হৃদস্পর্শে প্রেমসায়রে পর্ব-১০

0
49

#হৃদস্পর্শে_প্রেমসায়রে
#রক্তিমা(লেখনীতে)
১০.
-আমি আপনার কথার অর্থ বুঝলাম না মিস্টার!

-বাংলায় বলেছি না বোঝার তো কথা নয়।মাঝে মাঝে আমরা ইচ্ছা করেই কিছু কথা বুঝতে চাই না।

সুপ্ত শেষাক্ত বাক্যটুকু তাচ্ছিল্য নিয়ে শেষ করে ত্রয়ীর পানে চায়।হালকা গোলাপি সেলোয়ার-কামিজ আর গলায় সাদা ওড়না ঝোলানো রমনী সটান হয়ে দাড়িয়ে।সুপ্ত ওর দিক থেকে দৃষ্টি সড়িয়ে সয়নের পানে চায়।সয়ন সুপ্তের বলা কথাখান একবার মনে মনে আওড়ায়।তারপর কপাল ও ভ্রু কুঁচকে বলে উঠে,

-কারো সহধর্মিণী মানে?সি ইউ স্টিল আন ম্যারিড!এন্ড হু আর ইউ।ত্রয়ী আমার স্টুডেন্ট।ওর সাথে কথা বলছিলাম আমি এর মাঝে আপনি বাগড়া দিচ্ছেন কেন?

সয়নের কথা বলার ধরনে মেজাজ উষ্ণ হয়ে উঠে সুপ্ত।চোয়াল হয়ে আসে শক্ত।শক্ত চোখে সয়নের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

-আমি কে সেটা আপনাকে বলতে বাধ্য নই আমি।স্টুডেন্টের সাথে এমন ব্যবহার করেন আপনি?তাদের বিনা অনুমতিতে টাচ করে তাদের অস্বস্তিতে ফেলেন?কিয়া বাট হ্যা!

-মাইন্ড ইউর ল্যাঙ্গুয়েজ!আপনি আমার উপর আজেবাজে দোষারোপ করতে পারেন না।

ত্রয়ী সুপ্তের পাশে দাড়িয়ে চুপচাপ আড়চোখে সুপ্তের ভাবভঙ্গি লক্ষ করছে।ডাক্তার সয়ন কে তার একদম পছন্দ নয়।তাকে এভাবে সুপ্তের কথায় পিষ্ট হতে দেখে মনে মনে খুশি হলেও একটু ভয় হচ্ছে তার।পাছে না আবার সুপ্ত বলে বসে,

-আমার উপর দোষ চাপিয়ে নিজে এসব কি করে বেড়াও!

সুপ্ত সয়নের চোখ বরাবর তাকায়। তার চোখের দৃষ্টি শান্ত অথচ সে ভয়াবহ রেগে আছে।সুপ্ত শক্ত কন্ঠে বলে উঠে,

-ও কি আপনার ব্যাক্তিগত রমনী?

এমন প্রশ্নে ঘাবড়ে সুপ্তের দিকে তাকায় সয়ন।সুপ্তকে সয়ন চিনে না।তবুও হৃদয় টলতে শুরু করেছে তার।সে প্রশ্ন ঘুরানোর উদ্দেশ্যে বলে উঠে,

-আমাকে এসব প্রশ্ন করার আপনি কে?..

সুপ্ত আচমকা হালকা চিৎকার করে বলে উঠে,

-টেল মি ইয়েস ওর নো!

-নো।বাট..

সয়নকে আর কোন শব্দ উচ্চারণ করতে না দিয়ে সুপ্ত বলে উঠে,

-দ্যান ইউ নেভার লুক এট হার।

কথাখান শেষ করে সুপ্ত তার সেখানে একমুহূর্ত দাড়ায় না।আলতে করে ত্রয়ীর হাত তার মুঠোয় পুরে নিয়ে বেরিয়ে আসে কলেজ ক্যাম্পাস থেকে।গাড়ির সামনে এসে ত্রয়ী হাত ছেড়ে দেয় সে।ত্রয়ী কে খানিকটা তটস্থ দেখে সে বলে উঠে,

