#হৃদয়_মাঝে_হঠাৎ_তুমি
#সানা_শেখ
#পর্ব_অন্তিম_পর্ব
(কার্টেসি ব্যতীত কপি করা নিষিদ্ধ)
হসপিটালের করিডোরে অস্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আলভী, তাকিয়ে আছে ওটির দিকে।
বিকেল, সন্ধ্যা গড়িয়ে এখন রাত নয়টা।
বাড়ির সবাই হসপিটালে এসেছে। সকলেই আল্লাহর কাছে দোয়া করছে মায়া আর বেবি দের জন্য।
এমনিতেই শীতল প্রকৃতি, তার মধ্যে মাথার উপর ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছে বড় একটা সিলিং ফ্যান তবুও দরদর করে ঘামছে আলভী। ওর কপাল, ঘাড় বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ঘাম। হাত-পা কাপছে, থেকে থেকে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে মায়ার পেইন ওঠার পর থেকেই। ফর্সা চেহারা লাল হয়ে গেছে, চোখ দুটোও পানিতে টুইটুম্বর আর লাল হয়ে আছে। একটু পর পর চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে আর আলভী তা মুছে নিচ্ছে, আবার পড়ছে।
মাহির আর মাহিদ আলভী কে সাহস যোগায়।
একটু সময় পরেই দুজন নার্স বেবি দের কোলে নিয়ে ওটি থেকে বেরিয়ে আসে। বাড়ির সবাই ঘিরে ধরে নার্স দুজন কে। আলভী বেবি দের দিকে তাকায়। সাদা ধবধবে ফর্সা চেহারা, লাল টকটকে ঠোঁট জোড়া, ছোট ছোট চোখ জোড়া দুনিয়া আর নিজের পরিবার দেখছে। বেবি দের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আলভীর চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। নার্স দুজন নিজে থেকেই জানায় একজন ছেলে একজন মেয়ে হয়েছে।
আলভী কাপা গলায় মায়ার কথা জিজ্ঞেস করতেই নার্স জানায় মায়া ঠিক আছে, অপারেশন শেষ হলে কেবিনে সিফট করা হবে।
আলতাফ মাহমুদ ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেন,
“তোমার ছেলে মেয়ে কে তুমিই প্রথমে কোলে নাও।”
আলভী বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আবার ছেলে মেয়ের দিকে তাকায়। কাপা কাপা হাতে ছেলে-মেয়ে কে কোলে তুলে নেয় একসাথেই। নিজের বাহু তে চোখ মুছলেও লাভ হয় না আবার পানি গড়িয়ে পড়ে চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।
উপস্থিত সবাই তাকিয়ে আছে তিন জনের দিকে।
আলভী চোখ তুলে বাবার মুখের দিকে তাকায়। আলতাফ মাহমুদ ছেলের চোখে পানি দেখে হেসে বলেন,
“এবার আবার খুশিতে অজ্ঞান হয়ে যেও না। এখন কিন্তু তোমার ছেলে মেয়ে কোলে আছে, ওড়া ব্যাথা পাবে।”
আলতাফ মাহমুদ এর কথা শুনে সবাই হাসে কিন্তু আলভী হাসতে পারে না। বাবা মায়ের দিকে আগায় একটু। অপরাধীর ন্যায় মাথা নিচু করে জড়ানো গলায় বলে,
“আমাকে তোমরা মাফ করে দিও আব্বু-আম্মু। আমি তোমাদের সাথে অন্যায় করেছি, অনেক কষ্ট দিয়েছি। তোমাদের সন্তান কে তোমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিলাম।”
আলতাফ মাহমুদ ছেলের বাহু তে চাপড় মে রে বলেন,
“বাবা হওয়ার পর বুঝতে পারছো তাহলে!”
আলভী বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
“সরি আব্বু।”
“আর সরি বলতে হবে না। তুমি আমাদের একমাত্র সন্তান। তোমার উপর আমরা কখনোই রেগে থাকতে পারি না। আমাদের দোয়ায় আর ভালোবাসায় সব সময় তোমরা আছো। এখন মন খুলে হাসো।”
_______
মায়া কে কেবিনে সিফট করা হয়েছে। নার্স কেবিন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আলভী কেবিনে প্রবেশ করে। মায়া ডোরের দিকেই তাকিয়ে আছে। আলভী কে দেখে আবার হাসে। আলভী দ্রুত পায়ে এসে মায়ার পাশে দাঁড়ায়। মাথার মাথায় হাত বুলিয়ে সারা মুখে অসংখ্য চুমু খায়। মায়ার কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে বলে,
“এখন কেমন লাগছে?”
