হৃদয়ে লাগিল দোলা পর্ব-৩৪+৩৫

0
212

#হৃদয়ে_লাগিল_দোলা 🫶
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব৩৪

গতকাল সারাটা দিন ভ্যাপসা গরমের পর শেষরাতের দিকে দমকা হাওয়া আর ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছিল। এখন ঘড়ির কাঁটা নয়টা পেরিয়ে দশটার ঘর অতিক্রম করেছে তবুও সূর্যি মামার আর দেখা মিলল না আজ! আকাশ ঘন কালো মেঘে ছেয়ে আছে এখনো। মাঝেমধ্যে দমকা হাওয়া বইছে নয়তো এক পশলা ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। এই বৃষ্টির প্রকোপ নাকি আরও বাড়বে। পরবর্তীতে আবহাওয়ার নিউজে দেখলাম ‘ঘূর্ণিঝড়’ হবে।

ঘুম থেকে উঠেছি খানিক আগেই। আজ সকালটা একটু অন্যরকম! কেননা আগে ছিলাম এই বাড়ির নয়নের মণি আর আজ থেকে বউরাণি! কতো দায়িত্ব আমার উপর! কাল বিলম্ব না করে তাই একেবারে ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরের পথে পা বাড়ালাম।

নিত্যদিনকার মতোই মা আর মামনি যথারীতি হেঁশেল সামলাতে ব্যস্ত! আমায় দেখে তারা অমায়িক হাসলেন। কাছে এসে মামনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন

-‘ কিরে ঘুম ভালো হয়েছে তো?

মামনির কথায় মাথা নেড়ে সায় জানালাম শুধু। হাতে হাতে কাজ করার জন্য উদ্যত হতেই আমার হাত আঁকড়ে ধরে তিনি শাসনের সুরে বললেন

-‘ এই মেয়ে একটা মাইর দিব কিন্তু তোকে। শোন কোনো কাজ করতে হবেনা তোর। যা ঘরে গিয়ে আমার ছেলেটার সেবা যত্ন কর। আর হ্যাঁ, নাস্তা প্রায় শেষের পথে। তো ডাইনিং টেবিলে খাবি নাকি ঘরে গিয়ে খাবি?

-‘ ডাইনিং টেবিলেই তোমাদের সাথে বসে একসঙ্গে খাব মামনি। দাঁড়াও আমি ওনাকে ডেকে আনছি।

এতোটুকু বলেই চলে এলাম আদ্রিশের কক্ষে। এসে দেখলাম আদ্রিশ এখনো উবু হয়ে শুয়ে পরে পরে ঘুমাচ্ছে! কয়েকবার ডাক দিলাম কিন্তু তার ওঠার নামগন্ধ নেই। শেষমেশ উপায়ান্ত না পেয়ে বেড সাইড টেবিলের উপরে থাকা জগ থেকে কিছুটা পানি নিয়ে আদ্রিশের চোখেমুখে ছিটিয়ে দিলাম। এতে কাজ হয়। আড়মোড়া ভেঙে, চোখ ডলতে ডলতে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে উঠল

-‘ এতো সকাল সকাল ডাকছ কেন? আরও কিছুক্ষণ ঘুমাতে দাও আমায়!

আমি একবার দেয়াল ঘড়ির দিকে চেয়ে আবারও আদ্রিশের দিকে চাইলাম। আলগোছে আদ্রিশের মাথার ঘনকালো চুলগুলো টেনে দিয়ে বললাম

-‘ বলি ক’টা বাজে খেয়াল আছে কোনো? উঠে পড়ো। দশটা ওভার হয়ে গেছে, এরপরে খাবে কখন?

আদ্রিশ তবুও উঠল না। উল্টে একটানে আমায় নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে দাঁত কেলিয়ে বলল

-‘ খাওয়ার ইচ্ছে নেই এখন। আপাতত এই রোমান্টিক ওয়েদারে বউয়ের সাথে একটু রোমান্স করতে চাই!

