#হৃদয়_জুড়ে_তার_ছায়া
#পর্বঃ২০
#আদওয়া_ইবশার
অলস বিষন্ন দুপুর। শীতের আগমনে প্রকৃতি জীর্ণশীর্ণ। অর্ধ দিনেও সূর্যের দেখা নেই। মনে হয় ধরণীর সাথে প্রজ্জল রবির বড়সর কোনো দন্দ চলছে। যার কারণে হিংসাপরায়ন রবির ধরণীকূলে কিরণ ছড়াতে ভিষণ অনিহা। অলস দিনে পাপড়ির দেহ-মনেও আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে অলসতা। ভার্সিটিতে না গিয়ে চুপচাপ বসেছিল নিজের রুমে। দিনকে দিন বোনের প্রতি হাজারো অভিযোগ জমা হচ্ছে ছোট্ট পালকের। সেই সকাল থেকে কত করে অনুরোধ করল তার সাথে একটু ব্যাডমিন্টন খেলার জন্য। কিন্তু পালক নিরুত্তাপ। বোনের সারা না পেয়ে অভিমানে গাল ফুলিয়ে পাপড়ির থেকে দূরত্ব বজায় রেখে বসে আছে পালক। ছোট বোনের অভিমানের পাহাড় ভাঙার কোনো তোড়জোড় নেই পাপড়ির। দেখেও না দেখার ভান ধরে বসে আছে। তার একারই কেন এতো ঠ্যাকা সবার অভিমান ভাঙানোর? তার মনেও যে অভিমানের আস্তরণ জমতে জমতে বিষন্নতার বেড়াজাল ঘিরে ধরেছে। কই কেউ তো তার অভিমান গায়েও মাখলনা! কেন তার মতো এতো কোমলমতি একটা মেয়ের সাথে নাহিদ নামক পাষণ্ড পুরুষটা এমন করছে? তাহলে কি ভালোবাসা ফুরিয়ে গেছে এই অল্প দিনেই না কি মোহঘোর কেটে গেছে? পাপড়ির জন্য কি নাহিদের মনে আদও কোনো ভালোবাসা ছিল না কি যা ছিল তা স্রেফ ক্ষণিকের মোহ? ভালোবাসা থাকলে কি এতো নিষ্ঠুরতম আচরণ করতে পারত তার সাথে! কথা গুলো মনে আসতেই না চাইতেও বারবার কান্নার লহর এসে গলায় দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। চোখের কোলে টলমল জলটুকু বিদ্রোহ করছে বাইরে বেরিয়ে আসতে। হঠাৎ পাশে অবহেলায় পরে থাকা ফোনটা ব্রাইভ হতেই কিন্চিৎ কেঁপে ওঠে পাপড়ি। হাত বাড়িয়ে ফোনটা কাছে টেনে নেয়। পরিচিত নাম্বার থেকে আসা ছোট্ট একটা বার্তা দেখে অবাক নেত্রে তাকিয়ে থাকে ফোনের স্ক্রীনে। অবশেষে! দুদিন পর অবশেষে কাঙ্ক্ষিত নাম্বার থেকে ছোট্ট একটা বার্তা পেল পাপড়ি। পাষন্ডের মনে একটু সহানুভূতি উদয় হলো তাহলে পাপড়ির জন্য!বহু প্রতিক্ষার পর যেন তৃষ্ণার্ত পথিক উত্তপ্ত মরুভূমির বুকে এক বিন্দু জলের সন্ধান পেল। নাহিদের নাম্বার থেকে আসা অতি ক্ষুদ্র একটা বার্তা,
“গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি। এই অধমের প্রতি দয়া দেখাইয়া অনুগ্রহপূর্বক যদি একটু আসতেন খুবই উপকৃত হইতাম।”
বিষন্নতা দূর হয়ে ঠোঁটের কোণে এক টুকরো হাসির দেখা মিলে পাপড়ির। সাথে হাসে মায়াবী চোখ দুটো। বুকের ভিতর ছলকে ওঠে আনন্দের ঝিরি। তরিৎ বেগে ছুটে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। ড্রয়িং রুমে পৌঁছনোর পরই হঠাৎ মনে পরে ছোট বোনের মলিন মুখটা। কিছু একটা ভেবে আবারও ছুটে যায় রুমে। গোল গোল নেত্রে ঠোঁট ফুলিয়ে বোনের যাবার পানেই তাকিয়ে ছিল পালক। পূণরায় তাকে রুমে ফিরে আসতে দেখে ভ্রুদ্বয় কিন্চৎ কুঁচকে যায়। পালকের মুখের ভঙ্গিমা দেখে ঠোঁট দুটো অল্প বিস্তর ফাঁক করে ঝরঝরে হাসে পাপড়ি। হাত ধরে ছুট লাগিয়ে বলে,
“আর মুখ ফুলিয়ে থাকতে হবেনা। চল বাইরে নিয়ে যাচ্ছি। তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।”
পালকের জবাবের অপেক্ষায় থাকেনা পাপড়ি। শক্ত মুঠোই পালকের নরম হাতটা ধরে এক ছুটে বেরিয়ে যেতে যেতে মা’কে হাক ছেড়ে বলে যায় বাইরে থেকে একটু হেঁটে আসছে। হতবুদ্ধি পালক এখনো কিছুই বুঝে উঠতে পারছেনা হঠাৎ বোনের হলো টা কি! পালকের অবাকের মাত্রা বাড়িয়ে দিতেই বুঝি পাপড়ি এক ছুটে সব কিছু পিছনে ফেলে একেবারে গলির মোড়ে এসে থামে। এতটুকু পথ দ্রুত গতিতে এসেই হাপিয়ে গেছে দুজন। নিঃশ্বাসের সাথে বুক উঠানামা করছে সমান তালে। হাঁসফাঁস লাগছে শ্বাস টানতে। রাগ হয় পালকের। ঝারি মেরে বোনের মুঠো থেকে হাতটা সরিয়ে কন্ঠে তেজ মিশিয়ে বলে,
“কি শুরু করেছো এসব? এতোক্ষন যে বললাম একটু ব্যাডমিন্টল খেলতে তখন তো আমার কথা শুনলেনা। মুখটাকে একেবারে চুলায় রান্না করা পাতিলের হাড়ির মতো কালো করে রেখেছিলে। এখন কেন এখানে টেনে আনলে টর্নেডো গতিতে?”
