরিষ্কার করে বল! এমন হেয়ালি আমার পছন্দ নয়।
আদ্রিশ এবার শান্ত গলায় সোজাসাপটা জবাব দেয়
-‘ আমার মেহুকে ভালো লাগে। তাই ওকে বিয়ে করতে চাই আমি।
আদ্রিশ ভাইয়ার আচমকা এহেন কথায় হতভম্ব হয়ে যাই আমি। জোড় গলায় বলে উঠলাম
-‘ ইম্পসিবল!
-‘ ওকে ফাইন, বিয়ে করতে মন না চাইলে করতে হবে না। তবে কোনো অঘটন ঘটে গেলে কিন্তু আমি দায়ী থাকব না। মাইন্ড ইট!
হুট করে আদ্রিশ ভাইয়ার হলোটা কি? উনি এভাবে কেন কথা বলছে! আগের আদ্রিশ ভাইয়ার সাথে এই আদ্রিশ ভাইয়ার আকাশ পাতাল তফাত যেন! যে কিনা নিজের অনুভূতিগুলো সন্তর্পণে নিজের মাঝে চেপে রাখত, আর আজ সে-ই অকপটেই বলে দিচ্ছে এই কথাগুলো! আমি অবাক না হয়ে পারলাম না আর। চোখ বড় বড় করে চেয়ে রইলাম তাই।
-‘ মা চাচির সামনে এসব কি অসভ্যের মতো কথা বলছো! ছোট থেকে এই শিক্ষা দিয়ে মানুষ করেছি তোমায়?
মামনির ঝাড়ি খেয়ে মাথা নিচু করে নেয় আদ্রিশ ভাইয়া। তবে দমে যায়না সে। এবার তাকে একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে, প্রয়োজন পড়লে বেহায়া হবে, তবুও তার মেহুকে তার নিজের করা চাই! নিচু গলায় পুনরায় সে বলে উঠল
-‘ আম্মু আমার অবস্থাটা একটু বোঝার চেষ্টা করো। এতোদিন অনেক অপেক্ষা করেছি কিন্তু এখন আর সম্ভব নয় আমার পক্ষে। মেহুকে এখন আমার ইমিডিয়েটলি প্রয়োজন। তাই যত দ্রুত সম্ভব ওকে বিয়ে করে আমার বউ বানানো চাই!
মামনি এবার রেগে যান ভীষণ। মৃদু চেঁচিয়ে তাই বলে ফেললেন
-‘ দিনদিন অসভ্য হয়ে যাচ্ছ! কার সামনে কি বলতে হয় সে বুদ্ধিও লোপ পেয়েছে তোমার?
মা এতোক্ষণ নিরব দর্শকের ভুমিকা পালন করছিলেন। তবে তিনি এবার মুখ খুললেন। মামনির হাত চেপে বললেন
-‘ ভাবি, আমরা তো আগে থেকেই চাইতাম, আমাদের ছেলে মেয়ে দুটোর বিয়ে দিতে। আর এখন ওরাই যেহেতু দুজন দুজনকে পছন্দ করে সেহেতু আমি মনে করি বিয়েটা এবার দিয়েই দেওয়া উচিত।
মায়ের কথায় মামনি শান্ত হন। সরু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আমাদের দুজনকে পর্যবেক্ষণ করে নিলেন।
আদ্রিশের কাছে এগিয়ে এসে হালকা হেসে মা বললেন
-‘ আগামী মাসেই না হয়..
-‘ না না ওতো দেরি করলে চলবে না। আজ সোমবার আর পাঁচদিন পরেই তো শুক্রবার! শুক্রবারেই আমাদের বিয়েটা দিয়ে দাও, প্লীজ ছোট মা!
