#হৃদয়_মাঝে_হঠাৎ_তুমি
#সানা_শেখ
#পর্ব_15
[কার্টেসি ব্যতীত কপি করা নিষিদ্ধ]
আলভী মায়ার রুম থেকে বেরিয়ে নিজের রুমে আসে।
অস্থিরতায় ঘামছে পুরো শরীর। রুমে এসেই টাওয়েল নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। শাওয়ার না নেয়া পর্যন্ত আর ভালো লাগবে না।
গেস্টরা ফ্রেস হয়ে নীচে নেমে আসে। তাদের সকলের জন্য হালকা নাস্তা পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে অল্প সময়ের মধ্যেই।
সবাই কে খেতে দেওয়া হয়।
খাওয়া শেষ করে সবাই আবার সোফায় বসে। বাড়ির সবাই ড্রইং রুমে উপস্থিত থাকলেও মায়া আর আলভী নেই।
লিরা বসা থেকে উঠে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসে। দাঁড়ায় আলভীর রুমের সামনে এসে। ডোর ঠ্যালা দিয়ে বুঝতে পারে ভেতর থেকে লক করা।
মায়া আর আলভী রুমের ভেতরে একসাথে রয়েছে? লিরা যত টুকু শুনেছে আলভী এখনো মায়া কে সহ্য করতে পারে না। ডি ভোর্স দেওয়ার জন্যই দেশে এসেছে। তাহলে দুজন একসাথে বন্ধ রুমের ভেতর কি করছে?
মায়ের কাছ থেকে শুনেছিল আলভী দেশে এসেছে মায়া কে ডি ভোর্স দেওয়ার জন্য। কিন্তু ডি ভোর্স হয়েছে নাকি হবে না সেটা আর পরে জানতে পারেনি। কয়েক বার জিজ্ঞেস করলেও ওর মা বলতে পারেনি কারণ ওর মা নিজেও জানে না পরে কি কি হয়েছে বা ঘটেছে।
কারো পায়ের শব্দ পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। মায়া করিডোর দিয়ে হেঁটে এগিয়ে আসছে সিঁড়ির দিকে।
মায়া লিরা কে আলভীর রুমের সামনে দেখেও পাত্তা না দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যায়।
লিরা বুঝতে পারে আলভী রুমের ভেতরে একাই আছে।
ডোর নক করে কয়েক বার।
ভেতর থেকে কোন সাড়া শব্দ আসে না। আবার নক করার জন্য হাত উচু করতেই ডোর খুলে দেয় আলভী। সামনে লিরা কে দেখে কপাল ভ্রু কুঁচকে যায়। এই মেয়ে এখানে কেন?
“একা একা রুমের ভেতর কি করছো?”
“বউ তো কথা শুনছে না তাই একা একাই শুয়ে আছি।”
“মানে?”
“কিছু না, কিসের জন্য এসেছো সেটা বলো?”
“তোমার সাথে গল্প করতে এলাম।”
“নিচে গিয়ে সকলের সাথে গল্প করো, আমি এখন বের হবো।”
“কোথায় যাবে?”
“ঘুরতে?”
“আমিও যাব তাহলে, ঢাকা শহর তো সেভাবে কখনো ঘুরে দেখা হয়নি আমার।”
“আমার ফিরতে অনেক লেট হয়ে যাবে। অন্য কোন দিন সকল কে নিয়ে ঘুরতে যাব। এখন তুমি নিচে যাও।”
বলে লিরার মুখের উপর ডোর বন্ধ করে দেয়। লিরা হা করে বন্ধ ডোরের দিকে তাকিয়ে রইলো।
এভাবে অপমান করল?
ঘণ্টা খানিক পর রেডি হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে আলভী। ড্রইং রুমে আসতেই সকলের সাথে দেখা হয়। কিন্তু মায়া কে দেখতে পেল না। মনে মনে একটু খুশি হয়। যাক ওর কথা শুনেছে তাহলে। কিন্তু নাঈমুর কোথায়? ওই বদ ছেলেও তো নেই এখানে। ধক করে ওঠে আলভীর বুকের ভেতর। আহা রে ওর বউ কোথায় গেল?
মাহিদ নিজের রুম থেকে বেরিয়ে আসে।
সাজ্জাদ বলে,
“এভাবে তৈরি হয়ে কোথায় যাচ্ছো তোমরা দুজন?”
