হৃদয়েশ্বরী পরর -৩৩+৩৪

0
1038

#হৃদয়েশ্বরী
#লেখিকা-সাদিয়া মেহরুজ দোলা
#পর্ব-৩৩
___________

-‘ ক্যাম্পে ফিরবেন না? রাত অনেক হচ্ছে। ‘

মীরার মিহি কন্ঠস্বর। উশান জবাব দিলো না। বরঞ্চ আরেকটু নিবিড় ভাবে মীরাকে বক্ষঃস্থলের সাথে চেপে ধরলো। মীরা ধরেই নিলো এবার তার হাড়গোড় সব ভেঙে চুরমার হবে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। তবুও মুখ ফুটে বলল না উশানকে সরে যেতে। উশান তার কাধেঁ মাথা রেখে আঁখিজোড়া বন্ধ করে আছে। ঘন ঘন শ্বাস টেনে তার কেশের সুঘ্রাণ নিচ্ছে। কেশের এক গুচ্ছ উশানের হাতের মুঠোয় বন্দী। খানিকক্ষণ বাদে কন্ঠের খাদ নামিয়ে উশান প্রশ্ন করলো,

-‘ কি শ্যাম্পু ইউজ করো চুলে? আমিও এই শ্যাম্পু ইউজ করবো। তাহলে যখন তোমাকে মিস করবো তখন নিজের মাথায় চুল কেটে ঘ্রাণ নিয়ে এটলিষ্ট একটু হলেও অস্থিরতা কমবে। ‘

মীরা গলায় শব্দ কর হাসলো। নম্র হাতে উশানের মাথায় হাত দিয়ে হাস্যরত অবস্থায় বলল,

-‘ আপনার মাথায় চুল আছে যে কাটবেন? ‘

নাক মুখ কুঁচকে নিলো উশান। আসলেই তো! তার মাথায় চুল কোথায় যে কাটবে? তাদের চুল বড় রাখার নিয়ম নেই। একটুখানি চুল বড় হতে নিলেই কেটে ফেলতে হয়৷ কিয়ৎ সময়ের সুখে থাকার প্রক্রিয়াটা বিফলে গেলো ভাবার পর উশান তপ্তশ্বাস ছাড়লো সময় নিয়ে। বক্ষঃস্থলে মিইয়ে থাকা মীরাকে দুই হাতে আগলে ধরলো। ঘন, কাঁধ পর্যন্ত মীরার চুল গুলোতে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,

-‘ তোমার চুল এতো ঘন কিন্তু ছোট কেনো মীরা? ‘

-‘ কেটে ফেলি। বড় চুল ভালো লাগেনা। ‘

-‘ কিন্তু আমার যে লম্বা চুল পছন্দ। ‘

ভরাট কন্ঠ! মীরার গা শিরশিরিয়ে উঠলো। লোকটার আসক্তি মাখা কন্ঠ এতো চমৎকার কেনো? শ্রবণ করা মাত্রই যেনো হাত – পা হিম হয়ে আসে সম্পূর্ণ।শান্ত বক্ষঃস্থলে উথাল-পাতাল ঝড় বয়ে যায়। মীরা ঘোরে থাকলো কিয়ংদশ। অতঃপর বলল,

-‘ এখন থেকে বড় হলে আর কাটবো না। ‘

জবাব আসলো না কোনো। মীরা হাত ঘড়িতে সময় দেখলো। তৎক্ষনাৎ আঁতকে উঠলো সে। ছিটঁকে সরে গেলো উষ্ণ আলিঙ্গন হতে। উশান একটু চমকে যায়! বলে,

-‘ কি হয়েছে? ‘

মীরা ঘড়ি দেখিয়ে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,

-‘ দেখুন! ১২ টা বেজে গিয়েছে। ঐ বিল্ডিংটায় আগে থেকেই বলা ছিলো ১২ টার পর আর প্রবেশ করা যাবেনা ভিতরে। ‘

স্থির ওষ্ঠাধর প্রসারিত হয়ে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। মীরা ভ্র কুঁচকে নেয়! লোকটা হাসছে!কেনো? আশ্চর্য!

