হৃদয়েশ্বরী পর্ব-১৬+১৭

0
1203

#হৃদয়েশ্বরী
#লেখিকা- সাদিয়া মেহরুজ দোলা
#পর্ব–১৬

-‘ তখন আমায় বয়স ১২। সাইকেল চালাতে গিয়ে ভুলবশত এক্সিডেন্ট হয় আমার। তারপর থেকেই হাঁটুর ব্যাথার যন্ত্রণা। আম্মু প্রায়শই ঔষধ বলে আমায় একটা ইনজেকশন দিতো। ছোট ছিলাম তখন। ভেবে নিয়েছিলাম ঔষধই হবে।কিন্তু নাহ। আম্মু সেদিন থেকেই ঔষধের নাম করে আমায় ড্রাগ দিতো। ড্রাগের বিষয়টা জানতে পারি এইচএসসি পরিক্ষা যখন দিচ্ছিলাম। আম্মু ফোনে কারো সাথে বলছিলো আমায় ড্রাগ দেয়ার কথা। লুকিয়ে শুনে নিয়েছিলাম। লম্বা সময় নিয়ে ড্রাগ দেয়ার জন্য আমি নিজের মাঝে থাকতাম না। আমার মস্তিষ্ক ছিলো তখন আম্মুর দখলে। যখন আম্মু আমায় যা করতে বলতো তাই করতাম। উশান! ভাই, তোকে যে দুই দুইবার ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে চেয়েছি আরো অনেক ভাবে আহত করতে চেয়েছি সব আম্মুর কথায়। নিজেকে তখন আমি কন্ট্রোল করতে পারতাম না। ড্রাগ নিতে নিতে আমার শরীর প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছিলো। কাওকে কিছু বলতে পারতাম না। বলতে গেলে আম্মু শিকল দিয়ে পেটাতো। তারপর একদিন শুনলাম আম্মু আমায় বিক্রি করে দেয়ার চিন্তা – ভাবনা করছে। দেহ ব্যাবসায় এলিয়ে দিতে চাইছে। সেদিন খুব সাহস করে, নিজের মস্তিষ্কের সাথে যুদ্ধ করে পারি দিলাম কলকাতা। আমার কাছে টাকা ছিলো না। জীবনে প্রথমবার জান, ইজ্জত বাঁচাতে সোনা, টাকা নিয়ে পালিয়ে গেলাম। তখন আমার মস্তিষ্কে ছিলো না কাওকে কিছু বলা উচিত। শুধু মনে হচ্ছিলো বাংলাদেশ ছাড়তে হবে। এই নরক থেকে বের হতে হবে৷ কলকাতায় হোটেলে কাজ করতাম। ছোট একটা বাসা ভাড়া করে থাকতাম। শরীর, মন, মস্তিষ্ক যখন সুস্থ হলো তখন মনে হলো বাংলাদেশে ফেরা উচিত। ফিরে শুনি আম্মু সবার কাছে রটিয়েছে আমি এক ছেলের সাথে পালিয়েছি। কিছু বলিনি। মুখ বুজে সহ্য করে তোর ঠিকানা জোগাড় করেছি।তারপর এখানে আসা। আমায় মাফ করে উশান। আমি সত্যিই তোকে কখনো নিজ ইচ্ছেতে প্রাণে মেরে ফেলতে চাইনি। ‘

উমাইশা হু হু করে কেঁদে উঠলো। উপস্থিত ছয় জন ব্যাক্তি তখন নিস্তব্ধ। অন্তরাত্মা কাঁপছে। মস্তিষ্কের অবস্থা বেহাল তাদের। নিজের আপন জন্মদাত্রী মা কখনো সন্তানের সাথে এতোটা কলুষিত আচরণ করতে পারে? একজন মানুষ, একজন মা হিসেবে কতোটা ভয়ংকর ঊষা তা আবারও প্রমাণিত হলো! প্রতিটা সন্তানের প্রশ্রয়স্থল, স্বস্তির স্থান, ভরসাযোগ্য ব্যাক্তি এবং সকল ঝামেলা থেকে শান্তি প্রদানের অন্যতম ব্যাক্তি হয় ‘ মা ‘। দিনশেষে সেই মা যদি এতোটা কুৎসিত মনের হয় তাহলে সন্তানের কি হাল হবে? তীব্র কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,