আমি এবার দুম করে কিল বসিয়ে দিলাম আদ্রিশের বুকে। কপট রাগ দেখিয়ে বললাম

-‘ তোমার মুখে আজকাল কিছুই আটকায় না! দিনদিন অভদ্র হয়ে যাচ্ছ!

আদ্রিশের চোখের ঘুম এবার পুরোপুরি উবে যায়। হাতের বাঁধন আরো জোড়ালো হয়ে আসে তার। ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম। সে এবার শিষ বাজিয়ে গাইল

-‘ অভদ্র হয়েছি আমি তোমারই প্রেমে তাই…

আদ্রিশের মুখ চেপে ধরলাম আমি এবার। ঘুম থেকে উঠেও মানুষের এতো প্রেম কোথ থেকে আসে! এই লোক প্রচন্ড রকমের অসভ্য হয়ে যাচ্ছে! আড়াই বছর আগের আদ্রিশের সাথে তো এর কোনো মিল-ই নেই! দুবছরের মাথায় ঢাকা থেকে ফিরতে গিয়ে আবার এক্সচেঞ্জ হয়ে যায়নি তো কারো সাথে! হায় সর্বনাশ! চট করে তাই বলেই বসলাম

-‘ আপনি হুট করে নিরামিষ থেকে এমন আমিষ হয়ে গেলেন কিভাবে?

আমার কথায় হয়তো বেশ মজাই পেয়েছে আদ্রিশ! বিগলিত হেসে তাই জবাব দিল

-‘ আগে আমার শরীরে প্রোটিনের অভাব ছিল তাই নিরামিষ ছিলাম! এখন সেই অভাবটা আর নেই তাই একেবারে আমিষের ভাণ্ডার হয়ে গিয়েছি।

তার এহেন রসিকতায় আমি থম মেরে আগের মতোই রইলাম। সে এবার আমার গাল টেনে দিয়ে বলল

-‘ আমি জানি তুমি কি বলতে চাও। সত্যি বলতে কি, মানুষ রোমান্টিক-আনরোমান্টিক হয়ে জন্মায় না। রোমান্টিক হয় তার সামনে থাকা মানুষটার জন্য। ঠিক তেমনই তোমার জন্য আমার এই আমূল পরিবর্তন! বুঝলে বউ?

-‘ আমি আবার কি করলাম?

-‘ কি করোনি তুমি! গতরাতে যে আমার সব ইজ্জত লুটে নিলে, তার বেলায়!

এবার আমার কান গরম হয়ে যায়। যে করেই হোক এই লোকের মুখ বন্ধ করতে হবে নয়তো জ্বালিয়ে মারবে। উপায় না পেয়ে তাই শেষমেশ তার পেটে আমার ধারালো নখ দিয়ে দুটো চিমটি কেটে দিলাম। আদ্রিশ এবার ব্যাথাতুর শব্দ করে আমায় ছেড়ে দেয়। হাতের বাঁধন আলগা হতেই আমি সরে পড়লাম। সে করুণ সুরে বলে উঠল

-‘ সারাদিন পর একটা ধলা ইঁদুররে বিয়ে করছিলাম বোধহয় নইলে কেউ এভাবে চিমটি দেয়! জ্বলে গেল রে বাপ! ইচ্ছায় তোর জামাইরে নিয়ে এতো চিন্তায় থাকতাম, আমার জীবনটা তেজপাতা করার জন্য এই মেয়ে-ই যথেষ্ট!

এতোটুকু বলেই সে ওয়াশরুমে চলে যায় ফ্রেশ। আর এদিকে আমি তার এমন অবস্থা দেখে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলাম। আমার হাসি শুনে সে ওয়াশরুম থেকে থ্রেট দিয়ে বলল

-‘ এখন যত পারো হেসে নাও। এরপর আমার থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করেও কিন্তু লাভ হবেনা কোনো!

