#হৃদস্পর্শে_প্রেমসায়রে
#রক্তিমা(লেখনীতে)
২১.
-অবজেকশন অভাররোল!
জজের মুখ থেকে নিসৃত উপরোক্ত দুটি শব্দ কর্ণকুহরে পৌঁছানোর পরপরই দু আঙুলের সাহায্যে কপাল চেপে ধরে সুপ্ত।ঘুরে একবার আড়চোখে তাকায় ত্রয়ীর পানে।গোল গোল চোখ করে পরিস্থিতি বোঝার অপেক্ষায় সেই রমনী।সুপ্ত গোপনে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে জজের দেওয়া সুনানির শোনার হেতু তার দিকে তাকায়।কেয়া যে সুপ্তের পানে অনুভূতি শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তা দেখে শুকনো ঢোক গিলে সুপ্ত।
-দন্ডবিধি ২১১ ধারা অনুসারে মিস কেয়া সুলায়মান মিথ্যা অভিযোগ নিয়ে মামলা করায় এবং তা তদন্তে মিথ্যা প্রমানিত হওয়ায় আদালত তাকে দুই বছরের কারাদন্ডে দন্ডিত করছে।আর অভিযুক্ত আরসালান চৌধুরীকে নির্দোষ প্রমানিত করে সসম্মানে মুক্তি প্রদান করছে।দ্যা কেস ইস ক্লোসড!
জজ সাহেবের কথা শেষ হতেই সুপ্ত অনুভব করে প্রথম বারের মত সে কোন কেস হারলো।এত দিনে অর্জন করা বিজেতার খেতাপ আজ ভেঙে গেল একমুহুর্তে!হাত মুঠো করে চোখ বন্ধ করে সুপ্ত।মনে হলে কিছু একটা বড়সড় ভার আটকে কেন বক্ষে।মিস্টার আহমদের কথার তার দিকে ফিরে তাকায় সুপ্ত।
-জেতার জন্য অভিনন্দন জানাবেন না মিস্টার সুপ্ত রেহনেওয়াজ?
-অন্যায় কারীদের সুপ্ত রেহনেওয়াজ না কখনো অভিনন্দন জানিয়েছে আর না কখনো জানাবে।
সুপ্তের শক্তপোক্ত বাক্য শুনে ভ্রু উচিয়ে হাসে মিস্টার আহমেদ।যা শুকনো পাতায় দেশলাইয়ের ছোঁয়ার ন্যায় অগ্নিস্পর্শ মনে হয় সুপ্তের নিকট।মিস্টার আহমেদ আফসোস করে বলে,
-হারার জ্বালা বুঝি মিস্টার সুপ্ত।বেটার লাক নেক্সট টাইম।
-ভয় পান মিস্টার আহমেদ।আজকে আপনাদের অন্যায় ধরা না পরলেও কিংবা কোনদিন মনুষ্যজাতির নিকট ধরা না পরলেও একজনের নিকট একদিন এর জবাব দিতে হবে।তার জন্য ভয় পান মিস্টার আহমেদ।
কথাটুকু শেষ করে সুপ্ত ঘুরে দাঁড়াতেই আরসালানকে মুখোমুখি অবস্থায় পায়।আরসালান লম্বায় প্রায় সুপ্তের সমান হওয়ায় চোখেতে চোখ পরে দু’জনের।সুপ্তের দৃষ্টি কঠোর থেকে কঠোর হয়ে উঠে।আরসালান ঘাড় ঘুরিয়ে ত্রয়ীর পানে তাকায়।ততক্ষণে আদালত হতে সকলে প্রস্থান করেছে।আরসালান ত্রয়ীর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সুপ্তের পানল তাকিয়ে বলে,
-বউ সুরক্ষিত আছে দেখে কোথায় হাফ সেঁড়ে বাঁচবি,তা না!কেস লড়তেও চলে এসেছিস!একবার ভাব মেয়েটার জায়গায় সত্যি সত্যি তোর বউ থাকলে এমন হতো?জাস্ট ইমাজিন!
