হৃদস্পর্শে প্রেমসায়রে পর্ব-০৭

0
47

#হৃদস্পর্শে_প্রেমসায়রে
#রক্তিমা(লেখনীতে)
৭.
অপরাহ্নের সোনালী রোদ্দুর গায়ে মাখিয়ে ছুটে চলেছে সুপ্তের গাড়ি।পাশেই ফন্ট সিটে চুপচাপ বসে আছে ত্রয়ী।লম্বা চুলগুলো ডান সাইড করে সামনে এনে রাখা।কানে ছোট্ট একটা স্টোনের ইয়ারিং,কপালে ছোট কালো টিপ।মাঝে মাঝে আড়চোখে সুপ্তকে খেয়াল করছে সে।সুপুরুষ গম্ভীর হয়ে গাড়ি চালাচ্ছে।চোখে একটা সানগ্লাস।পরনে সাদা রঙের শার্ট,নেভিব্লু জিন্স,হাতের কালো বেল্টের ঘড়িতে গায়ের ফর্সা আরো ফুটে উঠেছে।সুপ্তের দিকে একবার তাকিয়ে নিজের হাতদুটো দেখে ত্রয়ী।সুপ্তের থেকে একশেড কালো তার গায়ের রং।
সুপ্ত এবার ডানে তাকিয়ে ত্রয়ীর পানে চায়।স্নিগ্ধতায় ঘেরা রমরী নিজের দুহাতের দিকে ঠোঁট উল্টে তাকিয়ে আছে।ভ্রু জোড়া কুঁচকে আছে তার।সুপ্ত খেয়াল করে মাঝে মাঝে রোদ এসে ত্রয়ীর উপর পরতেই নাকফুল আর গলায় থাকা স্বর্নের চেন ঝিলিক মারছে।ত্রয়ী হঠাৎ সুপ্তের পানে তাকাতেই দৃষ্টি সরায় সুপ্ত।গম্ভীর হয়ে আবার মনোযোগ দেয় গাড়ি চালানোয়।ত্রয়ী ভ্রু কুঁচকে ভাবে সুপ্ত কি তাকে এড়িয়ে গেল?
কৌতুহল মনের ভেতরে পুষে না রেখে ত্রয়ী প্রশ্ন করে বসে,

-আপনি কি আমাকে ইগনোর করছেন?

-এমন কেন মনে হচ্ছে তোমার?

ত্রয়ীর প্রশ্নের হেতু বুঝতে না পেরে সুপ্ত পাল্টা প্রশ্ন করে।ত্রয়ী জানালার বাইরে দৃষ্টি রেখে বলে,

-এমনি।

সুপ্ত আড়চোখে ত্রয়ীকে দেখে ভ্রু কুঁচকে বলে উঠে,

-তুৃমি কি এখন এটা এক্সপেক্ট করছো যে আমি চলন্ত গাড়ি থামিয়ে তোমার দিকে মনোযোগ দিই?

সুপ্ত কথাখান বলতে বলতে গাড়ি থামায়।তৎক্ষণাৎ সুপ্তের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকায় ত্রয়ী।সুপ্ত উত্তরের আশায় ত্রয়ীর পানে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে।ত্রয়ী এভাবে সুপ্তকে গাড়ি থামাতে দেখে বিভ্রান্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে,

-আমি তো এমন কিছু বলিনি।গাড়ি কেন থামালেন আপনি?

ত্রয়ীর মুখে বিস্ময়ের আভা ছেঁয়েছে ইতিমধ্যে।সুপ্ত গাড়ির দরজা খুলে নামলে ত্রয়ী ফের প্রশ্ন করে,

-কোথায় যাচ্ছেন আপনি?