তার এমন থ্রেটে ভয় পাওয়ার বদলে আরও জোরে হেসে উঠলাম। আদ্রিশ ব্যাটাকে শায়েস্তার জন্য এখন অন্য বুদ্ধি উঁকি দিচ্ছে! যদিও এসব ভাবার সময় নেই, এখন আমার অনেক কাজ। আলভি ভাইয়ার একটা ব্যবস্থা করতে হবে। যেইভাবা সেইকাজ! অগত্যা আর কাল বিলম্ব না করে তাই ডাইনিং রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম।

ডাইনিং রুমে ইতোমধ্যে বাবা, চাচ্চু, অরনী, রিশতা, আরাভ ভাইয়া, আলভি ভাইয়া আর আয়ুশী এসে হাজির হয়েছে। বৈরী আবহাওয়া জন্য আজ কেউ-ই বাসা ছেড়ে বের হতে পারেনি। নয়তো এসময় তাদের দেখা পাওয়া দূর্লভ! আমায় দেখতেই বাবা বলে উঠলেন

-‘ গুড মর্নিং মাই প্রিন্সেস!

-‘ গুড মর্নিং, বাবা।

এতোটুকু বলেই একহাতে জড়িয়ে ধরলাম বাবাকে। বহুদিন পর আজ একসাথে বসে সকালের ব্রেকফাস্টটা করার সৌভাগ্য হলো! পাশ বসে থাকা চাচ্চুকে বললাম

-‘ গুড মর্নিং, কেমন আছো চাচ্চু?

আমার কথায় তিনি গম্ভীরভাবে ‘ভালো’ বললেন। ভ্রু কুচকে এলো এতে আমার। তিনি এবার আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে থমথমে গলায় বললেন

-‘ আমি এখনো তোমার চাচা হই মেহরুন? আমার একমাত্র ছেলের বউ কিনা এখনো আমায় শশুর আব্বু বলে ডাকতে পারল না!

চাচ্চুর কথা শুনে হেসে ফেললাম আমি। মানুষটা বরাবরই গম্ভীর, তবে তার সাথে আমার সম্পর্কটা বাবা মেয়ের মতোই। আদ্রিশের উপর রাগ থাকলেও এখন আর সেই রাগটা নেই তার। ছেলে এখন একজন কার্ডিওলজিস্ট, নিজস্ব একটা পরিচয় আছে। ছেলের এমন সাফল্যে কোন বাবা রেগে থাকতে পারে! তার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ঘটেনি এর। বর্তমানে বাবা ছেলের মধ্যে আবারও আগের মতো সম্পর্ক ঠিক হয়ে গেছে। যদিও আমারও কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি এরজন্য। তাছাড়াও বাবা, চাচ্চুর পাশাপাশি এখন আমার ভাই ব্যবসাটা দেখছে, তাই রাগের রেশটাও ফিকে হয়ে এসেছে।

এসব ভাবতে ভাবতেই আদ্রিশ এসে তার জন্য বরাদ্দকৃত চেয়ারটাতে বসে পড়ল। তার পাশের চেয়ারটা খালিই পড়ে ছিল তবে লজ্জার কারণে আর তার পাশে না বসে রিশতার পাশে বসে পড়লাম আমি। এতে রেগে যায় আদ্রিশ। সরু চোখে একবার চেয়ে সেই যে খাওয়ায় মনোনিবেশ করল তারপর আর ঐ খাবারের অপরূপ সৌন্দর্য থেকে চোখই ফেরাতে পারল না!

রিশতার পাশে বসতেই রিশতা আমায় ধাক্কা দিয়ে মিনমিন করে বলল

-‘ কি ব্যাপার আদ্রিশ ভাইয়ার পাশে বসলিনা যে, লজ্জা পাচ্ছিস বুঝি?