মায়ের কথার মাঝে থামিয়ে দিয়ে আদ্রিশ বলে উঠল উক্ত কথাটা। মামনি গর্জে উঠেন আদ্রিশের এমন আচরণে। আদ্রিশ পাত্তা দেয় না সেসব। সে চেয়ে আছে তার চাচির পানে। তিনি নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন
-‘ আচ্ছা তবে তা-ই হবে বাবা।
তার চাচির এমন কথায় আদ্রিশের মনটা প্রফুল্ল হয়ে ওঠে। খুশিতে তার চাচির হাত ধরে বলে উঠল
-‘ তোমার মতো চাচি সবার ঘরে ঘরে হোক! তুমিই একমাত্র মানুষ যে বোঝে আমায়। আই লাভ ইউ ছোট মা, থ্যাংকুউ সো মাচ!
এতোটুকু বলেই চলে যায় আদ্রিশ। আমি অবাকের উপর অবাক হলাম। আচমকা আদ্রিশ ভাইয়ার এমন পরিবর্তনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম। এ কোন আদ্রিশ ভাইয়াকে দেখছি আমি!
আদ্রিশ ভাইয়ার পিছু পিছু আমিও বেরিয়ে পড়লাম। লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে। এতোদিন শুনতাম লোকটা ঠোঁটকাটা স্বভাবের, তবে আজ তার বাস্তব প্রমাণ পেলাম। এর সাথে বিয়ে হলে আমার জীবনটা ত্যানাত্যানা হয়ে যাবে নির্ঘাত! সেই শোকে কপাল চাপড়ালাম আমি।
আদ্রিশ ভাইয়া আবারও ফিরে এলো। আমার একদম কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলল
-‘ কি রে কেমন দিলাম? বলেছিলাম না তোর জন্য সারপ্রাইজ রয়েছে, আরও আছে কিন্তু! আমায় আজ সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপে দেখে ঝটকা লেগেছে তাই না? সবে তো শুরু হলো, কাহানি আভি বাকি হ্যা ইয়ার!
এতোটুকু বলেই বাঁকা একটা হাসি দিয়ে চলে গেল মানুষটা। আমি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছি যেন। কিছুটা ঘোরের মাঝে থাকার পর, যখন হুশ ফেরে তখন ফুঁসে উঠি আমি। আমিও দেখে নেব তাকে!
..
-‘ কি এতো ভাবছ বউ? এতো না ভেবে একটু বরের দিকে নজর দিলে তো পারো!
শীতল পুরুষালি কণ্ঠস্বর কর্ণকুহুরে ঠেকতেই চকিত ফিরে তাকালাম সেদিক পানে। আমার পাশে বসে দাঁত কেলিয়ে আদ্রিশ ভাইয়াকে হাসতে দেখে আবার রাগ চড়ে বসল আমার মাথায়। ভালো করে চারিদিকে পর্যবেক্ষণ করে নিলাম। আশেপাশে বিভিন্ন ধরনের গানবাজনা চলছে।ওদিকে আমাদের কাজিনরা যে যার কাজে ব্যস্ত, কেউ মেহেদি দিচ্ছে তো কেউ ডান্স প্রাকটিস করছে, তাছাড়াও বাড়ির বড়রাও এখানে নেই। এই সুযোগে দুম করে তার বুকে কিল, ঘুষি বসিয়ে দিলাম আমি। আকস্মিক আমার এহেন আচরণে সে অবাক হওয়ার পরিবর্তে হো হো হেসে উঠল। হাসি থামিয়ে ভ্রু নাচিয়ে সে বলল
-‘ আদ্রিশ খানের বউ এতো দূর্বল হলে চলে! তোর কিল ঘুষিতে আরও সুরসুরি লেগেছে আমার। বলি কি বেশি বেশি বাদাম, আখরোট খেয়ে শক্তি গেইন কর। নয়তো আমি যখন তোর উপরে উঠব তখন তো তোকে হারিকেন জ্বালিয়েও আর খুঁজে পাওয়া যাবেনা!
ভ্রু কুচকে খানিকক্ষণ চেয়ে রইলাম তার পানে। পরে বোধগম্য হতেই একরাশ লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেললাম আমি। বিয়ের আগেই এমন ঠোঁটকাটা, না জানি বিয়ের পর কি হয়!
