হৃদয় নিবাসে তুই পর্ব-৩৪

0
409

হৃদয় নিবাসে তুই
পর্ব-৩৪
লেখনীতেঃভূমি

সুইটহার্ট দরজা খুলতেই অদ্রিজা তার লাল হওয়া মুখচোখ নিয়ে সরু চোখে চেয়ে থাকল।নিচের ঠোঁটটা দাঁত দিয়ে চেপে রেখেই ওড়নাটা মাথা থেকে সরাতে সরাতেই ভেতরে আসল।সোফায় বসেই সুইটহার্টের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,

‘ সুইটহার্ট?তুমি বলেছিলে আমায় কথাগুলো বলবে।বলবে এখন?আমি জানতে চাই।’

সুইটহার্ট গম্ভীর চাহনিতে তাকাল।পরনের শাড়িটা ঠিক করে নিয়ে পা এগিয়ে অদ্রিজার সামনে দাঁড়াল।বার কয়েক নিঃশ্বাস ফেলেই পানির জগটা ইশারা করে বলে উঠল,

‘ বাইরে থেকে এসেছো অদ্রি।এক গ্লাস পানি খেয়ে নাও।’

অদ্রিজা জেদ নিয়ে তাকাল।নিচের ঠোঁটে রক্তিমের কাঁমড়ের জন্য হালকা ব্যাথা অনুভব করেই ঠোঁটে ঠোঁট চেপে মুখ ফুলিয়ে বসে রইল।গম্ভীর গলায় মুখ কালো করে বলল,

‘ বলবে না তা সোজাসুজি বললেই তো পারো সুইটহার্ট!তোমরা সবাই আসলেই রক্তিমমুখী!কি আছে ঐ খারাপ লোকটার মাঝে?ঐ লোকটা বলতে নিষেধ করলে তোমাদের মুখ থেকে একটা শব্দ তো দূর,একটা অক্ষরও বের হয় না সুইটহার্ট।অথচ আমার সব কথাই উনাকে বলে দাও।কেন?এই যে এখন উনার অপারেশনের কথা জিজ্ঞেস করছি এটাও নিশ্চয় বলে দিবে তাই না?সবাই খারাপ!আমায় কেউই ভালোবাসে না।’

সুইটহার্ট আনমনেই হাসল।কুচকানো চামড়ায় সেই হাসি ভারী মানাল।কাঁচা পাঁকা চুলগুলোর কিছু চুল কপালে ভীড় করতেই তা কানের পেঁছনে গুঁজে নিল।অদ্রিজার দিকে তাকিয়েই মুচকি হেসে বলল,

‘ ধুররর!কেন তোমায় কেউ ভালোবাসবে না?এই মিষ্টি মেয়েটাকে ভালো না বেসে থাকা যায়? ‘

অদ্রিজা ঠোঁট উল্টেই বলল,

‘ দিব্যি যায়।তুমি, নেহা সবাই তো ভালো না বেসেই আছে।কেউ আমায় সত্যিটা বলোনি।এখনও বলছো না সুইটহার্ট!’

সুইটহার্ট মিনমিনে চোখে তাকিয়ে রইল।অদ্রিজার মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় বলল,

‘ সত্যিটা জানার কি এতটাই প্রয়োজন অদ্রি?না জানলেই নয়?ঐসব তিক্ত দিনগুলোর কথা মনে করতেই খারাপ লাগে।বলতে গেলে তো আরো খারাপ লাগবে।তোমারও খারাপ লাগবে। ‘

অদ্রিজা ভ্রু কুঁচকাল।ঠোঁট বাঁকিয়েই বলল,

‘ কি এমন কথা যে খারাপ লাগবে?বলে ফেলো সুইটহার্ট।আমার নয়তো শান্তি হবে না।’

সুইটহার্ট হাসল ঠোঁট টেনে।লম্বা একটা শ্বাস ফেলেই বলল,

‘ আচ্ছা বলছি।’

অদ্রিজা মৃদু হাসল।চোখেমুখে উৎসুক দৃষ্টি।কি এমন ঘটেছিল?সত্যিটা আসলে কি ছিল?সুইটহার্ট কি বলবে? এসব ভেবেই মনোযোগী হয়ে তাকিয়ে রইলো সুইটহার্টের দিকে।সুইটহার্ট সেই উৎসুক দৃষ্টি পর্যবেক্ষণ করেই কয়েক সেকেন্ড পর বলতে লাগলেন,