পালকের কথায় পূণরায় ঝলমলে হাসির ঝিলিক দেখা দেয় পাপড়ির ঠোঁটে। বোনকে তখন থেকে কারণে অকারণে হাসতে দেখে যথাপরনায় অবাক পালক। কেমন যেন অদ্ভুত ঠেকছে সব কিছু ছোট্ট পালকের কাছে। হাত দুটো বুকের কাছে ভাজ করে গম্ভীর হয়ে বলে,
“কি চলছে তোমার মনে বলো তো! প্রেমে-টেমে পরেছো না কি? তোমার এই আচরণ গুলো কিন্তু প্রেমে পরার প্রথম লক্ষণ। দেখো, ভালোই ভালোই বলছি যদি প্রেম-টেম হয়ে থাকে তাহলে ঝটপট বলে দাও আমাকে। নইলে কিন্তু পরবর্তীতে তোমার প্রেমের ভিলেন হয়ে দাঁড়াব আমি। তখন একদম দোষ দিতে পারবেনা আমাকে। ”
এবার শব্দ করেই হেসে দিল পাপড়ি। প্রাণখোলা হেসে সরল চোখে বোনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কিছুদিন আগে তুই আমাকে অভিশাপ দিয়েছিলি মনে আছে? যেদিন ভুলবসত নাহিদের টাকা আমার একাউন্টে চলে আসে এরপরদিন! মনে নেই বলেছিলি, “তোমার জন্য আজকে আমাকে এই বকা গুলো শুনতে হল না! দেখবে আমার মনের অভিশাপে ঐ ছেলের সাথেই তোমার প্রেম হবে। এরপর ব্রেকআপ। সেই দুঃখে তুমি নার্গিস পাগলির মতো বনেবাদরে ঘুরে বেড়াবে। ছোট ছোট বাচ্চারা তোমার পিছনে ছুটতে ছুটতে পাগল বলে খ্যাঁপাবে।ছোট বোনের মনে কষ্ট দিয়ে কেউ কখনো ভালো থাকেনা।”, তোর ঐ অভিশাপ ফলে গেছে রে। ঐ অ’ভ’দ্র,অ’স’ভ্য, ই’ত’র ছেলেটার প্রেমে তোর বোন পাগল প্রায়। ভালোবাসার অনলে প্রতিনিয়ত পুড়ছে আমার এই মন। দ’গ্ধ হচ্ছে মনের আনাচকানাচ। তোর অভিশাপের বাণী সত্যি হয়ে প্রেম তো হলো ঠিকই। কিন্তু দোয়া কর কভু যেন বিচ্ছেদ না হয়। প্রেমের দহনেই আমি পু’ড়ে অঙ্গার। বিচ্ছের অনলে পোড়ার ক্ষমতা একদম নেই আমার। জীবন্ত লাশ হয়ে যাব তোর শেষের কথা গুলো ফলে গেলে। নাহয় একেবারেই ম’রে যাব।”
পালকের চোখ দুটো কোঠার থেকে বেরিয়ে আসার জোগাড়। কিছু বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে যেন একেবারে। কি শুনলো এগুলো সে! তার বোন প্রেমে পরেছে! তাও আবার ঐ নাহিদের! এটা আদও বিশ্বাসযোগ্য? পালকের অবাকের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে তখনই চোখের সামনে উপস্থিত হলো নাহিদ। হাত দিয়ে সিল্কি চুল গুলো পিছনে ঠেলে দিতে দিতে শান্ত ভঙ্গিতে এসে দাঁড়ায় তাদের পাশে। পাপড়ির সাথে পালককে দেখে নাহিদ একটু থমকায়। মনে মনে ভাবে, এই বেয়াক্কলের কি আর কোনোদিন আক্কেল হবেনা! প্রেমিকের সাথে দেখা করতে আসলে কেউ ছোট বোনকে নিয়ে আসে সাথে!,হতাশ হয় নাহিদ। বুক ফুলিয়ে একটা নিশ্বাস ছেড়ে পালকের বিস্ময়ে স্তম্ভিত মুখের দিকে তাকিয়ে পাপড়িকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“এই তিড়িং বিড়িংকে কোন আক্কেলে সাথে নিয়ে এসেছেন?তরকারির অভাবে কি দিন দিন আক্কেল জ্ঞান সব ভাতের সাথে গিলে খাচ্ছেন?”