ইতোমধ্যে আমাদের কাজিনরাও তাদের নৃত্য পরিবেশন শুরু করে দিলো। সোফায় বসে সেসব উপভোগ করছিলাম আমি। এরই মাঝে রিশতা, অরনী দুজনে ছুটে এসে আমায় টেনে নিয়ে গেল ওদের সাথে নাচার জন্য। আমি ইচ্ছে না থাকলেও ওদের জোড়াজুড়িতে তাল মেললাম শুধু।
ছেলেরা একদিকে নাচচ্ছে আর মেয়েরা আরেক দিকে। ছেলেদের মধ্যে রয়েছে আলভি, আরাভ, আদ্রিশ, আহির ছাড়াও আরও অনেকে। আর মেয়েদের মধ্যে মেহরুন, রিশতা, অরনী, আয়ুশীসহ আরও অনেকে। এবার পালা কাপল ডান্সের! ওদের এক করতে পেছন থেকে তাই আদ্রিশ আর মেহরুনকে ধাক্কা দেয় ওরা।
তাল সামলাতে না পেরে তাই আদ্রিশের বুকে আছড়ে পড়লাম আমি। আদ্রিশ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আমায়। সাউন্ড বক্সে চলছে সফট মিলডি সং। আমি এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম আদ্রিশের পানে। কালো রঙের পাঞ্জাবিতে তাকে মানিয়েছে বেশ! তাকে দেখলেই একরাশ মুগ্ধতা ঘিরে ফেলে আমায়। মন চায় শুধু চেয়ে থাকি তার পানে। এদিকে একইভাবে আদ্রিশও মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় চেয়ে রইল তার প্রেয়সীর পানে!
#চলবে~
#হৃদয়ে_লাগিল_দোলা 🫶
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব২৯ [হলুদ স্পেশাল]
হলুদ রঙের শাড়ি পরে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজেকে এক পলক দেখে নিলাম। সাঁজ বিহীন হলুদ শাড়িতে খুব একটা খারাপ লাগছে না আমায়। যদিও হলুদ রঙ আমার বরাবরই অপছন্দের। তবুও আজ আমার গায়ে হলুদ বলে অগত্যা এই শাড়িটা পরতে হলো আমায়। নয়তো এই শাড়ি কস্মিনকালেও পড়া হতো না আমার!
শাড়ির আঁচল ঠিক করতে করতে অরনীর উদ্দেশ্যে বললাম
-‘ তুই শাড়ি পরাতে ভালোই পটু রে অরু! ভাগ্যিস তুই ছিলি নয়তো আমায় শাড়ি পরিয়ে দিত কে?
আমার কথায় অরনী টিপ্পনী কেটে বলল
-‘ কেন আমাদের আদ্রিশ ভাই তো আছেই!
অরনীর কথায় আমি বিরবির করে বললাম
-‘ উনি শাড়ি পরানোর বদলে উল্টে খুলে ফেলার ফন্দি আঁটতো! ইতর লোক একটা!
প্রসঙ্গ পাল্টাতে তাই চট করে বলে উঠলাম
-‘ মা, মামনিরা তো সব হলুদ বাটাতে ব্যস্ত। শুধু শুধু এতো খাটা খাটনির কি দরকার ছিল, বল? এতো রিচুয়াল্স না মানলেও চলত!
-‘ কে বলেছে শুধু শুধু! এই বাড়ির একমাত্র মেয়ে বলে কথা, তার জন্য এসব করব না তো কার জন্য করব! বাই দ্যা ওয়ে, তোর দেখি আর তর সইছে না আমাদের আদ্রিশ ভাইয়ের জন্য! ইশ আরেকটু অপেক্ষা কর, সবুরে বাসর হয়!
আমি দমে গেলাম এবার। এদের সাথে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। যা-ই বলব সব জায়গায় এখন আদ্রিশকে টেনে এনে আমায় বিব্রত করাই এদের একমাত্র প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এই অরনী তো আদ্রিশের একেবারে খাস চামচা বলা চলে!