‘ রক্তিমের ব্রেইন টিউমার ছিল অদ্রি।তোমার সাথে যখন রক্তিমের বিয়ে হয় তারও প্রায় বছর এক আগে বিষয়টা আমরা জানতে পেরেছিলাম।প্রচন্ড মাথ ব্যাথায় যখন ছটফট করত প্রথমে বিষয়টা অতোটা গুরুত্ব না দিলেও পরবর্তীতে যখন ডক্টর দেখানো হলো, বিভিন্ন টেস্ট করা হলো তখনই জানতে পারলাম ওর ব্রেইন টিউমার।আমি তখন ভীষণ ভেঙ্গে পরেছিলাম।দিন রাত কেবল কান্না করতাম।কেন ওর জীবনে এমন কিছু হলো তা ভেবেই।ছোটবেলা থেকে কষ্ট পেতে পেতে জমে যাওয়া ছেলেটার জীবনেই আবার কেন এমন শাস্তি!সৃষ্টিকর্তার কাছে বারবার প্রার্থনা করেছি যাতে জানের সাথে খারাপ কিছু না হয়।দিনরাত কেঁদে ভাসিয়েছিলাম।কিন্তু ও কোনদিন এই বিষয়টা নিয়ে এটুকুও মন খারাপ করেনি।বাবা মায়ের থেকে কষ্ট পেয়ে ম্যাচিউর হওয়ার পর থেকে ওর মুখে সর্বক্ষন যে মুচকি হাসিটা জড়িয়ে থাকত সেই হাসিটা তখনও ছিল।নিজের জীবনের এমন একটা কথা জানতে পেরে কোনদিন ওর মনেই হয়নি দুঃখ করা উচিত।কারণ ও জানত, আমিও কিছু বছর পর ওর সাথে আর থাকব না।কোন একদিন আমিও শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করব।তখন তো ও একা হয়ে যাবে।কি করে বাঁচবে সেই নিঃসঙ্গ জীবন?সেই কষ্টকর নিঃসঙ্গ বিশ্রী জীবনটা কাঁটানোর থেকে এভাবে ব্রেইন টিউমারের উপলক্ষ্যে অকালে মরে যাওয়াই ভালো।এটাই ওর মাথায় ডুকেছিল তখন।ওর মনে হতো সৃষ্টিকর্তা এটা ওর ভালোর জন্যই করেছে।ঐ যে বলে না, বিধাতা যা করে ভালোর জন্যই করে।জানও ঐ কথাটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করল। কিন্তু আমি মানতে পারলাম না।ডক্টরের সাথে আলাপ করে জানতে পারলাম, অপারেশনের মাধ্যমে টিউমার নামক অভিশাপটা থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে।তবে নিশ্চয়তা নেই।অপরেশনটার সফলতার অংশ ছিল পঞ্চাশ শতাংশ আর অসফলতার অংশ পঞ্চাশ শতাংশ।আমি সেইদিন ভীষণ কান্না করেছিলাম। আজও মনে পড়ে।সেইদিন জানও আমায় জড়িয়ে কেঁদেছিল।চোখের পানি মুঁছিয়ে দিয়ে বলেছিল,” সুইটহার্ট?আর কতদিন বাঁচব তা তো আমি জানি না হয়তো খুব শীঘ্রই মরে যাব, নয়তো বেশি হলে আর অল্প কয়েক বছর।সেই তো একদিন আমি মারাই যাব সুইটহার্ট। কিন্তু অপারেশনটা অসফল হলে আমাকে এক্ষুনিই সব ছেড়ে চলে যেতে হবে। এই দুনিয়া থেকে, তোমার থেকে চিরতরে চলে যেতে হবে সুইটহার্ট। তার থেকে আর কয়টা দিন বাঁচি সুইটহার্ট? তোমায় নিয়ে।সুন্দর করে আর কয়েকটা বছর কাঁটাই?প্লিজ!’আমি সেইদিন জানের কথার উপর আর কোন কথা বলতে পারিনি অদ্রি।কান্নায় বারবার চোখ ভিজে গেছিল আমার।তারপর আর সেই প্রসঙ্গ জানের সামনে তুলিইনি কোনদিন আমি।যদি ওর মন খারাপ হয় সেই ভয়েই আর কোনদিন এই বিষয়টা ওর মনেই পড়তে দিই নি।সবসময় ওকে হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করতাম আমি।সবসময় আগলে রাখার চেষ্টা করতাম।যাতে কোনদিন ও ঐ কথাটা মনে করে কষ্ট না পায়।’

