হৃদস্পর্শে প্রেমসায়রে পর্ব-১৫+১৬

0
50

#হৃদস্পর্শে_প্রেমসায়রে
#রক্তিমা(লেখনীতে)
১৫.
ত্রয়ী চিন্তিত মুখশ্রীতে একটা প্রাইভেট হাসপাতালে বসে আছে।পাশেই একজন ডাক্তার রিক্তের হাতের গুলি বের করতে ব্যস্ত।ত্রয়ী উঁকি ঝুঁকি দিয়ে সেটাই প্রতক্ষ করছে।চোখে মুখে চিন্তার ছাপ তার অথচ যে আহত হয়েছে তার মুখে কোন প্রতিক্রিয়াই নেই!স্বাভাবিক ভাবে সে বা হাতের ক্ষতের দিকে তাকিয়ে।মাঝে মাঝে ব্যথায় চোখমুখ কুঁচকে ফেললেও ভয়ের ছাপ নেই মুখে!
রিক্তের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া দেখে ত্রয়ী ভ্রু কুঁচকে ফেলে।ত্রয়ী বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিল যখন রিক্তের হাতে গুলি লাগে।যখন সে দিশেহারা তখন অচেনা এক যুবক সাহায্য করে তাদের।গাড়িতে করে প্রাইভেট হাসপাতালটাতে নিয়ে আসে।ত্রয়ী সুপ্তকে ফোন করেছে আধঘন্টার মতো হলো।সে এখানেই আসছে।ত্রয়ী কেবিন থেকে বেরিয়ে যুবকটির সন্ধানে এদিক ওদিক তাকায়।কিছুটা দূরেই তাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ত্রয়ী ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে যায়।

-অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে!আপনি অপরিচিত হয়েও আমাদের সাহায্য করেছেন।

আরসালান মৃদু হেসে ত্রয়ীর দিকে ফিরে তাকায়।ত্রয়ী এবার ভালো করে তাকে লক্ষ্য করে।ভ্রু এর উপর অবধি পরে থাকা অবিন্যস্ত চুল,অস্বচ্ছ চোখ।যাকে খাঁটি বাংলায় বললে বলা হয় বিড়াল চোখ!ত্রয়ীর কেন জানি এমন চোখের মানুষদের দুষ্ট প্রকৃতির বলে মনে হয়।তবে আজকে ত্রয়ীর ভুল ভেঙেছে!কারো বাহ্যিক রুপ দিয়ে কাউকে বিচার করা উচিত নয়।

আরসালান ত্রয়ীর মুখশ্রী জুড়ে দৃষ্টি বোলাতে বোলাতে বলে,

-মানুষ মানুষের জন্য।ধন্যবাদ দেওয়ার প্রয়োজন নেই,মিস!

এ কি বাক্য উচ্চারণ করলো আরসালান!ওর সঙ্গী-সাথী আই মিন চ্যালা পেলারা এই মহান বাক্য শ্রবন করলে বড় বড় দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাদের নিষ্ঠুর মালিককে ঠিক কতক্ষণ যাবত ধরে দেখতো ভাবতেই মনে মনে হাসে আরসালান।
ত্রয়ী আরসালানের মুখে মিস সম্মোধন শুনে একটা ক্ষুদ্র শ্বাস ফেলে বলে,

-সরি বাট আমি মিস নই মিসেস!মিসেস সুপ্ত রেহনেওয়াজ!আপনি ওনার নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই?উনি একজন এডভোকেট!

ত্রয়ী বেশ উৎসুক হয়ে এই প্রথমবার নিজেকে সুপ্তের স্ত্রী বলে পরিচয় দিল।নিশ্চয়ই লোকটি সুপ্তকে চিনে!
আরসালান একমুহূর্তের জন্য ভুলে গিয়েছিল ত্রয়ী সুপ্তের স্ত্রী।আর তাকেই মারার জন্য সে লোক নিয়ে এসেছিল।কিন্তু হলোটা কি?
শিকার জ্যন্ত!আর শিকারি স্বয়ং মরে পরে আছে।

আরসালানের ভাবনার মাঝেই ত্রয়ী বলে উঠে,

-আপনি এবার আসতে পারেন।আমার স্বামী চলে এসেছে।উপকার করার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ!