-বিয়ের পর প্রথম শশুরবাড়ি যাচ্ছি।খালি হাতে গেলে আপনার নিশ্চয়ই সুনাম হবে না বঁধুসাহেবা।

সুপ্তের কথায় ত্রয়ী আশেপাশে তাকিয়ে থেকে বাজারের মাঝে গাড়ি থামিয়েছে সুপ্ত।সুপ্ত চলে যেতেই ত্রয়ীর ফট করে মনে পরে তারা যে যাচ্ছে তা তো বাড়িতে খবরই দেওয়া হয়নি।দ্রুত ফোন বের করে মায়ের নাম্বারে কল দেয় ত্রয়ী।সেকেন্ড পাঁচেক পর ফোন রিসিভ করে ত্রয়ীর মা।ত্রয়ী কিছু বলার আগেই তার উচ্ছাসিত কন্ঠ ভেসে আসে,

-তোরা নাকি আসছিস?

-হ্যা।কিন্তু তোমায় কে বললো?

-কে আর বলবে!জামাই বলেছে।তো কদ্দূর তোরা?

-এইতো **বাজারে।

-ঠিক আছে আয়।

ত্রয়ী ফোন রেখে দেখে সুপ্ত চলে এসেছে।সুপ্ত গাড়ি স্টার্ট দিলে ফের মৌনতা বজায় রাখে দুজনে।

গোধূলি লগ্নে নবদম্পতি গন্তব্যে পৌঁছায়।ত্রয়ী বাড়ির গেট খুলে ভেতরে প্রবেশ করতেই ত্রয়ীর ছোট বোন তোহা দৌড়ে আসে।চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করে জানান দেয় বাড়ির মেয়ে পৌঁছেছে।

ত্রয়ীর মাকে দেখে সুপ্ত শান্তস্বরে সালাম দেয়।ভদ্রমহিলা সালামের উত্তর দিয়ে ঘরে প্রবেশ করতে আহ্বান জানায় সুপ্তকে।ত্রয়ী আশেপাশে তাকিয়ে বাবার সন্ধান করে।মাকে জিজ্ঞেস করতেই জানে মেহরান সাহেব বাজারে গিয়েছেন।ত্রয়ী বাড়ির পুকুরঘাটে গিয়ে দাঁড়ায়।

শানবাঁধানো পুকুর পাড়ে বসে পানিতে পা ডুবায় ত্রয়ী।লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে অনুভব করে বিশুদ্ধ বাতাস নাসারন্ধ্র বেয়ে হৃদপিণ্ডে পৌঁছে মনকে করে তুলছে শান্ত,সতেজ।ত্রয়ী পুকুরের পানে তাকিয়ে দেখে মধ্যভাগে গুটি কয়েক সাদা শাপলা ফুল রয়েছে।শাপলা ভোরবেলায় ফুটে এবং বেলা গড়াতে গড়াতে ঝিমিয়ে যাই তাই ফুলগুলো ঝিমানো অবস্থায় রয়েছে।

অনেকদিন পর গ্রামের পরিবেশে এসে ত্রয়ীর অশান্ত হৃদয় প্রফুল্লতায় ভরে উঠে।গালে একহাত দিয়ে বসে নেত্র বন্ধ করে চারপাশের পাখিদের কিচিরমিচির শ্রবণ করে সে।তবে তার এই কার্যে ব্যাঘাত ঘটে তোহার কন্ঠস্বরে।তোহা এসে জানায় মা ডাকছে তাকে।অগত্যা ত্রয়ীকে পুকুরপাড় ত্যাগ করে বাড়ির দিকে পা বাড়াতে হয়।
.
চাঁদনী রাত।জোসনায় আলোকিত গ্রামাঞ্চল।বিদ্যুৎ না থাকায় সুপ্ত বারান্দায় বসে ছিল।এ কারণে ত্রয়ীর মায়ের কি লজ্জা!মেয়ের জামাই প্রথমবার বেড়াতে আসলো আর তাকে ঠিক মতো সুযোগসুবিধা দিতে পারছে না।সুপ্ত ধনী পরিবারের ছেলে এসবে হয়ত একদম অভ্যস্ত নয়।কিন্তু ত্রয়ীর মায়ের ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে সুপ্ত বলে উঠে,

-আপনারা জান্নাতে থাকেন মা!কি সুন্দর চাঁদের আলো মিশ্রিত,রাতের কোলাহল মুক্ত পরিবেশ।একদম উপভোগ্য!

