#হৃদস্পর্শে_প্রেমসায়রে
#রক্তিমা(লেখনীতে)
৬.
-দয়া করে আপনার এই সস্তা নাটক বন্ধ করুন,মিস্টার সুপ্ত রেহনেওয়াজ।
ত্রয়ীর রাগান্বিত আওয়াজে আর মেঝেতে কাঁচ ভাঙার শব্দ বন্ধ দরজার ওপারে না পৌঁছালেও সুপ্তের কানে ঝংকার তুললো।ত্রয়ীর এরূপ আচরণে সে একটুকুও না রেগে শান্ত চোখে তাকালো।ত্রয়ী তখন অগ্নিদৃষ্টি দিয়ে সুপ্তের দিকে তাকিয়ে।সুপ্ত ওর চোখের দিকে তাকিয়ে শান্ত আওয়াজে বলে উঠে,
-এতো রাগ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।শান্ত হও আর ডাইনিং এ চলো।তারপর আমরা তোমার বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হব।
সুপ্তের কথায় ত্রয়ীর রাগের মাত্রা কমলো না বৈ বাড়লো।তেজি স্বরে সুপ্তকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
-কতদিন এভাবে থার্ডক্লাস মানুষদের মত দুই নৌকায় পা দিয়ে চলবেন?
ত্রয়ীর কথার বিপরীতে সুপ্তের কোন প্রতিক্রিয়া না দেখে ত্রয়ী ভ্রু কুঁচকায়।সুপ্ত পকেটে হাত পুরে তার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।এতে যেন ত্রয়ীর মনে বহ্নিশিখারা তাদের মাত্রা ছাড়িয়ে যায়।নিচে যে ভাঙা কাঁচের টুকরো পরে আছে তাতে নজর নেই রাগান্বিতার।সুপ্তের দিকে তাকিয়ে দ্রুত পায়ে তার দিকে এগিয়ে আসতে গিয়ে পায়ে সদ্য ভাঙা ধারালো কাঁচের টুকরো আঘাত হানে।তবে ক্রোধের চরম শিখরে পৌঁছে গেলে মানুষ আঘাতের পরোয়া করে না।ত্রয়ী কাঁচের উপর দিয়ে এসে সুপ্তের সামনে দাঁড়ায়।অতিদ্রুত ত্রয়ী অবিশ্বাস্য এক কার্য করে বসে।সুপ্তের শার্টের কলারে ধরে ক্ষোভ নিয়ে বলে উঠে,
-আপনার কাজিন বেলা বা প্রেমিকা ও আমাকে কি বলেছে জানেন?উই লাভ ইস আদার!আপনি ওকে আর ও আপনাকে ভালোবসে!একজন নব বিবাহিতা স্ত্রীর কাছে স্বামীর নামে শোনা এই শব্দগুলো কতটা কষ্টদায়ক আন্দাজ করতে পারেন আপনি?
সুপ্ত কলারের দিকে ত্রয়ীর মুষ্টিবদ্ধ হাতের দিকে একবার চায় তারপর ভাঙা কাঁচের উপর দাঁড়ানো ত্রয়ীকে দেখে এক ঝটকায় ত্রয়ীর পেটে আর হাঁটুর নিচে ধরে কোলে তুলে ফেলে।আকস্মিক সুপ্তের এরূপ কাজে ত্রয়ী চমকে সুপ্তের মুখের পানে চায়।সুপ্তের গলায় থাকা হাতে সামান্য চাপ দিয়ে বলে উঠে,
-নামান আমাকে।এভাবে হুটহাট না বলে-কয়ে কোলে তুলছেন এটা আমার একদম ভালো লাগছে না।
সুপ্ত ত্রয়ীর অগ্নিচোখে চেয়ে ঠোঁটের কোণে সামান্য হাসি টেনে বলে উঠে,
-আই ডোন্ট কেয়ার,মাই ওয়াইফ!
সুপ্ত ত্রয়ীকে নিয়ে পালঙ্কের দিকে যায়।ত্রয়ী ফের বলে উঠে,
-আপনি আমার অনুমতি না নিয়ে দুইবার কোলে তুলনেন সুপ্ত।
-সরি টু সে বাট দুইবার না তিন বার!
