#হৃদয়_মাঝে_হঠাৎ_তুমি
#সানা_শেখ
#পর্ব_32 (বাসর স্পেশাল)
ফটোশুট, সকলের সাথে কথা-বার্তা অতিথিদের সঙ্গে পরিচয় শেষে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করতে করতে আলভী আর মায়ার রাত আটটা বেজে যায়। ভারী শাড়ি পড়ে মায়ার অসস্তি হচ্ছে এখন। শাড়িটা চেঞ্জ করতে পারলেই শান্তি।
বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে সোফায় বসে দুজন। দুজন কেই অরেঞ্জ জুস খেতে দেওয়া হয়।
নাহার বেগম ছোট ছেলের বউয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন,
“ওদের দুজন কে খাইয়ে রুমে পাঠিয়ে দাও। এভাবে আর কতক্ষন বসে থাকবে?”
মায়া শাশুরি মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমি এখন আর কিছুই খাব না।”
“অল্প করে খাও, খেয়ে ছিলে তো সেই কখন।”
“আসরের পর খেয়েছি তো, এখন আর খেতে পারবো না। আমি ফ্রেস হবো।”
“আলভী খেয়ে যাও তাহলে।”
“আমিও খাব না।”
“তাহলে আর কি! সানজিদা ওদের রুমে দিয়ে আসো।”
আলভী সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। মাহিদ এর দিকে তাকিয়ে চোখ ইশারা করে। তারপর বলে,
“মায়া কে রুমে নিয়ে যান। রানা আর তাজের ফ্যামিলি চলে যাবে, ওদের এগিয়ে দিয়ে আসছি আমি।”
সানজিদা মায়া কে নিয়ে আলভীর রুমের দিকে আগায়। ওদের দুজনের সাথে আরো অনেক মেয়েরা যায়।
আলভী মাহিদ আর বন্ধুদের সাথে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসে।
দুই বন্ধু কে বলে,
“আগামী কাল তাড়াতাড়ি চলে আসিস কিন্তু।”
“আসবো, আর বলতে হবে না। আসছি আমরা, শুভ বাসর রাত বন্ধু।”
তাজের কথা শুনে হেসে ওঠে চার জন। তাজ আর রানা বেরিয়ে যায় নিজেদের ফ্যামিলি নিয়ে।
আলভী মাহিদ আর রিমন কে নিয়ে কাজিন দের দিকে এগিয়ে যায়।
রুমে এসে মায়ার হিজাব খুলে দেয় সানজিদা। চুল গুলো ব্রাশ করে খোঁপা করে বেঁধে নেয়। তারপর খোঁপার ভাঁজে ভাঁজে টাটকা লাল সাদা গোলাপ ফুল গুঁজে দেয়। সোজা সিঁথির মাঝখানে টিকলি পড়িয়ে দেয়। কানে বড় বড় কানের দুল, গলায় হাড় পড়িয়ে দেয়। দোপাট্টা দিয়ে লম্বা করে ঘোমটা টেনে দিয়ে মায়া কে ফুল সজ্জিত বেডের মাঝখানে বসিয়ে দেয়।
সব কিছু ঠিক করে রেখে রুমের চারো দিকে সাজিয়ে রাখা ক্যান্ডেল গুলো জ্বালিয়ে দেয়। ডিম লাইট অন করে বড় লাইট অফ করে দেয়। তারপর সবাই কে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে বাইরে থেকে ডোর লক করে দেয়।
নিচে যেতে যেতে আলভীর ফোনে ম্যাসেজ পাঠায় “সব ডান।”
আলভী সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির ভেতরের দিকে এগিয়ে যায়। ওর পেছন পেছন কাজিন গুলোও আগায়।
বাসর ঘরের সামনে আসতেই দেখে ডোরের সামনে ভিড় জমিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েরা। আলভী কপাল ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে,
“সবাই এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে আছে কেন?”
সকলের পক্ষ থেকে শীতল বলে,
“বাসর ঘরের টাকা না দিলে ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে না।”
“মামার বাড়ির আবদার! বাসর ঘরের টাকা দেবে মেয়ের বাড়ির মানুষ, আমি কেনো দেব?”
“তো মেয়ের বাড়ির মানুষ জন কোথায়?”