মায়া আলভীর চোখে চোখ রেখে বলে,
“ভালো, তুমি ঠিক আছো? চোখ মুখ এমন করে রেখেছো কেন? কি হয়েছে তোমার?”
আলভী মায়ার বাম হাত টা মুঠো করে ধরে বলে,
“আর বেবি নেয়ার প্রয়োজন নেই। ছেলে মেয়ে দুজন হয়েছে, এখানেই সমাপ্তি।”
“কেন? তুমি না বলেছিলে দশ বারোটা টা নাতি নাতনী উপহার দেবে আব্বু কে।”
“ওই কথা এমনি বলেছিলাম, কিন্তু এখন সিরিয়াস হয়ে বলছি। আর একটাও না। এত টেনশন প্রেশার আর নিতে পারবো না, সোজা উপরে চলে যাব।”
আলভীর কথা শুনে মায়া মুচকি হাসে। বাড়িতে থাকতে আলভী মায়া কে সাহস যোগালেও হসপিটালে আসার পর থেকে আলভী নিজেই ভয়ে কেমন যেন করছিল। হাত কাপছিল, একটু পর পর চোখ মুছছিল।
এই সময় টা তে এত ভয় আর টেনশন লাগে যা ভাষায় প্রকাশ করার মতন না।
বেবি দের মায়ার কাছে নিয়ে আসা হয়।
ছেলে মেয়ে কে দেখে একটু পর পর আলভীর চোখ ভিজে উঠছে। এখন পুরোপুরি ফিল করতে পারছে ও ওর বাবা মা কে কত টা কষ্ট দিয়েছে। আর কাউকে কখনো কষ্ট পেতে দেবে না। নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে সবাই কে হ্যাপি রাখার।
_____________________
সিজারের তিন দিন পরই মায়া কে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে।
সাত দিনের দিন আকীকা করে ছেলে মেয়ে দুজনের নাম রাখা হয়েছে। ছেলের নাম “অভি আহমেদ”,
মেয়ের নাম “আইভী মুমতাহিনা”।
মায়া এখন অনেক টা সুস্থ হয়ে উঠেছে। বেবিরা সেরকম জ্বালাতন করে না।
আলভী স্টাডি রুমে বসে ভিডিও কনফারেন্সে মিটিং করছিল। মিটিং শেষ হতেই ল্যাপটপ চার্জে লাগিয়ে বেড রুমে ফিরে আসে। এখন বিকেল তিন টা, মায়া আর বেবিরা ঘুমিয়ে আছে। দু’টোর পর পর তিন জন ঘুমিয়েছে এখনো ওঠেনি। আলভী কে ফিরে আসতে দেখে ঐশী রহমান রুম থেকে বেরিয়ে নিজের রুমে চলে যান। এতক্ষণ নাতি নাতনী কে পাহারা দিচ্ছিলেন, কেউ যদি ঘুম থেকে উঠে কান্নাকাটি করে তাই।
ঐশী রহমান বেরিয়ে যেতেই আলভী বেডের উপর ঝুঁকে পড়ে মায়ার কপালে চুমু খায়, তারপর ছেলে মেয়ের। আলভীর কাছে তিন জনেই ভীষণ আদুরে। ইচ্ছে করে সব সময় তিন কে বুকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকতে, চুমু খেতে। আলভীর পুরো দুনিয়া এখন এই বাড়ির ভেতরেই।
আলভী আবার চুমু খেতেই মায়া চোখ মেলে তাকায়। ঘুম ঘুম চোখে আলভী কে দেখে হেসে বলে,
“কি হয়েছে?”