সাথে সাথেই পাপড়ির প্রফুল্ল বদনটা মলিন হয়ে যায়। বিস্ময় ছুটে যায় পালকের। পাপড়ি কিছু বলার আগেই পালক তেড়ে যায় নাহিদের দিকে। আঙ্গুল উচিয়ে নাক ফুলিয়ে বলে,
“আর একটা কথা বলবেন তো গুতো দিয়ে আপনার পেট কানা করে ফেলব নয়া কুটুম। সাহস কত আপনার ! আমার বোনের সাথে লুকিয়ে লুকিয়ে টাং’কি মেরে আবার আমাকেই এভাবে অপমান করছেন!”
পালকের এমন কথায় ভিষম খায় নাহিদ। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে পালকের দিকে। অন্যদিকে পাপড়ি অদৃশ্য হাতে নিজেই নিজের কপাল চাপড়ে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে আসলেই নাহিদ ভুল কিছু বলেনা। সত্য সত্যিই তার আক্কেল, জ্ঞান কম। নইলে এমন স্ফুলিঙ্গকে কি আর সাথে নিয়ে আসে? খুশির চোটে বোনের আচরণ যে কতটা মার্জিত ভুলেই গিয়েছিল। এখন যদি নাহিদের সাথে এটা নিয়ে ঝগড়া বেধে যায় তাহলে শেষ সব। এই মেয়েকে কেউ আটকে রাখতে পারবেনা। ঠিক ঠিক বাড়ি গিয়ে মায়ের কানে সব লাগিয়ে দিবে। দুজনের এই যুদ্ধের মাঝখানে বলি হবে বেচারি পাপড়ির সদ্য জন্মানো ভালোবাসাটুকু। পালকের দাপুটে কথার তোড়ে যথাপরনায় অবাক নাহিদ। চোখে মুখে অবাকের রেশটুকু ধরে রেখেই কন্ঠে বিস্ময় নিয়ে বলে,
“কি দিন আসলো রে নাহিদ তোর! এই দেড় ইঞ্চির একটা লিলিপুট কি না আমাকে হুমকি দিচ্ছে!”
আবারও অপমানজনক কথায় ফুসে উঠে পালক। ফুস ফুস শব্দ করে নিঃশ্বাস ছাড়ে। দাঁত কিড়মিড় করে বলে ওঠে,
“একেতো আমার মন ভেঙেছেন। তার উপর আবার আমাকেই এভাবে কথা শুনাচ্ছেন। লজ্জা করছেনা আপনার? আপনাকে আমি ভালো ভেবেছিলাম। কিন্তু এখন দেখছি আপনার থেকে সিনেমার ভিলেনরাও যথেষ্ট ভালো হয়। ওরা আন্তত কোনো নাইকার মন ভেঙে তার বড় বোনের সাথে লাইন মা’রে না। আপনার থেকেও অনেক ভালো মনুষত্ববোধ আছে ওদের।”
বোনের মুখের এমন কথা শুনে পাপড়ির জ্ঞান হারাবার যোগাড়। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে পালকের দিকে। নাহিদ’ও এর ব্যতিক্রম নই। দুজনের বিস্ফোরিত নেত্র যোগল একসাথেই তাক হয়ে আছে পালকের দিকে। জড়িভূত কন্ঠে পাপড়ি বলে ওঠে,
“এসব কি বলছিস তুই? কে মন ভাঙলো তোর?”
“কে আবার? তোমার ঐ আলাভোলা খ্যাচর মার্কা প্রেমিক। কত সাদ ছিল আমার মনে তার সাথে প্রেম করব। আমার সেই সাদে বালি ঢেলে এমন করতে পারলে তোমরা? এতো বড় দুঃখ দিতে পারলে আমার এই ছোট্ট মনে?”
পালকের কাঁদো কাঁদো কন্ঠের এমন অদ্ভুত কথা শুনে বুঝতে আর বাকি নেই পাপড়ির বোন তার চিরচারিত স্বভাবের ধারাতেই ফাজলামি করছে। বিষয়টা একদম পছন্দ হলনা পাপড়ির। চোখ পাকিয়ে বোনের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে ওমনি নাহিদ আফসোস টেনে বলে,
“ইশ! এই কথাটা আগে বলবেনা সুইটহার্ট! তোমার মতো একটা মিষ্টি, বুদ্ধিমতি, পাকা ডালিম রেখে কি না আমি বুড়ো কোমড়োর সাথে প্রেম করতে গেছি! হতাশ, হতাশ! আমি নিজেঈ নিজের প্রতি বড়ই হতাশ।”
মুখ বাঁকায় পালক। ঝামটা মেরে বলে,
“এখন আর কপাল চাপড়েও কোনো লাভ নেই। ভুল ডিজিটে যখন ডায়াল করেই ফেলেছেন তখন এর খেসারত তো আজীবন দিতেই হবে। আমি আর আপনার ধারেকাছে নেই। অন্যের জিনিসের প্রতি ছুক ছুক করার অব্যাস এই পালকের কখনো ছিল না আর ভবিষ্যতেও হবেনা। যাচ্ছি আমি। আপনাদের লুতুপুতু প্রেম দেখার একদম আগ্রহ নেই আমার।”
কথাটা বলে আর এক মুহুর্ত দাঁড়ায় না। হাওয়ার বেগে ছুটে যেতে থাকে একটু দূরেই সবুজ মাঠে খেলতে থাকা বাচ্চা গুলোর দিকে। পিছন থেকে চেঁচিয়ে ওঠে পাপড়ি।,
“অ্যাই! তুই আমাকে রেখে কোথায় যাচ্ছিস?”