সুপ্তের কথায় হাফ ছেড়ে বাঁচেন ত্রয়ীর মা।তারপর ঘরে চোখ বুলিয়ে ত্রয়ীকে খুঁজেন।মেয়েটা কোথায় গেল?ভাবতে ভাবতে ঘরে প্রবেশ করেন তিনি।
ত্রয়ীদের বাড়িটা সেমিপাকা।ওপরে টিনের চাল দেওয়া।বাড়ির সামনে অনেকখনি জায়গা জুড়ে উঠান।ধানের মৌসুমে ধান শুকানো হয় এখানে।বাড়ির পেছনে মাঝারি আকারের পুকুর রয়েছে।পুকুরের পাড়ে সুপারি গাছ লাগানো।
সুপ্ত বসে বসে পূর্ণ চন্দ্র উপভোগ করছিল তখনই তার মনে হলো পাশে তার বউ না থাকায় তার জোছনা রাত তেমন উপভোগ্য হচ্ছে না।অনেকক্ষণ যাবত ত্রয়ীকে দেখছে না সে।তখনি তোহা এসে তার পাশে দূরত্ব রেখে বসে পরে।তোহা এবার ক্লাস ফাইভে পড়ে। গোলগাল চেহারার মিষ্টি বাচ্চা।চেহারা অনেকটা ত্রয়ীর মতো দেখতে।সুপ্ত ওকে প্রশ্ন করে,

-বোন কোথায় তোমার?

সুপ্তের প্রশ্ন শুনে তোহা প্রথমে মুখ লুকিয়ে হাসে।সে মুখ লুকিয়ে হাসলেও সুপ্তের চোখে পরে সেটা। তোহা হাসি থামিয়ে বলে,

-আপি তো ওর বান্ধবীর সাথে দেখা করতে গেছে।

-এই রাতে?

সুপ্তের বিস্ময়সূচক প্রশ্নের উত্তর তোহা বেশ তাড়াতাড়ি দেয়।বলে উঠে,

-হ্যা রাতেই।আপি একদম ভয় পায় না তো।যখনই ঢাকা থেকে গ্রামে আসে তখনই ওর বান্ধবীর বাসায় চলে যায়।কখনো কখনো রাতেই চলে যায়।

সুপ্ত দশবর্ষী তোহার কথা কৌতূহল নিয়ে শুনে।তারপর ত্রয়ী কোনদিকে গেছে জেনে পা বাড়ায় সেদিকে।
.
গ্রামের মেঠোপথে একা একা বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটছে ত্রয়ী।জোসনায় ডুবে থাকা এই সবুজ প্রান্তর,মেঠোপথ সবই ত্রয়ীর চেনা।ছোটবেলায় খেলার ছলে কতো দৌড়েছে এই পথে।
আশেপাশে তাকিয়ে হাঁটছে ত্রয়ী।এখান থেকে সোজা তিন মিনিট হাঁটলে ওদের বাড়ি।মৃদু বাতাসে ত্রয়ীর নীল ওড়না উড়ছে।হাঁটার তালে হেলেদুলে উঠছে লম্বা বেনি।বেশ প্রফুল্ল মনেই হাটছিলো ত্রয়ী।কিন্তু আচমকা পেছন থেকে পুরুষালি আওয়াজে চমকে উঠে সে পেছন ফিরে তাকাতেই তিনটে বখাটে টাইপের ছেলেকে দেখে ঢোক গিলে ত্রয়ী।

-সুন্দরী রমনী।কই যাওয়া হচ্ছে শুনি?আমরাও আসি সাথে।

মন্তব্যে অশ্লীল ইঙ্গিত করে ত্রয়ীর দিকে তাকাতেই রাগে আর সুক্ষ ভয়ে ফের ঢোক গিলে ত্রয়ী।তবে চোখ মুখ শক্ত করে তাকিয়ে ছেলেগুলোর উদ্দেশ্যে বলে উঠে,