অরনী হলুদ অনুষ্ঠানের জন্য কিছু জুয়েলারি বের করে রেখে মুচকি হেসে চলে যেতে নিয়েও কি মনে করে ফিরে এসে বলল
-‘ শোন, বিছানার ওপর তোর জুয়েলারিগুলো বের করে রেখে এসেছি। তাড়াতাড়ি পরে নিচে চলে আয়। আর হ্যাঁ বেশি সাঁজিস না, পরে দেখা গেল আদ্রিশ ভাই তোকে দেখেই জ্ঞান হারালো!
কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ ফেলে ওর দিকে সরু চোখে চেয়ে বললাম
-‘ গায়ে হলুদে আবার কিসের জুয়েলারি? কোনো জুয়েলারি পরব না আমি। আর আমাকে দেখতে কি পেত্নির মতো লাগে যে উনি মূর্ছা যাবে?
হেসে ফেলে অরনী বলল
-‘ আরে তা না। তুই শুধু শুধু চটছিস। ওটা এমনি ফুলের জুয়েলারি, আদ্রিশ ভাই তোর জন্য নিজে পছন্দ করে কিনে এনেছে, এখন তুই না পরলে কেমন হয় বল তো?
অরনীর কথায় পাত্তা দিলাম না আমি। ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলে ও বলল
-‘ আমি যাই রে, অনেক কাজ বাকি পড়ে আছে। তুই কিন্তু তাড়াতাড়ি আসিস।
এটুকু বলে চলে যায় অরনী। ওর চলে যাওয়ার পানে এক পলক তাকিয়ে আবারও নিজের কাজে মনোনিবেশ করলাম। সামান্য একটু লিপস্টিক, ব্যাস এতেই আমার হলুদের সাঁজ হয়ে গেল। আমি বরাবরই সাঁজগোজের প্রতি বড়ই উদাসীন। সিম্পল থাকাতেই সাচ্ছন্দ্য বোধ করি ভীষণ।
আয়নায় পড়া বিছানায় রেখে যাওয়া জুয়েলারির প্রতিবিম্বের পানে নজর পড়তেই সেদিকে ফিরে চাইলাম আমি। উঠে গিয়ে বিছানায় বসে জুয়েলারিগুলো নেড়ে চেড়ে দেখলাম। লোকটার পছন্দ আছে বলতে হবে! সত্যিই অনেক বেশি সুন্দর এগুলো! পরতে মন চাইলেও কি মনে করে রেখে দিলাম আমি।
উঠতে গিয়ে খেয়াল করলাম শাড়ির কুঁচিটা খানিকটা এলোমেলো হয়ে গেছে। তাই শাড়ির কুঁচি ঠিক করতে করতে যখনই কক্ষ থেকে বের হতে যাব তখনই ধাক্কা লাগে কারো সাথে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আলতো করে দুহাত দিয়ে মুখে হলুদ মাখিয়ে দেয় ব্যক্তিটি। মুখ তুলে সামনে তাকাতেই দেখলাম আদ্রিশ দাঁড়িয়ে, অধরের কোণে তার লেপ্টে রয়েছে মুচকি হাসির রেখা। পড়নে তার হলুদ পাঞ্জাবি, হলদে গাত্রে মানিয়েছে বেশ!তাকে দেখে আবারও একরাশ মুগ্ধতা কাজ করল আমার মাঝে। বরাবরই চাইতাম এই উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের সুদর্শন পুরুষটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত হোক। আর মাত্র কয়েক প্রহর গুনলেই সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ লাভ করবে। ভাবতেই কেমন শিউরে উঠলাম আমি।
তার পানে আমায় এমন ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকতে দেখে কেশে ওঠে আদ্রিশ। দুষ্ট হেসে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল
-‘ বুঝেছি, তোমার আর তর সইছে না আমায় ছাড়া। কিন্তু তাই বলে এমন ভাবে চেয়ে থাকবে, মেহুপাখি! আর তো মাত্র একটা দিন, তারপরই তো…। আচ্ছা একেবারে না হয় আমায় বাসর রাতেই যত ইচ্ছে দেখে নিও। এখন তো একটু নিজের প্রতি নিয়ন্ত্রণ আনো।
এটুকু বলেই আমার গালের সাথে নিজের গালটা ঘষে নেয় আদ্রিশ। ফলে আমার গালে লেপ্টে থাকা হলুদের আস্তরণ তার গালেও লেগে যায় খানিকটা। তার এহেন কর্মকান্ডে লজ্জা পেলাম ভীষণ। এই লোক নিরামিষ করল্লা থেকে এমন আমিষ হয়ে গেল কিভাবে! শত ভেবেও লাভ হয়না কোনো। আমার ভাবনার মাঝেই আদ্রিশ এবার আমার নাকে নাক ঘষে বলল
-‘ সারপ্রাইজটা দারুন ছিল, তাই না?