“কিছু না।”
“আসো ঘুমাও।”
আলভী মায়ার পাশে শুয়ে মায়া কে বুকে আগলে নেয়। মায়া আলভীর বুকে মুখ গুঁজে নিশ্চুপ হয়ে যায়।
দুজনের আলিঙ্গন আর নীরবতার মাঝে আইভী কেঁদে ওঠে। মায়া আলভীর বুক থেকে মুখ তুলে তাকায়। আলভী মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আম্মা আপনি আর ঘুম থেকে ওঠার সময় পেলেন না? মাত্র বউ টা কে একটু ধরেছিলাম। আমি যখনোই বউ টা কে একটু ছুঁই আপনি তখনই এমন করেন, আপনার ভাই টাও এমন করে। দুজন এসে বউ টা কে ছিনিয়ে নিয়েছেন। আমার বউ অথচ আমি কাছে পাই না।”
মায়া হাসতে হাসতে মেয়ের দিকে ফিরে মেয়ে কে বুকে টেনে এনে খেতে দেয়। আলভী পেছন থেকে মায়া আর মেয়ে দুজন কেই জড়িয়ে ধরে একসাথে। ছেলে টা দূরে পড়ে গেছে, ঘুমিয়ে আছে তাই আর ডিস্টার্ব করে না আলভী। বউ আর মেয়ে কে জড়িয়ে ধরে চুপ হয়ে থাকে।
________
সময় থেমে থাকে না, সময় আগায় নিজ গতিতে।
পেরিয়ে গেছে অনেক গুলো দিন।
কিছু দিন আগে মাহিদ এর মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ হয়েছে। রেজাল্ট বের হতে অনেক দেরি। বাবা ভাইয়ের সাথে নিয়মিত অফিসে যাওয়া আসা করে এখন।
গত রাত থেকে মাহিদ এর মন বিষন্ন হয়ে আছে। হাসি খুশি ছেলে টা আর হাসছে না গত কাল রাত থেকে। কারো সাথে কোনো কথা বলছে না, নিজের রুম থেকেও বের হচ্ছে না। রুমে একা একা থাকে আর চোখের পানি ফেলে একটু পর পর।
বেচারা নিজের পরিস্থিতি অবস্থা কাউকে বোঝাতে পারছে না। বাড়ির কেউ ওকে বুঝতেই চাইছে না। বড় ভাই দুই টাও কেমন করে রয়েছে! সব কিছু জানার পরেও বাপ চাচা কে বোঝাচ্ছে না। মাহিদ এর এখন ইচ্ছে করছে গলায় দড়ি দিতে। ওর ফোন, ল্যাপটপ ও নিয়ে গেছে ওর বাপ। বাড়ির বাইরেও বের হতে দিচ্ছে না ওকে। মেয়েদের মতন বাড়ির ভেতর বন্দী করে রেখেছে।
এখন দুপুর আড়াই টা।
মাহির আসে মাহিদ এর রুমে। মাহিদ বেডে বসে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে উদাস মনে। এখন আর চোখ বেয়ে পানি পড়ছে না। কেমন যেন হয়ে বসে আছে। মাহির এসে ভাইয়ের পাশে দাঁড়ায়। মাহিদ তাকায় না ভাইয়ের দিকে। মাহির ছোট ভাইয়ের কাঁধের উপর হাত রেখে বলে,
“রেডি না হয়ে এখনো বসে আছিস কেন? আমাদের বের হতে হবে একটু পর।”
মাহিদ ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
“এই বিয়ে আমি করবো না ভাইয়া। তুমি তো সব জানোই। আব্বু কে তুমি বোঝাও না প্লীজ, আমি এই বিয়ে করতে পারবো না।”
“আব্বু শুনছে না আমার কথা। কিছু বললে উল্টো আমার উপর রাগ দেখায়। মেয়ে দেখতে যাচ্ছি শুধুমাত্র, দেখতে গেলেই তো বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না।”
“যদি হয়ে যায়?”
“হয়ে গেলে করে নিবি।”
“আমি যাব না, তোমরা যাও।”
“বসে না থেকে উঠে রেডি হ। আব্বু আবার রাগারাগি করবে।”
“আমি লীনা কে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করবো না।”
“ভাগ্য যেখানে আছে সেখানেই হবে।”
“লীনা কে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করবো না মানে করবো না।”
“আব্বু কে গিয়ে বল এভাবে।”
“আমার ফোন আর ল্যাপটপ এনে দাও।”
“নিজে গিয়ে চা।”
“ছোট বেলা থেকে তোমাদের সকলের সব কথা শুনেছি আমি আর এখন আমার একটা চাওয়া তোমরা পূরণ করবে না? তোমাদের কাছে তো বেশি কিছু চাইনি আমি, শুধু একটা মেয়ে কে চেয়েছি। দাও না ওকে, এমন কেনো করছো তোমরা?”