ত্রয়ী কথা শেষ করে ঘাড় সামান্য কাত করে আরসালানের পেছনে ব্যস্ত ভঙ্গিতে হেঁটে আসা যুবককে দেখে।কফি কালার শার্ট ইন করে পরা,কালো প্যান্ট পরিহিত যুবক কাছাকাছি আসতেই ত্রয়ীর হৃদয়ের সমস্ত ভয় কর্পূরের ন্যায় অদৃশ্য হয়ে যায়।সুপ্ত হেঁটে আসতে আসতে ত্রয়ীর সামনে একজন পুরুষকে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখে ভ্রু কুঁচকায়।তবে কাছাকাছি এসে যখন আরসালানের মুখ দেখে তখন তার দৃষ্টি অবিশ্বাসে পরিনত হয়।আরসালান জেল থেকে বেরিয়েছে!

ত্রয়ীর অগোচরে দু’জনের মাঝে এক ভয়ানক দৃষ্টি বিনিময় হয়।সুপ্ত ত্রয়ীর পাশে এসে দাঁড়াতেই আরসালান প্রস্থান করে সেখান থেকে।এবার সুপ্তের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির শিকার হয় ত্রয়ী।সুপ্ত ত্রয়ীর বাহুতে চেপে ধরে গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

-তুমি ওর সাথে এখানে দাড়িয়ে কি করছো?

সুপ্তের এমন আচরণ ত্রয়ীর জন্য কাঙ্ক্ষিত ছিল না।সে নিজের বাহুতে সুপ্তের বলিষ্ঠে হস্তের চাপ অনুভব করে সেদিকে একপলক তাকায়।তারপরও সুপ্তের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

-আপনি এমন ব্যবহার করছেন কেন?ব্যথা পাচ্ছি আমি হাত ছাড়ুন!

সুপ্ত ফট করে ত্রয়ীর হাত ছেড়ে দেয়।ত্রয়ী বাহুতে হাত বুলাতে বুলাতে বলে,

-এই লোকটায় তো আমাদের এখানে নিয়ে এসেছে।নয়ত সকলে তো সার্কাসের মতো দেখে এড়িয়ে গিয়েছে।ভাগ্যিস উনি ভালো লোক!

ত্রয়ীর কথা শুনে সুপ্ত ভ্রু উচিয়ে তাকায়।তারপর তাচ্ছিল্য হেসে বলে উঠে,

-একজন রেপিস্টকে ভালো লোক বলে সম্মোধন করো আর নিজের নিষ্পাপ স্বামীকে কতকিছু বলে দোষারোপ কর!দুটোয় না জেনে-বুঝে,শুধুমাত্র চোখের দেখায়!

কথাখনা বলে সুপ্ত রিক্তকে সেই কেবিনে রাখা হয়েছে সেখানে ঢুকে পরে।সুপ্তের কথা বুঝতে ত্রয়ীর দশ সেকেন্ডের মতো সময় লাগে।তারপর বোধগম্য হতেই অবাক হয়ে উচ্চারণ করে,

– রেপিস্ট!
.
-তুই ঠিক আছিস রিক্ত?

রিক্ত হঠাৎ সুপ্তের গলার স্বর পেয়ে সামনে তাকায়।এতক্ষণে ওর হাত থেকে গুলি বের করে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে।সে সুপ্তকে দেখে মাথা নাড়িয়ে বলে,

-হ্যা ঠিক আছি।

সুপ্ত একটা প্রশান্তির শ্বাস নিয়ে বাইরে তাকায়।ত্রয়ী এখনো বরফের ন্যায় জমে দাড়িয়ে আছে।হঠাৎ পাশ ফিরে কেবিনে ঢুকে সে।তাতেই চোখাচোখি হয় দুজনের।রিক্তকে সাথে নিয়ে ওরা হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে পরে।সুপ্ত ড্রাইভিং সিটে আর রিক্ত ফন্ট সিটে বসলে ত্রয়ী পেছনে এসে বসে।ত্রয়ী এখনো কেমন স্থির হয়ে আছে।সুপ্তের মুখ থেকে শোনা ধ্রুব সত্যটা যেন তার হজম হচ্ছে না।