-‘ আপনি হাসছেন কেনো? এতো রাত! কোথায় যাবো আমি? ‘

উশান অধর যুগল কোণে হাসি বজায় রেখে ক্ষীণ সুরে বলল,

-‘ কেনো আমি আছিনা? আমার সাথে যাবে। ‘

-‘ কি? পাগল! আপনার ক্যাম্পে গিয়ে আমি কি করবো? আর ওখানে আমাকে ঢুকতে দিবে? ‘

-‘ বোকা মেয়ে! ক্যাম্পে কেনো যাবো? ‘

মীরা ললাটে ভাজ ফেলে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় সে। তারই ভুল! যদি একটু খেয়াল রাখতো। তখন বেশ আবেগপ্রবণ হয়ে উশানকে জরীয়ে ধরে অনেকক্ষণ কেঁদেছিলো। তাদের দু’জনের এতোটা সময় কেটেছে বাহুডোরে আবদ্ধ হয়ে। সময়ের পরিধি সম্পর্কে খেয়ালই ছিলো না। এক অদৃশ্য, সম্মোহনী মোহে আঁটকে ছিলো দু’জন।

মীরা জিজ্ঞেস করলো,

-‘ তবে কোথায়া যাবো? আর আপনি না ট্রেনিং নিতে এসেছেন। এভাবে ক্যাম্পে না ফিরলে সমস্যা হবে না। ‘

উশান উঠে দাঁড়ালো। পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে উত্তর দিলো,

-‘ হবে না। আই উইল ম্যানেজ। বসো এখানে। আসছি আমি। ‘

পূর্ণিমার তখন দ্বিতীয় দিন৷ আঁধারে বিলীন অম্বরে চাঁদের দর্শন মিললেও তার রশ্মি এসে পৌঁছায়নি এখানে। আশপাশের কৃত্রিম রশ্মির প্রকোপে চাদের রশ্মি কোনটা আর কৃত্রিম রশ্মি কোনটা তা পৃথক করা কঠিন। মীরা বিরক্ত হয়! ক্যালিফোর্নিয়া অথবা বাহিরের দেশ তার এজন্য ভালো লাগেনা। সহ্য হয় না। বেঞ্চিতে পা গুটিয়ে বসেছিলো সে। এতক্ষণ পর পা দু’টো ভূমি স্পর্শ করালো। চিনচিন করছে।পুরো একসময়, একাধারে বসে থাকার কারণে পা দু’টো অবশ হয়ে এসেছে। উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটাহাটিঁ করলো। অদূরে দেখলো উশান আসছে। সে মীরার নিকটে পৌঁছে বলল,

-‘ চলো। ‘

মীরা পাল্টা প্রশ্ন করে চটপট,

-‘ কোথায় যাবো?’

-‘ বেশি প্রশ্ন করো মেয়ে। চলো আগে! গেলেই দেখতে পাবে। ‘

বাইকে করে আধাঘন্টার মাঝখানে বিলাসবহুল এক বাংলোর সামনে এসে থামে বাইক। মীরা তার নেত্র যুগল বড়সড় করে দেখছে সম্মুখ। দর্শন করা শেষে কৌতূহলী কন্ঠে বলল,

-‘ এটা কার বাংলো? এখানে কেনো এসেছি? ‘

উশান মাথার হেলমেট খুলতে খুলতে প্রতিত্তুর করলো,

-‘ আমার ফ্রেন্ডের। আজ রাতটা এখানে থাকবো। ‘

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিংবেলে প্রেস করলো না উশান।দরজার পাশে থাকা টাচস্ক্রীনে ফটাফট কয়েকটা সংখ্যা বসিয়ে দিলো। অতঃপর ক্যাচ করে একটা শব্দ প্রতিধ্বনিত হলো। স্ক্রিনে লিখা উঠলো,
‘ Password Matched ‘ দরজা খুলে যাওয়ার পর মীরার হাত নম্র ভাবে ধরে উশান অন্তর্ভাগে প্রবেশ করলো। চারিপাশে আলিশান ভাব! দেখতে কিছুটা রাজ প্রাসাদের মতো লাগল মীরার নিকট। কিয়ৎ দূর যেতেই একটা পাঁচ বছর বয়সী বাচ্চা ছুটে এসে উশানের পা জরিয়ে ধরে চেঁচিয়ে বলল,