“তুই যদি আমার ছেলে হতি তাহলে তোর সব চাওয়া আমি পূরণ করতাম। তুই তো আমার ছেলে না, তুই আমার ভাই। আব্বু না থাকলে একটা কথা ছিল, এখন তো আব্বু আছে আমি আব্বুর কথার উপর কিছু করতে পারবো না।”
মাহিদ ভাইয়ের দুই হাত মুঠো করে ধরে। করুন স্বরে বলে,
“লীনা কে ছাড়া আমি মরে যাব ভাইয়া, অন্য কাউকে বিয়ে করে লীনা কে ঠকাতে পারবো না আমি, অন্য নারী কে বিয়ে করে সেই নারী কেও ঠকাতে পারবো না। তার থেকে আমি মরে যাব সেটাই ভালো।”
মাহির ভাইয়ের দিকে রাগী চোখে তাঁকিয়ে বলে,
“উল্টা পাল্টা কথা বলবি তো এক চড়ে তোর সব দাঁত ফেলে দেব। রেডি হ তাড়াতাড়ি বিকেল হয়ে যাচ্ছে।”
মাহিদ কে টেনে তুলে দার করায়। আলমারি থেকে নিজেই ড্রেস বের করে হাতে ধরিয়ে দিয়ে ওয়াশরুমে ঠেলে ঢুকিয়ে দেয়। গলা ছেড়ে চলে,
“দশ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে নীচে আসবি।”
মাহিদ কিছু না বলে চুপ হয়ে থাকে। মাহির বেরিয়ে যায় নিজে তৈরি হওয়ার জন্য।
আলভী মেয়ে কে আগে তৈরি করাতে শুরু করে। জামা পরিয়ে মেয়ের চুল গুলোতে দুটো ঝুঁটি বেঁধে ক্লিপ লাগিয়ে দেয়। বেডের উপর দার করিয়ে তাকায় ছোট্ট একটি মিষ্টি মায়াবী পরীর দিকে। নিষ্পাপ চেহারায় বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে মায়াবী আইভী।
বউ বাচ্চাদের দেখলেই আলভীর দুনিয়া শান্ত হয়ে যায়। সব কিছু ভালো লাগে, পুরো দুনিয়ার সুখ শান্তি এখন ওর দুয়ারে।
মেয়ে কে বসিয়ে রেখে ছেলে কে রেডি করিয়ে দেয়। চুল গুলো সেট করে সানগ্লাস পড়িয়ে দিয়ে বলে,
“চুপ চাপ বসে থাকবে এক চুল নড়বে না এখান থেকে।”
অভি মাথা নাড়ায়, নড়বে না এখান থেকে।
মায়া ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে ড্রেস চেঞ্জ করে।
মায়া এসে আলভীর সামনে উল্টো ঘুরে দাঁড়ায়।
আলভী জামার ফিতে বেঁধে দিয়ে চুল গুলো ব্রাশ করে বেঁধে দেয় সেই আগের মতো। আগে এক মায়া কে সামলাতো এখন তিন জন কে সামলায়।
মায়া বোরকা হিজাব পড়তে পড়তে আলভী ফ্রেস হয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে নেয়।
রেডি হয়ে চার জন রুম থেকে বেরিয়ে আসে। আলভী দুই হাতে ছেলে মেয়ের দুই হাত ধরে রেখেছে। ছেলে মেয়ের সাথে তাল মিলিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে নিচে নেমে আসে। দাদা নানা কে দেখে দুজন গুটি গুটি পায়ে প্রায় দৌঁড়ে যায়।
সবাই এসে উপস্থিত ড্রইং রুমে শুধু মাহিদ বাদে। আহনাফ মাহমুদ গলা ছেড়ে ডেকে বলেন,
“নিচে আসবি নাকি! দেরি হয়ে যাচ্ছে তো।”
নিচে নেমে আসে মাহিদ। চোখ মুখ থমথমে মলিন বিষন্ন। অন্য দিনের মতন অত বেশি হ্যান্ডসাম লাগছে না আজকে। মলিন বিষন্ন চেহারা অর্ধেক হ্যান্ডসাম নেস গায়েব করে দিয়েছে।
দুই নাতনি কে কোলে নিয়ে দুই ভাই আগে আগে বেরিয়ে যান বাড়ি থেকে। অভি বেশি একটা কোলে উঠতে চায় না। ও সব সময় সকলের সাথে হেঁটে হেঁটে যায়।
আস্তে আস্তে সবাই বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে। বাড়ির ভেতর এখনো তিন ভাই রয়েছে। মাহিদ বাড়ি থেকে বের হতে চাচ্ছে না। দুই ভাই ওর দুই হাত টেনে ধরে নিয়ে যেতে থাকে। মাহিদ দুজন কে বলে,
“তোমরা দুজন তো আগে থেকেই জানতে আমি লীনা কে ভালোবাসি। তোমরা আব্বু কে কেনো বোঝাচ্ছ না? তোমরা বোঝালে আব্বু নিশ্চই বুঝবে। আমি অন্য মেয়ে কে বিয়ে করতে পারবো না। তোমরা এমন কেনো করছো আমার সাথে?”