আমি আমার মতো নির্বিকার বসে খাওয়ায় মনোনিবেশ করলাম। রিশতা পুনরায় বলে উঠল

-‘ অবশ্য লজ্জা পাওয়ারই কথা! আচ্ছা তোর গলায় ওটা কিসের দাগ মেহু?

রিশতার কথায় আমার সংবিৎ ফেরে, অতি সত্তর তাই ওড়না দিয়ে গলাটা ঢেকে নিলাম। রিশতা ব্যতিত ভাগ্যিস অন্য কেউ দেখেনি নয়তো লজ্জায় আজ পটল তুলতে হতো আমার! ওর দিকে ফিরে এবার দাঁতে দাঁত চেপে বললাম

-‘ এতোদিকে নজর না দিয়ে দয়া করে একটু খা। আর ওটা মশার কামড় ছিল!

-‘ জানিনা বাপু, আমারে তো আর কখনো মশায় কামড়ায়নি তাই বলতে পারিনা।

রিশতা ভালোই টিপ্পনী কাটছে আমায়। চোখ গরম করে তাকাতেই ও মিইয়ে যায়। এই মেয়েটার স্বভাব আর পাল্টাবেনা বোধহয়! অরনীর মুখে এ নিয়ে কোনো কথা নেই, কেননা ও জানে আমি এতো পার্সোনাল ম্যাটার নিয়ে কথা বলাটা খুব একটা পছন্দ করিনা। এজন্যই ওকে বেশি ভালো লাগে আমার। যদিও ও কম যায়না মাঝেমধ্যে।

মা মামনি যথারীতি সবার প্লেটে খাবার পরিবেশন করে নিজেরাও এখন খেতে বসলেন। যদিও আমি বার কয়েক বলেছিলাম তবে মামনির নিষেধের কারণে দমে যেতে হয় আমায়।

সবার খাওয়া দাওয়া শেষ হতেই যে যার মতো কক্ষে চলে যায়। বসে রইলেন শুধু মা, আলভি ভাইয়া। এটাই মোক্ষম সময়। তাই এবার আমি বলেই ফেললাম

-‘ মা, আমার তো বিয়ে হয়ে গেছে। এবার ভাইয়ার বিয়ের ব্যাপারেও একটু দেখো।

আমার কথায় তারা চকিত ফিরে তাকায়। মা আমায় বললেন

-‘ হ্যাঁ তাতো ভাবতেই হবে। তবে পাত্রী…

-‘ ওসব নিয়ে চিন্তা নেই, পাত্রী তো আমাদের হাতের কাছেই।

মায়ের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে চট করে এতোটুকু বলে আয়ুশীকে সামনে নিয়ে এলাম। আয়ুশী মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রয়। মুখে তার রা টিও নেই।

মা এবার গম্ভীর গলায় বললেন

-‘ নাম কি তোমার? বাসায় কে কে আছেন?

আয়ুশী নিচু গলায় জবাব দেয়

-‘ আমি আয়ুশী রহমান সাফা। আমায় আপনি আয়ুশী বা সাফা, যেকোনো একটা নামে ডাকতে পারেন। তিনকুলে আমার কেউ নেই বললেই চলে। এখানে হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করি।

মা আর কিছু শুনতে চাইলেন না আবার কিছু বললেনও না। যাওয়ার আগে শুধু বলে গেলেন

-‘ ঠিক আছে তোর বাবার সাথে কথা বলে ভেবে দেখব।

মা চলে যেতেই ভাইয়া এসে আমার হাত চেপে বলল

-‘ তুই আমার জন্য যা করেছিস, তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। তবে যা বুঝলাম মা বাবা হয়তো না-ও রাজি হতে পারে!