-‘ হ্যান্ডসাম চাচ্চু ইজ ব্যাক? ‘

আলগোছে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে তার গালে চুমু খায় উশান। হৃষ্টচিত্তে জবাব দেয়,

-‘ ইয়েস! হাউ আর ইউ টুইঙ্কেল? মিস মি? ‘

-‘ মিস’ড ইউ লট চাচু। ‘

-‘ হোয়ার ইজ ইউর পাপা টুইঙ্কেল? ‘

-‘ ড্যাড ইন দ্যা ওয়াশরুম। হি ইজ কামিং! ‘

টুইঙ্কেল লাফিয়ে উশানের কোল থেকে নামলো। মীরার সামনে দাঁড়িয়ে চোখ গোল গোল করে ওকে দেখলো কিছুক্ষণ। অতঃপর জিজ্ঞেস করলো,

-‘ হু ইজ সি? ইউর ওয়াইফ? ‘

-‘ উডবি ওয়াইফ। প্রিন্সেস! ‘

-‘ ওয়াও। সি ইজ টু মাচ কিউট চাচু। ‘

নিরুত্তর, নির্বাক রূপে উশান আর টুইঙ্কেলের কথোপকথন শ্রবণ করছে মীরা। এতটুকু বাচ্চা মেয়ে! সে কিনা ওয়াইফ মানে বোঝে? অবশ্য আমেরিকা বলে কথা। নিজেকে আশ্বাস দিয়ে টুইঙ্কেল কে কোলে তুললো মীরা। মিষ্টি হেঁসে প্রশ্ন করলো,

-‘ হোয়াট ইজ ইউর নেম কিউটি? ‘

-‘ টুইঙ্কেল! টুইঙ্কেল ইফরাদ। এন্ড ইউর? ‘

-‘ মীরা। তাঈরাত ইমরোজ মীরা। ‘

টুইঙ্কেল মীরার গালে ফটাফট দুটো চুমু খেলো।বলল,

-‘ সুইট নেম। ‘

সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো সুদর্শন এক পুরুষ। মীরা ধারণা করলো সে টুইঙ্কেলের বাবা এবং উশানের সেই কাঙ্খিত বন্ধু। লোকটা নেমে এসে উশানকে জরিয়ে ধরলো। শেষে মুচকি হেঁসে বলল,

-‘ ফাইনালি আসলি তুই আমার বাসায়? থ্যাংক্স টু ভাবী হাহ্?তারজন্যই এই প্রথমবার আমার বাসায় তোর আসা। ‘

লোকটি তাকালো এবার মীরার পানে। বলল,

-‘ আসসালামু আলাইকুম আপু। আমি ইফরাদ! ‘

মীরা হেঁসে সালামের জবাব নিলো। নিজের নাম বলে আবারও চুপ সে। ইফরাদ – উশান কথা বলতে বলতে সামনে এগোল। মীরা যায় তাদের পিছু পিছু। টুইঙ্কেল তখন মীরার কোলে। মীরার চুল নিয়ে কিছু একটা করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। মীরা গভীর চোখে একবার তা দেখে বলে উঠলো,

-‘ হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট টু ডু উইথ মাই হেয়ার? ‘

-‘ উ..হু! নাথিং ‘

.