আলভী বলে,
“তোকে প্রথমেই তো বলা হয়েছিল এই বাড়ির সবাই প্রেম বিদ্বেষী। যে যার সাথে প্রেম করবে তার সাথে বিয়ে হবে না জীবনেও।”
“এমন কিছু কোনো দিন বলা হয়নি আমাকে।”
“আমার সাথে করা হয়েছিল তখনই তোর বুঝে নেয়া উচিত ছিল। এখন চুপ চাপ চল, মেয়েটা সুন্দরী আছে দেখলেই তোর মন পরিবর্তন হয়ে যাবে।”
“তোমরা কি সত্যি সত্যিই আমার ভাই? বড় ভাই হয়ে ছোট ভাইয়ের সাথে এমন টা কিভাবে করতে পারো তোমরা?”
“আমরা করছি না কিছু, তোর বাপ চাচা করছে মানে আমার মীরজাফর বাপ আর শশুর।”
মাহির আলভীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
“তুই এখনো চাচ্চু কে কেনো মীরজাফর বলিস?”
“তোমার বোন কে এখনো মাঝে মধ্যে আমার মীরজাফর বাপ কু বুদ্ধি দেয়।”
“দোষ তো তোরই।”
“যতই দোষ করি তাই বলে সে আমার বউ কে কু বুদ্ধি দেবে?”
“আমার বোন টা তো সরল সোজা তাই।”
“সরল সোজা? সিরিয়াসলি? তোমার বোনের ভয়ে মাঝে মধ্যে আমার হার্ট এ্যাটাক হওয়ার যোগাড় হয়ে যায়। যেভাবে ভয় দেখায় তোমার বোন, সচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করবে না।”
“অমন ভয় সব বোনই দেখায়, আমার বোন তোমার বোন বলে কোনো কথা নেই।”
কথা বলতে বলতে মাহিদ কে টানতে টানতে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসে তিন জন।
আহনাফ মাহমুদ গাড়ির ভেতর থেকে মাথা বের করে বলেন,
“আজকে কি বাড়ি ফেরার ইচ্ছে আছে নাকি ঘর জামাই থাকবি?”
মাহিদ গাড়িতে উঠে বসতে বসতে বলে,
“কোন দুঃখে প্রেম করতে গিয়েছিলাম। এখন বেঁচেও শান্তি নেই মরেও শান্তি নেই।”
আলভী বলে,
“এই কারণেই প্রেম করা হারাম। হারামে প্রথমে খুব সুখ শান্তি আনন্দ থাকে কিন্তু পরে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেতে হয়। হারামে জড়ানোর শিক্ষা পাচ্ছিস তো এখন?”
“একদম হাড়ে হাড়ে। জীবনে আর প্রেম করবো না।”
“তোর কি আরো প্রেম করার ইচ্ছে ছিল?”