সুইটহার্ট ছোট নিঃশ্বাস ফেললেন সবগুলো কথা বলেই।অদ্রিজা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল।রক্তিমের জীবনের এতকিছু সম্পর্কে কোনদিনও এইটুকুও আন্দাজ করতে পারেনি সে।সত্যিই রক্তিমের মুখের হাসিটা কোনদিন ও বুঝতেই দেয় নি তার ভেতরের এতকিছু।সত্যিই কি কষ্ট হতো না তার এই কথাটা ভেবে?সৃষ্টিকর্তা যা করেন ভালোর জন্য করেন এটা মানলেও দিনশেষে কি আক্ষেপ হতো না?কান্না পেত না?অদ্রিজা ভেবে পেল না।চোখজোড়া অল্প টলমল করে উঠতেই অন্য পাশ ফিরে চাইল।জোরে জোরে শ্বাস ফেলেই কান্না দমিয়ে বলে উঠল,

‘ তারপর?তারপর কি হয়েছিল সুইটহার্ট?অপারেশণ টা কবে হয়েছিল?’

সুইটহার্ট তপ্তশ্বাস ফেললেন।গম্ভীর মুখখানি অদ্রিজার দিকে তাক করেই গম্ভীর চাহনি ফেললেন। ভিজে উঠা কন্ঠটা নিয়েই আবার বলতে লাগলেন,

‘ তোমার সাথে যে ওর বিয়ে হয়েছিল, বিষয়টা আমি প্রথমে জানতাম না।হয়তো ওর বাবার পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করেছে ভেবে কষ্ট পাব, এই ভেবেই বলেনি।জানি না ঠিক।তবে হয়তোবা তোমার সাথে বিয়ের পর থেকেই রক্তিম তার নিজের সাথে ভেতরে ভেতরে লড়তে থাকল।নিজের সাথে নিজেই প্রতিনিয়ত লড়তে লড়তে যখন ক্লান্ত হয়ে যেত, পরাজিত হয়ে যেত তখনই টলমলে চোখে চেয়ে থাকত ও।কোনকোনদিন কান্না ও করত।আমি অবাক হয়ে চাইতাম।যে সব দুঃখকে লুকিয়ে হাসতে জানে, সে যে কাঁদতেও জানে তা ঐ দিনগুলোতেই আমি টের পেয়েছিলাম।আমার ছোট্ট দাদুভাই যে সেই ছোট্টটিই রয়ে গেছে তা ঐ দিনগুলোতেই আমি বুঝেছিলাম।বারবার বলত, “সৃষ্টিকর্তা এমন কেন করল আমার সাথে।” আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলতাম।প্রায় একমাস, একমাস থেকে কম হবে অবশ্য, ও আমার থেকে দূরে ছিল।জিজ্ঞেস করলেই বলত অফিসের কাজে।সেই প্রথম ও আমার থেকে কিছু লুকিয়ে গিয়েছিল।তোমার সাথে ওর বিয়ের কথাটা লুকিয়ে গিয়েছিল।যেইদিন জানতে পারলাম তোমাদের বিয়ের বিষয়টা আমি বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম।সত্যিই বিশ্বাস হচ্ছিল না আমার। পরমুহুর্তেই অবশ্য আমি হেসেছিলাম।আমি সত্যিই চেয়েছিলাম ওর জীবনে কেউ আসুক, কেউ ভালোবাসুক ওকে।আমি যখন থাকব না দুনিয়ায় তখন যাতে কেউ তাকে ভালোবেসে আগলে রাখে।সত্যিই চেয়েছিলাম।সৃষ্টিকর্তা সেই ইচ্ছেটাই পূরণ করলেন তোমায় এনে।তখনই বুঝেছিলাম দিনের পর দিন ওর মন খারাপের কারণ।কান্নার কারণ।বুঝতে পেরেছিলাম ও তোমায় ভালোবাসে।সেইদিন সত্যিই কতোটা খুশি হয়েছিলাম আমি জানা নেই।মনে মনে বারংবার সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম।কিন্তু ঐ যে!দিনশেষে ঐ একটাই ভয়!ঐ ভয়টার কারণেই ও তোমাকে দূরে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল। ঐ ভয়টার কারণেই তোমার সুন্দর জীবনটাকে ওর অনিশ্চিত জীবনের সাথে জড়াতে চায়নি। নিজের ভালোবাসাকেও বিধাতার ঐ অভিশাপের ভেতর মুড়িয়ে নিয়েছিল।ভালোবাসার মানুষটা নিজের জেনেও পর করে দিতে চেয়েছিল।শুধু ঐ একটাই কারণে!’