“ভয় নেই। আম্মুকে কিছুই বলবনা। ইচ্ছেমতো প্রেম করতে থাকো। শুধু বাড়ি যাবার সময় আমার জন্য ঘুষ হিসেবে রফিক মামার ফুচকা নিয়ে আসলেই হবে।”
ছুটতে ছুটতেই পিছন ঘুরে এক পলক বোনের দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয় পালক। হেসে ফেলে পাপড়ি নাহিদ দুজনেই। বোনের দুরন্তপনায় হাসি মুখেই মৃদু স্বরে উচ্চারণ করে পাপড়ি, “পাগল একটা!’ পাপড়ির দৃষ্টি নিজের দিকে ঘুরাতে খুক খুক করে কেশে ওঠে নাহিদ। সাথে সাথেই দৃষ্টি তাক করে নাহিদের দিকে।,
“পাগল বোনকে তো দিন-রায় চব্বিশ ঘন্টায় দেখুন। এবার একটু দয়া করে এই অধমের দিকে দৃষ্টি ফেরান।”
কোথা থেকে যেন আবারও অভিমানী ভিজে বাতাস এসে ছুঁয়ে দেয় পাপড়িকে। হাসি মুখের আদল পাল্টে ভাসে অভিমানের ছাপ। দিপ্ত আক্ষিকুঠোর পরিপূর্ণ হয় জলে। ঘোলাটে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় প্রণয় পুরুষের দিক থেকে। প্রিয়তমার অভিমান বুঝতে আর বাকি রইল না নাহিদের। ঠোঁট কামড়ে অল্প হাসে এই ভেবে, একটু আগেই কি সুন্দর সব অভিমান ভুলে তার এক ডাকেই ছুটে এলো। এখন আবার বাচ্চাদের মতো মিছে অভিমানে গাল ফোলালো! নারী জাতির মন বোঝা আসলেই বড্ড কঠিন। তাদের মনের ঘরে কখন কি চলে কেউ বলতে পারেনা।
নিরব পদচারনায় পাপড়ির নিকট এগিয়ে আসে নাহিদ। দুজনের মাঝে অল্প বিস্তর দূরত্ব রেখে শক্ত হাতের মুঠোয় পুরে নেই পাপড়ি তুলতুলে নরম একটা হাত। আঙ্গুলে আঙ্গুল গুজে মৃদু চাপ প্রয়োগ করে। সহসা কেঁপে ওঠে পাপড়ি। সেই মৃদু কম্পন টের পায় নাহিদ। ঠোঁটের কোণে হাসিটুকু ধরে রেখেই ফিসফিসিয়ে জানতে চায়,
“অভিমানের পাল্লাটা কি খুব বেশিই ভারী হয়ে গেছে? তা কি করলে প্রিয়তমার অভিমান গলে জল হবে?”
নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত, স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে পাপড়ি। প্রসঙ্গ পাল্টে প্রশ্ন করে,
“রাজশাহী থেকে কখন এসেছেন?”
“সকালেই।”
“ডেকেছেন কিজন্য?”
এই প্রশ্ন টুকু করার মাঝে আর অভিমান টুকু লুকিয়ে রাখতে পারলনা। ঠিক কথার ভাজে লুকিয়ে থাকা অভিমানের পারদ টুকু প্রকাশ পেয়ে গেল। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে পাল্টা প্রশ্ন করে,
“ডাকতে বুঝি মানা?”
