হৃদস্পর্শে প্রেমসায়রে পর্ব-০৪

0
65

#হৃদস্পর্শে_প্রেমসায়রে
#রক্তিমা(লেখনীতে)
৪.
নিস্তব্ধতা ছেঁয়ে আছে ড্রয়িং রুমে।সোফায় সকলে থমথমে মুখে বসে।কারো কারো চোখে ভয় বিদ্যমান।গেস্টরা চলে গিয়েছেন বেশ কিছুক্ষণ হলো।বাড়ির সকলের মুখের দিকে একবার করে তাকিয়ে সুপ্ত বলে উঠে,

-এতো চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই।কারোর কিছু হয়নি, ত্রয়ী ঠিক আছে।

ত্রয়ী সুপ্তের কথায় চোখ তুলে তাকায়।তার চোখে মুখে কোন ভয়ের ছাপ নেই।তবে সেই সময়টায় সে বেশ ভয় পেয়েছিলো।দ্বিকবিদিক শূন্য হয়ে পরেছিলো তার।এমনকি সুপ্ত যে তার হাত ধরে টেনে ড্রয়িং রুম অবধি নিয়ে এসেছিলো সেটাতেও তার হুঁশ ছিলো না।গুলির আওয়াজে তটস্থ হয়ে অনেক গেস্টই পরপরই প্রস্থান করেন।
মিসের সুহৃদ সুপ্তের দিকে চেয়ে শাসনের স্বরে বলে,

-চিন্তিত হতে না বলছিস!বাচ্চাটার যদি কিছু হয়ে যেত!

সুপ্তের মায়ের কন্ঠে নিজের জন্য উৎকন্ঠা দেখে মনে মনে খুশি হয় ত্রয়ী।তারপর উনার পাশ ঘেঁষে বসে কাঁধে মাথা রেখে দুহাতে উনার বাহু জড়িয়ে ধরে সে।মিষ্টি করে বলে উঠে,

-কিছু হয়নি তো মা।এবার আর চিন্তা করবেন না।

মিসেস সুহৃদ ত্রয়ীর গালে আদর করে দিয়ে বলে,

-হুম বুঝেছি এসব তোমাদের কাছে কিছুই মনে হচ্ছে না।মা হওয়ার পর বুঝবে সন্তানের এইটুকুতেই মায়ের কতটা হৃদয় পুড়ে।

ত্রয়ী কিছু না বলে সুপ্তের দিকে আড়চোখে চায়।সুপ্ত তাদের দিকের চেয়ে আছে দেখে দ্রুত চোখ সড়ায় সে।পরক্ষণেই বেলার কথা মনে পরতেই অভিমান ও রাগের সংমিশ্রণে মুখশ্রী কঠিন হয়ে আসে তার।সুপ্তের দেওয়া ভিডিও সে সম্পূর্ণ দেখতে পারেনি সে।সুপ্ত যে বেলাকে প্রশ্ন করেছে ঠিক সেই মুহুর্তে গিয়ে হেঁচকা টানে সুপ্তের বুকে এসে পরে সে।তার ফল স্বরূপ হাত থেকে পরে ফোনের ডিসপ্লে চলে গেছে।
মিসেস রেহনেওয়াজ সবাইকে যার যার ঘরে যাওয়ার নির্দেশ দিলে সকলে ড্রয়িং রুম থেকে সকলের ঘরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।ত্রয়ীও উঠে দাড়ায় রুমে আসবে বলে।সিঁড়ির কাছাকাছি এসে একপর্যায়ে এসে তার চোখ পরে বেলার উপর।তাকে কিছুটা বিরক্ত মনে হচ্ছে।যেন ত্রয়ী সেই গুলির শিকার হলেই বরং ভালো হতো!