সুপ্ত আচমকা আরসালানের কলার চেপে ধরে।অগ্নিদৃষ্টি রাখে আরসালানের ধূসর আঁখিতে।ঝাঝালো কন্ঠে বলে উঠে,
-ফর্মাল ড্রেসআপ,কথাবার্তার কারণে যদি তোর মনে হয় আমি খুবই নাজুক তবে তোর মনটাকে খুলে ডাস্টবিনে ফেলে দিস।
সুপ্ত একবার ত্রয়ীর দিকে চায় তারপর বলে,
-গোলাপ নমনীয় হলেও তার আশেপাশে তীক্ষ্ণ,সূচালো কাঁটার বিস্তার থাকে আরসালান।তার সেই কাটা হলাম আমি।মাইন্ড ইট!
আরসালানের কলার ছেড়ে দিয়ে সুপ্ত ত্রয়ীর নিকট আসে।তারপর ত্রয়ীর হাত তার শক্ত মুঠোয় বন্দি করে নিয়ে বেরিয়ে আসে আদালত থেকে।
-ডক্টর কিরন,আদালতে কেন আপনি মিথ্যা বয়ান দিলেন?আপনার একটা কথা মেয়েটাকে ন্যায় পাইয়ে দিত!
সুপ্তের শক্ত কন্ঠে বলা রাগ মিশ্রিত বাক্য শুনে থামে ডক্টর কিরন।তারপর করুন চোখে তাকায় সুপ্তের পানে।সুপ্তের সাথে থাকা ত্রয়ীর যেন মুখে তালা লেগে গেছে।দুচোখ মেলে দেখা ছাড়া যেন এই মুহুর্তে সব বিষয়ে সে অক্ষম!সে সুপ্তের পানে তাকিয়ে আরেকবার ডক্টর কিরনের পানে তাকায়।ডক্টর কিরনের মুখে অপরাধ ছেঁয়ে!সুপ্তের উদ্দেশ্য কিছু বলবে তখনি সুপ্তের পেছনে তাকিয়ে তার দৃষ্টি সতর্ক হয়ে আসে।চোখ মুখ গম্ভীর হয়ে আসে নিমিষেই।সুপ্ত সবটায় খেয়াল করে সুক্ষ্মভাবে।ডক্টর কিরন মুখে গাম্ভীর্য ফুটিয়ে বলে উঠেন,
-মিথ্যা।যা সত্য আমি তাই বলেছি সুপ্ত।নাও আই ডোন্ট টক টু ইউ এবাউট ইট।
কথাখান বলে ডক্টর কিরন দ্রুত হেঁটে গাড়ির নিকট আসেন।তারপর চট জলদি সে চলে যায় সেখান থেকে।উনার আচরণ সুপ্তকে বেশ ভাবিয়ে তুলে।হঠাৎ চট করে পেছনে তাকায় সুপ্ত।
দৃষ্টিগোচর হয় ফর্মাল ড্রেসাপে থাকা নিঝুমকে।নিঝুমের মুখে দুঃশ্চিতার ছাপ।সুপ্তের নিকটে এসে সে দূঃখ প্রকাশ করে বলে উঠে,
-আপনি মেয়েটিকে ন্যায় বিচার দিতে পারলেন না স্যার।ভেরি ডিসঅ্যাপয়েন্টিং স্যার!
নিঝুমের কথার মাঝে যেন খোঁচা লেপ্টে।সুপ্ত অবাক হয়।মানুষের আচরণ বদলাতে সময় লাগে না।সুপ্ত গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠে,
-আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে।অফিসে থাকবেন।আমি ওকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসছি।
ত্রয়ী নিয়ে সুপ্ত বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়।অন্যদিনের তুলনায় আজকে গাড়ি বেশ জোরে চালাচ্ছে সুপ্ত।ত্রয়ী সুপ্তের পানে চেয়ে সতর্ক কন্ঠে বলে উঠে,
-গাড়ি আস্তে চালান সুপ্ত।
সুপ্ত আরো কিছুদূর যাওয়ার পর গাড়ির বেগ সামান্য কমায়।সুপ্তের পানেই দৃষ্টি রেখে ত্রয়ী মিহি কন্ঠে বলে উঠে,
-আপনার কি মনে হয় ওরা সকলে মিলে রিপোর্ট গায়েব হওয়ার পিছনে কার হাত আছে?আপনার এসিস্ট্যান্টের হাত নেই তো আবার?মেয়েটা কেমন..