“বাইরে যাব একটু।”
“আমিও যাব তাহলে।”
সাজ্জাদের ছোট ভাই সাদাত বলে,
“আমিও যাব তোমাদের সাথে।”
এই সুযোগে আলভী বলে,
“তাহলে নাঈমুর কেও নিয়ে যাই। নাঈমুর কোথায়?”
নাঈমুর সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে বলে,
“এই যে আমি, কোথায় যাওয়ার কথা হচ্ছে?”
সাজ্জাদ বলে,
“কোথায় ছিলি এতক্ষণ?”
“অফিসে।”
আলভী বলে,
“অফিস কোথায় পেলি বাড়িতে?”
সাদাত বলে,
“এই অফিস সেই অফিস না ব্রো। এই অফিসে গিয়ে সবাই নিজেকে হালকা করে।”
সাদাতের কথা আলভীর বুঝতে একটু সময় লাগে।
“আচ্ছা চলো সবাই।”
সোফায় বসে থাকা আলভীর মামা বলে,
“যেখানেই যাও বেশি রাত করো না কেউ, দ্রুত ফিরে এসো।”
“আচ্ছা।”
বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় পাঁচ জন।
সামসুন্নাহার বেগম মায়ার রুমে আসেন। মায়া তখন মানতাসা কে নিয়ে খেলছিল নিজের রুমে।
ওর বেশি মানুষ জন ভালো লাগে না এখন। তাই নিজের রুমে এসে বসে আছে।
“কি করছো মায়া?”
“এইতো বসে আছি নানু, বসুন।”
উপরে উপরে হেসে কথা বললেও ভেতরে ভেতরে রাগ হয় মায়ার। এই বুড়ি কে ওর দুচোখে সহ্য হয় না।
সামসুন্নাহার বেগম বেডের উপর বসেন মায়ার পাশে।
মানতাসার সাথে একটু কথা বলে মায়ার দিকে তাকান।
“একা একা রুমে বসে আছো কেন?”
“মানতাসা নিচে থাকতে চাইছিল না তাই ওকে নিয়ে এখানে বসে আছি।”
“তা কি ভাবলে?”
“কি ভাববো?”
“তোমার আর আলভীর সম্পর্ক নিয়ে।”
“কি?”
“ওর সাথেই সংসার করবে নাকি অন্য ছেলে কে বিয়ে করবে? শুনলাম আলভী নাকি তোমাকে ডিভোর্স দিতে রাজি হচ্ছে না।”
“কেন নানু নাতি কে আবার বিয়ে করানোর জন্য মেয়ে দেখে রেখেছেন নাকি?”
সামসুন্নাহার বেগমের মুখ টা ছোট হয়ে যায়। মেয়েটা চেটাং চেটাং কথা শিখে গেছে এখন।
মায়া আর কিছু না বলে মানতাসার দিকে তাকিয়ে রইল। এই বুড়ি কম কথা শোনায়নি ওকে এত দিন ধরে। যখনই এই বাড়িতে এসেছে নানান ছলে বলে কৌশলে কথা শুনিয়েছে।
সামসুন্নাহার বেগম আরো কিছু হয়তো বলতেন কিন্তু মায়ার শক্ত চোখ মুখ দেখে আর কিছু বললেন না।
আলগোছে বসা থেকে উঠে রুম থেকে বেরিয়ে জান।
মায়া ডোরের দিকে তাকিয়ে থাকে। এখনো কি আগের সেই বোকা ভীতু মায়া নাকি যে চুপ চাপ সব শুনবে কিন্তু কিছু বলবে না? যদি তাই ভেবে থাকে তাহলে ভুল ধারণা। এই মায়া আর চুপ থাকবে না, নিজের উপর করা অন্যায় আর মেনে নেবে না। একটা কথা শোনাতে আসলে দশটা শুনতে হবে।
“ফুপ্পি?”
“বলো বেইবি।”
“ছোত আব্বু যাব।”
“কেন আমার কাছে থাকলে কি হবে?”
“চলো।”
“না।”
“পিলিচ ফুপ্পি।”
“তুমি একা যাও আমি যেতে পারব না।”
“কেন?”
“কারণ তোমার ছোট আব্বু খুবই বাজে একজন মানুষ।”
“না, ছোত আব্বু বালো মানুস। আমালে অনেক আদল কলে।”
“দুদিন ধরে আসেনি তার মধ্যেই ছোট আব্বু অনেক ভালো মানুষ হয়ে গেল?”