রিক্তকে ওর বাড়িতে পৌছে দিয়ে তারপর বাড়িতে এসেছে সুপ্ত ও ত্রয়ী।ত্রয়ী কিছু না বলেই গাড়ি থেকে নেমে আগে ভাগে রুমে ঢুকে শাওয়ার নিতে ওয়াশরুমে ঢুকে পরে।ঠিক যখন ত্রয়ী গোসল শেষে মাথায় তাওয়াল পেছিয়ে বের হয় তখন সুপ্ত রুমে প্রবেশ করে।ত্রয়ী দরজার দিকে তাকালে চোখাচোখি হয় দুজনের।ত্রয়ী দৃষ্টি নামিয়ে বেলকনিতে এসে উপস্থিত হয়।সুপ্ত সেদিক পানে একবার চেয়ে টিশার্ট আর প্যান্ট নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পরে।

ত্রয়ী চুল থেকে তাওয়াল খুলতেই কোমড় সমান দীঘল চুল পিঠময় ছড়িয়ে যায়।আকাশপানে আনমনে তাকায় ত্রয়ী।মনুষ্য কত বৈচিত্র্যময়!তাদের বাহ্যিক আচার-আচরণের দ্বারা কিভাবে ভেতরে অমানুষটাকে লুকিয়ে রাখে।কেউ ঘুনাক্ষরেও টের পাই না কত জঘন্য সে!

ত্রয়ী তাওয়ালটা বেলকনিতে নেড়ে দিয়ে এসে দেখে সুপ্ত ফ্রেশ হয়ে এসে পরেছে।ত্রয়ী আরশির সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বিছানায় হেলান দিয়ে বসা সুপ্তের পানে চায়।ত্রয়ীর চেহারার যে বারোটা বেজে আছে সেটা কি লোকটা দেখছে না?
ত্রয়ী দ্বিধাদন্ডে ভুগে মিনমিন করে জিজ্ঞেস করে,

-লোকটা কি আসলেই রেপিস্ট?

সুপ্ত মোবাইল থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এবার ত্রয়ীর পানে তাকায়।বলে,

-মস্তিষ্কে চাপ দিন মিসেস।আপনার রুমমেডের আসামির চেহারা একবার স্মরণ করুন।এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলেন?কই আমি তো ভুলিনি সেদিন আপনি মুগ্ধ হয়ে আমার ওকালতি দেখছিলেন!

ত্রয়ী কিছুটা অতীতে গিয়ে কাঠ গোড়ায় দাঁড়ানো ব্যাক্তিটির চেহারা মনে করার চেষ্টা করে।সেদিন ঘৃণায় কেবল একবার দৃষ্টি দিয়েছিল সে লোকটার উপর।তাই আরসালানকে দ্বিতীয়বার দেখে মস্তিষ্ক চট করে ধরে ফেলতে পারেনি যে আরসালানই সেই রেপিস্ট।সবকিছু মনে পড়তেই ত্রয়ীর হৃদয় আরেকবার ঘৃনায় বিছিয়ে উঠে।মনে পরে যায় রুমমেটের ক্রন্দনের ধ্বনি।মেয়েদের সবচেয়ে বড় অহংকার সতিত্ব হারানোর লজ্জা ও কষ্ট।ত্রয়ী চোখ বন্ধ করে নেয়।ঘৃণায় রাগে দূঃখে একফোঁটা উষ্ণ অশ্রু বেয়ে পরে কপোল বেয়ে।
কিছুক্ষণ পরে সুপ্তের বলা সম্পূর্ণ কথাখান মনে পরতেই সে তড়িৎ ঘুরে সরাসরি সুপ্তের পানে চায়।বিস্ময় নিয়ে বলে উঠে,

-আপনি কি করে জানেন আমি সেদিন আপনাকেই দেখছিলাম?