টুইঙ্কেলের সাথে মীরার সখ্যতা গড়ে উঠলো যেনো অল্প খানেক সময়ের মধ্যেই। রাতের খাবার মীরার হাতে খেয়ে টুইঙ্কেল অনাবশ্যক জেদ ধরে সে মীরার সঙ্গে ঘুমোবে। ইফরাদ মেয়েকে বুঝিয়ে, শুনিয়ে, ধমকে – ধামকেও নিজের সাথে নিতে পারেনি। শেষে সে হাল ছেড়ে বলল,

-‘ ভাবি? আপনার কি সমস্যা হবে টুইঙ্কেল আপনার সাথে ঘুমোলে? সমস্যা না হলে আজ রাতের জন্য নাহয় ও আপনার সাথে ঘুমোক। মেয়েটা আজ একটু বেশিই জেদ করছে। এর আগে কখনো এমন করেনি। আজ কি হয়েছে বুঝতে পারছি না। ‘

মীরা মৃদু কন্ঠে আশ্বাস দিয়ে বলল,

-‘ নাহ ভাইয়া। কিসের সমস্যা? আপনি গিয়ে নাহয় নিজের কাজ করুন। টুইঙ্কেল আজ আমার সাথেই থাক। ‘

ইফরাদ উশানের সাথে কথা বলতে বলতে বাহিরে চলে যায়। তারা রুম থেকে চলে যেতেই মীরা ব্যাস্ত হয় টুইঙ্কেল কে ঘুম পাড়াতে৷ মেয়েটাকে ঘুম পাড়াতে তেমন একটা বেগ পেতে হয়না তার। ক্ষীণ সময়ের মাঝেই মীরাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জরিয়ে ধরে টুইঙ্কেল ঘুমে বিভোর। কিয়ৎক্ষণ পর মীরা টুইঙ্কেল এর পাশ থেকে সন্তপর্ণে উঠে দাঁড়িয়ে বারান্দায় গিয়ে বসলো। ফোন বের করে রুহিকে নিজের অবস্থান বলল। নাহলে নিশ্চিত মেয়েটা চিন্তায় পাগল হয়ে যাবে! কথা বলা শেষে কল কেটে উঠতে নিবে তৎক্ষনাৎ কোথা থেকে উশান এসে তার কোলে এসে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লো। মীরা একটু ভড়কায়। নিজেকে সামলে নিয়ে প্রশ্ন করে,

-‘ আপনি এখানে? ‘

উশান নির্লিপ্ত! সে পকেট হাতিয়ে একটা কাগজ আর কলম বের করে মীরার সামনে থাকা সেন্টার টেবিলের ওপর রাখলো। অতঃপর বলল,

-‘ কাগজটায় দ্রুত সাইন করো তো মীরা। ভাজ খুলবে না। ‘

মীরা ভ্রু কুঁচকে সন্দিহান গলায় বলল,

-‘ কিসের কাগজ এটা? আমার সাইন-ই বা কেনো দরকার এতে? ‘

-‘ দরকার আছে বলেই তো সাইন করতে বলছি।দ্রুত করো। আমার তাড়া আছে। ‘

-‘ ভাজ খুলে একটু পড়ে দেখি? ‘

চট করে উঠে বসলো উশান। মুখোশ্রীর অভিব্যাক্তী বদলালো ক্ষীণ। চেহারায় এলো থমথমে ভাব৷গম্ভীর গলায় ফের বলল,

-‘ তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করো না মেয়ে? ওকে দ্যান ফাইন! চলে যাই আমি? সাইন করার দরকার নেই। ‘

কাগজ তুলে উশান উঠতে নিলে মীরা ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে বলল,

-‘ আরে আশ্চর্য! এভাবে বলছেন কেনো? দিন আমি করে দিচ্ছি সিগনেচার। ‘

কলম হাতে ধীরে সুস্থে মীরা সিগনেচার করলো।অতঃপর কাগজ, কলম ফিরিয়ে দিলো উশানের কাছে। উশান বসলো। মীরার দিকে একটু নিবিড় হয়ে। কয়েকক্ষণ নীরবতায় কেটে যাওয়ার পর হুট করে উশান মীরার গাল ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিলো৷ আচানক মীরার খয়েরী বর্ণের অধর জোড়া আঁকড়ে নিলো নিজ ওষ্ঠাধরের মাঝে। মীরা থমকালো! ভীষণ চমকালো! হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রইল উশানের বদ্ধ নেত্র যুগলের পানে।

চলবে…

( রি – চেইক ছাড়া পর্ব! এটা বোনাস পার্ট..😒)