ভয় যে আমারও হচ্ছেনা, তা না! তবুও ওদের আশ্বাস দিলাম। হুট করে এমন সময়…

#চলবে~

#হৃদয়ে_লাগিল_দোলা 🫶
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব৩৫

ড্রয়িং রুমে থমথমে ভাব বিরাজমান। মা বাবার সিদ্ধান্তের জন্য অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছি আমি আর আলভি ভাইয়া। পাশেই মাথা নত করে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে, শক্ত করে আমার হাতটা জড়িয়ে ধরে বসে আছে আয়ুশী।

বাবার কথায় ধ্যান ভাঙল আমাদের। চকিত ফিরে তাই তার পানে চেয়ে রইলাম। গলা পরিষ্কার করে তিনি বললেন

-‘ আমি মেনে নিলাম। এখন তোমাদের কি অভিমত?

বাবার থেকে সম্মতি পেতেই আমি একপ্রকার লাফিয়ে উঠলাম। বাবাকে জড়িয়ে ধরে তাই খুশিতে আত্মহারা হয়ে বললাম

-‘ ইউ আর দ্যা বেস্ট ফাদার ইন মাই ওয়ার্ল্ড!

আমার কথায় বাবা মুচকি হেসে পরম যত্নে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আমরা দুই ভাই-বোন যখন যা চেয়েছি তা দেয়নি এমন কখনো হয়নি! বাবার সাথে সাথে এবার মা-ও সম্মত হলেন। ওরা সেম এজের এই ব্যাপারটা শুনে প্রথম প্রথম তারা মানতে নারাজ হলেও এবার সম্মত হলো। যদিও এসবই হয়েছে আদ্রিশের জন্য, ও না থাকলে হয়তো সবকিছু এতো সহজে হতো না কখনোই। ফলে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে ফিরে চাইলাম আদ্রিশের পানে। আমাদের চোখাচোখি হতেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় আদ্রিশ। বুঝলাম সকালের ব্যাপারটায় লোকটা বেজায় চটে আছে!

আলভি ভাইয়া আর দেরি না করে চট করে বলে বসল

-‘ তবে আজ-ই আয়ুকে বিয়ে করে নিতে চাই আমি।

-‘ আজ! এতো তাড়াহুড়োর কি আছে? আমরা তো মেনে নিয়েছি। আর আয়ুশীও তো পালিয়ে যাচ্ছেনা, তবে?

-‘ আমাদের বিয়েতে ওসব ঝই ঝামেলা করতে হবেনা বাবা। ঘরোয়াভাবে বিয়েটা সম্পন্ন হলেই বাঁচি। আর তাছাড়া আমরা তো মেহুর বিয়েতে হৈ হুল্লোড় করেছিই! তাই শুধু শুধু আর দেরি না ভালোয় ভালোয় বিয়েটা হলেই হয়!

পুনরায় সবাই নিশ্চুপ হয়ে রইলাম। ভাইয়া ভুল বলেনি কিন্তু আমার একটামাত্র ভাই বলে কথা, তার বিয়েটা এমন সাদামাটা হবে এটাই মানতে পারলাম না। তাই তীব্র প্রতিবাদের সহিত বললাম

-‘ তোর বিয়ে আমি ধুমধাম করেই দিব, ভাইয়া!

ভাইয়া এবার আমার পাশে এসে বসল। মিনমিন করে বলল

-‘ তোর বিয়েতে করা রিচুয়াল্সগুলো আমি আর আয়ুও মেইনটেইন করেছিলাম, মেহু। এখন শুধু বিয়ে করাটাই বাকি পড়ে আছে।

-‘ ওরে বাঁদর, তুই দেখি কয়েক ধাপ এগিয়ে! বলি তুই কি আমার ভাই নাকি ঐ খারুশটার ভাই?

আলভি ভাইয়ার কথার পিঠে উক্ত কথাটা বলে থামলাম আমি। ভাইয়া এবার শাসনের সুরে বলল

-‘ ভাইকে নিয়ে বাজে কথা বলবিনা মেহু! আদ্রিশ ভাইয়ের শালাবাবু হয়ে কিছুতেই এসব মানবোনা আমি! এমনকি তুই আমার আপন বোন বলেও কিন্তু চলবে না!