ত্রয়ী চোখে গোল গোল হয়ে আসে সুপ্তের কথা শুনে।
তিনবার!সজ্ঞানে তো ত্রয়ীকে দুইবারই কোলে নিয়েছে সুপ্ত।তবে কি ত্রয়ীর অজান্তে তাকে কোলে নিয়েছে সুপ্ত।
ত্রয়ীর ভাবনার মাঝেই ত্রয়ীকে পালঙ্কে বসিয়ে দেয় সুপ্ত। এবার পায়ের তালুতে ব্যাথা অনুভব হয় ত্রয়ীর।পা তুলে দেখে তাকে দুটো কাঁচের টুকরো গেঁথে আছে।রক্তে লালাভ হয়ে উঠেছে পায়ের তালু।তখনি সুপ্ত ফাস্ট এইট বক্স নিয়ে এসে মেঝেতে বসে পরে।ত্রয়ীর পায়ের তালুতে হাত রাখতে যাবো তখনি ত্রয়ী বলে উঠে,
-আমি নিজেই পারবো।আপনাকে কষ্ট করতে হবে না।
সুপ্ত এবারও শান্ত চোখে মাথা উচুঁ করে ত্রয়ীর পানে তাকায়।সুপ্ত নিজেকে শান্ত প্রমাণ করলেও ভেতরে ভেতরে রাগছে সে।তবে স্বামী স্ত্রীর মাঝে যখন একজনের উগ্রতা বৃদ্ধি পায় তখন অপরজনকে শান্ত মস্তিষ্কে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।
সুপ্ত বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে কসটেপ কেটে নিয়ে আসে।তারপর সেটা ত্রয়ীর মুখে লাগিয়ে দিয়ে বলে,
-অনেক কথা বলেছো,সব শুনেছি।এখন আমি বলব তুমি শুনবে।আর তারজন্য তোমার মুখটা কিছুক্ষণ বন্ধ রাখা দরকার।
ত্রয়ী কিছু না বলে সুপ্তের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।তার হাত যে উন্মুক্ত!সেটা দিয়েই মুখের টেপ খুলে ফেলবে পারবে সেই হুঁশ নেই তার।
সুপ্ত অতি সুক্ষভাবে পায়ের তলা থেকে কাঁচের টুকরো টেনে বের করে।চোখ বুঁজে ব্যথা সামলে নেয় ত্রয়ী।সুপ্ত পায়ে ড্রেসিং করতে করতে বলে,
-আমি বুঝলাম না তুৃমি কিভাবে ঘরের স্বামীর কথা রেখে বাইরের মেয়ের কথায় এত বিশ্বাস করে বসলে?
সুপ্তের কটাক্ষ শুনে ভ্রু উঁচায় ত্রয়ী।সুপ্ত ফের বলে উঠে,
-ট্রাস্ট মি,যদি বেলার প্রতি আমার একটুও ইন্টারেস্ট এন্ড ফিলিংস থাকতো তাহলে তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী রুপে আমার কক্ষে এই যত্নে থাকতে না।এখন তুমি আমার কথা বিশ্বাস করবে না অন্য কারো কথা তোমার ব্যাপার।
সুপ্ত ব্যান্ডেজ শেষে অতিযত্নে ত্রয়ীর পা নরম বিছানায় রেখে দেয়।তারপর একটানে খুলে দেয় মুখে লাগানো টেপ।বা পাশের ভ্রু সামান্য উচিয়ে সুপ্ত বলে উঠে,
-কিছু বলবে তুমি?
ত্রয়ী কিছু না বলে চুপ করে আছে দেখে সুপ্ত বলে উঠে,
-৩০ মিনিট বাদে রুমে খাবার পাঠাচ্ছি।শাওয়ার নিয়ে নাও।
তারপর কক্ষ থেকে বের হয়ে যায় সুপ্ত।রুম থেকে বেরিয়েই এতক্ষণ ধরে থাকা শান্ত স্বভাব উবে গিয়ে মুখমন্ডল কঠোর হয়ে আসে তার।দ্রুত লম্বা লম্বা পা ফেলে ড্রয়িং রুমে এসে পৌঁছায় সে।পুরো জায়গায় চোখ বুলিয়ে বেলাকে দেখতে না পেলে মিসেস সুহৃদের উদ্দেশ্য বলে উঠে,
-মা বেলাকে ডাকুন,শীঘ্রই।
ছেলের কন্ঠস্বর আর মুখভঙ্গি দেখে মিসেস সুহৃদ কিছু জিজ্ঞেস না করে বেলাকে ডেকে আনে।সুপ্ত তাকে ডাকছে ভেবে প্রথমে খুশি হলেও সুপ্তের মুখভঙ্গি দেখে ভয় গ্রাস করে বেলাকে।কাজিনদের মধ্যে সবচেয়ে রাগী হলো সুপ্ত।সবসময় রাহতে দেখা যায় না তাকে তবে যখন রাগান্বিত হয় তখন সকলে বেশ আতংকে থাকে।
সুপ্ত বেলাকে দেখেই সোজাসাপ্টা প্রশ্ন করে,
-তুই ত্রয়ীকে কি বলেছিস?