কথাটা বলেই ভ্রু নাচায় ত্রয়ী।সুপ্ত রহস্যময় হাসে।ত্রয়ীর ভেজা কেশ এখনো শুকায়নি।ক্ষনে ক্ষনে ফোঁটা ফোঁটা জল পরছে চুল থেকে।স্নানের পর ত্রয়ীর সুশ্রী মুখশ্রী হয়ে উঠেছে আরো স্নিগ্ধ।পাথরের নাকফুল খানা জ্বল জ্বল করছে।ত্রয়ীর চোখে মুখে অজানা কিছু জানার কৌতুহল।সুপ্ত চট করে উঠে দাড়িয়ে ত্রয়ীর নিকট আসে।ত্রয়ীকে মনভরে দেখে নিয়ে এলোমেলো ভাবে থাকা চুল কানের পিঠে গুঁজে দিতে দিতে বলে,

-কিছু রহস্য রহস্যই রাখতে হয় বউ।সব জেনে গেলে কৌতুহল থাকে না।

বিশাল আরশিতে তাদের প্রেমময় মুহুর্ত স্পষ্ট ফুটে উঠে।জড়বস্তু দর্পনের যদি সক্ষমতা থাকতো তবে এই যুগলের প্রেমময় এই মুহুর্ত সে সমগ্র জীবনের জন্য নিজের মধ্যে বন্দি করে রাখতো।একজোড়া কৌতুহলী দৃষ্টি আর আর একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকা একজোড়া মুগ্ধ চোখ!

চলবে..

#হৃদস্পর্শে_প্রেমসায়রে
#রক্তিমা(লেখনীতে)
১৬.
তন্দ্রা তার রুমের বেলকনিতে বসে হাসফাস করছে।যখন থেকে শুনেছে সুপ্ত ভাইয়ের বন্ধু রিক্তর হাতে গুলি লেগেছে তখন থেকে অজানা কারনে তার মন আনচান করছে।তন্দ্রা একবার নিজেকে প্রশ্ন করে,কারণটা কি সত্যিই অজানা?নাকি সে অজ্ঞাত আচরণ করছে বলেই এত পীড়া?
তন্দ্রা বেলকনিতে বসে ছিল।কোলের উপর ছিল তার মোবাইলটা।তন্দ্রা মোবাইলের লক খুলে একবার হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকলো।তারপর রিক্ত দিয়ে সেভ করা নাম্বারের সাথে কনভার্সনে ঢুকে মেসেজ টাইপ করতে লাগলো।লেখা সম্পূর্ণ না হতেই তা আবার মুছে ফেললো সে।বিকাল থেকে সে এমনটা প্রায় বিশ বারের মতো করে ফেলেছে।তন্দ্রা আবার রিক্তের দেওয়া শেষ মেসেজটা পড়লো।শেষ মেসেজে রিক্তের লেখা ‘ভালো করে পড়াশোনা করো’লেখাটা জ্বলজ্বল করছে।আর তাতে তন্দ্রার দীর্ঘশ্বাসের ইমোজি দেওয়া।এটা প্রায় একবছর আগের মেসেজ।এরপর আর তাদের কথা হয়নি।এ বাড়িতে আসলে কুশল বিনিময় হয়েছে বটে!পুরো বিকেলটা তন্দ্রার অবসন্ন মনেই কেটে গেল।
রাতে খাওয়ার সময় ডাইনিং এ সকলে উপস্থিত থাকলেও সুপ্ত ছিল না।মিসেস সুহৃদ রিক্তকে বড্ড স্নেহ করেন।সুপ্তকে অনুপস্থিত খেয়াল করে উনার রিক্তের কথা মনে আসে।যেহেতু ঘটনাস্থলে ত্রয়ী উপস্থিত ছিল তাই তিনি ত্রয়ীকে জিজ্ঞেস করেন,

-রিক্তের অবস্থা এখন কেমন বউমা?

মামীর মুখে বউমা উচ্চারণ শুনে বেলার খাওয়ার গতি কমে আসে।আড়চোখে সে ত্রয়ীর দিকে তাকায়।শাড়ি পরিহিতা রমনীটি যে সত্যিই নতুন বউদের ন্যায় শোভা বিকশিত করে তা মানতে তার ঈর্ষান্বিত মন বিছিয়ে উঠে।বেলার মনে হয় ত্রয়ীর কারণেই সুপ্ত চজ তার হলো না।এমনকি ত্রয়ীর জন্য তাকে সবার সামনে অপমানিতও হতে হয়েছে।ত্রয়ী কি বলে শোনার জন্য সে কান খাঁড়া করে খাবার খেতে থাকে।

-ভাগ্যিস গুলি তেমন গভীরভাবে বিদ্ধ হয়নি!আশা করছি সপ্তাহখানেকের মাঝে উনি সুস্থ হয়ে উটবেন।ইনশাআল্লাহ!