অদ্রিজা থমকে গেল!রক্তিম যে তাকে ভালোবাসে কথাটা মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছাতেই কেঁপে উঠল শরীর।কিছুতেই বোধগম্য হলো না কথাটা।মনটা বাচ্চাদের মতো বারংবার জিজ্ঞেস করল,” সত্যি?সত্যিই রক্তিম তোমাকে ভালোবাসে অদ্রিজা?” অদ্রিজা চোখ বন্ধ করল। রক্তিম তাকে ভালোবাসে কথাটা বারংবার মনের ভেতর ঘুরতে লাগল।চোখ মেলেই সুপ্তশ্বাস ফেলে সুইটহার্টের দিকে তাকাল।প্রশ্ন করল,

‘ উনি আমাকে ভালোবাসে?কিভাবে?কি বলছো তুমি সুইটহার্ট?’

সুইটহার্ট মুচকি হাসল। বলল,

‘ সেটা না হয় ওর কাছ থেকে জেনে নিও অদ্রি।ভালোবাসে কিনা জিজ্ঞেস করে নিও। ‘

‘ উনি বলবেন, উনি আমায় ভালোবাসেন?স্বীকার করবেন? ‘

‘ সেটা তো জানা নেই।’

অদ্রিজা হতবিহ্বল চাহনি নিয়ে তাকাল।ঠোঁট চেপে বলল,

‘ তারপর?তারপর কি হয়েছে?’

‘ তারপর?তারপর ও তোমায় দূরে সরিয়ে দিল।সিদ্ধান্ত নিয়েই নিল, ওর অনিশ্চিত জীবনের সাথে তেমার জীবন কিছুতেই জড়াবে না।সেই হিসেবে তোমার মায়ের কাছে ভুলভাল সব প্রমাণ করে তোমায় রেখে আসল।ভেবে নিয়েছিল এবার তোমার আর ওর পথ আলাদা।সেই আলাদা পথ হাঁটতে গিয়ে নিজেই বারংবার রক্ত ঝরিয়েছে।নিজেই কষ্ট পেয়েছে।চিৎকার করে কেঁদেছে।শুধুমাত্র তোমার থেকে আলাদা হওয়ার কষ্টে।দিনশেষে সেই কষ্টগুলোকে আপন করেও নিজেকে আলাদা রাখল তোমার থেকে।কিন্তু বিধাতা বোধ হয় তা চায় নি।তাই তো মাসখানেক পর অত্রিয়া কল করে বলল তুমি মা হতে চলেছো।সেইদিন ওর অনুভূতিটা কেমন হয়েছিল তা হয়তো বলে বুঝাতে পারব না।ওর মুখের সেই হাসিটাতে পৃথিবীর সব সুখ ছিল সেইদিন।আর সেইদিন ও সিদ্ধান্ত নিল অপারেশনটা হবে।নিজের সন্তানের জন্যই সেদিন ওর বাঁচার আকুতি মিনতি দেখে আমার চোখ টলমল করছিল।ঝাপসা চোখে ওর দিকে সেদিন অনেকক্ষন তাকিয়ে ছিলাম আমি।তারপর সেই সময়টা এল।দেশ ছেড়ে অপরিচিত দেশে ওর চিকিৎসার জন্যই গিয়েছিলাম।এতটা রিস্ক নিয়ে জীবন মরন নিয়ে প্রশ্ন রাখা সেই অপারেশনটা যখন ঠিকভাবে সম্পন্ন হলো, সফল হলো জানাল ডক্টর তখন কান্নায় চোখজোড়া লাল হয়ে গিয়েছিল আমার।দুইদিন পর যখন ওর জ্ঞান ফিরল তখন হাউমাউ করে কেঁদেছিলাম।ও শুধু হেসেছিল সেদিন।অস্ফুট স্বরে বলেছিল,” সুইটহার্ট!আমার সন্তান আমার সাথেই বাঁচবে।সৃষ্টিকর্তা আমার সন্তানের সাথে অন্যায় করেনি।”সে কথাটা শুনে কান্না করতে করতেও হেসেছিলাম আমি।তারপর আরও একমাস পর আবার দেশে ফেরা,তোমায় জ্বালানো, তোমার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা,তোমায় আপন করার প্রচেষ্টা।সেখান থেকেই শুরু। ‘

কথাগুলো বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল সুইটহার্ট। অদ্রিজা কেবল টলমলে চোখে চেয়ে থাকল।রক্তিমের এত বড় একটা অপারেশন হলো অথচ সে কিছুই জানল না?কিছুই জানাল না কেউ তাকে?যদি রক্তিম আজ না থাকত?যদি রক্তিমের কিছু হয়ে যেত?ভাবতেই মুঁছড়ে উঠল ভেতরটা।শত হোক, ভালোবাসে তো!ঐ মানুষটাকেই তো ভালোবাসে!

চলবে….