হৃদয় মাঝে হঠাৎ তুমি পর্ব-০৫

0
2

#হৃদয়_মাঝে_হঠাৎ_তুমি
#সানা_শেখ
#পর্ব_5
[কার্টেসি ব্যতীত কপি করা নিষিদ্ধ]

ঘুম ভাঙ্গে আলভীর। দুদিন ঘুমোতে না পারায় রাতে বিভোর হয়ে ঘুমিয়েছিল।
এখন খিদেয় পেট চো চো করছে। দুপুরে খাওয়ার পর রাতে আর খাওয়া হয়নি।
শোয়া থেকে উঠে বসে। ফোন হাতে নিয়ে টাইম দেখে নেয়। সকাল নয়টা বেজে গেছে। এত সময় এক টানা ঘুমিয়েছে ভেবেই অবাক হয়। এর আগে কোন দিন বোধহয় এভাবে ঘুমায়নি। রাতে কয়েক বার করে ঘুম ভেঙ্গে যায় সেখানে গত রাতে একবার ঘুম ভেঙ্গেছিল।

খাট থেকে নেমে দাড়ায়। চুল গুলো হাত দিয়ে ঠিক করে পেছনে ঠেলে দেয়। রুমের দরজা জানালা সব খুলে দেয়। বেলকনি থেকে টাওয়েল নিয়ে ওয়াশরুমে প্রবেশ করে।

বিশ মিনিটে শাওয়ার নিয়ে ফ্রেস হয়ে বেরিয়ে আসে।
ক্রিম কালার থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পড়ে নেয়। গায়ে জড়ায় অ্যাশ কালার টিশার্ট। চুল গুলো ভালোভাবে শুকিয়ে নিয়ে ব্রাশ করে নেয়।
ভেজা টাওয়েল আর প্যান্ট টিশার্ট বেলকনিতে মেলে দিয়ে আসে। বিছানা গুছিয়ে ফোন টা চার্জে লাগায়। এসি বন্ধ করে রুম থেকে বের হয়। করিডোরে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকায়। মায়ার রুম কোনটা?
সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায়। নিচে নেমে এসে দেখে বাড়ির সবাই সোফায় বসে আছে। কপাল ভ্রু কুঁচকে যায় আলভীর। বাপ চাচার অফিস নেই নাকি আজ? অফিসে না গিয়ে সবাই এভাবে বসে আছে কেন?
আলভী কে দেখে মানতাসা বলে,

_ বড় চাচ্চু এসে গেছে।

সবাই আলভীর দিকে তাকায়। মায়াও তাকায়। আলভী আর মায়ার চোখাচোখি হয়। মায়ার চোখ মুখ মলিন শুকনো। রাতে হয়তো ঘুমায়নি। মায়া চোখ নামিয়ে নিচের দিকে দৃষ্টি স্থির করে। হার্ট বিট বেড়ে গেছে আবার। টিপ টিপ করছে বুকের ভেতর। হাত কাঁপতে শুরু করে।
নিজের রুমে চলে যেতে নিয়েছিল মায়া, আলতাফ মাহমুদ যেতে দেননি। জোর করে বসিয়ে রেখেছেন সোফায়।

আলতাফ মাহমুদ ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেন,

_ ঘুম শেষ হয়েছে তোমার?

আলভীর গম্ভীর স্বর।

_ হুম।

_ তাহলে বলো এখন।

_ কি?

_ যা বলার জন্য এসেছো।

আলভী বুঝতে পারে সবাই ওর অপেক্ষায় বসে আছে। মায়ার দিকে তাকায় আবার। জড়সড় হয়ে বসে আছে। পরনে কালো রঙের থ্রী পিস। ওড়না দেওয়া রয়েছে মাথায়। মায়ার দিক থেকে চোখ সরিয়ে বাবার দিকে তাকায়।

_ আমি তো খেতে এসেছি। খিদে পেয়েছে আম্মু খেতে দাও।

হতভম্ভ সবাই।

_ যা করার জন্য দেশে এসেছো সেটা করতে বলেছি।
নিজের কাজ শেষ করে গিয়ে খাও।

_ তোমরা সবাই খেয়েছো?

_ হ্যাঁ।

_ একা একা খেলে আমাকে ডাকলেও না!