#হৃদয়েশ্বরী
#লেখিকা-সাদিয়া মেহরুজ দোলা
#পর্ব-৩৪
__________

অপরাহ্নের প্রথম প্রহর। রক্তিম বর্ণের অন্তরীক্ষের নিচে দল বেঁধে পুঞ্জ পুঞ্জ শুভ্র মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে। মেঘের আড়ালে সময়ের ঢাকা পড়েছে হরিদ্রা সূর্য। সময়ের তালে তালে সে নিজের বিদায় বার্তা জানাচ্ছে। সমীরে তখনও নিদারুণ তপ্ততা।দ্রুত পদে নিত্যপর্নের দোকান থেকে বের হলো মীরা। জলদি বাসায় ফিরতে হবে। ক্লাস শুরু হতে না হতেই ক্লাস টেস্টের রুটিন দিয়েছে তার৷ পরিক্ষা গুলো গুরুত্বপূর্ণ বেশ। এখনো তেমন প্রস্তুতিই নেয়া হয়নি। মীরা হাঁটা ধরলো তপ্ত রৌদ্দুরের মাঝেই। এখানকার গাড়ি ভাড়া খুব বেশিই বলা চলে। তার স্বল্প আয়! এভাবে টাকা নষ্ট করার মানে আছে? অন্তরীক্ষ হুট করে মেঘবর্ণ রূপ ধারণ করলো। দানবীয় শব্দধ্বনি থেমে থেমে আছড়ে পড়ছে। মনে হয় রৌদ্দুরের উত্তপ্তায় অতিষ্ঠ হওয়া মানুষদের স্বস্তি প্রদানের জন্য বৃষ্টি আসবে।

মীরা লম্বা লম্বা কদম ফেলে হাঁটছে। তার পদচারণ ক্ষণে ক্ষণে বৃদ্ধি পাচ্ছে তো আবার কমে আসছে। বর্তমানে তার মন ও মস্তিষ্কের সকল নিউরন অন্যত্রে পড়ে। তারা গহীন চিন্তায় মগ্ন। মীরা বেশ মনোযোগ সহকারে ভাবছিলো উশানের কথা। লোকটার সাথে তার যোগাযোগ, কোনোরূপ কথাবার্তা নেই আজ এক সপ্তাহের মতো হবে। সেদিনটায় ক্যাম্প ফেলে অন্যত্রে এক রাত্রি যাপন করার পর ওপর হতে নির্দেশ এসেছে উশানের হটাৎ এরূপ কর্মে তাকে শাস্তি দেয়া হবে! ঐদিনটায় গুরুত্বপূর্ণ এক ট্রেনিং ছিলো উশান তা মিস করেছে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে তাকে এক সপ্তাহ কড়া নিয়মকানুনের মাঝে থাকতে হবে। সঠিক সময় মতো খাওয়া দাওয়া করা যাবে না। ঘুম তো বাদই! ক্যাম্পের বাহিরে যাওয়া যাবেনা গুনে গুনে আটদিন৷ পরিবারের কারো সাথে এই ৮ দিন যোগাযোগ বিছিন্ন রাখতে হবে। এই শাস্তির ব্যাপারে মীরাকে বলেছে তীব্র। উশান বলতে বলেছে তাই। নয়তো নিশ্চিত মেয়েটা চিন্তায় আধমরা হয়ে যেতো।

মীরা চরম আহত হয় যখন এই বার্তা তার কর্ণগোচর হয়। তার মতে, লোকটা তারজন্য কষ্ট পাচ্ছে! সে যদি উশানের ফোন রিসিভ করতো, কথা বলতো, তাহলে নিশ্চিত লোকটা নিজের গুরুত্বপূর্ণ ট্রেনিং ফেলে সেখানে আসতো না। এটা ভাবার পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নেয় মীরা। যে যা প্রাপ্য তাকে তো তাই দেয়া উচিত। তাই না? তপ্তশ্বাস ছাড়লো মীরা। বিড়বিড়িয়ে বলল,

-‘ আপনাকে ছাড়া এক – একটা মূর্হত যে আমার নরক যন্ত্রণা সমেত মনে হচ্ছে। আমি বাকি জীবনটা কাটাবো কি করে? বলুন তো শেহজাদা! ‘