ত্রয়ীর কথায় মিসেস সুহৃদ চিন্তামুক্ত হলেও ত্রয়ীর পরে বলা কথা শুনে দুশ্চিন্তার রেখা ফুটে উঠে কপালে।

-একটু এদিক সেদিক হলেই উনার প্রাণ চলে যেতে পারতো!

তন্দ্রার গলায় খাবার আটকে যাবার জোগাড় হয়।সে দ্রুত পানি পান করে।চিন্তায় করুন হয়ে আসে চেহারা।নিশ্চয়ই রিক্তের অনেক কষ্ট হচ্ছে!

-তুমি এটা কেন বুঝতে পারছো না যে তুমিই এসবের মুল কারণ?

বেলার কটাক্ষ করে বলা কথাটির সঠিক অর্থ বুঝতে না ওেরে ত্রয়ী ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,

-মানে?কি বলতে চাইছো তুমি?স্পষ্ট করে বলো?

-এখানে স্পষ্ট করে বলার কি আছে?তোমার আর সুপ্তের বিয়ে হওয়ার পর থেকেই একের পর একটা ক্যাচাল লেগেই আছে।রিসিপশনের দিনও তোমার উপর হামলা হলো।আর আজকে,আজকে তো রিক্ত ভাই মরতে মরতে বেঁচে গেছে!তোমার ভাষ্যমতে!আমার তো মনে হচ্ছে গুলিটা তোমার উপর ছোঁড়া হয়েছিল।এর পরেও তুমি যদি না বোঝার ভান করো তবে আর কি বলবো?

বেলার কথায় ত্রয়ী আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রয়।ত্রয়ীর এমন অবস্থা চেহারা দেখে মনে মনে পৈশাচিক হাসে বেলা।তার হতে চলা জিনিস কেঁড়ে নেওয়া!তোমায় হারে হারে টের পাওয়াবো আমি কি জিনিস!
ত্রয়ী উত্তরে কি বলবে বুঝতে পারে না। বেলার কথায় সকলে বিরক্ত হলেও কেউ কিছু বললো না।সকলে চুপচাপ খাওয়া শেষ করে উঠে গেল।সবার শেষে ত্রয়ী ডাইনিং টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।যদিও তার পাতে এখনো অর্ধেক খাবারই পরে আছে।
ত্রয়ী তাদের রুমের কাছাকাছি আসতেই তন্দ্রাকে দরজার সামনে পায়চারি করতে দেখে।ত্রয়ী হাঁটার গতি কমিয়ে ধীরে ধীরে রুমের কাছে আসে।কিন্তু তন্দ্রা পায়চারি করতে ততটায় বিভোর ছিল যে তাকে দেখতেই পাইনি!
ত্রয়ী তন্দ্রাকে পরখ করে বলে উঠে,

-কি ব্যাপার তন্দ্রা?তুমি রুমের সামনে দাড়িয়ে এভাবে পায়চারি করছো কেন?চলো রুমে চলো!

তন্দ্রা ত্রয়ীকে দেখে একটা গোপন শ্বাস ফেলে তারপর বলে উঠে,

-তুমি এখন আসছো!আমি কতক্ষণ ধরে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি ভাবি।

ত্রয়ী ভ্রু কুঁচকে স্বল্প হেসে শুধায়,

-কেন?

তন্দ্রা কারনটা বলতে গিয়ে আঁটকে যায়।তারপর ঠোঁট কামড়ে কোন রকমে বলে,

-রিক্ত ভাই এখন কেমন আছে একটু খোঁজ নিয়ে দেখবে?আমার ওর জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে!

ত্রয়ী তন্দ্রার চোখের দৃষ্টি,আকুলতা পরখ করে মিটমিটিয়ে হেসে বলে,

-এতই যখন চিন্তা হচ্ছে গিয়ে দেখে আসো?আর তোমার কেন এত চিন্তা হচ্ছে শুনি?উনি তো তোমার কেউ হয় না!পরের জন্য এত আকুলতা,এত চিন্তা!