উপর নিচ মাথা নাড়ায় মানতাসা।
“চলো না।”
মায়া বির বির করে বলে,
“ওই অসভ্য অভদ্র শ/য়/তা/ন বদ লোকের সামনে যাব না আমি। এর পর আমার ধারে কাছে আসার চেষ্টাও করলে বারি দিয়ে মাথা ফাটিয়ে দেব।”
“একা একা কি বলছো তুমি?”
“কিছু না, তুমি খেলো।”
“না ছোট আব্বুর কাছে যাব।”
“মহা মুশকিল তো, ছোট আব্বুর মধ্যে কি আছে যে তার কাছেই যেতে হবে?”
“আসো দেকাচ্ছি।”
“কি?”
“ছোট আব্বু।”
“ওই অসভ্য লোক কে দেখতে চাই না আমি।”
মানতাসা শোনে না মায়ার কোন কথা। ওর এখন আলভীর কাছে যেতে ইচ্ছে করছে।
সেই সকালে একটু কোলে নিয়েছিল তারপর আর কোলে নেয়নি। এখন আলভীর কাছে যাওয়ার জন্য মন ছুটে গেছে। মায়ার হাত টেনে ধরে করিডোরে এসে দাঁড়ায়। মায়া আর এক পা ও আগায় না। মায়া কে টেনে নিয়ে যেতে না পেরে ওকে ছেড়েই দৌড়ে এগিয়ে যায় আলভীর রুমের দিকে। ডোর ধাক্কা দিতেই খুলে যায়। রুমের লাইট অফ করে জানালা দিয়ে আলো আসছে ভেতরে। রুমে কেউ নেই। আবার দৌড়ে মায়ার কাছে ফিরে আসে।
“ছোট আব্বু নেই তো।”
“রুমে নেই?”
“না।”
“তাহলে বোধহয় নিচে সকলের সাথে রয়েছে।”
“চলো।”
মায়া মানতাসার হাত ধরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে। সোফায় আলভী কেন মাহির ছাড়া আর কোন যুবক ছেলেই নেই।
বড়রা সবাই গল্পে মশগুল হয়ে গেছে।
“তোমার ছোট আব্বু বাইরে গেছে মনে হচ্ছে। তুমি তোমার আব্বুর কাছে যাও এখন।”
মানতাসা গুটি গুটি পায়ে মাহিরের কাছে এগিয়ে যায়।
মায়া রুমে ফিরে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাড়াতেই লিরা পেছন থেকে ডেকে ওঠে।
ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও দাঁড়ায় মায়া।
লিরা মায়ার কাছে এগিয়ে আসে।
“চলো উপরে গিয়ে কথা বলি।”
“হুম।”
মায়ার রুমে আসে দুজন। ওদের দুজনের পেছন পেছন আবার নাঈমুরের ছোট বোন নাদিরা আসে।
“কেমন কা/টছে তোমার দিন কাল?”
“আলহামদুলিল্লাহ খুব ভালো কা/ট/ছে আপু, তোমার কেমন কা/ট/ছে?
“ভালো, তা কি ভাবলে?”
“কোন বিষয়ে?”
“তোমাদের দুজনের।”
“আমি আর কে?”
“বুঝেও না বোঝার ভান করছো নাকি?”
“বুঝেও না বোঝার ভান করবো কেন? ক্লিয়ার করে বলো , না বললে বুঝবো কিভাবে?”
“তোমার আর আলভীর ডি ভো র্স কবে হচ্ছে?”
“নতুন ভাবী খুঁজে রেখেছো নাকি আপু?”
“মানে?”
“মানে হলো এটাই যে আমাদের দুজনের তা লাক হয়ে গেলে তোমাদের ভাইয়া কে তো আবার বিয়ে করাবে নিশ্চই। বিয়ে করানোর জন্য তো মেয়ে লাগবে, মেয়ে খুঁজে রেখেছো নাকি সেটাই জানতে চাইলাম।”
“আমি যেই প্রশ্ন করেছি সেটার উত্তর দাও, তানা নিজেই উল্টো প্রশ্ন করছো।
“এই জন্মে তা লাক না হলে কি খুব বেশি অন্যায় বা গুনাহ হয়ে যাবে?”
“কি বলতে চাইছো?”
“আমি কিছু বলতে চাইছি না। আমি তো মুক্তি চাইছি কিন্তু তোমার ভাইয়া তো কিছুতেই রাজি হচ্ছে না। এখন সুন্দরীবতী, মেকআপবতী, স্টাইলিশবতী, গোছালোবতী, শয় তানিবতী, ন্যাকাবতী, ছ্যাঁকাবতী ছ্যাচড়াবতী, কুটনিবতী, মেয়ে খুঁজে বের করে তোমার ভাইয়া কে দেখাও। তাকে পছন্দ করে যদি আমাকে একটু মুক্তি দেয় আমি তাহলে একটু খুশি হব।”
“পা গ লের মত কি সব বলছো!”