হাঁটার গতি বাড়লো। মস্তিষ্কের নিউরনে আঁটকে থাকা সেই সুন্দর দিনটার কথা মনে করলো মীরা ফের আরো একবার। লাজুক নেত্রে দৃষ্টি নত করলো তৎক্ষনাৎ। উশানের স্পর্শ! অনাকাঙ্ক্ষিত সেই স্পর্শ তার দেহে এখনো কাঁপুনি তৈরি করে। সে কি ভয়ংকর অনুভূতি। তবে পরবর্তীতে যখন স্পর্শটার অধিকারের দিকটা খুঁজতে যায়। তখন? তখন তার অন্তঃকরণ, বক্ষঃস্থল অদৃশ্য কষ্টে জর্জরিত হয়। সে নাহয় প্রথমদিন আবেগের বশে উশানকে জরিয়ে ধরেছিলো। কিন্তু পরবর্তী দিন গুলোতে তো দূরত্ব বজায় রেখে চলতো। তাদের মাঝে যে এখনো কোনো পবিত্র সম্পর্ক গড়ে উঠেনি। পরিণয় হয়নি!তাহলে সেই স্পর্শের কি নাম দেবে সে?

আচানক ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো। ক্যালিফোর্নিয়ার উত্তপ্ত ভূমি শীতল হতে লাগলো। মীরা সকল চিন্তা দূরে ফেলে হাতের ব্যাগ গুলো ভূমিতে ফেললো শব্দ করে। দুই হাত দু’দিকে ছড়িয়ে দিয়ে অন্তরীক্ষের পানে চেয়ে নেত্রজোড়া বন্ধ করে নিলো। আহা বৃষ্টি! পরম শান্তির বৃষ্টি! বৃষ্টিবিলাসে মত্ত হলো সে। অদূরে নাম না জানা গাছে বসে থাকা নীলচে রঙের পাখি দু’টোও বোধহয় মুগ্ধ হয়ে দর্শন করলো শ্যাম কন্যার বৃষ্টিবিলাস।

___

শুভ্র প্রভাতের আগমন ঘটেছে কিয়ৎকাল পূর্বেই। তখন সময় ছয়টা ছুঁই ছুঁই! অত্যান্ত তাড়াহুড়ো করে বরফ সমেত ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করে মাত্র বাথরুম থেকে বের হলো উজান।তার কোমড়ে তোয়ালে পেঁচানো। শরীরে বাকি পোশাক বলতে আর কিছুই নেই। ঠান্ডায় এক প্রকার দাঁতে দাঁত লেগে আসছে তার। কাল রাতে অবিরত বর্ষণ বর্ষিত হওয়ার দরুন পানি এতোটা ঠান্ডা হয়ে রয়েছে।বাম হাত দিয়ে অন্য আরেক তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে সবেই কক্ষের মাঝখানে এলো তৎক্ষনাৎ কোনো নারীর বিকট এক চিৎকার কর্ণপাত করে হাত ফসকে উজানের তোয়ালে পড়ে গেলো ভূমিতে।

-‘ ও মাই গড! ছিহঃ! এটা আমি কি দেখলাম। ‘

সিয়া উজানকে এক পলক দেখে চটজলদি উল্টো ঘুরে দাঁড়ালো। উজান ভীষণ চমকে দ্রুত করে বিছানায় পড়ে থাকা সবুজ রঙের কাপড়টা নিজের সহিত পেঁচিয়ে নিলো। অতঃপর প্রশ্ন ছুড়লো,