ভাইয়ের কথায় আমি অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম। এ-ই না এসে আদ্রিশের নামে কতো সমালোচনা করত আমার সাথে। আর আজ এ-ই আদ্রিশের দলে পাল্টি খেয়ে গেল! কি জাদু করল আমার ভাইটার উপর ঐ খারুশটা!

.

বিকেলের দিকে ঝড়বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর, কাজী ডাকা হয়। আলভি ভাইয়ার কথামতোই একেবারে জাঁকজমকহীনভাবে ওদের বিয়েটা হয়ে যায়। ছোট বোনের বিয়ের পরের দিনই হুট করে বড় ভাইয়েরও বিয়ে হয়ে যাওয়াটা একটু অন্যরকম বইকি! এছাড়াও ঝড়বৃষ্টির সুবাদে আমাদের বাড়িতে আত্মীয় স্বজনরাও রয়ে গিয়েছিল, ফলে তাদেরও আলভি ভাইয়ার বিয়েটা উপভোগ করার সৌভাগ্য হলো! মানে একে ‘এক ঢিলে দুই পাখি মারা’ বলা চলে আরকি! অবশেষে আবারও পূর্ণতা পেল দুটি মানব-মানবীর ভালোবাসা! চোখের নিমেষেই সবটা এতো দ্রুত ঘটে গেল যে বলার বাইরে।

আমি, অরনী আর রিশতা মিলে ওদের বাসর ঘর সাজাতে ব্যস্ত! বিয়েটা সাদামাটাভাবে হলেও, বাসর ঘর তো আর সাদামাটাভাবে সাজানো যায়না। ফুলের পাপড়িগুলো দিয়ে বিছানা সাজাচ্ছিল, এমন সময় অরনী বলে উঠল

-‘ আচ্ছা আয়ুশী ভাবির কি মা বাবা বা কোনো গার্ডিয়ান নেই! মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল অথচ ওর কোনো আত্মীয়ের দেখা নেই, বিষয়টা কেমন হয়ে গেল না?

অরনীর কথায় ছোট করে একটা শ্বাস ফেলে বললাম

-‘ জন্মের পূর্বেই মেয়েটা বাবাকে হারিয়েছে আর জন্মের পর মাকে। ছোট থেকে বড় হতে হয়েছে নানাবাড়িতে। নানা-নানী যতদিন বেঁচে ছিল ততদিনই তার জীবনটা সুন্দর ছিল, আর যখনই তারা চোখ বুজলেন তখন থেকেই শুরু হয় তার মামির অত্যাচার। কোনোরকমে পড়াশোনা করে এই অবধি এসেছে। পরবর্তীতে তারাও আর খোঁজ নেয়নি আর ভাবিও ভার্সিটির হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করেছে। আর এখন সেই যোদ্ধা মেয়েটাই আমার ভাবি! আমার একমাত্র ভাইয়ের বউ সে!

আয়ুশী ভাবি সম্পর্কে অরনী বা রিশতার কেউই জানত না এসব। আমার কাছ থেকে শুনে তাই অরনী কিছুটা আক্ষেপের সুরে বলল

-‘ ইশ! ভাবির কতো কষ্ট। আচ্ছা মামিরাও এমন হয় বুঝি? কই আমরাও তো মামাবাড়ি থেকে মানুষ হয়েছি, আমাদের সাথে তো দুই মামির একজনও খারাপ ব্যবহার করেনি কখনো। উল্টে তারা আরও নিজের মেয়ের মতো আগলে রাখত আমাদের। আমার মনে পড়েনা যে কোনোদিন মেহরুন আর আমাদের আলাদা নজরে দেখেছে মামিরা!