নিজেকে এবার সামলে নিলাম কিছুটা। আপাতত মনে যা চলছে তা বুঝতে দেওয়া যাবেনা। একটু ঘোল খাওয়াই, এতো সহজে ছাড়লে তো জমবে না ঠিক ব্যাপারটা। যে ভাবা সেই কাজ! নিজের থেকে এবার আদ্রিশকে সরিয়ে, এবার কিছুটা চেঁচিয়ে বলে উঠলাম
-‘ কি করলেন আপনি এইটা?
আমার কথায় আদ্রিশ ভাবলেশহীনভাবে বলল
-‘ কি আর করলাম! নিজের হবু বউকে প্রথম হলুদটা আমি-ই মাখিয়ে দিলাম, তো এতে দোষের কি আছে?
আমি কিছু বললাম আর। চলে যেতে নিলেই আমার হাত ধরে ফেলে আদ্রিশ। বিছানার ওপর পড়ে থাকা জুয়েলারির দিকে নজর রেখে বললাম
-‘ আমার দেওয়া জুয়েলারিগুলো না পরা অবধি এক পা-ও নড়বে না তুমি!
-‘ বয়েই গেছে আমার, আপনার দেওয়া জুয়েলারি পরতে! এসব ছাইপাঁশ পরার মুড নেই আমার।
আদ্রিশ ফিরে তাকায় আমার পানে। সরু চোখে চেয়ে থমথমে গলায় বলল
-‘ এগুলো আমি তোর জন্য কিনেছিলাম মেহু! আর তুই কি-না বলছিস, পরার মুড নেই। এই তুই কি ইন্ডিরেক্টলি আমার ভালোবাসা রিজেক্ট করতে চাইছিস? তুই তো সবই জানিস, সবটা জানার পরও এমন কেন করছিস? আমি কি ইচ্ছে করে তখন ওমন করেছিলাম! মানছি অনেক ভুল আছে আমার। তার জন্য তো হাজারবার ক্ষমা চেয়েছি। তারপরও এমন করবি?
নির্বিকার চিত্তে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। একসময় যে মানুষটা আমার ছোট্ট মনের অনুভূতিগুলো নিয়ে মশকরা করত, তাকে এখন পরোতে পরোতে শায়েস্তা করা না অবধি শান্তি মিলবে না আমার!