উত্তরে মৌনতা পালন করে পাপড়ি। বল প্রয়োগ করে হাতে টান লাগায় নাহিদ। মৃদু স্বরে বলে,
“চলো।” ঝটপট মৌনতা ভেঙ্গে উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চায় পাপড়ি,
“কোথায় যাব।”
“বেচে দেব আপনাকে ম্যাডাম। আপনাকে বেচে যে টাকা পাব সেই টাকা দিয়ে আমার ডালিম সুন্দরীর জন্য ফুচকা কিনব।”
এতোদিনের চেপে রাখা একটা প্রশ্ন মুখ্যম সুযোগ বুঝে করে ফেলে পাপড়ি,
“আপনি আমাকে একেক সময় একেক ভাবে সম্বোধন করেন কেন? এই ডাকেন তুমি আবার এই আপনি। যেকোন একটা ডাকবেন। হয় তুমি না হয় আপনি।”
“পারবনা। আমার যখন যেটা ইচ্ছে সেটাই ডাকব।”
নাহিদের সোজা উত্তর। একটু বিরক্ত হয় পাপড়ি। কিন্তু ফের আর কিছু বলতে পারেনা এই প্রসঙ্গে।
চলবে……
#হৃদয়_জুড়ে_তার_ছায়া
#পর্বঃ২১
#আদওয়া_ইবশার
প্রিয় মানুষটার সাথে একান্তে কিছুটা সময় কাটানোর জন্য নাহিদ পাপড়িকে নিয়ে নুহাশ পল্লীতে এসেছে। এই প্রথম প্রিয়তমার হাত ধরে এটুকু পথ ছুটে চলা তার। পাপড়ির ডান হাতটা এখনো নাহিদের পুরুষালী হাতে মুঠোয় বন্দী। কারো মুখে কোনো কথা নেই। নিঝুম সময়টাকে সাক্ষী রেখে পায়ে পায়ে তাল মিলিয়ে হেঁটে যাচ্ছে আপন মনে। অনুভব করছে দুজন দুজনকে নিরবে। পাপড়ির মনের কোণে ঘাপটি মেরে বসে থাকা সুপ্ত অভিমানটুকু একটু একটু করে মিলিয়ে যাচ্ছে মৃদুমন্দ বাতাসের সাথে। ভিতরের সত্বাটা চেঁচিয়ে বলছে বাংলা সিনেমার কালজয়ী সেই গানের মতোই, “এই পথ যেন না শেষ হয়।” মনে হচ্ছে হাজার বছর প্রিয়মত’র হাতের মুঠোয় নিজের হাত রেখে পারি দিতে পারবে সহস্র মাইল। হাটতে হাটতে একসময় দুজনে গিয়ে থামে নুহাশ পল্লীর সেই চিরচেনা তিনটি পুরোনো লিচু গাছের নিচে। যেখানে সমাধিত প্রয়াত কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ।
নিরব পরিবেশটাকে ছাপিয়ে হুট করেই ঝমঝমিয়ে এক পশলা বৃষ্টির আগমন ঘটে। এই অসময়ের বৃষ্টিতে বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিতে পরে যায় দুজনেই। নাহিদ চারপাশে তাকিয়ে কিছুটা দূরে একটা ছাউনি দেখতে পেয়ে পাপড়ির হাত ধরে এক ছুটে আশ্রয় নেয় সেখানে গিয়ে। দৌড়ে আসতে আসতেই দুজনের অর্ধভেজা অবস্থা। একে তো শীত শীত আমেজ। তার উপর আবার অসময়ী বৃষ্টি। দুইয়ে মিলিয়ে ভালোই ঠান্ডা ঝেঁকে ধরেছে দুজনকে। নাজুক অবস্থা পাপড়ির। শীতের প্রকোটে মৃদু কাঁপন ধরেছে পুরো শরীরে। নাহিদ এক পলক পাপড়ির দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। বৃষ্টির ছিটায় পরনের জামা আটসাট হয়ে লেগে পাপড়ির শরীরের অনেকাংশই দৃশ্যমান। দূরের জাম বাগানের দিকে দৃষ্টি রেখে ইতস্ততঃ গলায় নাহিদ বলে,
“ওড়নাটা ভালো ভাবে গায়ের সাথে জড়িয়ে নাও। ঠান্ডা কম লাগবে।”
পাপড়ি যাতে নাহিদের কথায় নিজের পরিস্থিতি বুঝে অস্বস্তিতে না পরে সেজন্য কথাটা ঘুরিয়ে বললেও সে ঠিকই নিজের অবস্থান বুঝতে পেরে লজ্জায় গাট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কাঁপা হাতে ওড়নাটা চাদরের মতো শরীরে জড়িয়ে নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করে,
“বাসায় যাব কখন? আমাকে রেখে পালক বাসায় চলে গেলে মা সন্দেহ করবে।”
ভ্রু দ্বয় কিন্চিৎ কুঁচকে আড় চোখে পাপড়ির দিকে তাকায় নাহিদ। বাঁকা স্বরে বলে,
“আক্কেলের সাথে সাথে কি চোখ দুটোর দৃষ্টিও খেয়ে নিয়েছো? দেখতে পাচ্ছো না অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে! এই বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি যাওয়ার বাহানায় রাস্তার মানুষজনকে নিজের আকর্ষনীয় ফিগার দেখানোর খুব শখ জেগেছে?”
কথাটা শেষ করে পূর্ণ দৃষ্টিতে পাপড়ির দিকে তাকায় নাহিদ।চোখে ভাসে তার গোলগাল মুখের শুভ্র আদলটুকু মুছে গিয়ে একটু আগে যে লজ্জার আস্তরণ টুকু জমা হয়েছিল। সেটা হুট করেই মিলিয়ে গিয়ে বিষাদের দেখা মিলছে। কাজল কালো চোখ দুটোতে ভীর জমিয়েছে টলটলে অশ্রু। নাহিদ বুঝতে পারে কথাটা হয়তো একটু বেশিই রূঢ় ভাবে বলে দিয়েছে। আবারও নিজের অজান্তেই প্রিয়তমার মনে কষ্ট দিয়ে বসেছে। একটু বুঝি আনুসূচনা হয় নাহিদের মনে। এমন সুন্দর একটা মুহুর্তে ঐরকম বেফাস কথা কিভাবে বের হলো তার কন্ঠনালী দিয়ে বুঝতে পারছেনা সে। নিজেই নিজের কাজে বিরক্ত। অতি কাছের দুজন মানুষের ছলনায় মন মেজাজ একেবারে ঘেটে গেছে। না চাইতেও বারবার তাদের রাগটুকু উগলে দিচ্ছে পাপড়ির উপর। কানে ভাসে পাপড়ির ক্ষুব্ধ কন্ঠস্বর,
“আমি আসতে চেয়েছিলাম এখানে? নিজে থেকে নিয়ে এসে এখন এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি ফেলে আমাকেই কথা শুনাচ্ছেন!”