-বাড়িতে এসে পরেছি।নামো।
সুপ্তের কথায় ত্রয়ী তাকিয়ে দেখে গেটের সামনে এসে গাড়ি থেমেছে।ত্রয়ী ধীরে সুষ্ঠে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়।সুপ্ত তখনো সামনে তাকিয়ে।কি এক জড়তা তাকে তার প্রাণেশ্বরীর পানেও তাকাতে দ্বিধান্তিত করছে।ত্রয়ী গাড়ি থেকে নেমে সুপ্তের দিকে তাকায়।ত্রয়ী মায়াময় কন্ঠে ডেকে উঠে,
-সুপ্ত!আমার দিকে তাকান না!
ত্রয়ীর কন্ঠের প্রেমময় আবদার ফেলার সাধ্য সুপ্তের নেই।বরং না মানলেই যেন ঘোর পাপ!সুপ্ত নিজের ভেতরের সমস্ত রাগত অনুভূতি সুপ্ত রাখার চেষ্টা করে ত্রয়ীর পানে তাকায়।তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ত্রয়ী বলে উঠে,
-রেগে গিয়ে কিছু সমাধান করা যায় না।আপনি ঠান্ডা মাথায় ভাবুন,প্রশ্নের উত্তর খুঁজুন।ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হবে।কেয়া মেয়েটিও তার ন্যায় পাবে।
সুপ্ত ত্রয়ীর দিকে অনিমেষ চেয়ে পলক ফেলে।বোঝায় ঠিক আছে।ত্রয়ী স্মিত হেসে বলে,
-আজকে তো মিনিকে আংটি পড়াতে আসবে।আপনি তাড়াতাড়ি আসবেন।পিংকু আপনাকে মিস করবে।
এতটুকু বলে থামে ত্রয়ী।তারপর সময় নিয়ে মিহি কন্ঠে বলে,
-আর আমিও।তাড়াতাড়ি আসবেন।আসি।
কথা শেষ করে কয়েক সেকেন্ড সুপ্তের পানে তাকিয়ে ত্রয়ী গেটের ভেতর প্রবেশ করে।ত্রয়ী চোখের সম্মুখ থেকে অদৃশ্য হয়ে যেতেি সুপ্তের চেহারা ফের শক্তপোক্ত হয়ে উঠে।গাড়ি ঘুড়িয়ে সে অফিসে এসে পৌঁছায়।
পৌছে নিঝুমের নাম্বারে ডায়াল করে বলে,
-আমার কেবিনে আসুন।
কথাটুকু বলে ফোন কেটে দেয় সুপ্ত।তার পাঁচ মিনিটের মাথায় নিঝুম এসে উপস্থিত হয়।সুপ্ত তখন বাইরে তাকিয়ে যানবাহনের ব্যস্ত চলাচল অবলোকন করছিল।নিঝুমের পায়ের শব্দ পেয়ে না ফিরেই সে প্রশ্ন করে,
-আসল রিপোর্টটা কি জন্য সরিয়েছেন?
নিঝুম চমকে উঠে।ভ্রু কুঁচকে বলে,
-এটা আপনি কি বলছেন স্যার?আমি কেন আসল রিপোর্ট সরাবো?
-ডোন্ট ট্রাই টু বি টু ক্লেভার।আই নো ইউ আর দ্যা মেইন কালপ্রিট।আরসালানের গোলামি কেন করছেন?
নিঝুম এমন করে সুপ্তের পানে তাকায় যেন তার নামে বড়সড় কোন মিথ্যা বলা হয়েছে।ক্ষনকাল ব্যয় হতেই অট্ট হেসে উঠে সে।সুপ্তের শিথিল ভ্রু জোড়া কুঁচকে আসে তাতে।
নিঝুম হাসি থামিয়ে বলে,
-মানতেই হবে আপনি বেশ চতুর।তবে কি লাভ!হারার ট্যাগ তো লেগে গেল না!
-আপনাকে আমি পুলিশে দেব।একটা মেয়েকে ন্যায় বিচার পাওয়ার পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছেন আপনি।আপনার জন্য সে বিনা দোষে শাস্তি পাওয়ার পথে।
সুপ্তের কথায় নিঝুমের ঠোঁটের কোণের বাঁকা হাসির রেশ ফুটে উঠে।ধীরে ধীরে সেটা বেড়ে আসে।নিঝুম সুপ্তের কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। তারপর ফিসফিসয়ে বলে উঠে,
-কাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায় সেটাই দেখার পালা স্যার!