ত্রয়ীর কথা শুনে প্রথমে তন্দ্রা দুঃখবোধ করলেও পরে আচমকা ত্রয়ীর হাত ধরে অনুরোধের সাথে বলে,

-তুমি আমার সাথে এখন রিক্তদের বাড়িতে যেতে পারবে?
.
সর্বোচ্চ গতিতে গাড়ি চললেও যেন তন্দ্রার মনে হলো যদি আরেকটু জোরে যাওয়া যেতো!ত্রয়ী চুপচাপ বসে তন্দ্রার অস্থিরতা দেখছে।তন্দ্রা নিঃসন্দেহে ত্রয়ীর থেকে সুন্দর।ফর্সা ত্বক,রেশমি চুল।কিন্তু তার বেকার একটা ছেলের জন্য এত ব্যাকুলতা দেখে মুগ্ধ হয় ত্রয়ী।পরক্ষণেই তন্দ্রার সাথে মজা নেওয়ার জন্য বলে উঠে,

-আরেকবার ভালো করে ভেবে নাও তন্দ্রা,ছেলে কিন্তু বেকার!

তন্দ্রা নিষ্পাপ চোখে ওর দিকে তাকায়।দেখে ত্রয়ী মিটমিটিয়ে হাসছে।তন্দ্রা হঠাৎ ক্ষেপে যায়।বলে উঠে,

-তুমি আমার সাথে মজা নিচ্ছো ভাবী!

ত্রয়ী কিছু না বলে রিনরিনিয়ে হেসে উঠে।হাসতে হাসতেই তার খেয়াল হয় একেকজন মানুষের কাছে সে একেক রকম পার্সোনালিটির!বড়ই বিচিত্র!
সারাপথ কিছু মনে না হলেও এতরাতে ভাইয়ের বন্ধুর খোঁজ নিতে আসার কাজটা তন্দ্রার নিকট অদ্ভুত মনে হলো।তবে ত্রয়ীর চোখমুখ স্বাভাবিক।তন্দ্রা তাই দেখে প্রশ্ন করে,

-এতরাতে এভাবে চলে আসলাম আমার কেমন অদ্ভুত লাগছে!তোমার কিছু মনে হচ্ছে না।

-না।কারণ তুমি আমায় নিয়ে এসেছো!আমি তো নিজে থেকে আসতে চাইনি!

ত্রয়ীর সোজাসাপ্টা জবাব শুনে তন্দ্রা দ্বিধাভরা মুখশ্রীতে কলিংবেল বাজায়।দরজাটা রিক্তই খুলে দেয়।এতরাতে এখানে ত্রয়ী আর তন্দ্রাকে দেখে যে সে অবাক হয়েছে তা তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।তন্দ্রাকে একবার গাঢ় চোখে দেখে ওের ভেতরে আসতে বলে রিক্ত।তন্দ্রা ধীরে ধীরে ভেতরে প্রবেশ করে সোফায় বসে।রিক্ত অবাক চোখে তন্দ্রাকে দেখে চলছে।ত্রয়ী বেশ স্বাভাবিক!

-ভাই আপনারা এতরাতে ভাবি?কিছু সমস্যা হয়েছে?

রিক্ত প্রশ্ন করার পরপরই ত্রয়ীর বাহুতে খামচে ধরে তন্দ্রা।ত্রয়ী মনে মনে হেসে স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দেয়,

-আসলে আপনি এখন কেমন আছেন তাই দেখতে আসলাম!তন্দ্রা খুব চিন্তা করছিল!

ত্রয়ীর মুখে এমন কথা শুনে তন্দ্রার মরি মরি অবস্থা!ইস!ভাবী কেন আগ বাড়িয়ে এটা বলতে গেল!রিক্ত কি ভাবলো?ওর জন্য তন্দ্রার খুব কষ্ট হচ্ছে!সত্যিই তো হচ্ছে!
তন্দ্রা আড়চোখে উজ্জ্বল শ্যামলা বরণের যুবকটির পানে চায়।ব্যাটা কেমন অদ্ভুত চোখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।ত্রয়ী আশেপাশে তাকিয়ে দেখতে থাকে।হয়ত বাড়ির সকলে ঘুমোতে গেছে!
তন্দ্রা হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়।বলে,

-আমরা এবার আসি।তুমি ভালো থেকো।ঠিক মতো ঔষধ খেয়ো!