“এরকম গুণ ওয়ালা মেয়ে খুঁজে পেলে নিয়ে আসবে আমি নিজ দায়িত্বে তোমার ভাইয়া কে বিয়ে করিয়ে দেব তার সাথে। এই গুণ গুলো না থাকলে কিন্তু বিয়ে ক্যানসেল।”
“সত্যি সত্যিই পা গ ল হয়েছো নাকি তুমি?”
“পা গ ল হতে যাব কেন? আজব। এই সব গুণ তো আমার মধ্যে নেই, ছিল না কখনো। তোমার ভাইয়ের বোধহয় এই সব গুণ ওয়ালা মেয়েই পছন্দ। এসব গুণ ওয়ালা মেয়ে দেখলেই তো দাঁত বের করে হাসে।”
“মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছ তুমি, দ্রুত চিকিৎসা করাও নিজের। নাদিরা আয়।”
দুজন চলে যেতেই মায়া চিৎ হয়ে শুয়ে গা ঝাঁকিয়ে হেসে ওঠে।
,
,
সন্ধ্যার পর পর বাড়িতে ফিরে আসে পাঁচ জন।
বাকি চার জন স্বাভাবিক থাকলেও স্বাভাবিক নেই আলভী। আলভীর হাতে পায়ে কপালে ব্যান্ডেজ বাঁধা।
সাদা শার্টের জায়গায় জায়গায় লাল ছোপ ছোপ দাগ হয়ে আছে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে আসছে।
সোফায় বসে থাকা সকলেই লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায়।
দ্রুত এগিয়ে আসে আলভীর কাছে।
ঐশী রহমান ছেলে কে ধরে উতলা হয়ে বলে,
” তোমার কি হয়েছে আলভী? এমন অবস্থা কিভাবে হলো? কোথায় গিয়েছিলে?”
“শান্ত হও আম্মু, সেরকম কিছু হয়নি। বাইক নিয়ে পড়ে গিয়েছিলাম হাত পা ছিলে গেছে একটু একটু।”
“কিভাবে পড়লে?”
“চালাতে গিয়ে।”
সাদাত বলে,
“ভাইয়া বাইক চালাতে পারে না। দুদিন শিখেছে। আজকে ভালোই চালাচ্ছিল। গিয়ার বাড়িয়ে টান দিতেই বাইক নিয়ে রাস্তায় চিৎপটাং হয়ে গিয়েছিল। আর এখন এই অবস্থা।”
“আলভী বাইক চালাতে পারে না?”
কয়েক জনের অবাক গলার স্বর।
আলভী বলে,
“বাইক চালাতে না পারা টা কি অনেক বড় পাপ?”
“না মানে এত বড় হয়েও বাইক চালাতে পারো না তাই আরকি।”
“আগে কোন দিন চালাইনি তাহলে শিখব কিভাবে?”
“জার্মানিতে বাইক নেই?”
নাঈমুরের ছোট ভাই বলে কথা গুলো।
“জার্মানিতে বাইক আছে কিন্তু আমার মু তা র সময় নেই। তাই চালানো শিখতে পারিনি।”
আলভীর কথা শুনে ছোট বড় সকলের অবস্থা দেখার মত। এমন ভাবে আলভীর দিকে তাকিয়ে আছে যেন অবিশ্বাস্য কিছু দেখে ফেলেছে বা শুনে ফেলেছে।
আশ্চর্য্য এই ছোট্ট একটা কথার জন্য এভাবে তাঁকিয়ে থাকার কি হয়েছে?
চলবে………….