রিশতা এতোক্ষণ চুপ করে শুনছিল আমাদের কথোপকথন। ও এবার চুপ না থেকে উৎফুল্ল হয়ে বলল

-‘ আমাদের মামিরাই পৃথিবীর সেরা মামিমা!

রিশতার সাথে তাল মেলায় অরনী। তা দেখে আমি অভিমানী সুরে বললাম

-‘ হুহ, মামা-মামি, মামাতো ভাই সবাই ভালো শুধু আমিই ভালো না।

আমায় এমন করতে দেখে ওরা দুজনে আমায় জাপটে ধরে বলল

-‘ তুই তো সবচাইতে ভালো মেহু। আমরা শুধু তিনবোনই না আমরা তিনজন বেস্টফ্রেণ্ড! দোয়া করি, আমাদের সম্পর্ক চিরকাল এমন অটুট থাকুক।

আমিও জড়িয়ে ধরলাম ওদেরকে। ওদের সঙ্গ পেয়ে আমার শৈশব-কৈশোর খুব আনন্দ উল্লাসে কেটেছিল। হাসি মজা করেই দিনগুলো পার করতাম আমরা। আর এখন সেসব মনে পড়লে খারাপই লাগে ভীষণ। অরনীর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর, আমি আর রিশতা একা হয়ে পড়েছি। প্রতি মুহুর্তে ভীষণভাবে মিস করি অরনীকে। এইযে পরশু সকালেই চলে যাবে মেয়েটা, ভাবতেই বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে আমার!

-‘ এই আজ তো আবার আলভি ভাইয়া আর আয়ুশী ভাবির বাসর রাত! তো মশারী টানিয়ে বা কয়েল জ্বালিয়ে দে নয়তো দেখা গেল মেহুর মতো আয়ুশী ভাবিকেও মশায় কামড় দিয়ে বসল!

রিশতার কথায় ধ্যান ভাঙে আমার। অরনী ভ্রু কুচকে বলল

-‘ মেহুকে মশায় কামড় দিয়েছে! কই আমাদের বাড়িতে তো মশা নেই বললেই চলে।

-‘ আরে এটা কোনো সাধারণ মশা নয়, এটা অন্যরকম মশা। যে মশা শুধু বাসর রাতেই কামড়ায়! কি ঠিক বলিনি মেহু?

হুট করে রিশতাকে এমন টিপ্পনী কেটে কথা বলতে দেখে অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম আমি। বুঝতে বাকি নেই সকালের বিষয়টা নিয়েই খোঁচা মারছে আমায়। তবুও কিছু বুঝতে না দিয়ে কপট রাগ দেখিয়ে বললাম

-‘ তখন থেকে কি কামড়াকামড়ির কথা বলছিস তোরা! কথা না বলে কাজে মন দে।

আমার কথায় ওরা কাজে মন দেয়, তবে অরনী কিছুক্ষণ পর পর আমায় দেখছে আর মুচকি মুচকি হাসছে। সেসবে পাত্তা না দিয়ে পুনরায় নিজের কাজে মনোনিবেশ করলাম আমি।

বেশ সুন্দর করে ঘরটা সাজিয়ে, আমি বেরিয়ে পড়লাম আয়ুশী ভাবিকে নিয়ে আসতে। কোনোরূপ প্রসাধনী বিহীন সাজে বেশ মায়াবী দেখাচ্ছে ভাবিকে। ভাবি হয়তো ওতোটা ফর্সা নয়, তবে তার সৌন্দর্যেরও কোনো কমতি নেই। আমার কাছে মনে হয়, পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর রঙ হলো শ্যামলা, ফর্সা রঙ তো বর্ণহীন। তবে বাস্তবে শ্যামলা রঙ বড়োই অবহেলিত! স্রষ্টার এই অপরূপ সৃষ্টিকে নিয়েও মাঝেমধ্যে মানুষেরা কটাক্ষ করতেও দুদণ্ড ভাবেনা! অথচ একদিন তো আমাদের আবারও ঐ মাটিতেই মিশে যেতে হবে, এটা তারা বেমালুম ভুলে যায়!

