হৃদয়ে লাগিল দোলা পর্ব-৩৬+৩৭

0
203

#হৃদয়ে_লাগিল_দোলা 🫶
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব৩৬ (বোনাস পর্ব)

ধীর পায়ে কক্ষের পথে পা বাড়ালাম আমি। এ মুহুর্তে কক্ষের মাঝে বিরাজ করছে এক অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ। কক্ষে প্রবেশ করে তাই হাতড়িয়ে বাতি জ্বালিয়ে দিলাম। অশান্ত চাহনিতে একবার এদিক ওদিক পরোখ করেও আদ্রিশের দেখা মিলল না। ফলে ললাটে যৎকিঞ্চিত ভাঁজ আপনাআপনিই চলে এলো আমার। হুট করে বেলকনির দিকে নজর পড়তেই এক ছায়ামূর্তির সন্ধান পাওয়া যায়। আমি তাই দেরি না করে সে পথেই চরণ ফেললাম।

পেছন থেকে কয়েকবার ডাক দিলাম আদ্রিশকে। কিন্তু তার কোনো সাড়াশব্দ মেলেনা। সে তো এক ধ্যানে ঐ দূর অন্তরীক্ষের মিটিমিটি তারার হাসি আর মেঘের আড়ালে শশাঙ্কের লুকোচুরি দেখাতেই ব্যস্ত। আমি এবার আদ্রিশের কাঁধে আমার ডান হাতটা আলতো করে রাখলাম। তবুও এতে বিন্দুমাত্রও হেলদোল হলোনা তার। সে পূর্বের ন্যায় রাতের অরূপ সৌন্দর্যে মগ্ন! বুঝলাম মানুষটা বেজায় চটে আছে, সকালের অমন আচরণে হয়তো মানুষটার অভিমানের দেয়াল প্রগাঢ় হয়েছে! আচ্ছা পুরুষ মানুষও কি অভিমান করে? সাত পাঁচ আর না ভেবে তাই তো পেছন থেকেই জড়িয়ে ধরলাম আদ্রিশকে।

বুকের মাঝে প্রেয়সীর শীতল হাতের ছোঁয়া অনুভব হতেই, সমস্ত রাগ অভিমানের পুরু আস্তরণ ঝরে যায়। মনের আকাশ ভেঙে নেমে আসে বৃষ্টির ফোয়ারা। আচমকা এক শীতল হাওয়া এসে হৃদয়ে দোলা দিয়ে যায়। পূর্বের ন্যায় পুনরায় সেই হৃদয় উপকূলে ঢেউ তোলে এক উত্তাল জোয়ার!

সমস্ত রাগ অভিমানকে দূরে সরিয়ে প্রেয়সীকে আগলে নেয় নিজের বক্ষপিঞ্জরের মাঝে। আমিও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম আদ্রিশকে।

কয়েক মুহুর্ত অতিবাহিত হতেই আমায় নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয় আদ্রিশ। আমি অসহায় ভাবে তার পানে চেয়ে এবার তার গলা জড়িয়ে ধরে বললাম

-‘ হুট করে ভাইয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় সেদিকেই তো এতো ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। আবার নতুন ভাবিকেও তো সবটা বুঝিয়ে পড়িয়ে দিয়ে আসতে হতো। আফটার অল আমি তার একমাত্র ননদিনী বলে কথা! আমারও তো একটা দায় দায়িত্ব আছে, তাইনা?

আমার হাত নিজের গলা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কাটকাট গলায় সে বলল

-‘ আর ভাইয়ের বিয়ে নিয়ে আজ সারাদিন এতোটাই মগ্ন ছিলে যে নিজের বরের দিকে একটাবার ফিরে তাকানোরও সময় হয়নি তোমার! তো যাও না যাও গিয়ে আরও দায়িত্ব পালন করে আসো। আমার কাছে এসেছো কি জন্য? নাকি সারাদিন পর রাতের বেলায় আমায় খুব প্রয়োজন পড়েছে তোমার?

তার এহেন বাক্যচয়নে আহত হলাম আমি। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম

-‘ স’রি আমার ভুল হয়েছে, আমায় ক্ষমা করে দাও। তুমি যে এসব নিয়ে বাচ্চাদের মতো এমন অভিমান করে বসে থাকবে তা আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি।

আদ্রিশ চোখ বুঁজে দাঁড়িয়ে রয়, এরপর চট করে কি মনে করে বলে দিল

-‘ ক্ষমা করতে পারি এক শর্তে!

-‘ কি শর্ত?

-‘ ফটাফট দুটো চু’মু খাও নয়তো কিছুতেই আমার এই রাগ মিটবে না!

আমি হতভম্ব বনে গেলাম। সত্যিই ধরে নিয়েছিলাম, বেচারা আমার উপর রেগে আছে কিন্তু এই ব্যাটা যে এতোক্ষণ যাবত ভং ধরেছিল তা কে জানত! আমি কিছু না বলে চলে আসতে নিলেই সে আমার হাত টেনে ধরে, শক্ত করে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে তীক্ষ্ণ গলায় বলে

-‘ আমার পারমিশন ব্যতিত এখন কোথাও যাওয়া চলবেনা। বলেছিলাম না একবার ধরলে, আমি হতে ছাড়া পাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করলেও ছাড়ব না, মনে আছে তো? আর না থাকলেও সমস্যা নেই, গতরাতের স্পেশাল খাতির যত্ন তো ঠিকই মনে থাকার কথা!

শীতল অথচ ধারালো এই কথায় ভড়কে যাওয়ার বদলে আমি বাঁকা হেসে তার গলায় জড়িয়ে ধরলাম। আদুরে ভঙ্গিতে বললাম

-‘ আচ্ছা শোন, ওসব বাদ দাও তো! আমার সাতটা না পাঁচটা না একটা মাত্র গুণধর বর মশাইয়ের জন্য আমার পক্ষ থেকে একটা ছোট্ট সারপ্রাইজ দেওয়ার আছে! কি গ্রহণ করবে তো এই অধমের সারপ্রাইজ?

আদ্রিশ চেয়েছিল তার বউকে ওলোট পালোট বলে ভড়কে দিতে, মেয়েটাকে ছোট থেকেই তার উজবুক বানাতে সেই লাগে। কিন্তু আচমকা মেয়েটার এমন আচরণে যে নিজেই উজবুক বনে যাচ্ছে। তবুও নিজেকে ধাতস্থ করে নেয় সে। অনুভূতি লুকানোতে তো সে এক্সপার্ট, এর পূর্ব নজিরও রয়েছে। তাই সে মুখে কাঠিন্যে ভাব বজায় রেখে বলল

-‘ নো এক্সকিউজ, আগে চু’মু তারপর সারপ্রাইজ।

-‘ আরে তুমি বুঝতে পারছো না, এই সারপ্রাইজটা এর চাইতেও বড়। সেটা দেখলেই বুঝতে পারবে।

আদ্রিশ আর কথা বাড়ায় না। তার চোখেমুখে এখন অন্য ইঙ্গিত! সেসবে পাত্তা না দিয়ে, আমার কোমড় থেকে তার হাতের বাঁধন আলগা হতেই সরে এলাম আমি। ইশ এই লোকের পাল্লায় পড়ে আমিও কিসব ছাইপাঁশ, অসভ্যমার্কা কথাবার্তা বলতে আরম্ভ করে দিয়েছি। ছ্যাঁহ্, কি লজ্জা!