ত্রয়ী চোখ ফিরিয়ে চুপচাপ রুমে এসে পরে।আরশির সামনে দাঁড়িয়ে কানের ঝুমকো,চুড়ি খুলে রেখে দেয়।তার মুখ থমথমে,মলিন দেখাচ্ছে।গলায় একটা চেন পরেছে ত্রয়ী।এটা মূলত মিনি আর তন্দ্রায় নিয়ে এসেছিল সাজগোজের সময়।ভারি ভারি নেকলেসকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সিম্পল চেনটাই পরেছে ত্রয়ী।সেটা খুলবে বলে হাত দিতেই পুরুষালি কন্ঠে হাত স্থির হয়ে আসে ত্রয়ীর।

-ওটা খুলতে হবে না।তুমি যাতে সবসময় পরতে পারো তাই এটা বানিয়েছেন মা।

সুপ্তের কথায় গলা থেকে হাত নামায় ত্রয়ী।তারপর দর্পনে সুপ্তের প্রতিবিম্বের দিকে একপলক তাকিয়ে সুটকেস থেকে প্রয়োজনীয় কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পরে সে।
পনেরো মিনিট সময় নিয়ে তারপর ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আসে ত্রয়ী।সাদা কামিজ,সাদা স্কার্ট প্লাজু আর গলায় খয়েরি রঙের ওড়না পরিহিত ত্রয়ীর দিকে তাকিয়ে থমকায় সুপ্ত।কিন্তু ত্রয়ী আনমনা তাই সুপ্তের দৃষ্টি যে তার সর্বাঙ্গে বিচরণ করছে তা বুঝতে পারে না সে।খোলা চুল ছড়িয়ে পরেছে পিঠ জুড়ে।চলন্ত ফ্যানের বাতাসে তারা উড়ছে বাধাহীন,মুগ্ধ করছে তার দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকা যুবককে।চোখে মুখে পানি দেওয়ায় ভ্রু জোড়া আর চোখের পাপড়িতে পানির কণা লেগে আছে যা আরো আকর্ষনীয় করে তুলেছে সাজসজ্জা বিহীন ত্রয়ীকে।সুপ্তের দিকে এক পলকও না তাকিয়ে ত্রয়ী সোজা বেলকনিতে এসে পরে।রেলিং ধরে দাড়িয়ে দৃষ্টি দেয় ও নিকষ কালো আসমানের পানে।

দরজা আটকানোর শব্দ কর্ণগোচর হতেই ত্রয়ী বুঝতে পারে এতক্ষণ বিছানায় বসে থাকা মানবটি ওয়াশরুমে ঢুকেছে।
বাহিরের ঠান্ডা হাওয়া এসে ত্রয়ীকে ছুঁয়ে যায়।শীতলতা অনুভব করতে সে চোখ বুঁজে সন্তর্পণে।
মিনিট দশেক নিরবতা উপভোগ করার পর ত্রয়ীর কানে ভেসে আসে,

-ঝগড়ুটে মহিলা,ঝগড়া করেই নিশ্চয়ই এমন শত্রু বানিয়েছেন যে প্রাণে মারার মত পদক্ষেপ নিতে পারে?

সুপ্তের কথায় বিরক্তি নিয়ে তার পানে ফিরে তাকায় ত্রয়ী।অন্ধকার আছন্ন বেলকনিতে সুপ্তের চেহারা আবছা দৃশ্যমান হয় ত্রয়ীর নিকট।ত্রয়ী ভ্রু কুঁচকে বলে উঠে,

-উল্টা পাল্টা কথা বলবেন না একদম।

ত্রয়ীর কন্ঠ মলিন শোনায় অনেকটায়।সুপ্ত তবুও ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসিটা বজায় রেখে বলে,

-আমার তো তাই মনে হচ্ছে।

-আপনি মনে করলেই যে তা ঠিক এমন কোন কথা আছে?আশ্চর্য!

-আমিও তাই বলি তুমি মনে করলেই যে সব ঠিক এমন কোন কথা আছে।আর প্রশ্নটা এমনি এমনি করিনি।তুমি আমার সাথে যে পরিমান তর্ক কর,সো আই গেস!

-আপনার সাথে তর্ক করি কারণ আপনি আমার স্বামী আর আমি আপনাকে..

এতটুকু বলে যেন ত্রয়ীর হুঁশ ফিরে সে কি বলছে।মনে আসা শব্দ এসে জ্বিভের আগায় এসে আঁটকায়।এদিকে সুপ্ত ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে বাক্যের বাকি শব্দটুকু শোনার জন্য উৎসুক।কয়েক সেকেন্ড ব্যয় হওয়ার পরও ত্রয়ী স্তব্ধ দেখে তার দিকে সামান্য ঝুঁকে সুপ্ত।কিন্তু এটুকুতেই ত্রয়ীর দৃষ্টি বড় বড় হয়ে আসে।সুপ্ত ভ্রু উচিয়ে শুধায়,

-তুৃমি আমাকে?