-ডোন্ট ওয়ারি!আমি তোমার মত দোষারোপ দিয়ে চরিত্রে আঘাত লাগার মত কোন কথা বলব না।

সুপ্ত অতি শান্ত স্বরে বলছে দেখে ত্রয়ী একটা শব্দও উচ্চারণ না করে গাড়িতে বসে পরে।তার পরই সুপ্ত ড্রাইভিং সিটে বসে বিকট শব্দে দরজা লাগায়।আচমকা এমন হওয়ায় চমকে উঠে ত্রয়ী।তবে কিছু মুহুর্ত পার হতেই মনে মনে আনন্দ পায় ত্রয়ী।এখন উনি বুঝছেন একান্ত ব্যাক্তিগতভাবে আমরা যাকে চাই তার পাশে
অন্য কাউকে কেমন লাগে।হঠাৎ সুপ্তের ফোনে কল আসে। কিন্তু সুপ্ত যেন সেটা শুনতেই পাইনি এমন ভাবে ড্রাইভিং করছে।ফোন বাজতে বাজতে একসময় কেটে গিয়ে লকস্ক্রিন ভেসে উঠে।ত্রয়ী বাঁকা চোখে ফোনের স্ক্রিনে চোখ রাখতেই আবছা আবছা ভাবে এক রমনীর প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই।লেমন কালারের সেলোয়ার-কামিজ পরিহিতা রমনী কোলে বাচ্চা নিয়ে রাস্তার মাঝখানে হাঁটছে।সম্ভবত রাস্তা পার হচ্ছিল!ত্রয়ীর ভালো ভাবে দেখতে যাবে তখনি ফোনের আলো নিভে আসে।ত্রয়ী একবার সুপ্তের মুখপানে তাকায় তারপর ফোনের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বাইরেতাকিয়ে ভাবে,

-কেন মনে হচ্ছে মেয়েটা আমি?কিন্তু এটা কি করে সম্ভব?

বাড়িতে পৌঁছে রুমে আসতেই কালকে নিয়ে আসা বিড়াল ছানাটা সুপ্তের পায়ের কাছে ঘুরঘুর করতে করতে মিউ মিউ স্বরে ডাকছে।ত্রয়ী তার নাম দিয়েছে পিংকু।বাচ্চাটা কালকে শুধু শুয়ে থাকলেও তার সে বড্ড চঞ্চলতা প্রদর্শন করছে।সুপ্তের পায়ে গা ঘেঁষে এটেনশন পাওয়ার আপ্রান চেষ্টা করছে সে।কিন্তু সুপ্ত পিংকুকে ওর কাছে আসতে দেখলেই দ্রুত সেই স্থান ত্যাগ করেছে।অবশেষে পিংকুকে ক্লান্ত হয়ে বসে থাকতে দেখে ত্রয়ী কোলে এনে ঘুম পাড়িয়ে ওর জন্য বানানো ঘরে রেখে দিয়েছে।সন্ধ্যায় ঘুম থেকে উঠে আবার সেই একই কান্ড!
সুপ্ত বিছানায় বসে বসে ল্যাপটপে কাজ করছিলো আর ত্রয়ী ছিল সুপ্তের পড়ার টেবিলে।বসে বসে পড়ছিল ত্রয়ী।পিংকুকে নিয়ে ওর পাশে রেখে দিয়েছিল ত্রয়ী।কিন্তু পাজি বাচ্চাটা কখন যেন সুপ্তের কাছে গিয়ে ফের মিউ মিউ করতে ছিল।ত্রয়ী ওর অবস্থা দেখে হতাশা হয়ে পিংকুর কান্ড অবলোকন করে।
যারা আমাদের পেছনে পাগল তাদের পাত্তা দিতে আমরা নারাজ।অথচ যাদের কাছে আমাদের একটুও মূল্য নেই আমরা তাদের পেছনেই দৌড়াবো।পিংকুর অবস্থা হয়েছে এমন।
ত্রয়ী সুপ্তের দিকে না তাকিয়ে বইয়ে মগ্ন থেকে শাসিয়ে বলে উঠে,

-বাচ্চাটা কষ্ট পাচ্ছে দেখছেন না আপনি?তখন থেকে আপনার পেছনে ঘুরছে।একটু গায়ে হাত বুলিয়ে দিলে কি হাতে ফোস্কা পরবে আপনার?

সুপ্ত ল্যাপটপ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ত্রয়ীর দিকে তাকায়।মেয়েটা তার দিকে পিঠ ঘুরিয়ে বসে।লম্বা বিনুনি দুলছে একটু পরপর।পিংকু ততক্ষণে সুপ্তের কোল দখল করে নিয়েছে।সুপ্ত ওর গায়ে সংকোচের সহিত আলতো করে হাত বুলায়।কিছুক্ষণ হাত বুলাতেই ঘুমিয়ে পরে পিংকু।সুপ্ত তা দেখে স্মিত হাসে।ছোটবেলায় একবার বিড়ালের কামড় খাওয়ায় ইন্জেকশন দিতে হয়েছিল। সেই থেকে বিড়ালদের ধারে কাছেও ঘেঁষে না সে।বহুবছর পর আবার ছোট একটা বিড়ালের সংস্পর্শে এসে ভেতরে জমে থাকা ভয়ের অন্ত ঘটে।ত্রয়ী পাশ ফিরে একবার তাকিয়ে দেখে সুপ্ত মাথা নিচু করে পিংকুর দিকে তাকিয়ে আছে।পিংকুটা কি আদুরে ভাবে শুয়ে আছে সুপ্তের কোলের উষ্ণতা পেয়ে!ত্রয়ী মৃদু হেসে ফের বইয়ে মনোযোগ দেয়।
সুপ্ত এবার মাথা তুলে ত্রয়ীর পানে তাকায়।চোখের পরে থাকা চশমাটা উপরের দিকে ঠেলে দিয়ে বিরবিরয়ে বলে উঠে,