আদ্রিশ তপ্ত শ্বাস ফেলে পুনরায় করুণ গলায় বলল
-‘ তোর এই বিয়েতে মত নেই মেহু? আমি জোর করিনি তো তোকে। সবাই যখন আমাদের বিয়ের দিন তারিখ ফিক্সড করছিল, তখনও তো চুপ ছিলি তুই। তাই সবাই তোর মৌনতাকে সম্মতি ধরে নিয়েছিল। ওহ আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম, তোর তো আবার আহির…
প্রথমটুকু করুনভাবে বললেও শেষোক্ত কথাগুলো তাচ্ছিল্য হেসে বলল আদ্রিশ। তার এহেন কথায় দুম করে রাগ চড়ে বসল আমার মাথায়। আহিরের ভুত এবার তার মাথা থেকে নামাতে হবে। এজন্য তার কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে, ক্ষিপ্ত গলায় তাই বলে উঠলাম
-‘ জাস্ট ইনাফ ইজ ইনাফ! আমার সাথে আহিরকে জড়িয়ে একটাও বাজে কথা বলবেন না। আগেও বলেছি এখনও বলছি আহির শুধু আমার খালাতো ভাই না আমার আপন ভাইয়ের মতো। আর ওর সাথে রিশতার অলরেডি দুই বছরের রিলেশন। এইজন্যই আহির সেদিন বিদায় নেওয়ার আগ মুহুর্তে মজা করে বলেছিল ও এই বাড়িতে জামাইরূপে ফিরবে। মানে রিশতার জামাই, আমার না। আশা করি, বুঝতে পেরেছেন ভাইয়া।
এতোটুকু বলে ফোঁস করে শ্বাস ফেললাম আমি।
আদ্রিশ আমার গালে স্লাইড করতে করতে বলল
-‘ আরে আগে বলবি তো! আমি তো শুধু শুধু টেনশনে ছিলাম। ভেবেছিলাম এই বুঝি আমার মেহুপাখি আমায় ছেড়ে চলে গেল।
-‘ আগে বলার সেই সুযোগটা দিলেন কোথায়?
আমার কথায় হেসে ফেলে আদ্রিশ। এবার আমায় ধরে নিয়ে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসিয়ে দিল। তারপর জুয়েলারিগুলো এনে একে একে পরিয়ে দিল আমায়। এর মাঝে আমিও আর কোনোরূপ বাঁধা প্রদান করিনি। মনে মনে খুশি হলাম ভীষণ। বরাবরের মতো এবারও একরাশ মুগ্ধতা ঘিরে ফেলল আমায়। যদিও বাইরে তা প্রকাশ করিনি।
জুয়েলারি পরানো হয়ে গেলে আমার ঘাড়ে থুতনি ঠেকিয়ে, মোহনীয় দৃষ্টিতে চেয়ে আড়ষ্ট কন্ঠে আদ্রিশ বলল
-‘ মাশাআল্লাহ! আমার মাখিয়ে দেওয়া হলুদে আমার মিসেস মেহরুন আদ্রিশ খানকে তো একেবারে হলুদ পরীর মতো দেখাচ্ছে! শুনেছি, বিয়ের ফুল ফুটলে নাকি মেয়েদের সৌন্দর্য ঠিকরে পড়ে! আজ তার বাস্তব প্রমাণ পেলাম!
আদ্রিশের এহেন কথায় লজ্জায় মুখমন্ডলে রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়ল আমার। তা দেখে স্মিত হাসে আদ্রিশ। মনে মনে সে বলল, ‘এতোদিনের অপেক্ষার অবসান ঘটতে চলেছে তবে!’
-‘ আমরা কিচ্ছু দেখিনি। এই চল সবাই। ওদেরকে ওদের মতো কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতে দে!
রিশতার কন্ঠস্বর পেতেই হুড়মুড় করে সরে পড়লাম আদ্রিশ হতে। এদিকে আদ্রিশও কিছুটা ইতস্তত বোধ করে।
আমাদের দুজনের এমন অবস্থা দেখে আমাদের সব কাজিনরা উচ্চস্বরে হেসে ফেলল। ফিচালো হেসে রিশতা বলে উঠল
-‘ দেখ তোরা, আমাদের আদ্রিশ ভাইয়া আমাদের মেহুকে ছাড়া থাকতেই পারেনা। মেহু ছাড়া থাকতে থাকতে বেচারা ভাইয়া কেমন শুকিয়ে যাচ্ছে দিনদিন। তাইতো ছুটে চলে এসেছে হবু বউকে দেখতে। বলি ভাইয়া আর মাত্র একদিন অপেক্ষা করা যেত না বউয়ের জন্য? খুব তো বিয়ের সব অনুষ্ঠান করতে হবে বলে লাফিয়েছিলেন, এখন কেমন লাগছে ভাইয়া?