“তুমিই তো মেয়ের বাড়ির মানুষ।”
“একদম না, আমি ছেলে পক্ষের মানুষ।”
“তাহলে মেয়ের ভাই নয়তো ভাবীর কাছে চাও।”
মাহিদ সকলের ভিড় ঠেলে পেছনের দিকে যেতে যেতে বলে,
“মেয়ের ছোট ভাই সারা দিন দৌড়াদৌড়ি করে অসুস্থ হয়ে পিজি হসপিটালে ভর্তি।”
বলতে বলতে নিজের রুমে ঢুকে ডোর লক করে বেডে শুয়ে পড়ে।
“মেয়ের ছোট ভাই হসপিটালে ভর্তি আছে তাই দয়া করে আপনারা সবাই আসুন।”
“মেয়ের ছোট ভাই অসুস্থ হলেও মেজো ভাই সুস্থ সবল আছে এখনো।”
“আস্তাগফিরুল্লাহ, মেয়ের মেজো ভাই গত তেরো বছর আগে ইহ জগত ছেড়ে পরলোকে গমন করেছে। যে বেঁচে আছে সে মেয়ের জ্বলজ্যান্ত হাসবেন্ড।”
“মেয়ের হাসবেন্ডই টাকা দেবে এখন নয়তো বাসর ঘরে প্রবেশ নিষিদ্ধ।”
“এ্যাহ্, বাসর ঘর আমার নিজের টাকায় সাজিয়েছি তাহলে তোমাদের কেনো টাকা দেব? তোমরা সাজালে নাহয় তোমাদের টাকা দিতাম।”
“বউ কে রুমে এনে আমরাও কষ্ট করে রুমের দরজায় তালা ঝুলিয়েছি। টাকা ছাড়া এই তালা এই জন্মে খোলা হবে না।”
“কোন দেশে বিয়ে করতে আসলাম রে ভাই! যেখানেই যাই সেখানেই দাবি টাকা দিতে হবে। এত টাকা আমি কোথায় পাব?”
“এত গুলো বছর জার্মানিতে কি করেছো?”
“শোক পালন করেছি।”
“কিসের শোক?”
“সে মেলা বড় কাহিনী। এই কাহিনী বলতে বলতে আমার বাসর রাত শেষ হয়ে বাসি রাত চলে আসবে।”
“টাকা না দিলে বাসি রাতই পালন করতে হবে।”
“আমার কাছে টাকা নেই সত্যি সত্যি। এই যে দেখো।”
বলে নিজের শেরওয়ানির দুই পকেট দেখায়।
নাদিরা বলে,
“এক লক্ষ টাকা দিয়ে বাসর ঘরে প্রবেশ করতে হবে নয়তো বাসর রাত সত্যি সত্যিই বাসি রাতে পরিণত হবে।”
“সব গুলো আমার মীরজাফর বাপের অনুসারী। সব গুলো বোধহয় এক জায়গার মাটি দিয়ে তৈরি। সব সময় সবাই আমার মতো একটা নিষ্পাপ, ভোলা-ভালা, ইনোসেন্ট ছেলে কে ব্ল্যাকমেইল করে।”
আলভীর কথা আর বলার ধরণ দেখে সবাই হাসতে হাসতে শেষ। শীতল নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
“ভাইয়া টাকা দিয়ে দাও না আমরা চলে যাই।”
“আমার কাছে তো টাকা নেই।”
“কারো কাছ থেকে ধার করে আনো।”
“দশ মিনিট সময় দাও।”
“আচ্ছা।”
আলভী নিচে নেমে আসে।
একটু পরেই রিমন আর নাজিম কে খুঁজে নিয়ে আসে।
ওদের দুজন কে সিঁড়ির কাছে দাড় করিয়ে রেখে নিজের রুমের সামনে এসে দাঁড়ায়।
“টাকা কই?”
“টাকা ওদের দুজনের কাছে। তোমরা সবাই ওদের দুজনের কাছে গেলেই টাকা পাবে।”
“মিথ্যে কথা বলছো তুমি।”
“একশো পার্সেন্ট সত্যি কথা বলছি আমি। বিশ্বাস না হলে ওদের জিজ্ঞেস করো ওদের কাছে টাকা আছে কি না!”
নাদিরা ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
“তোমাদের কাছে টাকা আছে?”