“ছিঃ ছিঃ আস্তাগফিরুল্লাহ আস্তাগফিরুল্লাহ তওবা তওবা, একটাই শুরু একটাই শেষ। হারাম টা এখন হালাল হয়ে গেলেই হয়। আল্লাহ মাফ করো আর লীনা কে আমার বউ বানিয়ে দাও। জীবনে আর কোনো দিন হারাম কাজ করবো না আল্লাহ শুধু এবারের মতো মাফ করে আমার চাওয়া টা পূরণ করে দাও।”
মাহির ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দেয়।
পেছনের সিটে সানজিদা, মানতাসা, নাহার বেগম আর মায়া আক্তার বসেছে। ড্রাইভিং সিটে মাহির আর ওর পাশে মাহিদ।
সামনের গাড়িতে আলতাফ মাহমুদ, আহনাফ মাহমুদ, মেহবুবা মেহের, ঐশী রহমান আর অভি, আইভী।
আলভীর ব্ল্যাক মার্সিডিজ গাড়িতে শুধু মায়া আর আলভী। ওদের সাথে আর কেউ নেই।
পর পর বাড়ির গেট পেরিয়ে তিন টা গাড়ি বেরিয়ে যায় গন্তব্যের দিকে।
মাহিদ বিষন্ন মনে চুপ চাপ বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। বাপ কে এত বার করে বলল অন্য কাউকে বিয়ে করবে না, লীনা কে ভালোবাসে, ওকেই বিয়ে করবে। বাপের কাছে আর কোনো দিন কিছু চাইবে না শুধু লীনা কে চায় কিন্তু ওর বাপ ওর কোনো কথা শুনল না। ধরে বেঁধে অন্য জায়গায় মেয়ে দেখতে নিয়ে যাচ্ছে। লীনা কি করছে কে জানে? গত রাত থেকে লীনার সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি একবারের জন্যেও।
গন্তব্যে এসে পৌঁছায় তিন টা গাড়ি। বাড়ির দিকে তাকাতেই মাহিদ এর চোখ দুটো বড় বড় হয়ে যায়। হার্ট বিট বেড়ে যায়। ভাবনায় এতই মগ্ন ছিল যে গাড়ি কোন দিক দিয়ে কোথায় এসেছে খেয়ালই করেনি।
অবাক চোখে বড় ভাইয়ের মুখের দিকে তাকায়। মাহির মিটি মিটি হাসছে। গাড়ির ভেতরেই উড়ে এসে মাহির কে জড়িয়ে ধরে মাহিদ।
একটু পর ছেড়ে দিতেই মাহির হেসে বলে,
“সারপ্রাইজ টা কেমন?”
“খুবই বাজে, আরেকটু হলে দম বন্ধ হয়ে মরে যেতাম।”
“নাম এখন।”
মাহিদ নিজেকে স্বাভাবিক করে গাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে। বাড়ির সবাই মিটি মিটি হাসছে। লজ্জা পেয়ে আলভীর পেছনে এসে দাঁড়ায় নিজেকে আড়াল করে। রাতে কি হাঙ্গামাটাই না করেছিল বাড়িতে। চিৎকার চেঁচামেচি করে না পেরে শেষে বাপের পা জড়িয়ে ধরে বলেছিল লীনা কে বিয়ে করবে, লীনা কে যেন এনে দেয়। আহনাফ মাহমুদের কাঠ কাঠ গলার স্বর ছিল “আমি আমার পছন্দের মেয়ে কেই তোর বউ করে আনব। তোর পছন্দের বা অন্য কারো পছন্দের মেয়ে এই বাড়ির বউ হবে না। আমি যাকে পছন্দ করেছি তাকেই বিয়ে করতে হবে তোর এটাই ফাইনাল।”
ফোন ল্যাপটপ সব রাতেই নিয়ে নিয়েছিলেন। বেচারা সারা রাত ঘুমোতে পারেনি।
আলভী মাহিদ কে পেছন থেকে টেনে বের করার চেষ্টা করে বলে,
“বাচ্চাদের মতো পেছনে লুকাচ্ছিস কেন? বের হ।”
“তোমরা সবাই আগে থেকেই সব প্ল্যান করে করেছো তাইনা?”
“তোকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য স্বশুরের প্ল্যান এটা। জীবনে অনেক উড়েছো একবার তো মুখ থুবড়ে পড়া উচিৎ। রঙ্গ তামাশা তো কম করোনি জীবনে, এখন ভেতরে চল।”
বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে সবাই। কুশল বিনিময় শেষে সকল কে সোফায় বসতে দেওয়া হয়।
আগে থেকেই তো সকলের সাথে সকলে পরিচিত এখন আর আলাদা করে কি পরিচিত হবে?