-‘ কি আশ্চর্য! মিস লাফালাফি? আপনি এতো সকালে আমার ফ্লাটে, আমার রুমে কি করছেন? ‘

সিয়া উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে বসলো,

-‘ আগে বলুন। আপনি কি গায়ে পোশাক জরিয়েছেন? আমি কি ঘুরবো? ‘

-‘ অবশ্যই। আমি ব্যাঙদের মতো নির্লজ্জ নই যে যার তার রুমে হুটহাট প্রবেশ করবো। ‘

সিয়া চটে গেলো প্রচন্ড পরিমাণে। তিক্ত কন্ঠে বলল,

-‘ আপনি আবার! আবার আমাকে ব্যাঙ বলছেন? আচ্ছা আমাকে কোন এঙ্গেলে আমাকে ব্যাঙের মতো লাগে বলুন তো? আমি কি ব্যাঙের মতো দেখতে নাকি ব্যাঙের মতো ‘ ঘ্যাঙর! ঘ্যাঙর! করে ডাকি? ‘

ওষ্ঠ দ্বারা অধর চেপে মৃদু হাসলো উজান। বলল,

-‘ ব্যাঙের মতো দেখতে কিনা জানিনা। কিন্তু মাত্রই তো ব্যাঙের মতো করে ডেকে দেখালেন। আর কি লাগে? প্রমাণ হলো তো আপনি ব্যাঙ। এন্ড মিস! আপনি কিন্তু দারুণ ডাকতে পারেন ব্যাঙের মতো। ‘

রুষ্ট চাহনি নিক্ষেপ করলো সিয়া। কটমট করে কিছু বলতে নিয়েও থেমে গেলো। লোকটা তাকে কথার জালে ফাঁসাচ্ছে। দারুণ চালাক মানব তো!

মৌনতা বজায়। নীরবতা ধ্বংস করে উজান বলে উঠলো,

-‘ কিসের জন্য আমার ফ্লাটে এসেছেন বললেন না তো মিস. ব্যাঙ? আর আমার বাসার ঠিকানা পেলেন কোথায়?ফ্লাটের দরজাই বা কে খুলে দিল?’

উজানকে মাথা হতে পা পর্যন্ত পরখ করে সিয়া বাঁকা হাসি দিলো। হাসিটা দর্শন করা মাত্র ভ্র কুঁচকে নেয় উজান। মেয়েটার মাথায় আবার কি শয়তানী ঢুকলো? কে জানে! দুই কদম এগোল সিয়া।ক্ষীণ সুরে বলল,

-‘ উম.., এসেছিলাম তো এক কাজে। কিন্তু এখানে এসে যে আপনাকে হাফ লেডিস অবস্থাতে দেখবো তা কে জানতো? জানলে আরো আগে আসতাম আমি। ইশ! দারুণ বিনোদন দিলেন সকাল সকাল উজান সাহেব। ‘

হকচকিয়ে নিজের প্রতি দৃষ্টিপাত ফেললো উজান। তৎক্ষনাৎ তার চক্ষু ছানাবড়া।তাড়াহুড়ো করে এটা কি গায়ে জরিয়েছে সে?উমাইশার শাড়ী? মাই গড!কি লজ্জাজনক ব্যাপার-স্যাপার। উজান উঠে পড়ে দৌড় লাগালো বাথরুমে। সিয়ার অবস্থা তখন হাসতে হাসতে নাজেহাল। ফুলো ফুলো গাল দু’টো তার হাসতে হাসতে ব্যাথায় জর্জরিত হয়ে নাজেহাল অবস্থা। তবুও হাসি যেনো থামার নামই নিচ্ছে না।

___

তখন সায়ংকাল। অম্বর জুড়ে ক্ষীণ নীলাভাব বজায় রয়েছে। ক্ষণকালে সেইটুকুও বিদায় নিচ্ছে ধীরে ধীরে। অম্বরের এক কোণে টিমটিম করে জ্বলছে সন্ধ্যাতারা। শীতল সমীরের সাইঁ সাইঁ পদচারণ।এক ফালি চাঁদের রশ্মি প্রতিফলিত হয়েছে নিখুঁত ভাবে মীরার বাসার সামনের সুইমিং পুলে। অত্যান্ত মনোযোগ সহিত মীরা তাই লক্ষ করছিলো এতক্ষণ যাবৎ। মাঝেমধ্যে মৃদু শব্দে মুখোশ্রী কুঁচকে হাঁচি দিচ্ছে। রুহি গম্ভীর মুখে বসে। মীরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠলো,