তন্দ্রা উঠে বাহিরে বেরিয়ে এসে জোরে জোরে শ্বাস নেয়।যেন কেউ তার শ্বাসরোধ করে রেখেছিল!দ্রুত গাড়িতে বসে সে।ত্রয়ী আসলে গাড়ি ছেড়ে দেয় ড্রাইভার।রিক্ত অবাক চোখে ওদের আসা যাওয়া লক্ষ করে।
.
প্রচন্ড ড্রাংক হয়ে ড্রাইভ করছে আরসালান।অতিরিক্ত অ্যালকোহল গ্রহনের ফলে এখন চোখে অস্পষ্ট দেখতে সে।হঠাৎ সামনে কেউ এসে পড়লে দ্রুত ব্রেক কষে আরসালান।তারপর বেশ কয়েকটা গালি দিয়ে গাড়ি থেকে বের হয়ে আসে সে।তার পেছনে থাকা গার্ড ভর্তি গাড়িটাও থামে তাতে।আরসালান গাড়ির সামনে আসতেই দেখে একটা মেয়ে গাড়ির পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।আরসালান ঝাপসা দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়।খয়েরী রঙের জামা পরিহিত মেয়েটির হাতে অনেকগুলো শপিং ব্যাপ।বাবার সাথে ফোনে কথা বলতে বলতে আসায় আরসালানের গাড়ি লক্ষ্য করেনি সে।আগন্তুক মেয়েটি বিনয়ের সাথে আরসালানকে সরি বলে।কিন্তু তাতে খেয়াল নেই মাতাল আরসালানের।তার অবচেতন মন এই মুহুর্তে মেয়েটির মাঝে ত্রয়ীকে দেখছে!ঝাপসা দৃষ্টিতে মেয়েটিকে দেখার পর তার মনে হচ্ছে এটাই ত্রয়ী।সুপ্তের স্ত্রী!মুহুর্তেই পৈশাচিক হাসি ফুটে আরসালানের মুখে।খপ করে চেপে ধরে মেয়েটির হাত।আচমকা এমন হওয়ায় মেয়েটি দিশা হারিয়ে চারপাশে তাকায়।কিন্তু হায়!কেউ নেই যে তাকে সাহায্য করবে!সকলে একবার এদিকে তাকিয়ে যার যার মতো চলে যাচ্ছে!

আরসালানের শক্তির কাছে পেরে উঠে না মেয়েটি।অগত্যা তাকে আরসালান জোর করে গাড়িতে নিয়ে বসায়।তারপর সজোরে গাড়ি ছুড়িয়ে তাদের পুরোনো একটা বাংলোয় নিয়ে আসে।
ফোন বের করে কল লাগায় সুপ্তের নাম্বারে।
সুপ্ত সবে বাড়িতে এসে পৌঁছেছিল।আননোন নাম্বারের কল দেখেও সে রিসিভ করে কেননা কোন ক্লাইন্ডের কল হতে পারে।কল রিসিভ করতে করতে রুমে প্রবেশ করে সে।ওপর পাশ থেকে পুরুষালি অট্টহাসির শব্দ পেয়ে ভ্রু কুঁচকায় সুপ্ত।ভেসে আসে,

-শুনতে পাচ্ছিস তোর বউয়ের আকুতি ভরা কন্ঠ!

আরসালানের কন্ঠ চিনতে পেরে সুপ্তের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে।কিছু বলতে যবে তার আগেই কর্ণগোচর হয় মেয়েলি কান্নার আওয়াজে থমকে যায় সে।সুপ্ত পুরো রুমে ত্রয়ীকে খুঁজে না পেয়ে সত্যিই ভেবে নেয় ত্রয়ী আরসালানের কাছে।সুপ্ত বেশ রাগী কন্ঠে বলে উঠে,

-লিভ হার রাইট নাও আরসালান!

আরসালানে উত্তর কুৎসিতভাবে হেসে উঠে।মেয়েটি যাকে নেশায় মত্ত আরসালানের ত্রয়ী বলে মনে হচ্ছে সে এখন আরসালানের হাতের মুঠোয় বন্দি।আরসালান তার দিকে তাকিয়ে ফোনের ওপাশে থাকা সুপ্তকে বলে উঠে,

-নাও সি ইস মাইন!তুই যা করতে পারিস কর।এত সুন্দর বউ শুধু তুই একাই ভো*গ করবি!

চলবে…
ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো।