হৃদয় নিবাসে তুই
পর্ব-২৫
লেখনীতেঃভূমি
টিউশনি শেষ করে নেহাদের বাসার সামনে দিয়েই চলে যাচ্ছিল দিহান।রাত তখন আটটা কি সাড়ে আটটা।রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের হলদেটে আলোয় চারপাশটা বেশ আলোকিত।সোডিয়ামের সে আলোয় একনজর তাকিয়েই নেহাদের বাসার দিকে বেশ কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকল দিহান।বেলকনিতে মিনিট কয়েক তাকিয়ে থাকতেই হঠাৎ নেহাকে সেখানে উপস্থিত হতে দেখেই চমকাল সে।বুকের ভেতর দমবন্ধকর চাপা পরিবেশ সৃষ্টি হলো মুহুর্তেই।বেলকনির লালচে ঢিম লাইটের আলোয় মেয়েটার আবছা ছায়া স্পষ্ট।গ্রিলে হাত রেখেই দাঁড়িয়েছে।দিহানের নজর তার উপর পরতেই বোধ হয় খিলখিলিয়ে হাসল।ঢিম লাইটটা নিভিয়ে সাদা ঝকঝকে লাইটটা জ্বালিয়ে দিয়েই হাত নাড়াল সে।দিহান ভারী চাহনিতে তাকাল।ইশশ!টিউশনি শেষে ফেরার পথে ব্যস্ততার মাঝে একদমই উচিত হয়নি নেহার বেলকনির দিকে তাকানো।কি ভাবছে এখন? পরমুহুর্তেই বেপরোয়া মন বলল,”ভাবলে ভাবুক না। কি ক্ষতি?সে তো তোমাকেই ভালোবাসে।তোমার নরম চাহনি দেখে সে নিশ্চয় তোমায় খারাপ ভাববে না।তোমার দৃষ্টিতে তার উপস্থিতির রেশ, ভালোবাসার এটুকু ছিটেফুটে যদি পেয়েও থাকে সে। ক্ষতি কি?মানুষটাতো ভালোবাসে তোমাকেই। তোমারই তো।”দিহান ভ্রু চুলকাল।উশখুঁশ করে কৃত্রিম হাসল।এই মুহুর্তে কোন দক্ষ প্রেমিকের মতো কোন আচরণ বা কথা মনে পড়ল না তার।নেহাকে কি বলা উচিত, বা কি করা উচিত তাও বুঝল না।মাথা কেমন ভোতা হয়ে গেল।সেই ভোতা মাথা নিয়েই দাঁড়িয়ে থেকে হা করে নেহার দিকে তাকিয়ে রইল সে।নেহা হাসল সেই চাহনি আর নার্ভাস হওয়া মুখ দেখে।দিহানের দিকে তাকিয়েই মিষ্টি হেসে চোখ টিপল সে।দিহান অপ্রস্তুত হলো।নেহার আচরণে বিস্মিত হয়ে চোখ বড়বড় করে চাইতেই নেহা ইশারা দিয়ে বুঝাল সেও নিচে আসছে।দিহান ছোট শ্বাস ফেলল।মার্চের শুরুর দিকে ভ্যাপসা গরমে ঘেমে উঠা শার্টটা একহাতে হালকা ঢিলে করে আবার ছেড়ে দিল।কপালের ঘামটা মুঁছে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকার মাঝেই তার সামনে এসে দাঁড়াল সেই চমৎকার, চঞ্চল, প্রাণবন্ত মেয়েটি।মুখে তার দারুণ এক হাসি।দিহান ইতস্থত হয়ে এক নজর নেহার দিকে তাকিয়েই মাথা নোয়াল।উঁশখুঁশ করে বলে উঠল,
‘ আসলে এখান দিয়েই বাসায় ফিরছিলাম তাই। ‘
নেহা হাসল।ভ্রু উঁচু করে প্রশ্ন ছুড়ল,
‘ তাই?তাই কি?’
দিহান গলা ঝাড়ল।কয়েক সেকেন্ড নেহার দিকে তাকিয়েই নেহার হাসিটা দেখে হতাশ হলো।নেহা নিশ্চয় মনে মনে তাকে অনেক কিছু ভাবছে।ছিঃ ছিঃ!একদমই উচিক হয়নি এভাবে টিপিক্যাল প্রেমিকদের মতো নেহার বাসার সামনে এসে তার বেলকনির দিকে হ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকা।একদমই না।মানসম্মানটা কোথায় গিয়ে ঠেকল এখন?উঁশখুঁশ করেই বলে উঠল সে,
‘ না কিছু না।আসি?’
নেহা মুখ ফুলাল।দিহানকে যাওয়ার অনুমতি না দিয়ে পথ আটকে দাঁড়াল সে।দিহানের হাতটা চট করেই বাচ্চাদের মতো জড়িয়ে ধরে চোখ টিপে হাসল।ঠোঁট উল্টে বলল,
‘ উহ,তুই মেয়েদের মতো লজ্জ্বা পাচ্ছিস কেন দিহান?আমি কি তোকে খেয়ে ফেলব?মেয়েদের মতো লজ্জ্বায় মাথা নামিয়ে নিচ্ছিস, পালাই পালাই করছিস কেন? আমাদের ফুলশয্যা হচ্ছে না তো ইয়ার..’
দিহান ক্লান্ত চাহনিকে তাকিয়ে রইল।ঠোঁট বাকিয়ে হেসে বলল,
‘ ছেলেদের মতো বিহেভিয়ার করব?করি?’
নেহা ড্যাবড্যাব করে তাকাল।চোখজোড়ায় খেলল তীব্র বিস্ময়।সেই বিস্ময় কাঁটাতেই দিহান মুচকি হাসল।নেহার হাতের তালুটা শক্তভাবে চেপে ধরেই মুচকি হেসে বলল,
‘ প্রেমিকের মতো বিহেভ করব না।ভয় পাস না।চল হাঁটবি?আকাশের চাঁদ দেখি দুজন মিলে।রাস্তার একধারে আজ তোর হাত ধরে হাঁটব।যাবি? ‘
নেহা হাসল।হাত দুলিয়ে হাঁটতে লাগল দিহানের সাথে পা চালিয়ে।মাঝেমাঝেই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকটির দিকে থাকাল গভীর দৃষ্টিতে।
.
অদ্রিজা থম মেরে বসে রইল।মুখে চোখে বেশ গম্ভীর ভাব।দৃষ্টিটা মোবাইলের স্ক্রিনে স্থির।প্র্যাগনেন্সির রিপোর্ট পাওয়ার পর থেকেই তার প্রতি অত্রিয়ার খেয়াল করা, যত্ন নেওয়া বেশ করে বেড়ে গিয়েছে।নেহাও তার সাথে যুক্ত হয়েছে।ইদানিং তার আর মন খারাপ হয় না।এই দুইজন মেয়ে সবসময় তাকে আগলে রাখার চেষ্টা করে।কিন্তু হঠাৎ করেই এত ভালোবাসা?এত আগলে রাখা?প্র্যাগনেন্সির জন্য? অদ্রিজা বুঝল না।একটু আগেও নেহা কল করে অনেকক্ষন কথা বলেছে।মাঝে সাঝেই তার কথাবার্তা, ছুটোছুটি করা ভিডিও করে।কখনও বা তার দিকে মোবাইলটা তাক করে ধরে রাখে।অদ্রিজা বুঝে উঠে না বিষয়গুলা।এখন ঘড়ির কাঁটায় রাত বারোটা।তবুও তার চোখে ঘুম আসছে না।কিছুক্ষন আগে যখন নেহা কল করেছিল, সাফসাফ বলে দিয়েছে কোন এক আননোন নাম্বার থেকে কল আসলে যাতে সে রিসিভড করে।কিন্তু কেন করবে?নাম্বারটা কার?কিছু জানায়নি।অদ্রিজা থম মেরেই বসে রইল।মোবাইলের স্ক্রিনে এখনো জ্বলজ্বল করছে সেই আননোন নাম্বারটা।আজ বেশ কয়দিন হলো এই নাম্বারটা থেকে কল এসেছে।সে একবারও রিসিভড করে নি।কিন্তু এবার বিস্তর কৌতুহল জমল। বেশ কয়বার কল দেওয়ার পরই হাত দিয়ে মোবাইল তুলল অদ্রিজা।ক্লান্ত চাহনিতে নাম্বারটা দেখেই বুঝল নাম্বারটা দেশীয় নয়।অদ্রিজা ক্লান্তি নিয়ে নিঃশ্বাস ফেলল।কল রিসিভড করেই রাশভারী গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠল,
‘ হ্যালো?’
ওপাশ থেকে কথা বলল না কেউ।বেশ গাঢ় নিরবতা উপলব্ধি করতেই চুপ হয়ে রইল অদ্রিজা।আবারও বলল,
‘ হ্যালো।’
ওপাশ থেকে এবার কেউ একজন কেঁশে উঠল।হালকা মৃদু গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,
‘ কেমন আছেন? ‘
অদ্রিজা থমকাল।কন্ঠটা শুনে বুঝতে বাকি রইল না মানুষটা কে।সঙ্গে সঙ্গেই চোখমুখ কঠিন হলো।কপালে ফুটে উঠল গভীর ভাজ।তীব্র বিরক্তি নিয়ে কল কাঁটতে যাবে ঠিক তখনই ওপাশের মানুষটা আবার ও বলল,
‘খবরদার কল রাখবেন না অদ্রিজা।অনেক কষ্টে কলে আপনাকে পেয়েছি।আজকে কতদিন ধরে কতবার কল দিয়েছি খবর আছে আপনার?কোন দরকার আছে নিশ্চয় এতবার যখন কল দিচ্ছি।কিন্তু আপনি তো আপনিই।তাই না?’
অদ্রিজা মুখে চোখে তীব্র রাগ নিয়ে বসে রইল খাটে।থমথমে মেজাজ নিয়ে কয়েক সেকেন্ড বসে থেকেই গম্ভীর গলায় শুধাল,
‘ কি দরকার?আপনার সাথে কোন দরকার থাকবে বলে মনে হয় না,হচ্ছে ও না।’
রক্তিম হালকা হাসল বোধ হয়।বেশ কিছুটা সময় চুপ থেকেই হালকা কাঁশল।জড়ানো কন্ঠে বলে উঠল,
‘ আমি আপনাকে একবার দেখতে চাই।সুযোগ দিবেন প্লিজ?একবার আপনার মুখটা দেখব।প্লিজ। একবার ভিডিও কল দিব?’
অদ্রিজার স্পষ্ট উত্তর,
‘ একদমই না।মাঝরাতে এসব বলে বিরক্ত করছেন একটা মেয়েকে?লজ্জ্বা করছে না?রাখছি।’
‘ এই এই।না রাখবেন না।আরেকটু কথা বলি প্লিজ।অনেকদিন হলো আপনার সাথে কথা বলা হয় না অদ্রিজা।অনেকদিন আপনার চুলগুলো ফু দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয়ে উঠে না।অনেকদিন আপনার ঘুমন্ত মুখটাও দেখা হয় না।খুব অভাববোধ করছি আপনার।খুবব!’
অদ্রিজা চুপ রইল।কিছু বলল না।মিনিট দুই চুপ থাকতেই রক্তিম আবারও বলল,
‘ আজ খুব ইচ্ছে হচ্ছে আপনাকে একবার জড়িয়ে ধরি অদ্রিজা।আপনার কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে এক অপ্রত্যাশিত শব্দ মুখ দিয়ে আওড়াতে ইচ্ছে করছে ভীষণ।আপনার খোলা চুলে মাতাল হতে বড্ড ইচ্ছে হচ্ছে।আপনার ঠোঁট একবার ছুঁয়ে দেখতেও ইচ্ছে হচ্ছে।আমি খুব খারাপ ভাবে আজ আপনাকে মিস করছি অদ্রিজা।আপনার কোমড় জড়িয়ে কিছুটা সময় মুখটা কাঁধে ভর দিয়ে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আপনাকে উপলব্ধি করতে ভীষণ মন চাইছে অদ্রিজা।একবার আপনার মুখটা দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে।ভীষণভাবে!’
অদ্রিজা কেঁপে উঠল কথাগুলো শুনে।রক্তিমের গলা ভীষণ রকম শীতল,ঠান্ডা।এর আগে এতটা শীতল, নিচু কন্ঠে রক্তিম তার সাথে কথা বলেছে কিনা মনে পড়ে না।কয়েক মিনিট নিশ্চুপ থেকেই বলে উঠল সে,
‘ আমার ঘুম পাচ্ছে মিঃ রক্তিম।মাঝরাতে আপনার এসব ফালতু কথা শোনার সময় নেই।রাখছি।’
অদ্রিজা কল রাখার আগেই রক্তিম আবারও বলল,
‘ আজ আমায় এতটা অবহেলা করা আপনার উচিত হচ্ছে না অদ্রিজা।আপনিই বলুন উচিত হচ্ছে?এতটা আকুতি মিনতি করার পরও কেন এই ব্যবহার?পরে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেন তো অদ্রিজা?’
‘ মানে?’
রক্তিম হাসল।ঠোঁট চেপে বলল,
‘ কিছুই না।যদি আর কোনদিন আমার সাথে আপনার কথা না হয় তবে নিশ্চয় কোন একদিন ভাববেন, একটা যুবক আপনার মুখ দেখার জন্য ছটফট করেছে।বোধ হয় তার চোখে পানিও ছিল কথা গুলো শুধানোর সময়। আপনি তার আকুতি মিনতি কত সহজেই প্রত্যাহার করলেন।আর যদি আবার দেখা হয়, আবার কথা হয় তবে সুদে আসলে ফেরত পাবেন আপনি সবটা।সবটাই!’
অদ্রিজা হাঁসফাঁস করল।রক্তিমের কথাগুলো মস্তিষ্কের ভেতর ঘুরতেই দ্রুত কল রাখল অদ্রিজা।
চলবে….