বেলা ভীতু চোখে সুপ্তের পানে তাকিয়ে রয়।মুখে কিছু বলে না।সুপ্ত ফের বলে,
-তাড়াতাড়ি আন্সার দে বেয়াদব।
সুপ্তের হুংকার পূর্ণ আওয়াজে কেঁপে উঠে বেলা।কিছু না বলে চুপ করে রয় শুধু।তার মৌনতা দেখে সুপ্ত ক্ষিপ্ততা নিয়ে বলে,
-এটাই বলেছিস তো,আমি তোকে আর তুই আমাকে ভালোবাসিস।
সুপ্তের চিৎকারে মিনি,তন্দ্রা ও বর্ণ সকলে এসে ড্রয়িংরুমে ভীড় জমায়।মিনি আর বর্ণ সুপ্তের চাচাতো ভাইবোন।জয়েন্ট ফ্যামিলি হওয়ায় ওরা সকলে মিলে এই বাড়িতেই থাকে।চেঁচামেচি শুনে বেলার মা,সুপ্তের একমাত্র ফুপু এসে হাজির হয়।মেয়ের উপর সুপ্তকে চেঁচামেচি করতে দেখে মেয়েকে আগলে নিয়ে বলেন,
-দেখ আমার মেয়েটাকে কিভাবে ভয় পেয়ে আছে।তুই দুইদিন আগে করে বউ নিয়ে আসা মেয়েটার জন্য বেলাকে এভাবে বকছিস!
এই কথা শুনে সুপ্তের রক্ত উষ্ণ হয়ে উঠে।ফুপুর কটাক্ষপূর্ণ কথা আর বেলার নেকামো দেখে পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে তার।সে বলে উঠে,
-আপনার মেয়ে যখন আমার নামে আজেবাজে বলে আমার চরিত্রের দিকে আঙুল তুললো তখন যদি আপনি মেয়েকে শাসন করতেন তখন আজকে সবার সামনে ওকে এভাবে অপমানিত হতে হতো না।আর কি ধরনের ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করছেন আপনি?ত্রয়ী আমার স্ত্রী।ওর নাম এই বাড়িতে সম্মানের সাথে নেওয়া হবে।
সুপ্তের ক্ষিপ্রতাপূর্ণ আওয়াজে বেলার মা মনিকা বেশ অসন্তুষ্ট হলেন।সুপ্ত বেলার উদ্দেশ্য বলে উঠে,
-যদি তুই আবার আমার নামে ত্রয়ীর কাছে উল্টাপাল্টা কিছু বলবি বলে মনে করিস তবে ব্যাগ প্যাক কর আর তোদের বাড়িতে গিয়ে বিশ্রাম কর।
সুপ্তের মুখে সোজাসাপ্টা এমন কথা শুনে বেলা অবাক হয়ে তাকায়।সাথে সাথে সকলেই অবাক হয়ে সুপ্তের মুখপানে চায়।বেলা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে উঠে,
-কিছুদিন আগে অবধিও তো তুমি ত্রয়ীকে চিনতে না।মামির পছন্দে বিয়ে করেছো ওকে।আর আজকে ওর জন্য আমাকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলছো?
সুপ্ত এবার বেলার দিকে শান্ত চোখে চায়।কন্ঠ খুবই শান্ত করে বলে উঠে,
-তোর কি মনে হয় ত্রয়ী শুধুই আমার মায়ের পছন্দ করা মেয়ে?
.
ত্রয়ী ওয়াশরুম থেকে গোসল করে বেরিয়েছে মাত্র।পরনে কমলা রঙের জর্জেটের শাড়ি,গোল্ডেন কালার ব্রাউজের বিস্তার কনুই অবধি,চুলে তোয়ালে পেছানো।ত্রয়ী যেই চুলে হাত দিবে তখনি দরজায় নক করে কেউ।ত্রয়ী কে জানতে চাইলে মিনির গলার আওয়াজ ভেসে আসে।ত্রয়ী দরজা খুলে দিলে ভেতরে প্রবেশ করে সে।হাতের ট্রে তে খাবার সাজানো।ত্রয়ী ওর হাতে খাবার দেখে কিছুটা ইতস্তত বোধ করে।মিনি ট্রেসহ খাবার বিছানায় রাখতে রাখতে বলে,
-আচ্ছা ভাবি,বেলাপু তোমায় কি বলেছিলো বলতো?যার জন্য সুপ্ত ভাইয়াকে অনেকদিন পর এভাবে রাগতে দেখলাম।
ত্রয়ী মিনির কথা শুনে কিছু আন্দাজ করে বলে,
-নিচে কিছু হয়েছে মিনি?কিছু করেছেন উনি?
মিনি দাড়িয়ে কোমড়ে একহাত রাখে। তারপর বলে,
-সুপ্ত ভাই রেগে বোম হয়ে ছিল।বেলাপুকে ইচ্ছে মত ধুয়ে দিয়েছে।তুমি বেলাপুর কথা একদম বিশ্বাস করো না।ভাইয়ার কাছ থেকে রিজেক্ট হওয়ার পর থেকে মনে ক্ষোভ পুষে রেখেছে তাই হয়ত তোমায় উল্টো পাল্টা কিছু বলেছে।ভাবি জানো তোমাকে কিসব বলেছে তার জন্য ভাইয়া বেলাপুকে বাড়ি থেকে চলে যেতে অবধি বলেছে।আমি তো জাস্ট শকড!
চলবে..