নিঝুম কথাখান বলার পর দরজার কাছে আসে।সুপ্তের দিকে বাঁকা হেসে তাকিয়ে দরজা লক করে।সুপ্ত সতর্ক কন্ঠে বলে উঠে,
-হোয়াট আর ইউ ডুয়িং?
-সি হোয়াট আই ডু!
.
আরশিতে নিজেকে শেষবারের মতে পর্যবেক্ষণ করে উঠে দাড়ায় ত্রয়ী।অরেঞ্জ কালারের কাঞ্জিভরম শাড়ির আঁচলটা সুন্দর করে ছেড়ে দিয়েছে।দীঘল কেশ মুক্ত আজকে।কপালে ছোট কালো টিপ আর হাতে একগুচ্ছ সাদা চুড়ি পরে নেয়।তারপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখতেই দেখে সাতটা বেজে গেছে অলরেডি।দ্রুত চোখে কাজল লেপ্টে বেরিয়ে আসে রুম থেকে।
সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে মিনির হবু শশুর বাড়ি থেকে আসা লোকদের উওর দৃষ্টি বোলায় ত্রয়ী।আশ্চর্যজনক ভাবে সয়নকে সেখানে উপস্থিত না দেখে অবাক হলেও মনে মনে হাফ ছেড়ে বাঁচে ত্রয়ী।তন্দ্রার পাশে এসে দাঁড়াতেই এক পশলা প্রশংসা কুড়ায় সে।তন্দ্রা তাকে দেখে ভ্রু উচিয়ে বলে উঠে,
-মানতে হবে আমার ভাইয়ের চয়েজ একশো তে দুশো।এই রঙের শাড়িতে কি সুন্দর লাগছে তোমায় ভাবি।বাই দ্যা ওয়ে।তোমার উনি কখন আসবে?মিনি কিন্তু ভাইয়াকে ছাড়া আংটি পড়বে না।
ত্রয়ী কিছু বলবে তার আগেই মিনির মাঝেই বিস্ফোরিত কন্ঠ ভেসে আসে।তন্দ্রা ও ত্রয়ী দৌড়ে ওনার নিকটে আসে।মিনির মা টিভিতে খবর দেখছেন সেখানে বলা হচ্ছে,
-কেয়া নামের মেয়েটি যে নিজেকে আরসালান চৌধুরীর ধর্ষণের শিকার বলে দাবি করেছিল সে আত্নহত্যা করেছে।
ত্রয়ী সংবাদ শুনে বিস্ময়ে মুখে হাত দেয়।আকস্মিক এমন দুঃসংবাদ পেয়ে ত্রয়ীর পিলে চমকে উঠে।অনুশোচনা,অপরাধবোধ একসাথে গ্রাস করে ফেলে তাকে।কানে তখনো ভেসে আসছে,
-এডভোকেট সুপ্ত রেহনেওয়াজ তার কেসটা হেরে যাওয়ায় কি মেয়েটি আত্নহত্যা করতে বাধ্য হলো?
ত্রয়ী আর কিছু না শুনে ঘুরে দাঁড়ায়।যন্ত্রমানবীর ন্যায় হেঁটে কয়েক কদম সামনে এগুতেই কর্ণগোচর হয়,
-ব্রেকিং নিউজ!এই খবর পাওয়া গেছে এডভোকেট সুপ্ত রেহনেওয়াজ তার সহকর্মী নিঝুমকে ধর্ষণের চেষ্টা করায় আটক হয়েছেন!
চলবে..
#হৃদস্পর্শে_প্রেমসায়রে
#রক্তিমা(লেখনীতে)
২২.
-ব্যাক্তিত্ববান ল্যয়ার সুপ্ত রেহনেওয়াজকে ধর্ষণের চেষ্টা করায় গ্রেফতার করা হয়েছে।
পুলিশ স্টেশনের টিভি থেকে আওয়াজটা কানে ভেসে আসতেই হাত মুঠো করে চোখ বন্ধ করে নেয় সুপ্ত।জেলের ভেতর দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে সে।পরনের সাদা শার্ট ময়লা দেওয়ালে লেগে আছে।চোখ লাল হয়ে আছে রাগে।মুহুর্তেই কানে ভেসে আসে ইন্সপেক্টরের কটাক্ষপূর্ণ বাক্য,
-রেপ কেসে ওকালতি করা উকিল যখন নিজেই তার এসিস্ট্যান্টকে রেপ করার চেষ্টায় গ্রেফতার হয়!