ত্রয়ী আমতা আমতা করে নিচমুখ তাকিয়ে বলে উঠে,

-আমি আপনাকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে দেখেছি,অন্যায়ের সাথে সন্ধি করতে নয়।

-বাই দ্যা ওয়ে,আই ডিজার্ভ এ থ্যাংকস!

-বাট আ’ম নট থ্যাংকফুল টু ইউ কারন আপনার জন্য আমাকে দুনিয়ার তিক্ততা আরো সহ্য করতে হবে।আপনার করা কর্মের তিক্ততা আমায় সহ্য করতে হবে।

ত্রয়ীর নেত্র রাগে পূর্ণ,তেজে পূর্ণ কন্ঠে কথাখান হয়ত ভেসে আসলো তবে সুপ্ত শুনলো না তার দৃষ্টি স্থির হয়েছে তেজপূর্ণ
ওই নেত্রদ্বয়ে।মানস্পটে একটু সুর ভেসে আসে,

“কি নামে ডেকে বলবো তোমাকে?
মন্দ করেছে আমাকে ওই দুটি চোখে”

সুপ্তের এভাবে তাকানো দেখে ভ্রুজোড়া কুঁচকে ফেলে ত্রয়ী।সুপ্ত তার অনেকটাই কাছাকাছি চলে এসেছে।যার ফলে ত্রয়ী সেঁটে আছে রেলিং এর সাথে।আচমকা ত্রয়ী ধাক্কা লাগায় সুপ্তের বুকে।সুঠাম গড়নের যুবক তাতে খুব বেশি পিছিয়ে যায় না।সুপ্তকে পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে বলে,

-আজ ভাগ্যে মৃত্যু লেখা ছিলো না বলে বাঁচাতে পেরেছেন তবে যেদিন সত্যি সত্যিই মরণ এসে পরছে সেদিন শত চেষ্টার পরেও আমার প্রাণ রক্ষা করা হয়ে উঠবে না।

চলন্ত ত্রয়ীকে পেছন থেকে আঁকড়ে ধরলো সুপ্তের অদৃশ্য হাত।অদৃশ্য!তাই তো তার নাগালে না এসে নিজ গন্তব্যে পৌঁছালো রমনী।

সুপ্ত আরেকবার মুগ্ধ হলো তার ব্যাক্তিগত রমনীর তর্ককলায়।ত্রয়ী গিয়ে সোজা পালঙ্কে শুয়ে পরেছে।ঘুম পিপাসু আঁখিদ্বয় করেছে অনিশ্ছায় বদ্ধ, তবে মস্তিষ্কে ঘুরতে থাকা নানা প্রশ্ন তাদের উত্তর খুঁজতে ব্যস্ত।সত্য মিথ্যার নিপীড়নে অতিষ্ঠ তার শক্ত রুপী কোমল হৃদয়!বদ্ধ চোখজোড়া খুলে গিয়ে আপনা আপনি ছুটে যায় বেলকনি পানে।তার দিকে পিঠ দিয়ে থাকা মেরুন রঙের শার্ট পরিহিত যুবককেআবছা দেখা যাচ্ছে আঁধারে।ত্রয়ী দেখে তার আর সুপ্তের মাঝে বিষদ দূরত্ব।সুপ্তের দিকে চেয়ে ত্রয়ী অকপটে উচ্চারণ করলো,

-আপনার আর আমার মাঝের দূরত্ব ততদিন ঘুচবে না যতদিন না আপনার শুদ্ধ হৃদয় আমার হৃদয়ের নিকট শুদ্ধ হয়ে উঠবে।আর সেদিন থেকে যাই হয়ে যাক না কেন আপনার শুদ্ধতা,আপনার পবিত্রতা আমি চেখ বুঁজে স্বীকার করব!

বেলকনিতে দাড়িয়ে থাকা সুপ্ত নিকষ আঁধারের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
-মেডিকেলে পড়ুয়া সাধারণ ছাত্রী,শান্তিপ্রিয় ত্রয়ীর উপর হামলা হতে পারে না তবে তার উপর এই প্রাণঘাতী হামলার হেতু স্বয়ং আমি?

চলবে…