-তুমি একটা বোবা প্রানীর কষ্ট বুঝলে অথচ এই অধম মনুষ্য যে কষ্ট পাচ্ছে সেটা বুঝলে না বধু সাহেবা।
.
পরদিন সকালে সকলে তাড়াতাড়ি উঠে রান্না-বান্নার কাজে লেগে পরে।ত্রয়ী শাশুড়ী আর কাকি শাশুড়ীর কাজ এগিয়ে দেয়। ত্রয়ী রান্নাবান্না তেমন একটা পারে না বললেই চলে।ইন্টার লাইফ থেকে সে হোস্টেলের বাসিন্দা।এখন বিয়ের পর মুক্তি পেল সেখান থেকে।হোস্টেলের খাবার খাওয়ার দরুন রান্নাবান্না শিখার প্রয়োজন মনে করেনি সে।রান্না শেষ হলে ত্রয়ীকে রুমে গিয়ে তৈরি হতে আর মিনিকে তৈরি করতে বলেন মিসেস সুহৃদ।
ত্রয়ী রুমে এসে গোসল ছেড়ে তৈরি হয়ে নেয়।লাল সাদার মিশ্রণে একটা শাড়ি পরে নেয় সে। সাদা রঙের মাঝারি ঝুমকো পরে লোচনে কাজল লেপ্টে নেয়।ঠোঁটদুটো খয়েরী রঙের কৃত্রিমতায় রাঙায়।তারপর মাথায় খোঁপা করে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।দোতলার সিঁড়ি বেয়ে হাঁটতে হাঁটতে ড্রয়িং রুমে তাকাতেই সুপ্তকে দেখতে পায় ত্রয়ী।কালো রঙের টিশার্ট পরিহিত যুবকের হাতে মিষ্টান্নের বক্স।ঘামে ভিজে ঘাড়ের দিকের টিশার্ট শরীরের সাথে লেপ্টে।সুপ্ত রান্নাঘরে গেলে ত্রয়ী উঁকি ঝুঁকি দিয়েও তাকে দেখতে পায় না।তারপর ব্যর্থ দৃষ্টিতে তাকিয়ে মিনির দরজায় নক করে ত্রয়ী।মিনি বলে উঠে,

-আরে ভাবি এসো এসো।অনুমতি নেওয়ার কি আছে।তুমি তো আমাদেরই ঘরের লোক।

ত্রয়ী স্মিত হেসে মিনির রুমে প্রবেশ করে।তন্দ্রা আর মিনি বিছানায় বসে মোবাইল স্ক্রল করছিল।ত্রয়ী বিছানার নিকটে আসতেই মিনি বালিশের তলায় মোবাইল রেখে কিছু একটা শোনার প্রত্যাশায় ত্রয়ীর পানে আগ্রহভরে তাকায়।তখনি ত্রয়ী তার উদ্দেশ্য বলে উঠে,

-এখনও রেডি হতে শুরু করনি?ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে তো পাত্রপক্ষ চলে আসবে।

-আরে ভাবি এই কথাটা শোনার জন্য কখন থেকে অপেক্ষা করছি।কিন্তু তোমরা বলার আগেই যদি রেডি হয়ে থাকতাম তবে তোমরা ভাবতে আমি বিয়ের জন্য পাগল হয়ে গেছি।এখন তো বলে দিয়েছো আমি ফটাফট রেডি হয়ে আসছি।

মিনির বলতে দেরি কিন্তু ড্রেস নিয়ে বাথরুমে ঢুকতে দেরি হয় না।তার কান্ড দেখে ত্রয়ী মুখ টিপে হাসে।তাকে হাসতে দেখে তন্দ্রা বলে উঠে,

-আচ্ছা ভাবি একটা প্রশ্ন করি?

ত্রয়ী তন্দ্রার পাশে বাবু হয়ে বসতে বসতে বলে,

-নিঃসংকোচে বলো।

-ওইদিন বেলাপুর সাথে ঝগড়া লাগার সময় ভাইয়া বলেছিল তুমি শুধু মায়ের পছন্দ করা মেয়ে নও।তবে কি ভাইয়া আর তোমার মাঝে বিয়ের আগেও কিছু ছিল?আই মিন গোপনে কিছু যেমনটা মিনি আর ওকে যে আজকে দেখতে আসবে সেই ছেলেটার মাঝে আছে।

ত্রয়ী বিস্মিত চোখে তন্দ্রার পানে চায়।তন্দ্রা ত্রয়ীর উত্তরের আশায় কৌতুহলী হয়ে তাকিয়ে। কিন্তু ত্রয়ী কোন উত্তর না দিয়ে বলে উঠে,
-সেদিন কি বলেছিল সুপ্ত?আমি শুধু উনার মায়ের পছন্দ করা মেয়ে নই!তবে এর উত্তর কি দাড়ায় তন্দ্রা?উনি আমাকে আগে থেকে চিনতেন?

চলবে..