“বাপরে! বোকা রানী দেখি রাগতেও জানে!”
অবাক হবার ভান ধরে বলে নাহিদ। কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না পাপড়ি। টলমল দৃষ্টিটুকু পায়ের দিকে তাক করে স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুক্ষণ চুপচাপ পাপড়ির ভাব গতি লক্ষ্য করে পূণরায় নাহিদ বলে ওঠে,
“আচ্ছা বাবা সরি। আমার ভুল হয়েছে। আমাকে ক্ষমা করে দিন জনাবা।”
এবারও কোনো প্রতিক্রিয়া নেই পাপড়ির। অসহায় চোখে পাপড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে নাহিদ। ফের বলে,
“সরি বললাম তো। এখন কি কানে ধরতে হবে?”
“নাটক করতে হবেনা এতো।”
ঠোঁট কামড়ে অল্প হাসে নাহিদ। হাত দিয়ে হালকা ভেজা চুল গুলো এলোমেলো করতে করতে বলে,
“ওয়েদারটা রুমান্টিক না? ঝুম বৃষ্টি, হিমশীতল বাতাস, রিমঝিম সুরে বৃষ্টির মূর্ছনা, একটা ছাউনির নিচে দুজন ছেলে-মেয়ে একা। ইশ! এর থেকেও রুমান্টিক ওয়েদার হয় না কি আর?”
কথাটা শেষ করে একটু থামে। দুষ্টু হেসে দু পা এগিয়ে আসে পাপড়ির দিকে।কানের কাছে মুখটা নিয়ে ফিসফিসিয়ে আবারো বলে,
“আমার তো খুব প্রেম প্রেম পাচ্ছে সুইটহার্ট। তোমার পাচ্ছেনা?”
মুহূর্তেই কান ঝা ঝা করে ওটে পাপড়ির। শুভ্র মুখে ছড়িয়ে পরে আরক্তিম আভা।মাথা ঝিম ধরে যায় এমন লাগামছাড়া কথায়। অস্পষ্ট স্বরে কাঁপা ঠোঁট দুটো নাড়িয়ে বলে ওঠে,
“অসভ্য লোক কোথাকার।”
এখনো মিটিমিটি হাসছে নাহিদ। নাটকীয় ভঙ্গিতে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হতাশ স্বরে বলে,
“আজ-কাল সত্যি কথা বললেও মানুষ অসভ্য হয়ে যায়। দিন দিন যে আর কি কি শুনতে হবে। কপাল, কপাল। সবই কপাল।”
কথাটা শেষ করেই পাপড়ির দিকে এক নজর তাকিয়ে আবারো দুষ্টুমি ভরা গলায় সুর তুলে গেয়ে ওঠে হাবিব ওয়াহিদ এবং নেন্সির জনপ্রিয় সেই গান,
বৃষ্টি যদি আর না থামে আজ
আলতো ছোঁয়ায় ভাঙ্গাবো যে লাজ
কালো মেঘে ঢেকেছে আকাশ
শোনো এ হৃদয়ে তোমার বসবাস
তোমাতে ডুবে থাকে এলোমেলো মন
খুব কাছে পেতে চায় যখন তখন
রিমঝিম সুর তুলে আকাশ বেয়ে
এই বুকে নেমে এসো বৃষ্টি হয়ে
আর শুনতে পারেনা পাপড়ি। কান দুটো গরম হয়ে ওঠে। লজ্জা, অস্বস্তিতে হাসফাস করে চিত্ত। মাত্রাতিরিক্ত লজ্জায় দিশা হারিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে,
“চুপ, একদম চুপ। আপনি, আপনি যে এতোটা অসভ্য আগে জানলে কখনো আসতাম না আপনার সাথে। উপর দিয়ে দেখলে যে কেউ বলবে ভাজা মাছটাও উল্টে খেতে জানেনা। অথচ ভিতরে ভিতরে কি অ’শ্লী’ল। এ জীবনে আপনার সাথে আর কখনো কোথাও যাবনা আমি। এটাই প্রথম আর এটাই শেষ।”
পাপড়ির এমন নাস্তানাবুদ অবস্থা দেখে উচ্চ স্বরে হেসে ওঠে নাহিদ। শরীর দুলিয়ে হাসতে হাসতে বুকে ব্যথা অনুভব হয়। চোখের কোণে জল জমে। তবুও হাসি থামাতে পারেনা। রিমঝিম বৃষ্টির সুরের সাথে নাহিদের উচ্চ স্বরের হাসির শব্দে পাপড়ির মনে হয় এক অন্যরকম ঐন্দ্রজালিক মুহুর্তের আর্বিভাব ঘটেছে। মুগ্ধ চোখে লাজ ভুলে তাকিয়ে থাকে নাহিদের মুখের দিকে। মনে মনে ভাবে,’ছেলেদের হাসিও বুঝি এতো সুন্দর হয়?’
****
সেদিন হালকা বৃষ্টিতে ভিজেই বাড়ি এসে জ্বরে পরে পাপড়ি। পালক আগেই বাড়িতে এসে মা’কে মিথ্যে বলে মানিয়ে নেয় এটা বলে, পাপড়ি তার এক বান্ধবীর বাসায় গিয়েছে কিছু নোট’স আনার জন্য। ফলস্বরূপ পাপড়িকে আর রওশন আরা’র কোনো প্রশ্নের সম্মুখে পরতে হয় না। তবে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বাড়ি আসায় কথা শুনাতে ভুলেন না। কিছুদিন যাবৎ এমনিতেই পাপড়ি শরীরে অত্যধিক তাপ অনুভব করে। সবসময় জ্বর জ্বর ভাব লেগেই থাকে। অল্পতেই ক্লান্তিরা এসে ভীর জমায় শরীর জুড়ে। তার উপর আবার বৃষ্টিতে ভিজায় জ্বরটা ভালোই ভোগান্তিতে ফেলে তাকে। গত তিন দিন ধরে জ্বরে অচেতন হয়ে পরে আছে বিছানায়। ঠিক মতো খেতে পারেনা। শোয়া থেকে ওঠে বসতেও যেন তার রাজ্যের অলসতা। পুরো শরীর জুড়ে ব্যথার ছড়াছড়ি। রওশন আরা হাজার বলেও ডাক্তারের কাছে নিতে পারছেন না। ডাক্তার, হাসপাতাল এই দুটো জিনিসের প্রতি পাপড়ির সেই ছোট বেলা থেকেই অন্যরকম এক বিতৃষ্ণা কাজ করে। সে অসুখে ঘরে পরে ম’র’তে রাজি। কিন্তু হাসপাতালমুখো হতে রাজি না। রওশন আরা হাজারবার বুঝিয়ে বলার পরও পাপড়ি নিজের সিদ্ধান্তে অনড়। একদিকে মা অন্যদিকে নাহিদ। দুটো মানুষেই সেই জ্বরে পরার দিন থেকে তার মাথা খে’য়ে ফেলছে ডাক্তার ডাক্তার করতে করতে। পাপড়ি দুজনের একজনকেও কিছুতেই বুঝিয়ে উঠতে পারছেনা তার ডাক্তারের কাছে যাওয়া নিয়ে কতটা অস্বস্থি। এইতো গতকাল রাতের ঘটনা। নাহিদ ফোন করেই সরাসরি আগে পরে কিছু জিজ্ঞেস না করে হুমকি দিয়ে বসে,
“কাল দুপুর পযর্ন্ত সময় দিলাম। এর মাঝে যদি আমি শুনি ডাক্তারের কাছে না গিয়ে নাটক করা শুরু করেছো ঘরে তখন কিন্তু আমি একদম পা গুটিয়ে বসে থাকবনা। কে কি ভাবলো না ভাবলো ঐসব একদম পরোয়া না করে সোজা তোমার বাড়িতে এসে সয়ং তোমার মায়ের সামনে দিয়ে কোলে তুলে নিয়ে যাব ডাক্তারের কাছে। এবার তোমার ডিসিশন। কি করবে ভেবে দেখো। সহজভাবে ডাক্তারের কাছে যাবে, না কি আমার কোলে ওঠবে! আর একটা কথা নিশ্চয়ই জানো, আমি কখনো তোমার মতো খালি কলসি বাজায় না! এই নাহিদ যা বলে তা করে দেখায়। ড্যামো তো প্রথম দিকেই দিয়েছিলাম। মনে আছে !”
একদমে কথা গুলো শেষ করে পাপড়িকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ফোনটা কেটে দেয় নাহিদ। সেই থেকেই গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত পাপড়ি। বারবার কল দেবার পরও নাহিদ ফোন তুলছেনা। এদিকে চিন্তায় জ্বরের কারণে হওয়া মাথা ব্যথা দ্বিগুণ বেড়ে গেছে পাপড়ির। অসহ্য ঠেকছে সব কিছুই। বিতৃষ্ণায় ভিতরটা একেবারে ছেয়ে গেছে। মনে মনে মাথা ঠুকে ম’র’ছে কোন কুক্ষণে ঐ পাগলটার সাথে প্রেম করতে গেল এই ভেবে।
চিন্তায় চিন্তায় অস্থির হয়েও কোনো কূল-কিনারা না পেয়ে বিরস মুখে রওশন আরা’কে জানায় সে ডাক্তারের কাছে যেতে রাজি। রওশন আরা মেয়ের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,
“হঠাৎ সুবুদ্ধির উদয় হলো কিভাবে তোর নিরেট মাথায়? জ্বরের চোটে আবার আবোলতাবোল বলা শুরু করে দিস নি তো?”