#হৃদয়_মাঝে_হঠাৎ_তুমি
#সানা_শেখ
#পর্ব_16
[কার্টেসি ব্যতীত কপি করা নিষিদ্ধ]
মায়া নিজের রুম থেকে বেরিয়ে নিচে নেমে আসতেই
দেখে হাত পা মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা আলভী কে।
আলভী কে এমন অবস্থায় দেখেই পা দুটো থেমে যায় মায়ার। সবাই কথা বলছে আর আলভী চুপ চাপ শুনছে।
আলভীর মনে হতে থাকে মায়া ওর আশে পাশে আছে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখে সত্যি সত্যিই মায়া দাঁড়িয়ে আছে একটু দূরে, তাঁকিয়ে আছে ওর দিকেই।
আলভী কে তাকাতে দেখে দৃষ্টি সরিয়ে নেয় মায়া। ঘুরে দাদির রুমের দিকে এগিয়ে যায়।
আলভী বির বির করে বলে,
“হায়রে বউ রে, কাছে এসে একটু জিজ্ঞেসও করলো না “কি হয়েছে?” উল্টো মুখ বাঁকিয়ে চলে গেল, পাষাণ বউ।”
“আমি ড্রেস চেঞ্জ করে ফ্রেস হয়ে আসছি।”
বলেই বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে যায় সিঁড়ির দিকে।
মায়া দাদির রুমে এসে দেখে দাদি এখনো জায়নামাজের উপর বসে তাসবীহ পাঠ করছেন।
মায়া কে দেখে কাছে ডাকেন।
“ড্রইং রুমে কি হয়েছে? সকলে জোড়ে জোড়ে কথা বললো কেন?”
“তোমার পেয়ারের নাতির কি যেন হয়েছে।”
“মাহিরের? ওর আবার কি হলো? নামাজ পড়তে আসার আগে না ওকে সোফায় দেখে আসলাম।”
“আরে ভাইয়ার না তো, তোমার বিদেশি ধলা ইন্দুর নাতির কি যেন হয়েছে। হাত পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা দেখলাম।”
আতকে ওঠেন নাহার বেগম।
“কি হয়েছে আলভীর?”
“মনে হয় এক্সিডেন্ট হয়েছে।”
নাহার বেগম দ্রুত বসা থেকে উঠে দাঁড়ান। ডোরের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলেন,
“পাষাণ মেয়ে তোর জামাই ম/রে যায় আর তুই এখানে এসে দাঁত বের করে কথা বলছিস?”
“আশ্চর্য তো, কথা বললে তো দাঁত বের হবেই। তোমার মত দাঁত ছাড়া নাকি আমি?”
“বেশি কথা না বলে তাড়াতাড়ি আয়।”
“তুমি যাও আমি যাব না।”
নাহার বেগম ফিরে ভেতরে আসেন আবার। মায়ার হাত ধরে টেনে রুম থেকে বেরিয়ে আসেন। রুমের বাইরে এসে শক্ত হয়ে দাঁড়ায় মায়া।
“অদ্ভুত তো, এভাবে আমার হাত ধরে টানছো কেন?”
“বাড়িতে এত গুলো মেহমান এসেছে তারা কি বলবে, ছেলেটার এক্সিডেন্ট হয়েছে আর তুই বউ হয়ে ওর সেবা যত্ন তো দূরে থাক কাছেও যাচ্ছিস না।”
“মেহমানরা খুশিই হবে। এখন ছাড়ো আমার হাত। তোমার ঐ শ য় তা ন নাতির সামনে যাব না আমি।”
“জামাই কে এভাবে বলতে হয় না।”
“ওহ নাতির জন্য দরদ উথলে পড়ছে বুঝি?”
“তুই বেশি কথা বলিস।”
“যাব না আমি।”
নাহার বেগম শোনেন না মায়ার কোন কথা। হাত ধরে জোর করেই ড্রইং রুমে নিয়ে আসেন।
“আলভী কোথায়?”
নাহার বেগমের কথা শুনে সবাই ওনার দিকে তাকায়। মাহির বলে,
“রুমে গেছে।”
নাহার বেগম আর কোন কথা না বলে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে জান মায়ার হাত ধরে রেখেই।
সোফায় সবাই বসে আছে তাই মায়া কিছু বলছে না।
দাদি কে ধরে নিয়ে উপরে উঠে আসে।
“এখন ছাড়ো আমাকে।”
“কোন ছাড়াছাড়ি নেই, তুই আয় আমার সাথে।”
“বুড়ো হয়ে গেছো, শরীরে এখনো এত শক্তি কেন?”