কথাটুকু কর্ণকুহরে পৌছানোর পরই হাতের শক্ত মুঠো আলগা হয়ে আসে সুপ্তের।দীর্ঘশ্বাস ফেলে দেওয়ালে মাথা ঠেকায় সে।নেত্র দুটি বন্ধ করার কিছুসময় পরই কানে নুপুরের রিনরিন আওয়াজ এসে ঠেকে।চট করে চোখ মেলে তাকায় সুপ্ত।ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই কারাগারের লৌহ নির্মিত কপাট ধরে দাঁড়ানো রমনী স্পষ্ট হয়ে উঠে অক্ষিকোটরে।
কমলা রঙের শাড়ি পরিহিতা রমনী যে স্বয়ং তার সহধর্মিণী সেটা মস্তিষ্ক বুঝে উঠার পরেও সেভাবেই ঠাঁই বসে রয় সুপ্ত।একদৃষ্টে তাকিয়ে রয় কপাট ধরে তার দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা তার একান্ত ব্যাক্তিগত রমনীর পানে।
ত্রয়ী কারাগারের কপাট থেকে সরে এসে ইনস্পেক্টরের সামনে দাঁড়ায়।শক্ত কন্ঠে বলে উঠে,
-আমি উনার সাথে কথা বলতে চাই।আমাকে ভেতরে যেতে দিন।
ইনস্পেকটর ত্রয়ীর দিকে ভালো করে তাকায়।শাড়ি পরিহিতা রমনী,খোলা চুল,গম্ভীর মুখশ্রী দেখে প্রশ্ন করে উঠে,
-উকিল বাবু কি হয় তোমার?
ইনস্পেকটর রয়েসয়ে প্রশ্ন করলেও ত্রয়ীর মুখ থেকে বাতাসের গতিতে উত্তর বেরোয়।
-আমার স্বামী।আমাকে উনার সাথে কথা বলতে দিন।
-আপনার তো এখন মুখ লুকিয়ে ঘরে বসে থাকার কথা ছিল!
-কারাগারের দরজা খুলে দিন জলদি।
ডেস্কের উপর হালকা থাপ্পড় মেরে কথাটা বলে ত্রয়ী।ইনস্পেকটর ত্রয়ীর দিকে আরেকবার গাঢ় চোখে তাকিয়ে কনস্টেবলকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,
-এই কারার দরজাটা খুলে দে তো।
কনস্টেবল দরজা খুলে দিতেই হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢুকে পরে ত্রয়ী।হাতের চুড়ি,পায়ের নুপুরে ঈষৎ ছন্দ তৈরি হয় তাতে।সুপ্ত খানিক বিস্ময় নিয়ে তার দিকে তাকায়।ঠোঁটের কোনে বেদনা ভর্তি বাঁকা হাসি ফুটিয়ে ত্রয়ীর উদ্দেশ্যে বলে উঠে,
-এসো তুমিও এসো।দোষারোপ ভর্তি ঝাঁঝালো বাক্য শুনাতে এত তাড়া!জেলের মধ্যে চলে এসেছো।আমি এখন তোমার সামনে সে এনিথিং ইউ ওয়ান্ট।
ত্রয়ীর ঠোঁট ফুলে উঠে।শাড়ির আঁচলে খামচে ধরে সে শক্ত কন্ঠে বলে উঠে,
-আপনি উঠে আমার সামনে আসুন।
সুপ্ত তাচ্ছিল্য হেসে ত্রয়ীর সামনে দাঁড়ায়।সে জানে এখন তার কলার ত্রয়ীর মুঠোয় চলে যাবে।ত্রয়ী সুপ্তের চোখে চোখ রেখে বলে উঠে,
-আমি একদিন বলেছিলাম সুপ্ত।হয়ত আপনি শুনেননি!যেদিন আপনার শুদ্ধ হৃদয় আমার হৃদয়ের নিকট শুদ্ধ হয়ে উঠবে সেদিন থেকে যাই হয়ে যাক না কেন আপনার শুদ্ধতা,আপনার পবিত্রতা আমি চোখ বুঁজে স্বীকার করব!