রিশতার কথা শুনে সবাই হেসে উঠল। পাশ থেকে অরনী টিটকারি মেরে বলে উঠল
-‘ শুধু কি দেখতে এসেছে, দেখ হলুদও তো মাখিয়েছে! কাজের জন্য একটু ঘর ছেরে বেরিয়েছিলাম, আর ওমনি..। ইশ আমরা না আসলে আরো কতো যে কি করে বসত?
আমি চোখ রাঙিয়ে তাকালাম ওদের দিকে। আহিরও বাদ যায়নি ঠিকই রসিকতা করে বলে উঠল
-‘ থাক থাক মেহুবুড়ি, আর চোখ রাঙাতে হবেনা। আর ভাই আপনি কিন্তু রুলস্ ব্রেক করে ফেলেছেন। এটা কিন্তু ঠিক না।
আদ্রিশ আড়চোখে একবার তাকিয়ে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে নিচে চলে যায়। এদিকে এখনো সবাই মুখ টিপে হেসেই চলেছে। আর আমি লজ্জায় মরছি। ভালোয় ভালোয় বিয়েটা শুধু একবার হোক, তারপর আদ্রিশ বুড়ো দেখাচ্ছি তোমায় মজা!
আমায় নিয়ে আমার কাজিনগণ নিচে নেমে এলো। মা, মামনি আমায় কেমন করে যেন দেখল। লজ্জা পেলাম এতে ভীষন। মামনি তো অবশেষে বলেই বসল
-‘ হলুদের অনুষ্ঠান তো এখনো শুরুই হয়নি। তাহলে ওর গালে হলুদ এলো কিভাবে?
-‘ মামিমা, এই শুভ কাজটা আমাদের আদ্রিশ ভাই করে ফেলেছে।
কথাটা বলেই হেসে ফেলে অরনী। ওর সাথে তাল মিলিয়ে উপস্থিত সবাই ফিক করে হেসে ফেলে। বাদ যায়নি মা, মামনিও। আঁচলে মুখ লুকিয়ে হেসে ফেলেন তাঁরা।
আমায় এক অবলা প্রাণী পেয়ে সবাই মিলে হলুদ মাখিয়ে একেবারে ভুত বানিয়ে ফেলল! আদ্রিশের অবস্থাও হয়েছে ঠিক তাই। বেচারার আজ কোনো হম্বিতম্বিতে কাজ হয়নি আর। ব্যাটাকে বাগে পেয়ে ইচ্ছে মতো ভুত বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছে বিচ্ছুগুলো!
অরনীর সাহায্য নিয়ে টিস্যু দিয়ে মুখে লেগে থাকা হলুদগুলো মুছে নিলাম। তারপর কাজিনরা মিলে সব চলে গেলাম ছাঁদে, ফটোশুটের জন্য। বিয়ে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন! গায়ে হলুদ নিয়ে আর হলুদ শাড়ি পরে বিভিন্ন স্টাইলে ছবি তুলব বলেই হলুদের আগের দিন মেহেন্দি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। সবাই মিলে ছবি তোলার এক পর্যায়ে, আদ্রিশ এসে আমার কাঁধে হাত রেখে বলল
-‘ সবার সাথে যখন ছবি তুললি, আমি-ইবা কেন বাদ যাব!
তার পানে ফিরে একগাল হেসে আমি বলে উঠলাম
-‘ হুম শিওর! আমার চাচাতো ভাই বলে কথা! আপনার সাথে কি ছবি না তুললে হয় ভাইয়া!
আদ্রিশের ইগোতে লাগে এবার। আগামীকালই যে মেয়েটা তার বউ হতে চলেছে, সে কিনা তাকে এখনো ভাইয়া বলে ডাকছে! ব্যাপারটা হজম হয়না তার। শক্ত করে তাই আমার কোমড় চেপে ধরে ক্ষিপ্ত গলায় বলল
-‘ খবরদার বলছি, একদম ভাইয়া বলে ডাকবি না আমায়! বরকে কি কেউ ‘ভাইয়া’ বলে সম্মোধন করে, অসভ্য মেয়ে!
#চলবে~