-যদি জ্বিভ দিয়ে ভালো কথা উচ্চারিত না হয় তবে সেটা কেটে ফেলিস।কোথা থেকে আসছিস তোরা?আমার গ্রামে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিস।

ত্রয়ী মুখে এমন অপমানসূচক শব্দ শুনে ছেলেগুলো ত্রয়ীর দিকে তেড়ে আসে।একজন উচ্চস্বরে বলে উঠে,

-কি বললি তুই?আয় তোকে মজা দেখাচ্ছি।

ছেলেগুলোর মাঝে একজন যখন ত্রয়ীর দিকে হাত বাড়ায় তখন শক্তপোক্ত একটা হাতের চড় বসে তার গালে।আচমকা এমন হওয়ায় চমকে পাশে তাকায় ত্রয়ী।বলিষ্ঠ একখানা হাত আঁকড়ে ধরে তাকে।শুভ্র শার্ট পরিহিত যুবকটি যে সুপ্ত তাতে আর সন্দেহ নেই।ত্রয়ী তার দিকে ভালো করে তাকিয়ে খেয়াল করে ডানহাতে মশালের ন্যায় কিছু।যার ফলে বেশ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে চারপাশ।
সুপ্ত অচেনা তিনজনের উদ্দেশ্য বলে উঠে,

-কি বলছিলি?মজা দেখাবি।ট্রাই নাও ইফ ইউ ডেয়ার!

গালে চড় খাওয়া ছেলেটা রাগে ফুঁসে উঠেছে।বাকি তিনজনও রেগে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে।এর আগেও অনেক রাত-বিরোতে গ্রামে ঘুরেছে ত্রয়ী।তবে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন এই প্রথম হলো।

সুপ্ত মুঠোয় বন্দি হাত শক্ত করে ধরে।ছেলেগুলোর মাঝে একজন এগিয়ে আসতেই মশালের আগুন লাগিয়ে দেয় ছেলেটার শার্টে।বাকিরা এটা দেখে ভয়ে পিছিয়ে যায়।যে ছেলেটার গায়ে আগুন লাগিয়েছে সে এতক্ষণে দৌড়ে পালিয়ে গেছে।
বাকি দুটো ছেলে সুপ্তের দিকে তাকায়।জ্বলন্ত আগুনের আলোয় তার শক্ত চোখের অগ্নিদৃষ্টি ছেলেদুটোর অন্তর্আত্মা কাঁপিয়ে তুলে।আচমকা দৌড় দিয়ে পালায় বখাটে গুলো।
ত্রয়ীর সেদিকে খেয়াল নেই। সে নিষ্পলক তাকিয়ে দেখছে সুপ্তকে।সেই রাগান্বিত অগ্নিদৃষ্টি তার মনে তোলপাড় শুরু করেছে।সুপ্ত এবার সামনে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ত্রয়ীর দিকে তাকায়।কিন্তু ত্রয়ী এবার চোখ না সরিয়ে সোজা দৃষ্টি রাখে সুপ্তের চোখে।হৃদপিণ্ডের সংকোচন-প্রসারন বেশ দ্রুত হচ্ছে তার।সুপ্ত ত্রয়ীর চোখে চোখ রেখে বলে উঠে,

-“একটা কথা মনে রেখো ত্রয়ী।যত বাজে পরিস্থিতিতেই থাকো না কেন নিজের গলায় জোর আর কথায় তেজটা বজায় রেখো।সেই সমস্যা তাড়াতাড়ি সলভ হোক আর না হোক,অপরপক্ষ বিভ্রান্ত হবেই।আর তোমাকে এই কথা মনে রাখতেই হবে কেননা তুমি এমন একজনের স্ত্রী যার জন্য তোমায় পদে পদে বিপদের সম্মুখীন হতে হবে।

চলবে…