“হ্যাঁ।”
“কোথায়? আমাদের দেখাও নয়তো আমরা বিশ্বাস করি না।”
দুজনেই নিজেদের পকেট থেকে দুটো টাকার বান্ডিল বের করে সবাই কে দেখায়।
এক হাজার টাকার বান্ডিল স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
আলভী সকলের দিকে তাকিয়ে বলে,
“বিশ্বাস হয়েছে তো আমার কথা! এখন ওদের দুজনের কাছে যাও ওরা তোমাদের সকল কে টাকা বুঝিয়ে দেবে।”
“সব গুলো দেবে তো নাকি আবার চিট করবে?”
“একদম সব গুলো টাকা দিয়ে দেবে তোমাদের।”
“সত্যি?”
“মিথ্যে বলি না আমি।”
আলভীর হাতে চাবি দিয়ে সবাই ডোরের সামনে থেকে সরে রিমন আর নাজিম এর সামনে আসে।
আলভী দ্রুত ডোর খুলে ভেতরে প্রবেশ করে। পেছন থেকে ছেলেদের দল গান গেয়ে ওঠে সাথে মিউজিক বক্সেও গান প্লে হয়।
ছেলেরা গলা ছেড়ে চিৎকার করে গাইছে,
“তুমি দিও না গো বাসর ঘরের বাত্তি নিভাইয়া,
আমি অন্ধকারে বন্ধ ঘরে যাব মরিয়া।”
ছেলেদের গান শুনে বেডে বসে থাকা মায়া হেসে ওঠে সাথে লজ্জাও পায়। আলভী ডোর লক করে সোজা হয়ে দাড়ায়। অবশেষে বাসর করবে আজ। আহা ওর বউটা ওর জন্য বউ সেজে ফুল সজ্জিত বেডে বসে অপেক্ষা করছে তখন থেকে। বেডের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়।
লম্বা ঘোমটা টেনে বসে আছে মায়া। হঠাৎ আলভীর হৃদস্পন্দন বাড়তে শুরু করে। বুকের বা পাশে হাত দিয়ে চেপে ধরে। চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস টেনে নেয়।
তারপর এক পা দুই পা করে বেডের দিকে আগায়। রুমের বড় লাইট অন করে। দূরত্ব মিটিয়ে অবশেষে বেডে উঠে বসে।
বিসমিল্লাহ বলে মায়ার ঘোমটা তুলে মায়ার মুখের দিকে উঁকি দেয় ঘাড় কাত করে। মৃদু স্বরে সালাম দেয়,
“আসসালামু আলাইকুম বিবী সাহেবা।”
চোখ তুলে তাকায় মায়া। আলভীর হাস্যোজ্বল মুখ জ্বলজ্বল করছে যেন।
মায়া নিজেও মৃদু স্বরে সালামের জবাব দেয়,
“ওয়ালাইকুম আসসালাম বিবীর সাহেব।”
আলভীর হাসি আগের চেয়েও চওড়া হয়।
মায়ার ঘোমটার নিচে নিজের মাথা ঢুকিয়ে দেয়।
চোখ রাখে মায়ার চোখে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলে,
“বাকি জীবন এভাবেই পাড় হয়ে যাক। সময় এখানেই থেমে যাক। আমি অনন্ত কাল তোমাকে এভাবেই দেখতে থাকি।”
মায়া কিছু না বলে আলভীর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। আলভী মায়ার দুই চোখের পাতায় সযত্নে আলতো চুমু খায়। টিকলি টা সরিয়ে ললাটে অধর ছোঁয়ায়। তারপর বেড থেকে নেমে দাড়ায়।
মায়ার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে। আলভী ওর কাছাকাছি আসলেই ওর এমন হয়।
মায়ার এক হাত ধরে বলে,
“কষ্ট করে একটু নিচে নামুন মায়া রানী।”
মায়া বেড থেকে নেমে দাড়ায়। আলভী একটু দূরে দাঁড়িয়ে মায়া কে দেখতে থাকে। মায়া নিজেও আলভীর দিকে তাকিয়ে থাকে।
আলভী ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে নিজের ক্যামেরা বের করে। মায়া কে ফুল সজ্জিত বেডের সামনে দাঁড় করায়। দোপাট্টা মায়ার দুই হাত দিয়ে ধরিয়ে উচু করে ধরায়। তারপর নিজে দাঁড়ায় মায়ার থেকে কিছুটা দূরে।
“হাসি দাও আলভীর রানী।”
মায়া হাসে, পর পর কয়েক বার ক্যামেরায় ক্লিক হয়।
“নতুন পোজ দাও সাহেবের বিবী।”
ঘুরে ফিরে অনেক গুলো পোজ দেয় মায়া।
আলভী আবার মায়া কে বেডে বসায়। মায়ার শাড়ি চারো দিকে গোল করে ছড়িয়ে দেয়। দোপাট্টা খুলে দিয়ে মায়া কে উপরের দিকে তাকাতে বলে। মায়া উপরের দিকে তাকায়। বেডের উপর দাঁড়িয়ে মায়ার ফটো তোলে আলভী। এই ফটো গুলো সবচেয়ে বেশি সুন্দর হয়েছে। মায়ার পার্সোনাল ফটোগ্রাফার আলভী।
ফটো তোলা শেষ হলে মায়া কে বেড থেকে নামায় আবার। মায়ার আলভীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
“এসব এখন খুলি?”
“হ্যাঁ, আসো আমি খুলে দিচ্ছি।”
মায়া টুলের উপর বসে। আলভী আগে জুয়েলারি গুলো খুলে দেয়। তারপর খোঁপায় লাগানো ফুল গুলো।
শাড়ির সেফটিপিন গুলো একটা একটা করে খুলে দেয়। ভারী শাড়ি টা নিজেই খুলে নিয়ে সোফার উপর রাখে। লজ্জায় দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে মায়া। আলভী আলমারি থেকে হালকা শাড়ি বের করতে করতে বলে,
“এমন লজ্জা পাচ্ছো মনে হচ্ছে আজকেই প্রথম দেখছো আমাকে, অথচ আমি তোমার তেরো বছরের পুরোনো স্বামী।”
“তুমি নির্লজ্জ্ব বলে কি আমিও নির্লজ্জ্ব নাকি?”
“এই টুকুন শরীরে এত লজ্জা সরম কোথায় স্টক করে রেখেছো দেখি একটু।”
বলে মায়ার হাত ধরে। মায়া আলভীর হাত থেকে থাবা দিয়ে শাড়ি টা নিয়ে দ্রুত ওয়াশরুমে প্রবেশ করে।
আলভী ওয়াশরুমের দিকে তাকিয়ে বলে,
“যা বাবা দেখতেও দিল না লজ্জা সরম কোথায় স্টক করে রেখেছে। এক ঘণ্টার মধ্যে ওই লজ্জা সরম স্টক আউট করতে হবে।”
কথা বলতে বলতে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায়। শেরওয়ানি খুলে রেখে দেয়। কোমরে টাওয়েল পেঁচিয়ে শেরওয়ানির পায়জামা খুলে নরমাল ট্রাউজার পড়ে নেয়। গায়ে জড়ায় নতুন একটা শুভ্র রঙা পাঞ্জাবি। সাদা ড্রেস পড়তে আলভীর একটু বেশিই ভালো লাগে।
শাড়ি পড়ে মেকআপ রিমুভ করে ফ্রেস হয়ে ওযু করে বেরিয়ে আসে মায়া। আলভী নিজেও ওয়াশরুমে প্রবেশ করে।
পাঁচ মিনিটেই আবার বেরিয়ে আসে। হাত মুখ মুছে নিজের গায়ে সাথে মায়ার গায়েও আতর দিয়ে দেয়। আগে পিঠে করে জায়নামাজ বিছিয়ে দেয় মায়া। আলভী সামনে দাঁড়ায় পেছনে দাঁড়ায় মায়া।
দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করে উঠে দাঁড়ায় দুজনেই। জায়নামাজ ভাঁজ করে তুলে রাখে আলভী।
মায়া কে বেডে গিয়ে বসতে বলে নিজের গায়ের পাঞ্জাবি খুলে রাখে। আলমারির ভেতর থেকে ছোট একটা বক্স বের করে উদাম গায়েই মায়ার কাছে এগিয়ে আসে। বড় লাইট অফ করে বেডে উঠে বসে। ডিম লাইট আর ক্যান্ডেলের লাল নীল আলোতে মায়ার মুখশ্রী আরো মায়াময় হয়ে উঠেছে।
বক্স টা মায়ার হাতে তুলে দেয় আলভী।
“কি আছে বক্সের ভেতর?”
“খুলে দেখো।”
আলভীর দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বক্সের দিকে দৃষ্টি দেয় আবার। বক্সের উপরের ঢাকনা টা খুলতেই বক্সের ভেতরের লাইট জ্বলে ওঠে। লাইটের আলোয় মায়ার চোখ মুখ আরো জ্বলজ্বলে হয়ে ওঠে। এই মুহূর্ত টা পুরো স্বপ্নের মতন লাগছে মায়ার কাছে। বক্সের ভেতরে থাকা আংটি টা বের করে মায়ার আঙ্গুলে পড়িয়ে দেয় আলভী। তারপর হাতের উল্টো পিঠে চুমু খায়। ট্রাউজারের পকেট হাতড়ে স্বর্ণের চেইন টা বের করে। চেইন টাও নিজেই পড়িয়ে দেয় মায়ার গলায়।
সব শেষে মায়ার মুখের সামনে হাত পাতে আলভী। মায়ার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
“এবার আমার গিফট দাও।”
মায়া চোখে মুখে অসহায়ত্ব ফুটিয়ে তুলে বলে,
“আমি তো তোমার জন্য কোনো গিফট আনিনি।”
“কেনো আননি?”
“বাসর রাতে হাসবেন্ড কে যে গিফট দিতে হয় সেটা তো আমি জানতাম না, কেউ তো বলেওনি।”
“এত বড় একটা গিফট থাকতে আলাদা কোনো গিফটের প্রয়োজন নেই আমার।”
“বড় গিফট?”
“তুমি নিজেকেই গিফট করে দাও আমাকে। তোমার চেয়ে বড় গিফট এই দুনিয়ায় আমার জন্য আর আছে নাকি?”
“সারা জীবনের জন্য তোমাকে গিফট করে দিলাম পুরো আমি টা কেই।”
আলভী এক ঝটকায় মায়া কে টেনে আনে নিজের অতি নিকটে। মায়ার কোমর পেঁচিয়ে ধরে এক হাতে। মায়ার ঘাড়ে মুখ গুজে আলতো চুমু খেয়ে বলে,
“গিফট একসেপ্ট করে নিলাম অনন্ত কালের জন্য।”
চলবে……………..
#হৃদয়_মাঝে_হঠাৎ_তুমি
#সানা_শেখ
#পর্ব_33
(কার্টেসি ব্যতীত কপি করা নিষিদ্ধ)
ফজরের নামাজ শেষ করে মায়ার কোলের উপর মাথা রেখে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে আলভী।
মায়া আলভী কে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে বলে,
“ওঠো, বিছানায় গিয়ে ঘুমাও।”
“এখানেই ঘুমাব আমি।”
“আমার ঘুম পাচ্ছে এখন, আর তাঁকিয়ে থাকতে পারছি না। সারা রাত একটুও চোখ বন্ধ করতে দাওনি তুমি।”
আলভী শোয়া থেকে উঠে দাঁড়ায়। মায়া নিজেও উঠে দাঁড়িয়ে জায়নামাজ দুটো ভাজ করে আলমারিতে তুলে রাখে।
ভেজা চুলের খোঁপা খুলে দিয়ে বেডে উঠে শুয়ে পড়ে। আলভী ফ্যান অন করে লাইট অফ করে দেয়। তারপর নিজেও বেডে উঠে মায়া কে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ে।
মায়া আলভীর বুকে মুখ গুঁজে চোখ বন্ধ রেখেই বলে,
“এসি তো অন করাই আছে, তাহলে আবার ফ্যান অন করলে কেন?”
“ফ্যানের বাতাসে চুল শুকিয়ে যাবে, আলাদা করে আর শুকাতে হবে না।”
“ভীষণ শীত করছে এখন।”
“ফ্যান নাহয় এসি দুইটার একটা বন্ধ করো।”
আলভী শোয়া থেকে উঠে বসে পায়ের নিচ থেকে ব্ল্যাঙ্কেট তুলে গায়ে জড়িয়ে নেয় দুজনের। তারপর আবারো মায়া কে শক্ত বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করে বলে,
“এখন আর শীত করবে না।”
___________
মায়ার ঘুম ভেঙ্গে যায়। আগের মতো করেই ধরে রয়েছে আলভী। এক হাত বের করে নিজের ফোন টা হাতে নেয়। পাওয়ার বাটন চেপে টাইম দেখে নেয়। আলভীর হাত সরিয়ে দিয়ে উঠে বসতেই আলভীর ঘুম ভেঙ্গে যায়। উপুর হয়ে শুয়ে মায়ার কোমর এক হাতে জড়িয়ে ধরে। চোখ বন্ধ রেখেই ঘুম জড়ানো গলায় বলে,
“উঠছো কেন?”
“ওঠো আট টা বারো বেজে গেছে।”
“শুয়ে থাকো, এখন উঠে কি করবে?”
“তুমি শুয়ে থাকো, ছাড়ো আমাকে।”
আলভীর হাত সরিয়ে দিয়ে বেড থেকে নেমে দাড়ায়। রুমের লাইট অন করে। এলোমেলো চুল গুলো হাত খোঁপা করে নেয়। তারপর এলোমেলো শাড়ি কোনো রকমে ঠিক করে ওয়াশরুমে প্রবেশ করে।
ফ্রেস হয়ে এসে দেখে আলভী শোয়া থেকে উঠে বেড গুছিয়ে ঝিম ধরে বসে রয়েছে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায় মায়া। আলভী বেড থেকে নেমে ওয়াশরুমে প্রবেশ করে।
কয়েক মিনিট পরেই ফ্রেস হয়ে বেরিয়ে আসে। টাওয়েল দিয়ে হাত মুখ মুছতে মুছতে মায়ার পেছনে এসে দাঁড়ায়। টাওয়েল সোফার উপর ছুঁড়ে দিয়ে মায়া কে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে।
“কি করছো?”
“জড়িয়ে ধরেছি।”
“শাড়ি ঠিক করবো আমি, ছাড়ো এখন।”
ছেড়ে দাঁড়ায় আলভী।
“রুম থেকে বের হও।”
“কেন?”
“শাড়ি ঠিক করবো আমি।”
“করো, আমি কি বাধা দিচ্ছি নাকি? এই এক মিনিট তুমি কি আমার সামনে শাড়ি ঠিক করতে লজ্জা পাচ্ছো? এত কিছুর পরেও তোমার লজ্জার স্টক শেষ হয়নি?”
“উল্টা পাল্টা কথা না বলে বের হও এখান থেকে। গিয়ে ভাবী কে আসতে বলো।”
“ভাবী কে কেনো আসতে বলবো?”
“শাড়ি পড়িয়ে দেওয়ার জন্য।”
“শাড়ি আমি পড়াবো তোমাকে।”
“তুমি শাড়ি পড়াতে জানো?”
“জানিনা এখন শিখে যাব। এখন সোজা হয়ে দাঁড়াও।”
মায়ার কোনো কথা না শুনে নিজেই শাড়ি পড়ানোর জন্য উদ্যত হয়। জোর করে আঁচল নামিয়ে নেয়।
আলভীর জেদের কাছে না পেরে মায়া বলে,
“আমি পড়ছি, তুমি শুধু আমাকে সাহায্য করো।”
“আচ্ছা।”
শাড়ি প্যাচ দিয়ে কুচি করে নেয় মায়া। আলভী নিচে হাঁটু মুড়ে বসে কুচি গুলো ঠিক করে সমান করে দেয়।
খুব একটা সময় লাগে না দ্রুতই শাড়ি পড়ানো হয়ে যায়। আলভী মায়ার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
“শাড়ি পরানো তো একদম ইজি। পাঁচ মিনিটেই হয়ে যায়। কত সুন্দর করে শাড়ি টা পড়ালাম দেখো।”
মায়া কপাল ভ্রু কুঁচকে বলে,
“শাড়ি তুমি পরিয়েছ?”
“হ্যাঁ।”
“কয়েক টা কুচি ধরলে আর একটা সেফটিপিন লাগিয়ে দিলেই শাড়ি পড়ানো হয়ে যায়? কষ্ট করে শাড়ি পড়লাম আমি আর এসেছে নিজে ক্রেডিট নিতে।”
“এহ্ শাড়ি আমি পড়িয়েছি।”
“হ্যাঁ আমি তো শুধু দাঁড়িয়ে ছিলাম।”
“চুপ চাপ দাড়াও দেখি।”
মায়া কে দার করিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে নেয় আলভী কোথাও দিয়ে পেট দেখা যাচ্ছে কিনা। লম্বা করে ঘোমটা টেনে দেয় আলভী নিজেই।
তারপর বলে,
“রুম থেকে বের হবে না একদম, বেডে উঠে শুয়ে থাকো নয়তো বসে থাকো। যার দেখতে ইচ্ছে হবে রুমে এসে দেখে যাবে। আমার কথা যেন মনে থাকে, রুম থেকে বের হবে না। বাইরে গেলে সকলের সামনে ঘোমটা ফেলে উল্টে পাল্টে দেখবে সবাই।”
“ঠিক আছে।”
মায়া বেডে উঠে বসে। রুমেই যখন থাকবে তখন এক হাত ঘোমটা টেনে দিতে হবে কেন?
আলভী ডোর খুলে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
আলভী ড্রইং রুমে আসতেই শীতল নাদিরা সহ বাকি মেয়েরা আলভী কে ঘেরাও করে ধরে।
আলভী কপাল ভ্রু কুঁচকে বলে,
“এখন আবার কোন দাবিতে টাকা চাই?”
ড্রইং রুমে থাকা সকলেই ওদের দিকে তাকায়।
নাদিরা বলে,
“তুমি আমাদের ঠকিয়েছ।”
“কিভাবে ঠকালাম?”
“মাত্র দশ হাজার টাকা দিয়েছো রাতে। গেটে দশ হাজার বাসর ঘরেও দশ হাজার। এত কিপটা কেনো তুমি?”
“দশ টাকা দিয়ে একটা লেবু কিনে এনে এক গ্লাস শরবত দাওনি কেউ, দশ টাকা দিয়ে একটা মোমবাতি কিনে দাওনি সেখানে যে দশ হাজার টাকা দিয়েছি সেটাই তো অনেক। বিয়ে করে লাভ কোথায়? সব দিক থেকে শুধু জামাইয়ের লস, লাভ হয় শুধু শা*লা শা*লী আর বাকিদের। আমার তো কোনো লাভ হলো না।”
“বিয়ে করে এত সুন্দর একটা বউ পেয়েছো আর কি চাও?”
“বউ টা তো আমার নিজেরই ছিল।”
“তো, তুমি কি অন্যের বউ বিয়ে করতে চেয়েছিলে?”
“আস্তাগফিরুল্লাহ, নাউজুবিল্লাহ বলে কি! আমি কেনো অন্যের বউ বিয়ে করতে চাইবো?”
“তোমার কথা শুনে তো তাই মনে হচ্ছে।”
“কথা বলতে বলতে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। গলা টা ভিজিয়ে নেই তারপর বাকি কথা বলছি। সাইট প্লীজ।”
সকলের মাঝখান থেকে বেরিয়ে সোফায় এসে বসে নানার পাশে।
মায়ার নানা আলভীর দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলেন,
“জামাই চোখ মুখের এই হাল কেন? সারা রাত ঘুমাননি নাকি?”
আলভী নানার দিকে ঘাড় লম্বা করে এগিয়ে মৃদু স্বরে বলে,
“আপনার নাতনী তো সারা রাত ঘুমোতে দিল না নানা।”
“আমার নাতনী ঘুমোতে দেয়নি নাকি তুমি আমার নাতনী কে ঘুমোতে দাওনি?”
“এত সত্য কথা বলতে নেই নানা।”
আলভীর কথা শুনে তিন নানা নাতিই হেসে ওঠে।
আলভী গলা ছেড়ে বলে,
“আম্মু কফি দাও।”
মায়ার নানি সোফার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলেন,
“মায়া কোথায়?”
আলভী নানি শাশুরির দিকে তাকিয়ে বলে,
“রুমে।”
“রুমে কেন? প্রতিবেশীরা আসছে ওকে দেখার জন্য।”
“রুমে গিয়ে দেখে আসুক যার দেখতে ইচ্ছে করে। আর কোনো পুরুষ যেন ঐ রুমে না যায়।”
নানি আলভীর দিকে তাকিয়ে আবার প্রতিবেশী দের দিকে তাকায়। এরাও এক সময় সুযোগ পেয়ে মায়া কে কটু কথা শুনিয়েছিল।
_____________________
দুপুরে পার্লার থেকে গত কালকের মেয়ে টা আসে মায়া কে সাজানোর জন্য।
মায়া শাওয়ার নিয়ে খেয়ে চুল শুকিয়ে তার অপেক্ষাই করছিল এতক্ষণ।
মেরুন রঙের লেহেঙ্গা টা ওয়াশরুম থেকে পড়ে আসে মায়া।
মেকআপ শেষ করে গোল্ডেন কালার হিজাব বেঁধে দেয়। হিজাবের উপর ছোট ছোট হোয়াইট স্টোনের পিন লাগিয়ে দেয়। পিন গুলো লাইটের আলোয় ঝিকিমিকি করছে।
সাঁজানো শেষ করে মেয়ে টা নিচে চলে যায়। আলভী নিজের রুমে প্রবেশ করে। রুমে মেয়ে মানুষ দিয়ে গিজগিজ করছে। আলভী কে দেখেই অর্ধেক মেয়ে বেরিয়ে যায়। আলভী মায়ার দিকে তাকায়। ওর কল্পনার চেয়েও বেশি সুন্দর লাগছে মায়া কে।
আলভী নিজের ড্রেস বের করে আলমারির ভেতর থেকে। তারপর ওয়াশরুমে প্রবেশ করে।
মায়া হেঁটে এসে বেডে বসে। শাড়ির চেয়ে লেহেঙ্গা টা বেশি ভারী।
,
,
তিন টা বাজতেই আলতাফ মাহমুদ আলভীর রুমের সামনে এসে গলা খাঁকারি দেন। আলভী বুঝতে পেরে রুম থেকে বেরিয়ে আসে।
আলতাফ মাহমুদ ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেন,
“মায়া কে নিয়ে নিচে আসো এখন, গেস্টরা সবাই চলে এসেছে।”
আলভী মায়ার হাত ধরে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। গত কাল অনেক গেস্ট আসেনি তারা সবাই আজকে এসেছে।
স্টেজের দিকে এগিয়ে যায় দুজন একে অপরের হাত ধরে। সবাই ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। মায়ার পরনে মেরুন রঙের লেহেঙ্গা, আলভী ব্ল্যাক কোট প্যান্ট পড়েছে। দুজন কে পাশাপাশি অনেক সুন্দর লাগছে। এরা দুজন যেন একে অপরের জন্যই তৈরি।
হেঁটে এসে স্টেজে উঠে দাঁড়ায়। সকলেই তাঁকিয়ে দেখে দুজন কে। সবাই প্রশংসাও করে।
চেয়ারে বসার সময় আলভী আস্তে আস্তে বলে,
“এদের দেখা দেখি দ্রুত শেষ হলেই বাঁচি। সকালের পর আর বউ কে আদর করার সুযোগই পেলাম না। বউ কে ছয় সাত দিন আদর করে পোষাবে না। নিজের সাথে করে নিয়ে যাব এটাই ফাইনাল।”
,
,
রাত আটটা আলভী গান গাইতে গাইতে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছিল। মাহিদ পেছন পেছন আসতে আসতে শুনে ফেলে আলভীর গান যদিও আলভী আস্তে আস্তে গানটা গাইছিল। মাহিদ আলভী কে বলে,
“তুমি নাকি ভালো হয়ে গেছো! এখন আবার গান গাইছ দেখছি , তু খিচ মেরি ফটো।”
ওদের দুজনের সামনে দিয়ে একটা পাঁচ-ছয় বছরের পিচ্চি ছেলে যাচ্ছিল। মাহিদ এর কথা গুলো শুনতে পেয়েছে স্পষ্টই।
আলভী কিছু বলবে তার আগেই ছেলেটা বলে,
“তু খিচ মেরি ফটো
তোর বাপে চালায় অটো,
তোর মা’য় চালায় হুন্ডা
তোর চৌদ্দ গুষ্টি গুন্ডা।”
ছেলেটার গান, ছড়া হোক বা কবিতা শুনে দুই ভাই শকড। অবাক হয়ে একে অপরের মুখের দিকে তাকায় দুই ভাই তারপর আবার ছেলেটার দিকে তাকায়।
মাহিদ বলে,
“এই সব কার কাছে শিখেছিস?”
“মাইনষের কাছে।”
“তুই কাকে বললি এগুলো?”
“তোমাকে।”
বলেই ভোঁ দৌড় ছেলে টা।
মাহিদ নিজেও ছেলে টার পেছনে দৌড়ে যায়। আজকে ধরতে পারলেই হলো, হুন্ডা-গুন্ডা সব বের করে দেবে।
চলবে……….