-‘ আর কতক্ষণ এমনে বসে থাকবি? সরি বললাম তো নাকি? প্রমিস ইয়ার..! আর ভিজবোনা বৃষ্টিতে। একটু নরমাল হ এবার। ‘

জবাবহীন রুহি। নিরবে প্রস্থান করলো কক্ষ হতে। মীরা হতাশ হয়! মেয়েটা এতো রাগছে কেনো?একটু তো বৃষ্টিতেই ভিজেছে। সু’ই’সাইড তো আর করার চেষ্টা করেনি আশ্চর্য!
কিয়ংদশ বাদে রুহি আসলো। মীরার পায়ে ধপ করে বসলো। হাতে তার এলোমেলো ধোঁয়া উড়ন্ত কফির মগ। মীরার হাতে মগ দিয়ে হতাশ কন্ঠে বলল,

-‘ গম্ভীর স্বভাবের এক্টিং করা এতো কঠিন ক্যান জান? ভাবছিলাম আজ সারাদিন তোর ওপর রাগ কইরা গম্ভীর হয়ে থাকমু। পারলাম না! নাকে কেমন উশখুশ করে। ‘

কফি গলাধঃকরণ করতে করতে মীরা হটাৎ কেশে উঠলো। জিজ্ঞেস করলো,

-‘ গম্ভীরের এক্টিং এর সাথে নাকের কি সম্পর্ক? আশ্চর্য! ‘

-‘ আছে। আছে। বুঝবানা তুমি। খাও এখন জলদি। আমি একটু আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে কথা বইলা আসি। ‘

মীরা বাম ভ্রু উঁচু করে বলল,

-‘ নতুন? কবে হলো? ‘

রুহি একটু লাজুকলতা রূপ ধরার ভাঙ ধরলো। হলো না! দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে থেমে থেমে বলল,

-‘ এইতো কয়েকদিন। কাহিনি দেখছো বেইব? আমি লজ্জা পাওয়ার ও এক্টিং করতে পারিনা। কি মুশকিল! ‘

কৌতূক শুনেছে! এমনিভাবে হাসলো মীরা৷ রুহি ততক্ষণে ফোন হাতে নিয়ে পাশের কক্ষে চলে গিয়েছে। মীরা উঠে দাঁড়ালো৷ উদ্দেশ্য তার কিচেন।হাতের কফির মগটা ধৌত করা প্রয়োজন।পথিমধ্যে যেতেই আচানক ফোনের ম্যাসেজ টোন কর্ণপাত হলো। ফিরে আসা বৃদ্ধা আঙুল দ্বারা টাচস্ক্রিনে স্পর্শ করতেই তার নেত্র সম্মুখে দৃশ্যমান হলো ইংরেজি বর্ণমালার মাধ্যমে প্রেরিত ছোট্ট একটা বার্তা। বার্তাটি কিছুটা এরূপ,

-‘ Come to the ground floor. I’m waiting for you. Come first. ‘

ফোন, হাতের কফি মগটা অবিন্যস্ত রূপে পড়ে রইল ম্যাট্রেসের ওপর। ধপাধপ পা ফেলার শব্দে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলো৷ অনেকটা ‘ হাওয়ায় উড়ে ‘ কথাটার মতো করেই মীরা বাতাসের বেগে ছুটলো গ্রাউন্ড ফ্লোরে। কাঙ্ক্ষিত স্থানে পৌঁছানোর পরই হাঁপাতে হাঁপাতে চারপাশে নজর বুলালো। কোথায় সে? সটান হয়ে দাঁড়িয়ে সামনে এগোতেই বাঁধা প্রদান করা হলো পেছন হতে৷ এক জোড়া শক্তপোক্ত হাত তাকে পিছন থেকে জরিয়ে ধরলো। চিবুক এসে স্থাপন হলো তার কাঁধে। এযে উশান! মীরার তা বুঝতে বেগ পেতে হলো না। ক্ষীণ সময় বাদে ভরাট কন্ঠে উশান বলে উঠলো,

-‘ আ’ম হেয়ার ম্যাডাম। আ’ম হেয়ার! ‘

চলবে…