আপনার চোখে আমি কোন অপরাধের ছাপ দেখছিনা সুপ্ত।আপনি শুদ্ধ,ঠিক এই শুভ্র শার্টের মত!
আকস্মিক সুপ্তকে আলিঙ্গন করে ত্রয়ী।ভেসে আসে তার ক্রন্দনের ধ্বনি।ত্রয়ীর কোমল হস্ত খানা খামচে ধরে সুপ্তের পিঠ।
আচমকা এমন হওয়ায় একপা পিছিয়ে আসে সুপ্ত।তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে আলতো করে হাত রাখে ত্রয়ীর পিঠে।দীঘল চুলের অভ্যন্তরে অদৃশ্য হয়ে যেতে চায় তার বলিষ্ঠ ফর্সা হাত।সুপ্তের কানে ভেসে আসে অর্ধাঙ্গিনীর ক্রন্দন মিশ্রিত কন্ঠ,
-আমি আপনাকে ভালোবাসি সুপ্ত!সেই মুহুর্ত থেকে যেই মুহুর্তে আপনি কবুল বলে আমাকে আপনার স্ত্রীরুপে স্বীকার করেছেন।আমি আপনাকে ভালোবাসি!ভালোবাসি আপনার রাগ মিশ্রিত কন্ঠ,আপনার যত্নশীল আচরণ।আপনার ঘুমন্ত মুখশ্রী,আপনার মুখনিঃসৃত বেশরম সব শব্দ আমি ভালোবাসি।আমি গোটা আপনিটাকেই ভালোবাসি সুপ্ত রেহনেওয়াজ।আপনি একবার বলুন,আপনার সাথে বলা এই মিথ্যে।শুধু একবার বলুন।
সুপ্ত ত্রয়ীকে বুকের সাথে চেপে ধরে।তার শুষ্ক নেত্র থেকে জল গরায় এক ফোঁটা।ত্রয়ীর সিঁথিতে ঠোঁট ছুঁইয়ে সুপ্ত বলে উঠে,
-মিথ্যে।আমি তাকে স্পর্শ করার চেষ্টাও করিনি।ট্রাস্ট মি!
-আই ট্রাস্ট ইউ।আমি জানি এসব ওই আরসালান চৌধুরী করেছে।নিঝুৃম মেয়েটা হাত মিলিয়েছে ওদের সাথে।
ত্রয়ী সুপ্তের বুক থেকে মাথা উঠায়।বুকের কাছের সাদা শার্ট ভিজে ফর্সা পুরুষালি দেহ ফুটে উঠেছে।সুপ্ত একপলক সেদিকে চায়।তারপর ত্রয়ীর কপোলে লেগে থাকা অশ্রু মুছে দেয় সন্তর্পণে।ত্রয়ীর গালে দুহাত রেখে বলে উঠে,
-আমার বাঘিনীর চোখে অশ্রু মানায় না।তার চোখের অগ্নিদৃষ্টিই আমার সর্বাপেক্ষা প্রিয়।
-আপনি এখান থেকে কিভাবে বেরুবেন?সকলে আপনার নামে বাজে মন্তব্য করছে!
-সত্যের পথে চললে বাঁধা আসবেই ত্রয়ী।এই কারাগার কিংবা এই মিথ্যা অপবাদ আমার চরিত্রে কোনপ্রকার কলংক লাগাতে অক্ষম।জাস্ট তোমাকে একটা কাজ করতে হবে।মন দিয়ে শুন।
.