কক্ষে এসেই ড্রয়ার খুলে একটা বক্স বের করে নিলাম। আদ্রিশ দেখার পূর্বেই তা দ্রুত আড়াল করে নিলাম। তাকে বিছানায় বসতে বলে, চোখ বন্ধ করতে বললাম। প্রথমে তার আপত্তি থাকলেও শেষমেষ আমার কথায় সে একপ্রকার বাধ্য হয়। এই লোককে বিশ্বাস নেই, এ যা পল্ট্রি মোরগ, চিটিংবাজ, তা তে করে চিটিং করবেই তাই আমার গায়ে জড়িয়ে রাখা ওড়নাটা দিয়ে তার চোখ বেঁধে দিলাম।

-‘ কি এমন দেবে যার জন্য তুমি আমার চোখ বেঁধে দিয়েছো?

-‘ তোমার মতো লোককে বিশ্বাস নেই। তুমি যে একটা এক নম্বরের চিটিংবাজ, তা আমি ভালো করেই জানি।

-‘ কি বললি…

আদ্রিশের ওষ্ঠাধরে আঙুল ছুঁইয়ে চুপ করিয়ে দিলাম। এখন আপাতত আমি আমার কাজে মনোনিবেশ করি।
এর মাঝে আবারও আদ্রিশ বলে উঠল

-‘ কিরে, সুরসুরি লাগছে কেন?

-‘ তুমি কথা বললে কিন্তু আমার সারপ্রাইজ দেওয়ার মুডটাই নষ্ট হয়ে যাবে। তখন আমি আর তোমার সাথে কথা বলব না!

আমার কথায় দমে যায় আদ্রিশ। মনের কোণে শত প্রশ্ন ঘুরঘুর করলেও আর মুখ খোলেনা সে।

কাজ শেষ হতেই তাকে আয়নার সামনে নিয়ে গিয়ে চোখের বাঁধন খুলে দিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলাম

-‘ সারপ্রাইজ!

চোখ মেলে আয়নায় পড়া নিজের প্রতিবিম্ব নজরে আসতেই, আদ্রিশের চক্ষু চড়কগাছ! চিৎকার করে সে বলে উঠল

-‘ সর্বনাশ! এটা তুই কি করলি মেহু!

আদ্রিশের এমন রিয়াকশন দেখে আমি হাসিতে ফেটে পড়লাম। বেচারা খুব ভাব দেখিয়ে একবার বলেছিল, ‘আমার জন্য নাকি একটা লাল টুকটুকে বর এনে দিবে!’ অথচ সে নিজেই আমার বর হলো কিন্তু তার কথামতো লাল টুকটুকে বর আর পেলাম না। তাই তো নিজের দুঃখ মেটাতে আমার মেকআপ বক্সে থাকা লাল ব্লাসটা লেপে দিলাম আদ্রিশের পুরো মুখে , সাথে আদ্রিশের ঠোঁটে একদম কটকটা লাল লিপস্টিকও মেরে দিলাম। শুধু চোখ ঢাকা থাকায় আর লাল আইসেডোটা দেওয়া গেল না। তবে আমার তাতে আফসোস নেই, আমার লাল টুকটুকে বর দেখার স্বপ্নটা তো পূরণ হলো। এতেই চলবে!

আদ্রিশ আমার দিকে ফিরতেই আরও একদফা হাসলাম। তা দেখে সে কটমট করে তাকায় আমার দিকে। বেচারা আমার একদম লাল টুকটুকে জামাই! আমি এবার বিদ্রুপ করে বললাম

-‘ খুব তো ভাব নিয়ে বলেছিলে, আমার জন্য একেবারে লাল টুকটুকে জামাই নিয়ে আসবে তবে তুমি একথা ভুলে গেলেও আমি কিন্তু ঠিকই মনে রেখেছি। আর তাছাড়াও এখন তো আর জামাই পাল্টাতে পারবোনা, তাই যেটা আছে সেটাকেই একটু ঘসামাজা করে লাল বানিয়ে দিলাম!

এতোটুকু বলে পুনরায় হেসে উঠলাম আমি। আদ্রিশ আমার হাসি দেখে কটমট করে বলল

-‘ খুব হাসি পাচ্ছে তাইনা? ওয়েট এই তোরও তো আমাকে একটা লাল টুকটুকে বউ এনে দেওয়ার কথা ছিল, রাইট?

আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বাঁকা হেসে উক্ত কথাটা বলল আদ্রিশ। এবার ভড়কে যাই আমি। এই লোক এবার আমায় রঙ মাখিয়ে সঙ সাজিয়ে দেবে না তো? এখনই একটা ব্যবস্থা করতে হবে, তাই হাতে একটা বালিশ তুলে নিলাম। আদ্রিশও কম নয়, সেও বালিশ তুলে নেয়। তারপর দুটো মিলে বালিশ নিয়ে মারামারি বাঁধিয়ে দিলাম। আমাদের দেখলে কে বলবে যে আমরা হাসবেন্ড-ওয়াইফ! এই কাজিন-কাজিন বিয়ে করলে বোধহয় এমনই টম&জেরির মতো ঝগড়া মারামারি লেগেই থাকে! হায়রে কপাল আমার!

অনেকক্ষণ যাবত বালিশ নিয়ে মারামারির পর, ক্লান্ত হয়ে ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম আমি। আদ্রিশও সুযোগ বুঝে সুরসুরি দিতে আরম্ভ করে আমায়। আর এদিকে হাসতে হাসতে আমার অবস্থা যায়যায়।

-‘ খুব তো আমায় সুরসুরি দিয়েছিলি, এখন দেখ কেমন লাগে?

-‘ এবার থামো, হাসতে হাসতে আমার পেট ধরে আসছে।

আদ্রিশ থামেনা, আরও কিছুক্ষণ সুরসুরি দিয়ে থামে সে। কেন মরতে যে ব্যাটারে উজবুক বানায়তে গেলাম, এমন তো নিজেরই মরিমরি অবস্থা হচ্ছে!

এরপর আমার উপর ভর দিয়ে আদ্রিশ ভ্রু নাচিয়ে, দুষ্ট হেসে বলল

-‘ তোর মতো আমারও লাল টুকটুকে বউ দেখার অনেক শখ! তুই তো আমায় কিসব ছাইপাঁশ মাখিয়ে লাল বানিয়ে দিয়েছিস, তবে তোর আর ওসব কৃত্রিম রঙের কোনো প্রয়োজন নেই। একটু পর তুই এমনিতেও লাল টুকটুকে হয়ে যাবি। জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ!🧛

#চলবে~

#হৃদয়ে_লাগিল_দোলা 🫶
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব৩৭

ব্যাগপত্র সব গোছগাছ করে, নিজেও তৈরি হয়ে নিলাম। উদ্দেশ্য কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে যাওয়া। হুট করেই আদ্রিশের খেয়াল চাপল আজই কক্সবাজার যাওয়ার। তাছাড়াও তার ছুটির আর অল্প কিছুদিন বাকি রয়েছে, আবার আজকের এমন নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া দেখে তার মনোবাসনা আরও প্রগাঢ় হয়। অগত্যা আর কাল বিলম্ব না করে আমাদের হানিমুনে যাওয়ার উদ্দেশ্যে টিকিটটা তাই কেটেই ফেলল আদ্রিশ!

ঘুরতে শুধু আমরাই যাবোনা, সঙ্গে আরাভ ভাইয়া-অরনী, আলভি ভাইয়া-আয়ুশী ভাবিও যাবে। যেহেতু ওদের বিয়ে হওয়ার পরে কোথাও আর ঘুরতে যাওয়া হয়নি তাই ভাবলাম তিন জুটি মিলে ছোট-খাটো একটা ট্যুর দেওয়া গেলে খুব একটা মন্দ হয়না! আনন্দ ফূর্তিও হবে আবার নিজেরা নিজেরা একান্ত মুহুর্তও কাটানো যাবে!

এদিকে আমাদের এহেন তোড়জোড় দেখে রিশতাও বায়না জুড়ে দেয় আমাদের সঙ্গে যাবে বলে। হুট করে ওর এমন বায়না দেখে আমি এবার কিছুটা বিরক্তির সুরে বললাম

-‘ একমাস পর তোর ভার্সিটি এডমিশন পরীক্ষা। আর তুই কিনা পড়া বাদ দিয়ে আমাদের সাথে যাওয়ার জন্য উতলা হয়ে উঠেছিস! ঘুরাঘুরি পরেও হবে, এসব বাদ দিয়ে চুপচাপ পড়তে যা।

আমার কথায় রিশতা কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল

-‘ আদ্রিশ ভাইয়ার সাথে থাকতে থাকতে তুইও তো ওনার মতো হয়ে গেছিস, দেখছি! একমাস তো এখনও অনেক সময়! দু’টো দিন যেয়ে একটু ঘুরে আসলে কি আর এমন হবে? দরকার পড়লে পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে না পড়ে ন্যাশনালে পড়ব, তবুও আমি তোদের সাথেই যাব।

আমি রিশতাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেও, মেয়েটা ঐ পূর্বের ন্যায় নাছোড়বান্দাই রয়ে গেল! শেষমেশ অরনী তাই চুপ না থেকে বলে বসল

-‘ এই তুই আমাদের কাপলদের মাঝে কাবাব মে হাড্ডি হবি কেন? তোর বিয়ে হলে তো তুই সুদ্ধ তোর জামাই নিয়ে ঘুরে আসতাম! কিন্তু আফসোস আমাদের সবার বিয়ে হয়ে গেলেও তোরটা আর হলো না!

এতোটুকু বলেই মুখ টিপে হাসে অরনী। ওর সাথে তাল মিলিয়ে আমিও হেসে ফেললাম। সময় পেলেই আমি আর অরনী মিলে রিশতাকে নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা জুড়ে দেই। আমাদের টিপ্পনীতে, অস্ফুটস্বরে রিশতা বিড়বিড়িয়ে বলল,

-‘বিয়ে হয়ে গেছে বলে বাঁদরগুলো আমায় নিয়ে মশকরাও করছে। হায় কপাল আমার! জামাই তুমি কই, বিয়াত্তা বেডি হয়েও এসব সহ্য করতে হচ্ছে আমার!’

অস্ফুটস্বরে রিশতার প্রথমদিকের কথাগুলো কর্ণগোচড় হয়না তা আমার। ফলে আমি খিলখিলিয়ে হেসে ফেললাম। আমাদের সাথে এসে এবার যোগ দেয় আয়ুশী ভাবিও। মেয়েটা দু’দিন হলো আমাদের বাড়িতে অথচ এই মেয়েটা কতো আপন করে নিয়েছে আমাদের সবাইকে!

-‘ কি গো ননদিনী, কি এতো ভেবে হাসছো? বলি হানিমুনে গিয়ে আমাদের আদ্রিশ ভাইয়ের সাথে কি কি করবে তা ভেবেই কি এতো খুশি?

আয়ুশীর কথায় আমার মুখের হাসি উবে যায়। যথারীতি এবারও একরাশ লজ্জায় মাথা নুইয়ে পড়ল আমার। গতরাতের কথা মনে পড়তেই আবারও অজানা শিহরণে শিউরে উঠলাম আমি। আদ্রিশকে লাল টুকটুকে বানাতে গিয়ে আমার-ই যে লাল,নীল,বেগুনি হবার উপক্রম হয়ে উঠেছিল! এসব ছাইপাঁশ ভাবনার মাঝেই অন্য এক ভাবনার আবির্ভাব ঘটে। ফলে আমার মুখের হাসি প্রগাঢ় হয় এবার। চট করে তাই মাথা তুলে, আয়ুশী ভাবির প্রশ্ন উপেক্ষা করে রিশতার উদ্দেশ্যে বললাম

-‘ চল তবে যাওয়াই যাক!

আচমকা আমার সম্মতি পেতেই খুশিতে নেচে ওঠে রিশতার মন। তবে অরনী আর আয়ুশী ভাবির ভ্রু কুণ্ঠিত হয় এতে। অরনী সন্দিহান চিত্তে বলে উঠল

-‘ এসব কি মেহরুন! তোর মাথা ঠিক আছে তো? আমরা কাপলরা মিলে হানিমুনে যাচ্ছি। আর তুই এর মধ্যে ওকে কেন টানছিস?

অধরের কোণে বাঁকা হাসির রেখা প্রশস্ত করে বললাম

-‘ হানিমুন নয়, আমরা চারজন মিলে ট্যুর দিব!

-‘ তাহলে হানিমুন! আর আমার জামাইটার ই-বা কি হবে?

-‘ তুই আছিস তোর জামাই নিয়ে। বলি বিয়ের পর কি আর আগের মতো আমরা তিনজন মিলে কোথাও ঘুরতে বেরিয়েছি না একসাথে আর গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ার সুযোগ হয়েছে। আর এখন তো আরও একজন সদস্য আই মিন আয়ুশী ভাবিও আমাদের সাথে যুক্ত হয়েছে। তাই ভেবে দেখলাম আমরা চারজন মিলেই ঘুরতে গেলে মন্দ হয়না বিষয়টা।

আমার সাথে একমাত্র রিশতাই সম্মত হয় তবে ওদের দুজনের মুখটা ভার হয়ে যায়। আয়ুশী ভাবি মন খারাপ করে বলল

-‘ আমাদের চাইতেও বেশি তোড়জোড় আমাদের জামাইদের। বেচারাগুলো চেয়েছিল বউ নিয়ে হানিমুনে যাবে আর তুমি কিনা ওদের আশায় জল ঢেলে দিতে চাইছো! এগুলো কি উচিত হচ্ছে ননদিনী?

-‘ ওরাও যাবে, আমরাও যাব। শুধু ওরা ওদের মতো যাবে আর আমরা আমাদের মতো। আর তাছাড়া জামাই খুব বেশি আহামরি কিছুই না, ছেলেরা রাতের বেলা ঘুমাতে ভয় পায় বলেই আমরা মেয়েরা বিয়ে করি, এছাড়া আর কিছুই না। আর একদিনেরই তো ব্যাপার। এতো মন খারাপ করো না তো ভাবি।

আমার এহেন কথায় ওরা না হেসে পারল না।

জরুরী কিছু জিনিসপত্র নিয়ে সিড়ি দিয়ে নেমে গাড়ির কাছে যাচ্ছিল আদ্রিশ। এমন সময় তার বউয়ের মুখে উক্ত কথাগুলো কথা শুনে থেমে যায় তার চরণ দু’খানা। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন ফিরে তাই ভ্রু উঁচিয়ে খানিকটা বিষ্ময় নিয়ে চাইল আমার পানে। চোখের ইশারায় বোঝাতে চাইল, ‘তাই নাকি?’ তার পানে চেয়ে সূক্ষ্ম হেসে মাথা নাড়ালাম। আদ্রিশ আর এক মুহূর্তও দাঁড়ায় না। ধুপধাপ পা ফেলে গাড়ির দিকটায় চলে যায়। তা দেখে আরও একদফা হাসলাম। ভেবেছিলাম, ‘লোকটা হয়তো এর তীব্র প্রতিবাদ করবে কিন্তু কিছু না বলাতে আমার কাজটা সহজই হলো।’

আর কথা না বাড়িয়ে আমরাও চললাম গাড়ির দিকে। গাড়িতে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সব আগে থেকেই রাখা হয়েছে। আমাদের যেতে দেখে বাদ যায়না আহিরও। সে-ও এসে বলে বসল, ‘রিশতা গেলে আমিও যাব!’

আহিরকেও এমন করতে দেখে অরনী দাঁতে দাঁত চেপে বলে

-‘ ভাই, আমরা হানিমুনে যাচ্ছি, তোদের সবডিরে নিয়ে ঘুরতে না। আমাদের মাঝে তোরা দুইটা মিলে কাবাব মে হাড্ডি কেন হচ্ছিস? এমন হলে আমি আর যাব না!

আহির অসহায় ভঙ্গিতে বলল

-‘ তাহলে আমাদেরও কাপল বানিয়ে দাও, তবুও নিয়ে চলো না!

-‘ কি দু’দিনের ছোকরা বলে কি-না কপাল বানিয়ে দিতে! এই তুই এখনও ভার্সিটিতেই উঠিসনি, তুই আবার কারে বিয়ে করবি?

-‘ কেন তোমার বোন রিশতা আছে তো!

বত্রিশ পাটি দাঁত কেলিয়ে উক্ত কথাগুলো বলে ওঠে আহির। এদিকে অরনী কটমট করে তাকায় আহিরের দিকে। ক্রুদ্ধ গলায় বলল

-‘ এই তোর বয়স হয়েছে? নাক টিপলে সর্দি পড়ে, সে কি-না বিয়ে করবে!

-‘ বয়স আমার বিশ হলেও, সার্টিফিকেটে একুশ দেওয়া। অর্থাৎ বিয়ের বয়স হয়েছে আমার। আর তাছাড়াও রিশতার সাথে আমার বিয়ে হয়ে…

এতোটুকু বলতে বলতেই থেমে যায় আহির। দুম করে রিশতার চিমটিতে তার হুশ ফেরে। অরনীসহ আমরা সকলে বিষ্ময় নিয়ে চেয়ে রইলাম। দুজনেই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রয়।

অরনী এগিয়ে যায় রিশতার দিকে। অতঃপর ঠাস করে থাপ্পড় বসিয়ে দিয়ে বলল

-‘ আমাদের সকলের থেকে লুকিয়ে বিয়েও করে নিয়েছিস তোরা?

মাথা নত করে চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে রিশতা। পরবর্তীতে আহিরের থেকে জানলাম ওরা নাকি দু’জন প্রাপ্ত বয়স্ক সাক্ষী রেখে বিয়ে করেছে। অথচ আমরা বুঝতেও পারিনি। একবার জানানোরও প্রয়োজন বোধ করল না ওরা! কাওকে না বলুক অন্তত আমায় তো জানাতে পারত! ফলে আমরা কেউই মেনে নিলাম না।
তবে শর্ত জুড়ে দিলাম, ‘আমরা মেনে না নেওয়া অবধি ওরা দেখাও করতে পারবেনা, একসাথে থাকতেও পারবেনা।’

আমার শর্তে ওরা মাথা নেড়ে সম্মত হয়। তবে আকুতি ভরা গলায় বলল,‘ওদের নিয়ে যেতে।’ শত নাটকীয়তার পর অবশেষে ওদের নিয়ে যেতে সম্মত হলাম আমরা। কেননা সবাই মিলে ঘুরতে যাওয়ার সুযোগ আর কবে হবে বলা মুশকিল। এরপরে আদ্রিশের হসপিটালের প্রেসার শুরু হবে, আমারও পড়াশোনা শুরু হবে, তাই দ্বিমত করলাম না আর।

ভাগ্যিস আদ্রিশ, আরাভ আর আলভি ভাইয়ার সাথে কথা বলাতে ব্যস্ত ছিল নয়তো ও জানলে আহিরের আজ খবর ছিল!

সবশেষে মা-বাবা, চাচ্চু-মামনির থেকে বিদায় নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম আমাদের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।
চাচ্চুর গাড়িতে আদ্রিশ, আহির, আরাভ ভাইয়া, আলভি ভাইয়া আর বাবার গাড়িতে আমি, রিশতা, অরনী, আয়ুশী ভাবি উঠলাম। পরবর্তীতে আমি নিজেও ড্রাইভিং শিখেছিলাম, তাই আমাদের ড্রাইভারের কোনো প্রয়োজন পড়ল না আর। গাড়িতে ওঠার আগে অবশ্য আদ্রিশ আহির, রিশতাকে দেখে ঝামেলা করেছিল তবে আমি কোনোমতে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে সামাল দিলাম ব্যাপারটাকে।

গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার সাথে সাথে ফুল ভলিউমে গান ছেড়ে দিলাম। আদ্রিশদের গাড়িকে ফলো করে আমিও গাড়ি চালাতে শুরু করলাম। আমার এমন গুণ দেখে ওরা বাহবা না দিয়ে পারলো না। তা দেখে বিনিময়ে সূক্ষ্ম হাসলাম শুধু।

অবশেষে দীর্ঘ এক পথ পাড়ি জমিয়ে পৌঁছে এলাম আমাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। এখানেরই এক রিসোর্ট আগে থেকেই বুক করে রাখা ছিল। আমরা ম্যানেজারের সাথে কথা বলে আমাদের জন্য বরাদ্দকৃত কক্ষে চলে এলাম। ততক্ষণে রিশতা, অরনী দুজনেই বিছানায় গা এলিয়ে দিল। আমি আর আয়ুশী ভাবি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

সবাই মিলে খাওয়া-দাওয়া সেরে চারপাশটা ঘুরে দেখতে শুরু করলাম। তবে বেশিক্ষণ আর স্থায়ী হলো না তা কেননা ততক্ষণে মাগরিবের আজান পড়ে গিয়েছিল, তাই যে যার কক্ষে চলে এলাম। নামাজ আদায় শেষে আমরা চারজন মিলে আড্ডা দেওয়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।

আড্ডা দিতে দিতে কখন যে সময় পেরিয়ে গিয়েছে খেয়াল নেই তা। এর মাঝেই কক্ষের বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটে। ফলে ঘরটা একেবারে জমাট বাঁধা আঁধারে ছেয়ে যায়। আমি হাতড়ে মোবাইল খুঁজতে আরম্ভ করলাম, ফ্লাশ লাইট জ্বালানোর জন্য কিন্তু মোবাইল পেলাম না কোথাও। এদিকে এতোক্ষণ হয়ে যাওয়ার পর ওদের সাড়াশব্দ না পেয়ে তাই বলে উঠলাম

-‘ কিরে তোদের কোনো সাড়াশব্দ নেই যে! তোরা বেঁচে আছিস তো!

না আমি কথা বলাতেও কারো কোনো সাড়াশব্দ এলো না। এবার আমি কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম। নতুন জায়গা, কাওকে তেমন চিনিও না, তার উপর আবার এমন অন্ধকার। এবার তাই আমি হাঁক ছেড়ে ওদের ডাকলাম। তবুও সাড়া নেই। গেল কই সব? একটু আগেও তো এখানেই ছিল, তবে!

ম্যাচের কাঠির ঘর্ষণে হুট করেই জ্বলে ওঠে আলো! আলোর সন্ধান পেতে সেদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করার আগেই তা আবারও নিভে যায়। আমি এবার কিছুটা চেঁচিয়ে বললাম

-‘ কে কে ওখানে? আলো আঁধারে এমন লুকোচুরি না খেলে, সাহস থাকলে সামনে আসুন আমার!

এরপর কিছু সময় অতিবাহিত হয়ে যায়, চারপাশে নিস্তব্ধতায় ছেয়ে আছে। নিস্তব্ধতা ভেদ করে আমি আবারও বলে উঠলাম, ‘কে ওখানে?’ পূর্বের ন্যায় পুনরায় আলো জ্বলে ওঠে এবার। মোমের আলো তার হলদে মুখশ্রীতে পড়তেই চিনতে অসুবিধে হয়না আমার। অধরের কোণে চমৎকার এক হাসি ফুটিয়ে বলে উঠল

-‘ ভয় পেও না বউ, আমি তোমার শাশুড়ির ছেলে!

#চলবে~