মায়ের কথার প্রেক্ষিতে প্রত্যাশা কিছু বলতে যাবে। তার আগেই পালক পাশ থেকে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে ওঠে,
“ডেয়ার মা জননি!আপনার মেয়ের মাথায় সুবুদ্ধি উদয় হইয়াছে কি হয় নাই সেইটা জানার থেকেও এইটা জানা অতিব জরুরি যে, আপনার মেয়েকে শায়েস্তা করার মতো পাবলিক উদয় হইয়াছে কি হয় নাই।”
পালকের কথা কিছুই বোধগম্য হয়না রওশন আরা’র নিকট। চোখ পিটপিট করে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন করে,
“তোরও কি আবোলতাবোল বলার বদ অভ্যাস শুরু হলো না কি! না কোনো জ্বিন, ভূত আসর করেছে?”
জ্বরের প্রকোপে নিভু নিভু চোখ দুটোই বহু কষ্টে হালকা তেজের আভাষ এনে তাকায় পাপড়ি পালকের দিকে। চোখের দৃষ্টিতে বোনকে শাসিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
“ওফ মা! তোমাদের সমস্যাটা কি বলবে আমায়? ডাক্তারের কাছে না গেলেও তোমাদের অশান্তি। এখন যেতে রাজি হয়েছি এতেও তোমাদের অশান্তি। করব টা কি আমি? ভালো লাগছেনা আমার একদম এসব।”
****
গত এক ঘন্টা যাবৎ বিরক্ত ভঙ্গিতে হাসপাতালের ওয়েটিং রুমে বসে আছে পাপড়ি। পাশেই রওশন আরা কোমরের ব্যথায় এক টানা বসে থাকতে না পেরে ক্ষণে উঠছে তো ক্ষণে বসছে। গিজগিজ মানুষের হাওকাওয়ে মাথা ব্যথাটা দ্বিগুণ থেকে চারগুণ হয়ে আছে পাপড়ির। ডাক্তারের চেম্বারে ডুকে সমস্যার কথা বলতে না বলতেই পাপড়ির ভাষ্যমতে মেডিক্যাল সাইন্সে যত হাবিজাবি পরীক্ষা-নিরীক্ষা আছে সব দিয়ে দিয়েছে তাকে। ঠিক এই কারণেই ডাক্তার হাসপাতালের প্রতি এতো অনিহা তার। সামান্য একটা জ্বরের ওষুধ দিতেও তারা হাজারটা টেস্ট করিয়ে আগেই রুগিকে নাজেহাল তো করবেই সাথে মনের জোড়টাও ভেঙে দিবে। আর টাকার কথা কি’ই বা বলবে! জনগণের তো এখন জানাই হয়ে গেছে। ডাক্তার মানেই কসাইয়ের আরেক রূপ।বিরক্ত ভঙ্গিতেই এসব ভাবতে ভাবতে ডান হাতের দিকে তাকায় পাপড়ি। একটু আগেই ডা’কা’তে’র দল গুলো এই হাত থেকেই পুরো এক সিরিঞ্জ র’ক্ত নিয়ে গেছে। হাতের শি’রাটা এখনো কেমন জ্বলছে। রা’গে ক্ষু’ব্ধ হয়ে বিরবির করে বলে ওঠে,
“মানুষের সেবা করার নামে প্রকাশ্যে ডা’কা’তি শুরু করে দিয়েছে দ’স্যু গুলো। টেস্টের জন্য লাগবে সামান্য এক ফোটা র’ক্ত অথচ নিয়ে নিল পুরো এক সিরিঞ্জ। মনে হয় তাদের বাপ-দাদার টাকায় খেয়ে খেয়ে র’ক্ত উৎপাদন হয় আমাদের শরীরে।”
“যেভাবে বলছো মনে হচ্ছে ‘রক্ত না পুরো একটা কি’ড’নি নিয়ে গেছে।”
হঠাৎ পরিচিত পুরুষালী কন্ঠ শুনে চমকে মাথা তুলে তাকায় পাপড়ি। দেখতে পায় তার ঠিক পাশের চেয়ারটাতেই সাবলীল ভঙ্গিতে বসে আছে নাহিদ। ভূত দেখার মতো চোখ বড় বড় করে নাহিদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উত্তেজিত কন্ঠে বলে ওঠে,
“আপনি এখানে কি করছেন? পাগল হয়ে গেছেন না কি? জানেন না সাথে মা আছে ! এখানে এই অবস্থায় আপনাকে দেখলে কি ভাববে! ফাঁসাতে চাইছেন আমাকে?
কথা শেষ করে ভয়ার্ত চোখে একবার দূরে দাঁড়ানো রওশন আরার দিকে তো একবার নাহিদের দিকে তাকাচ্ছে পাপড়ি। তার এমন অবস্থা দেখে নাহিদ হুট করে এক অভাবনীয় কান্ড ঘটিয়ে দেয়। দূরে দাঁড়ানো রওশন আরাকে ডেকে ওঠে চেঁচিয়ে,
“আন্টি! আপনি এখানে এসে বসুন। আমি কাউন্টারে দেখে আসি রিপোর্ট এসেছে কি না।”
চলবে……