এসব ভাবতে ভাবতেই আয়ুশী ভাবিকে নিয়ে আলভি ভাইয়ার কক্ষে চলে এলাম। ভাবিকে দেখা মাত্রই ওরা বলে উঠল

-‘ মাশাআল্লাহ ভাবি, আলভি ভাইয়া আজ চোখ ফেরাতে পারবেনা তোমার থেকে!

ওদের কথায় লজ্জায় পড়ে যায় ভাবি। আমি ভাবিকে বসিয়ে দিলাম। ভাবি এবার আমার হাতটা টেনে বলল

-‘ তুমি অনেক ভালো মেহরুন। তোমার মতো এমন একটা মিষ্টি ননদিনী পেয়ে আমি ভীষণ প্রাউড ফিল করছি। সত্যিই তুমি আর আদ্রিশ ভাই না থাকলে হয়তো আর এসব হতো না! খুব ভালোবাসি তোমায় বোন।

-‘ বোন বলেই যখন ডেকেছো তখন আমায় বোনই মনে করো কেমন!

আমার কথায় আলতো করে হাসে ভাবি। আলভি ভাইয়া আসতেই আমরা সবাই বেরিয়ে পড়লাম।

.

আলভিকে আসতে দেখে তাড়াহুড়ো করে মাথায় একহাত ঘোমটা টেনে বসল আয়ুশী। আলভি ছোট ছোট পা ফেলে নিজের প্রেয়সীর দিকে এগিয়ে যায়। বুকের মাঝে ধুকপুক করছে তার। চার বছরের প্রণয়ের পর অবশেষে তাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পেয়েছে যে! সামনে থেকে ঘোমটা তুলতেই আবারও নজরে পড়ে পরিচিত সেই মায়াবী মুখশ্রীটার পানে। মুগ্ধ নয়নে কিছু সময় চেয়ে থেকে আলভি আড়ষ্ট গলায় বলল

-‘ মাশাআল্লাহ, আমার মায়াবতীকে ভারী মিষ্টি লাগছে তো আজ!

লাজুক হেসে মাথা নুইয়ে ফেলে আয়ুশী। আলভি আর দেরি না করে নিজের বুকের মধ্যিখানে জড়িয়ে নেয় তার প্রেয়সীকে। আয়ুশীও আলতো হাতে জড়িয়ে নেয় তার কাঙ্খিত পুরুষটিকে। দুজনের ভালোবাসার আলিঙ্গনে মুখরিত হয় চারপাশ। সূচনা হয় আরও একজোড়া মানব-মানবীর জীবনের প্রণয়ের বসন্ত!

.

আমরা বেরিয়ে পড়তেই অরনী আমার হাত টেনে মুচকি হেসে বলল

-‘ কিরে মেহু, আদ্রিশ ভাই অনেক বেশি রোমান্টিক, তাইনা?

আচমকা অরনী হতে এহেন প্রশ্নে কিছুটা থতমত খেয়ে যাই আমি। বিরবির করে বললাম

-‘ বর আনরোমান্টিক হইলে বউয়ের জীবন অর্ধেক তেজপাতা হয়ে যায়, আর রোমান্টিক হইলে পুরোপুরি আওলায় যায় জীবনটা।

এতোটুকু কোনোরকম আওড়িয়ে চলে এলাম আমি।আমার কথা আদৌও ওরা শুনছে কিনা জানিনা তবে পেছন থেকে ভেসে এলো দুই তরুণীর হাসির ঝংকার। একদিকে এদের টিটকারি আর অন্যদিকে আমার জনাবের রাগ। লোকটা ভালোই চটে আছে আমার উপর, এজন্য তো সারাদিনে তার ছায়াও নজরে পড়েনি আমার। ঘরে গেলে কপালে কি আছে কে জানে!😵

#চলবে~