আলভী লীনার কথা শশুর কে জানিয়েছিল প্রথম। লীনার বাবা,দাদা, চাচা সবাই কেই চেনেন আহনাফ মাহমুদ। লীনার বাবার সাথে বেশ সক্ষতাও আছে বিজনেসের সূত্রে।
ছেলে মেয়ে কে না জানিয়ে দুই পরিবার সব কিছু ঠিক করে রাখে।
খাওয়া দাওয়া শেষ হলে সবাই আবার সোফায় বসে। লীনা কে নিয়ে আসে ওর ভাবী। লীনার পরনে মেরুন রঙের শাড়ি। লম্বা ঘোমটা টেনে ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে। মাহিদ বার কয়েক ঘাড় ঘুরিয়ে লীনার দিকে তাকায়।
সকলের সামনের সোফায় লীনা কে বসানো হয়।
লীনার ঘোমটা সরিয়ে দেয় ওর ভাবী।
লীনা চোখ তুলে তাকায় না, ওর চেহারা বিষন্ন।
পুরো দুনিয়ার দুঃখ কষ্ট অন্ধকার ওর চেহারায় ছেয়ে আছে।
ছেলে কে দেখার জন্য লীনা কে বার বার তাকাতে বললেও লীনা তাকায় না, ওর দৃষ্টি নিচের দিকে স্থির হয়ে আছে।
লীনার ভাবী লীনার মাথা জোর করে উঁচু করে ধরে। লীনা এক পলক চোখ তুলে তাকায়। দৃষ্টি নামিয়ে নিলেও ন্যানো সেকেন্ডের মধ্যে আবার তাকায়। এবার চোখের পলক ফেলতেই ভুলে যায়। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সামনে বসে থাকা সুঠাম দেহের তাগড়া যুবকের দিকে। মাহিদ বুঝতে পারে ওর মতো লীনাও কিছু জানতো না। লীনাও ভেবেছিল অন্য কেউ এসেছে ওকে বউ করে নেয়ার জন্য।
তাকিয়ে থাকতে থাকতে দুই হাতে মুখ ঢেকে ঝর ঝর করে কেঁদে ওঠে লীনা। হকচকিয়ে যায় সবাই।
লীনা কে ওর ভাবী নিচের একটা রুমে নিয়ে আসে।
ভাবী রুম থেকে বের হতেই রুমে প্রবেশ করে মাহিদ। লীনা মাহিদ এর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আবারো শব্দ করে কেঁদে ওঠে। বেড থেকে উঠে দাড়িয়ে মাহিদ কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাদতে কাদতে বলে,
“আমি কত ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম তোমার সাথে আর দেখা হবে না। তোমার সাথে যোগাযোগ করার সব রাস্তা আব্বু আর ভাইয়া রাতেই বন্ধ করে দিয়েছিল। আমি রাতে সুই/সা/ইড করতে নিয়েছিলাম তারপর ভাবলাম কোনো একটা সুযোগ যদি পাই তোমাকে পাওয়ার তাই পিছিয়ে যাই। ভাগ্যিস শয়তানের প্ররোচনায় অমন পাপ কাজ করিনি নয়তো তোমাকে না পাওয়ার আফসোস অনন্ত কাল থেকে যেত আমার মনে। আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারতাম না মাহিদ, আমি তোমাকে অনেক অনেক অনেক ভালোবাসি।”
“আমিও ভালোবাসি তোমাকে নিজের থেকেও বেশি।”
,
,
সবাই কে রেখে সন্ধ্যার আগে আগে মায়া কে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে আলভী। মায়া কে নিয়ে যাবে এখন লং ড্রাইভে। বাচ্চা দের বাবা মায়ের কাছে রেখে এসেছে। ফিডার খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখবে দুজন কে। একবার ঘুমিয়ে গেলে সারা রাত আর ঘুম থেকে উঠবে না দুজনের একজনও।
এক মাস পর মাহিদ আর লীনার বিয়ে।
আজকে আকদ সম্পন্ন করা হয়েছে দুজনের।
ব্ল্যাক মার্সিডিজ ছুটে চলেছে নিজ গতিতে।
চারো দিক অন্ধকারে তলিয়ে গেছে ধীরে ধীরে।
পূর্ণিমার চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে ধরণীর বুকে।
নিরিবিলি রাস্তার পাশে গাড়ি দার করায় আলভী।
গাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে দুজনেই।
শীতল বাতাস বইছে। শীতল বাতাসে অন্তর শীতল হয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি দাঁড়ায় দুজন গাড়ির সাথে ঠেস দিয়ে।
আলভী এক হাতে মায়া কে টেনে বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়।
নিরিবিলি শান্ত পরিবেশ, জোস্নার আলো সাথে প্রিয় মানুষ। এক অসাধারণ মুহূর্ত তৈরি হয়েছে এখন।
আলভী মায়ার কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে বলে,
“অনেক গুলো দিন পর এমন একটা রাত পেলাম তাইনা?”