“তোর বয়সে আমি দুই সন্তানের মা হয়ে গিয়েছিলাম।”
“আশ্চর্য্য, আমি বলছি একটা তুমি বলছো আরেকটা।”
“বেশি কথা না বলে আয় আমার সাথে।”
মায়া কে টেনে নিয়ে আলভীর রুমের সামনে এসে দাঁড়ায়। কিছুতেই ভেতরে প্রবেশ করবে না।
“আলভী।”
দাদির গলার স্বর শুনে ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে ডোরের দিকে উঁকি দেয়।
“ভেতরে আসো।”
“তুমি একটু আসো।”
আলভী ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে সরে আসে। দাদি নাতনী কে এক প্রকার কুস্তি করতে দেখে কয়েক সেকেন্ড চুপ চাপ দাঁড়িয়ে থাকে।
মায়া আলভীর দিকে তাকাচ্ছেই না। দাদির হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে সমানে।
“বলো দাদু।”
“ওকে একটু ভেতরে নিতে সাহায্য করো। পারবে কি?”
আলভী দুই কদম এগিয়ে আসে। মায়ার বাম হাত টা নিজের বাম হাত দিয়ে ধরে এক টানে ভেতরে নিয়ে আসে।
“উপরের সিটকিনি টা লাগিয়ে দাও।”
দাদির কথা মতন তাই করে আলভী।
মায়া এক পাশে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। রাগে লাল হয়ে গেছে। বুড়ো মানুষ বেশি জোরে টানাটানি বা ধাক্কা দিলে পড়ে গিয়ে ব্যাথা পাবে তাই মায়া করে সেরকম কিছু করেনি মায়া। আর এই বুড়ি ওকে ধরে বেঁধে বাঘের খাঁচায় এনে বন্দী করলো তাও যে সে বাঘ না এক নাম্বারের অসভ্য অভদ্র লুচ্চু বাঘ। সুযোগ পেলেই চেপে ধরে।
নাহার বেগম মায়া কে টেনে এনে দাঁড়ান আলভীর সামনে। মায়া মাথা নিচু করেই দাঁড়িয়ে থাকে। একটা বারও উপরের দিকে তাকায় না। নাহার বেগম ভালো ভাবে তাকান নাতির দিকে।
“এরকম হয়েছে কিভাবে তোমার? কিভাবে এক্সিডেন্ট হয়েছে?”
“বাইক চালাতে গিয়ে বাইক নিয়ে পড়ে গিয়েছিলাম।”
“আর কোথায় কোথায় ব্যাথা পেয়েছো?”
“বেশি ব্যাথা পাইনি আর। কয়েক দিনেই ঠিক হয়ে যাবে।”
“তুমি দেখাও আমি দেখব।”
গায়ের টিশার্ট তুলে ডান পাশের পিঠ দেখায়।
“এরকম হয়ে গেছে আর বলছো বেশি কিছু হয়নি?”
দাদির কথা শুনে মায়া চোখ তুলে তাকায়। আলভীর ফর্সা পিঠ ডান পাশ টা পুরোপুরি জখম হয়ে গেছে। এমন অবস্থা দেখেই মায়ার শরীর কা টা দিয়ে ওঠে।
আলভী ঘুরে দাঁড়াতেই চোখাচোখি হয় দুজনের।
মায়ার চোখে মুখে স্পষ্ট ব্যাথা যন্ত্রণার ছাপ দেখতে পায় আলভী। এই ব্যাথা যন্ত্রণার ছাপ পড়ার কারণ, মায়া আঘাত পেয়েছে এমন নয়। আলভী আঘাত পেয়েছে সেটা দেখেই ওর চোখে মুখে এই ব্যাথা যন্ত্রণার ছাপ ফুটে উঠেছে। মায়া নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। আলভী বুঝতে পারে মায়া ওর কাছ থেকে নিজের দৃষ্টি লুকিয়ে নিল। আলভী খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বেডে বসে পা ঝুলিয়ে। দাদি আর মায়া কেও বসতে বলে। দাদি মায়া কে টেনে নিয়ে বসেন আলভীর পাশে।
“ডক্টর কি বলেছেন?”
“কয়েক দিনে ঘা শুকিয়ে যাবে।”
“দেখে শুনে বাইক চালাবে না? যদি বড় ধরনের কিছু হয়ে যেত?”
আলভী সামনের দিকে দৃষ্টি রেখে বলে,
“কি আর হতো? সবাই কে মুক্তি দিয়ে চলে যেতাম। আমার জন্য আর কাউকে কষ্ট পেতে হতো না।”
“আলভী।”
“রেগে যাচ্ছো কেন? ভুল কিছু বলেছি আমি? তুমিই হিসেব করে দেখো, আমার জন্য এই বাড়ির প্রত্যেক জন কে ঠিক কতটা কষ্ট পেতে হয়েছে। সবাই কে আমি অনেক কষ্ট দিয়েছি এত গুলো বছর ধরে।”
“পুরোনো কথা বাদ দাও।”
“কিভাবে বাদ দেব? পুরোনো স্মৃতি কি ভুলতে পারবে?”