ত্রয়ী থানা থেকে বেরোতেই সামনে একটা গাড়ি এসে থামে।বাড়িতে টিভিতে এমন নিউজ শোনার পরপরই ছুটে থানায় এসেছে সে,একা।পেছন থেকে তন্দ্রা আর বর্ণ ডাকলেও শোনেনি সে।বাইরে বেরিয়ে রিক্সা নিয়েই থানায় এসেছে সে।তাই থানা থেকে বেরিয়ে রিক্সার জন্যই অপেক্ষা করছিল সে।কিন্তু আকস্মিক একটা বড়সড় গাড়ি সামনে এসে থামলে চমকে যায় সে।সতর্ক চোখে তাকিয়ে কিছু বুঝে উঠার আগেই কয়েকজন লোক তার মুখে স্পে করে। ত্রয়ী মুহুর্তেই অচেতন হয়ে ঢলে পরে।লোকগুলো তাকে গাড়িতে উঠিয়ে রওনা দেয়তাের গন্তব্যে।
চোখে মুখে সজোরে পানির ছিটা পড়তেই চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে ত্রয়ী।পরক্ষণেই দৃষ্টি মেলে সামনে তাকাতেই অবাক হয়ে উঠে তার চিত্ত।বিশাল মহলের ন্যায় অট্টালিকার সামনে সে।গাড়ি থেকে ধীরে সুষ্ঠে নামে ত্রয়ী।আশেপাশে চোখ বুলিয়ে কিছু লোককে দাড়িয়ে থাকতে দেখেই অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে তাদের দিকল তাকায় ত্রয়ী।মুখশ্রী রাগের রক্তিমা ছেয়ে উঠে।রাগে গর্জে উঠে বলে উঠে,
-আমাকে কোথায় নিয়ে এসেছেন এটা?কারা আপনারা?
একজন লোক নতমস্তক করে তার সামনে দাঁড়ায়।বলে উঠে,
-মেমসাহেব!হুজুর আপনাকে ভেতরে যেতে বলেছেন।
কথাখানা শেষ করে লোকটি পুনরায় নিজের স্থানে দাঁড়াতেই এতখন অন্ধকারে ছেয়ে থাকা মহলের সামনের সমস্ত বাড়ি জ্বলে উঠে।বাতিগুলো অনেকটা ল্যাম্বপোস্টের মত একের পর একটি করে বসানো।তীব্র আলোয় চোখ বদ্ধ করে নেয় ত্রয়ী।সামনে দৃষ্টি রাখতেই গোলাপের পাপড়ি নির্মিত রাস্তা নজরে আসে তার যা এতক্ষণ অন্ধকারের হেতু বোঝা যাইনি।
ত্রয়ী সকলের দিকে তাকিয়ে আক্রোশ নিয়ে বলে উঠে,
-আপনাদের হুজুর মাই ফুট!
কথাখান শেষ করে ত্রয়ী অদূরে থাকা বিশাল গেটের দিকে যেই যাবে ওমনি আরেকটা লোক এসে গম্ভীর আওয়াজে বলে উঠে,
-আপনার সামনে এখন এই একটি রাস্তায় খোলা আছে।
ত্রয়ী রাগে দাঁত দাঁত চেপে গোলাপের পাপড়ি নির্মিত রাস্তায় পা রাখে।কোমল পাপড়িতে পা দিয়েও ত্রয়ীর ভিতরে ক্রোধের বহ্নি জ্বলে উঠে দাউ দাউ করে।
বেশ কয়েক কদম হাঁটতেই মহলের ড্রয়িং রুমে পৌঁছায় ত্রয়ী।দৃষ্টিতে ভেসে উঠে রাজকীয় আসনে বসে থাকা আরসালানের চেহারা।ত্রয়ীর ভেতরের ক্রোধ আরো দ্বিগুন হয়।ত্রয়ী এসে তার সামনে দাঁড়াতেই আরসালান আপাদমস্তক একবার তাকে দেখে নেয়।এই রংটা ত্রয়ীকে একটু বেশিই মানিয়েছে বলে মনে হয় আরসালানে।খোলা কেশ কোমড় ছাড়িয়েছে,চোখে অগ্নিদৃষ্টি!
এ যেন সবচেয়ে অপরূপা রমনী।আরসালান মুগ্ধ কন্ঠে বলে উঠে,
-এই রাজকীয় স্বাগতম কেমন লাগলো ত্রয়ী মেহরোজ?
-ঘৃণিত ব্যাক্তি যদি পায়ের তলায় গোলাপের পাপড়ি বিছিয়ে রাখে তাও কাঁটার ন্যায় সূঁচালো মনে হয়।
ত্রয়ীর মুখের তেজঃপূর্ণ বাক্য শুনে আবেশে চোখ বুজে নেয় আরসালান।ত্রয়ী ভ্রু কুঁচকে তাকায় ত্রয়ী।
-স্বামী কারাগারের ভেতরে,আমার কাছে এই মুহুর্তে বন্দি তুমি।নারী,অবলা তুমি।অথচ কন্ঠে এত তেজ!আ’ম ইমপ্রেসড!
চলবে..