“হুম।”
“কেমন লাগছে তোমার?”
“দারুন।”
“আমি তোমাকে ভালো রাখতে পেরেছি?”
মায়া হাসে। আলভীর দুই গালে হাত রেখে বলে,
“শুধু ভালো রাখোনি, অনেক ভালো রেখেছো, ততটা ভালো যতটা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।”
আলভী মায়া কে জড়িয়ে ধরে বলে,
“আর কি চাও আমার কাছে?”
“আমি চাই আরও শত শত রাত তোমার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়তে। চাই প্রতিটি ভোর তোমার সাথে দেখা হোক, তোমার উষ্ণ বাহুতে জড়িয়ে নতুন দিনের শুরু করতে। তোমার কণ্ঠের মিষ্টি ডাক দিয়ে ঘুম ভাঙুক আমার, আর তোমার ভালোবাসার ছোঁয়ায় ভরে উঠুক আমার প্রতিটি সকাল।
আমি চাই তোমার হাত শক্ত করে ধরে জীবনের প্রতিটি পথে হাঁটতে। একসাথে বার্ধক্যের দিকে এগিয়ে যেতে, তোমার চোখের কোণে ভাঁজ পড়ুক আর সেখানেও ভালোবাসা লুকিয়ে থাকুক। আমি চাই তোমার আদর, যত্ন আর অশেষ ভালোবাসায় আরও অনেক বছর ডুবে থাকতে।
আমাদের ছোট্ট সংসারটাকে হাসি-আনন্দে ভরে তুলতে চাই। আমাদের সন্তানদের নিয়ে স্বপ্ন বুনতে চাই, তাদের হাসিতে আমাদের পৃথিবীকে রঙিন করতে চাই। প্রতিটি উৎসব, প্রতিটি আনন্দের মুহূর্তে তোমার হাতটা শক্ত করে ধরে রাখতে চাই, যাতে পৃথিবী যত কঠিনই হোক, আমরা একসাথে সবকিছু জয় করতে পারি।
আমি চাই তোমার হৃদয়ে আমার জন্য ভালোবাসা কখনো ফুরিয়ে না যায়। আমি চাই আমরা একে অপরের সবচেয়ে বড় আশ্রয় হয়ে থাকি, যতদিন পৃথিবী আছে, যতদিন ভালোবাসা আছে আর যত দিন আমরা আছি।”
“আমার মনে হয় আমি এখনো তোমাকে পুরোপুরি ভালো রাখতে পারিনি, কমতি রয়ে গেছে এখনো।”
“কোনো কমতি নেই। তুমি বেস্ট, তুমি অসাধারণ, তুমি কোটিতে একজন। অনেক বেশি ভালো ভাগ্য নিয়ে জন্ম গ্রহণ না করলে তোমার মতো পুরুষ কে কেউ জীবন সঙ্গী হিসেবে পাবে না। সেই অনেক বেশি ভাগ্য নিয়ে জন্মানো মেয়েদের মধ্যে আমি একজন। আমার মনে হয় আমিই তোমাকে ভালো রাখতে পারিনি, আমার মধ্যেই কমতি আছে।”
মায়ার মুখ টা বুকে চেপে ধরে আলভী। তারপর বলে,
“তোমার মধ্যে কোনো কমতি নেই, তুমি পরিপূর্ণ একজন নারী, আমার মায়া পরী।”
~সমাপ্ত ~