“পুরোনো কথা মনে করে কেন কষ্ট পাবে? বর্তমান আর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবো। ভবিষ্যতে যেন কাউকে কষ্ট পেতে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখবে।”
“অতীতের কষ্টই তো মুছে দিতে পারছি না বর্তমান ভবিষ্যৎ নিয়ে কখন ভাববো? আগের ক্ষত টা তো সারাতে হবে আগে।”
আলভীর কথা শুনে মায়ার মুখের দিকে তাকান নাহার বেগম। মায়া এখনো চোখ মুখ শক্ত করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। আলভীর কথা ওর কর্ণকুহরে পৌঁছেছে কিনা কে জানে।
আলভী পুনরায় বলে,
“তোমার কি মনে হয় দাদু, তোমাদের সকল কে ছেড়ে জার্মানিতে আমি খুব সুখে আনন্দে নেচে গেয়ে দিন পাড় করেছি?”
“এরকম কেন মনে হবে? আমাদের পরিবারের সবাই এখানে আছে শুধু তুমি ছিলে না তাতেই সকলের এত কষ্ট হয়েছে। সব সময় শূন্যতা ঘিরে রেখেছে সবাই কে।সেখানে তুমি পরিবারের সবাই কে ছেড়ে একা একা ছিলে এত গুলো বছর, আমাদের থেকে তোমার অনেক বেশিই কষ্ট হয়েছে।”
“ভুল বললে দাদু ,যাদের হৃদয় থাকে তাদের কষ্ট হয়, আমার তো হৃদয় নেই তাই আমার কষ্টও হয়নি।”
আলভী একটু থেমে আবার বলে,
“সদ্য আঠারো বছর বয়স। অপরিচিত একটা দেশ, অপরিচিত জায়গা, অপরিচিত মানুষ। পরিচিত বলতে শুধু আমার আমি টাই। পরিবারের সাথে যোগাযোগ বন্ধ, কথা বলার মতো কেউ নেই। যদিও এর জন্য একমাত্র আমি নিজেই দায়ী। দিন যায়, মাস যায়, বছর পেরিয়ে নতুন বছর আসে। কিন্তু আমার জীবনে হাসি আনন্দ আসে না। এভাবেই পড়াশোনা করতে করতে সাত টা বছর পেরিয়ে যায়। রাগ জেদ তখনো আমার শরীরের প্রত্যেক টা শিরায় উপশিরায়। রাগী, গম্ভীর, বদ মেজাজি, খিটখিটে মেজাজ। কারো সাথে কথা বলতেই ইচ্ছে করতো না। মানে কেমন যেন হয়ে গিয়েছিলাম। সিদ্ধান্ত নিয়েই নিলাম দেশে ফিরবোই না। জব করার সিদ্ধান্ত নিয়েও আবার মত পাল্টে বিজনেস করার সিদ্ধান্ত নেই। আব্বুর কাছ থেকে টাকা নিয়ে শেয়ারে বিজনেস শুরু করলাম। ব্যস্ত হলাম নতুন ভাবে। সারা দিন কাজ কর্ম ব্যস্ততা শেষে যখন ওই বাড়িটায় ফিরতাম দম বন্ধ হয়ে আসতো। ডাইনিং টেবিলে খাবার খেতে বসে প্রত্যেক লোকমা ভাতের সাথে এক ঢোক পানি গিলতে হয়েছে। পানি ছাড়া ভাত গলা থেকে নেমে পেটে যেতেই চাইতো না।”
এত টুকু বলেই একটু থামে। তাকায় দাদির মুখের দিকে। দাদির চোখ দুটো পানিতে টুইটুম্বর হয়ে আছে। আলভী মুচকি হেসে নিজের হাত দিয়ে দাদির চোখের পানি মুছিয়ে দেয়।
এক হাতে জড়িয়ে ধরে দাদি কে। দাদি কে জড়িয়ে ধরার সময় মায়ার বাহুতে ছোঁয়া লাগে। মায়া একটু সরে যায়। আরো কিছু বলতে চাইলেও দাদির চোখে পানি দেখে আর বলে না আলভী।
“কি হয়েছে? চোখে পানি কেন?”
“সবাই কে ছেড়ে থাকতে অনেক কষ্ট হয়েছে তাইনা?”