_ তুমি নিজেই তো গত কাল বললে তোমাকে যেন কেউ ডিস্টার্ব না করে। তাইতো ডাকেনি।

আলভী ডাইনিং রুমের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে,

_ খেয়ে তারপর আসছি।

আলতাফ মাহমুদ এর গলার স্বর একটু জোড়ে হয়।

_ আলভী নিজের কাজ শেষ করে তারপর গিয়ে খাও।

_ খিদের চটে আমার পেটে হাতি ডান্স করছে। কথা বলার শক্তি নেই, খেয়ে আসছি।

আলভী ডাইনিং রুমে ঢুকে যায়। সোফায় বসে থাকা সকলে একে অপরের মুখের দিকে তাকাতাকি করে।
মায়া চোখ তোলে না আর।
আলভী সামনে থেকে সরে যাওয়ায় একটু যেন স্বস্তি ফিরে পায়। আলভী সামনে আসলেই কেমন যেন লাগছে। বুকের ভেতর অস্বাভাবিক ভাবে কম্পন শুরু হয়।

ঐশী রহমান ডাইনিং রুমে প্রবেশ করেন। আলভী চেয়ারে বসে আছে।
আজ ছেলের পছন্দের অনেক কিছু রান্না করেছেন নিজের হাতে। মেহবুবা মেহের ও আলভীর জন্য রান্না করেছেন।

আলভী মায়ের মুখের দিকে তাকায়। ওনার মুখ টা মায়ার মুখের চেয়েও বেশি মলিন হয়ে আছে। চোখে টলমলে পানি। চোখ দুটো ফোলা ফোলা লাল লাল। সারা রাত ঘুমায়নি নাকি? কান্নাও করেছে বোধহয়।

_ খাওয়া শুরু করো।

মায়ের কথা শুনে প্লেটের দিকে তাকায় আলভী। ওর পছন্দের খাবার। আবার মায়ের মুখের দিকে তাকায়। ওর মা বোধহয় এখনই কেঁদে দেবে।

আলভী নিজের পাশের চেয়ার টা টেনে ওর মাকে হাত ধরে বসায়।

_ তুমি খেয়েছো আম্মু?

ঐশী রহমান বলতে পারেন না। কথা বলতে গিয়েই বোধহয় কেঁদে দেবেন।

_ খাওনি তাইনা?

তবুও বলেন না কিছু। শুধু তাঁকিয়ে দেখেন ছেলে কে।
আলভী চোখ নামিয়ে নিয়ে হাত ধুয়ে ভাত মাখায়। ভাত তুলে মায়ের মুখের সামনে ধরে।

_ হা করো।

ঐশী রহমান হা করেন। মাকে খাইয়ে দেয় আলভী। টুপ করে ঐশী রহমান এর চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে।
টিস্যু বক্স থেকে টিস্যু নিয়ে মায়ের চোখ মুখ মুছিয়ে দেয় নিজের হাতে। আবার গড়িয়ে পড়ে, আবার মুছিয়ে দেয়। দ্বিতীয় বার ভাত তুলে মায়ের মুখের সামনে ধরে। ঐশী রহমান আলভীর হাত ঘুরিয়ে ওর মুখের সামনে ধরে। কান্না গিলে বলে,

_ তুমি খাও।

খায় আলভী। আবার ভাত মেখে মাকে খাইয়ে দেয়। একবার নিজে খায় আবার মাকে খাওয়ায়। ঐশী রহমান এর চোখ বেয়ে পানি পড়ে গাল ভিজে গেছে। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে গেছে। ভাতের সাথে সাথে কান্নাও গিলে খাচ্ছেন। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে যাওয়ায় ছেলে কে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন না। একটু পর পর শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছছেন। তখনই আবার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।

ডাইনিং রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মা ছেলে কে কতক্ষন দেখেন মেহবুবা মেহের। তারপর আবার ফিরে আসেন ডাইনিং রুমে।
,
,
খাওয়া শেষে আলভী ড্রইং রুমে এসে দাঁড়ায়।
ঐশী রহমান বেসিনে মুখ ধুয়ে লম্বা শ্বাস শ্বাস টেনে নিয়ে ডাইনিং রুম থেকে বেরিয়ে আসেন।

_ এবার বলো।

_ ওয়েট আসছি আমি।

বলেই সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায়।

_ কোথায় যাচ্ছো?

_ আসছি এখনই।

চলে যায় আলভী চোখের আড়ালে।
বহু কষ্টে নিজের রাগ কন্ট্রোল করে বসে আছে মাহির। আলভী আর নিজের পরিবারের উপর ওর রাগ অনেক আগে থেকেই। এই পরিবারের একটা ভুল সিদ্ধান্ত আর আলভীর করা কাজের জন্য ওর বোন কে ছোট বেলা থেকে অনেক কিছু সহ্য করতে হয়েছে। বার বার মানুষের কটু কথা, খোঁচা মা রা কথা মুখ বুঝে সহ্য করেছে। যদিও এখন আর সহ্য করে না, আগে বোকা ছিল তাই চুপ চাপ শুনতো আর একা একা কাদতো।

মাহির রাগ করে পরিবারের কারো সাথে সেভাবে কথা বলে না। মাহির পুরো দোষ আলভী কেও দিতে পারে না। দোষ টা ওর পরিবারের। তারা এরকম কিছু না করলে মায়া কে এত কষ্ট পেতে হতো না, আলভী কেও পরিবার ছেড়ে এত গুলো বছর বাইরে থাকতে হতো না। দিন শেষে আজ দুজনেই ভালো থাকতো। আবেগের বশবর্তী হয়ে অনেক বড় ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওর পরিবার।

মায়ার দাদি নাহার বেগম বলেন,

_ ও কি কাবিনের টাকা নেওয়ার জন্য রুমে গেল নাকি?

সবাই তার দিকে তাকায়।

_ হতে পারে মা।

সবাই অপেক্ষা করছে আলভীর ফিরে আসার।
মায়া সোফা খামচে ধরে বসে রইলো। এত কাল সবাই বলেছে “জামাই থাকতেও জামাই ছাড়া। বিয়ে করে জামাই ফেলে রেখে চলে গেছে দ্বিতীয় বার মুখটাও দেখেনি আর”। আরো নানান রকম কথা। আর এখন বলবে “ডি ভো র্সী”। ডি ভো র্সী ট্যাগ লেগে যাবে আজ থেকে। বিয়ে হলো সংসার হলো না। স্বামী ছিল কিন্তু স্বামীর ভালোবাসা ছিল না। বিয়ে হয়েছিল , আজ
ডি ভো র্স ও হয়ে যাবে। মাজ খান থেকে এত গুলো বছর মানুষের খোঁচা সহ্য করলো শুধু শুধু। অবুঝ বয়সে বিয়ে টা না হলে কি এমন ক্ষতি হতো?
অন্তত বন্ধ দরজার ভেতরে রাতের আধারে গুমরে গুমরে কাদতে হতো এত কাল। অপেক্ষা করতো না একজনের ফিরে আসার। আজ ওর অপেক্ষা শেষ হয়েছে। যার অপেক্ষায় ছিল সে ফিরে এসেছে কিন্তু ওকে ভালোবাসার জন্য নয় , ওর সাথে সংসার করার জন্য না। ওর থেকে মুক্তি পেতে ,মুক্তি দিতে। কেন যেন ওর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। হবে না কেন ভালোবেসেছিল তো।

আলভী নিচে নেমে আসে। সবাই তাকায় ওর দিকে।
এ কি এই ছেলে এমন ফিটফাট হয়ে এসেছে কেন ?
ব্ল্যাক প্যান্ট, হোয়াইট শার্ট, এক হাতে ফোন অন্য হাতের সাহায্যে সানগ্লাস গোল গোল করে ঘুরাচ্ছে। চুল গুলো জেল দিয়ে সেট করা। সুন্দর লাগছে দেখতে। মায়া একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। এই পুরুষ টা ওর হয়েও হয়নি।

আলতাফ মাহমুদ আবার তাড়া দেন আলভী কে।
আলভী ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলে,

_ আমার একটা কাজ আছে বাইরে। কাজ টা শেষ করে আসছি আগে।

বলেই শিস বাজাতে বাজাতে বাইরের দিকে এগিয়ে যায়। এখনো সানগ্লাস টা গোল গোল ঘুরাচ্ছে। আবারো বাড়ির সবাই কে অবাক, বিস্ময়ে বিমূঢ় করে দিয়ে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে।

এবার আর নিজেকে শান্ত রাখতে পারে না মাহির। রাগে ক্ষোভে চেঁচিয়ে বলে,

_ কি পেয়েছে ও? ওর যা ইচ্ছে হবে তাই করবে? পুতুল পেয়েছে আমার বোন কে? তালাক দিলে দ্রুত দিয়ে দিক। আর যদি না দেয় তাহলে মায়ার সাথে সংসার করুক। আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাচ্ছে এখন। কোনটা করবে স্পষ্ট করে বলতে বলো ওকে। নয়তো ওকে ধরে কিন্তু মা র বো আমি।

মায়া সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। বড় ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

_ আমি সংসার করবো না তার সাথে। কোনো ভাবেই মা। তালাক দিতে এসেছে তালাক দিয়ে দিতে বলো।

বলেই হনহন করে হেঁটে এগিয়ে যায় সিঁড়ির দিকে।

চলবে……….