“আমার কষ্ট হয় না।”
ছলছল চোখে নাতির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন নাহার বেগম।
আলভী দাদি কে ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।
“তোমরা দুই মিনিট বসো আমি আসছি।”
টাওয়েল হাতে ওয়াশরুমে প্রবেশ করে আলভী। ড্রেস চেঞ্জ করলেও হাত মুখ ধোয়া হয়নি।
টাওয়েল ভিজিয়ে হাত মুখ মুছে নেয়। ব্যান্ডেজে এখন পানি লাগাতে নিষেধ করেছে। সকালে লাগাতে পারবে সমস্যা হবে না।
নাহার বেগম মায়ার মুখের দিকে তাকান। মায়া এখনো আগের মতোই বসে আছে। মায়ার এক হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলেন,
“আর কত জেদ ধরে থাকবি? এবার অন্তত সব রাগ জেদ ঝেড়ে ফেলে দে। তুই যেমন কষ্ট পেয়েছিস আলভী ও তো তেমন কষ্ট পেয়েছে।”
“কষ্ট পেয়েছে ঠিক আছে কিন্তু আমাকে যা যা ফেস করতে হয়েছে তোমার নাতি কে কি সেসব ফেস করতে হয়েছে? আমি শুনেছি মানুষ দের তীরের ফলার মত ধারালো কথা। হাজার বার ছু রি দিয়ে আঘাত করলেও বোধহয় অতটা কষ্ট হতো না যত টা কষ্ট মানুষের কথায় হয়েছে। সে ছেলে বলে এখনো তাকে দুটো কথা বলেনি কেউ। আর বাড়িতে মানুষ আসতে না আসতেই আমাকে কথা শোনানোর জন্য চলে এসেছিল। আমাকেই সব সহ্য করতে হবে, আমাকেই মানিয়ে নিতে হবে, আবার আমাকেই ছেড়ে দিতে হবে। আমি কি তোমার নাতি কে ধরে রেখেছি? নাকি তাকে আবার বিয়ে করতে নিষেধ করেছি? সে এখনই বিয়ে করে নিক তাতে আমার কোন আপত্তি নেই। এর পর যে আমাকে কথা শোনাতে আসবে আমি কিন্তু তাকে অপমান করে দেব। তারপর কেউ বলতে পারবে না আমি এত বড় বেয়াদপ কেন হয়েছি!”
“কে তোকে কি বলেছে আবার?”
“কে কি বলেছে এখন বলতে চাইছি না কিন্তু নেক্সট টাইম বললে অপমান করতে দুই সেকেন্ড ভাববো না, সে যেই হোক না কেন।”
দাদি হয়তো বুঝতে পারলেন কিছু। তিনি এর আগেও আলভীর নানীর বাড়ির কয়েক জন কে দেখেছিলেন মায়া কে কথা শোনাতে। তখন তিনি হুশিয়ার করে দিয়েছিলেন পরের বার যেন এমন কিছু না করে।
কিন্তু তারা এবারেও এসে একই কাজ করছে। কিন্তু কে করেছে সেটা শিওর হতে পারছেন না।
ওয়াশরুমের ডোরের সামনে দাঁড়িয়ে দাদি নাতনীর সব কথা শুনেছে আলভী।
মায়া যখনোই বলেছে “আসতে না আসতেই কথা শোনানোর জন্য চলে এসেছিল” তখনই বুঝতে পেরেছে ওর নানার বাড়ির কেউ একজন মায়া কে পছন্দ করে না। আর সেও অন্যদের মতোই মায়া কে কথা শোনায়, আগেও শুনিয়েছে।
ডোর খুলে রুমে চলে আসে। মায়া আর কোন কথা না বলে চুপ হয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকে।
আলভী ভেজা টাওয়েল শুকিয়ে দিয়ে আসে বেলকনিতে।
রুমে এসে ডোর খুলে মায়ার দিকে তাকিয়ে বলে,
“মায়া তুমি যাও।”
মায়া আর এক সেকেন্ড ও দেরি করে না। সাথে সাথেই উঠে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। মায়া চলে যাওয়ার পর আলভী আবার ডোর লক করে দেয়।
তারপর দাদির পাশে এসে বসে।
“তোমাকে যা জিজ্ঞেস করব তার সঠিক উত্তর দেবে।”
“কি জানতে চাও?”
“মায়া একটু আগে যা যা বলেছে তা সবই শুনেছি আমি।”
“তুমি কিন্তু কোন ঝামেলা করো না দাদু ভাই।”
“ঝামেলা করব না তুমি শুধু আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।”
চলবে…………….