-‘ ঊষা..! ইনি না একজন মা, না মানুষ। সে একজন নরপিশাচ। মায়ের জাতকে কলুষিত করেছে। ‘

উশান সবসময়কার মতো শান্ত। সর্ব পরিস্থিতিতে শান্ত থাকা তার একান্ত ব্যাক্তিত্ব। উজানের মতো রাগী নয় সে। নির্বিকার রূপে উশান এসে বসলো বোনের পাশে। আদুরে হাতে স্পর্শ করলো এক গুচ্ছ কৃষ্ণকালো কেশ। উমাইশা ক্রন্দনরত অবস্থায় উশানের বক্ষঃস্থলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে ক্রন্দনের পরিমাণ দ্বিগুণ হচ্ছে। মীরা উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,

-‘ আপু কাঁদবেন না প্লিজ। আপনার ক্ষতি হবে অনেক। এমনিতেই আপনি অনেক দূর্বল। ড্রাগ এফেক্ট আপনার হার্ট দূর্বল করে দিয়েছে। ‘

মীরা উশানকে ইশারায় উমাইশা কে শান্ত করাতে বলল। উশান কয়েকবার বলল বোনকে চুপ হতে, শান্ত হতে। কিন্তু উমাইশার অবস্থা বেগতিক। শেষে তপ্তশ্বাস ফেলে উশান দক্ষ হাতে উমাইশার কাঁধে ইনজেকশন পুশ করে দিলো। তৎক্ষনাৎ ঘুমে কাতর হয়ে পিছনে হেলে পড়লো উমাইশা। বোনকে সঠিক ভাবে শুইয়ে দিয়ে উঠে আসে উশান। সঙ্গে সঙ্গে দিগন্ত বলে উঠে,

-‘ স্যার? ম্যামকে এখন কোথায় রাখবেন? উমাইশা ম্যামের প্রাণ শঙ্কা রয়েছে। আর, ডাক্তার না বলল ম্যামকে স্বাভাবিক করতে খোলামেলা জায়গায় নিয়ে যেতে? ‘

উশান নিষ্প্রাণ কন্ঠে বলল,

-‘ মীরার সাথে আমরাও চট্রগ্রাম যাচ্ছি। প্রস্তুতি নাও সবাই। আপুকে ছদ্মবেশে নিয়ে যাবো। ঊষা তো ঢাকায়। চট্টগ্রাম নিয়ে আপুর মাইন্ড ফ্রেশও সহজে করা যাবে। ‘

উজান তৎক্ষনাৎ ফোড়ন কেটে বলল,

-‘ তোরা যা ভাই। আমি আসতে পারবো না। থানায় জরুরি কাজ আছে। আমি বরং তোদের সাথে সিক্রেট দু’জন পুলিশ দিয়ে দিবো। তোদের সর্বক্ষণ সুরক্ষা দিবে। ‘

-‘ পুলিশ দরকার নেই। গার্ড আছে আমার। ‘

-‘ অহ! তাহলে তো হলোই। আজ থাকছি। কাল সকালে যাবো। ‘

-‘ রেষ্ট কর। ঘুমিয়ে পড়তে পারিস সবাই। আমি জেগে আছি। আপুকে আমি দেখবো। ‘

সকলে সম্মতি জানায়। শুধু মীরা বাদে। সে জেদ ধরেছে উমাইশার পাশে থেকে আজ রাত নির্ঘুম কাটাবে। কয়েকবার চোখ রাঙানি দিলেও মীরা উশানকে তোয়াক্কা করেনি। পরিশেষে সকলে আলাদা রুমে চলে যায় ঘুমোতে। মীরা বেলকনিতে আসে। অতঃপর তার কিছুক্ষণ পর সেখানে উপস্থিত হয় উশান। এসেই গা এলিয়ে দেয় সে বেতের সোফায়। মীরা ভ্রু’কুটি কুঁচকে নিয়ে বলল,

-‘ আমার বানানো কফি খেতে পারেন না, তো এখন আমার বাসায় স্বাচ্ছন্দে থাকছেন কিভাবে? ‘

জবাব এলো খানিকক্ষণ বাদে। উশান ভরাট কন্ঠে বলল,

-‘ এটা শুধু তোর বাসা না মীরা। এটা রুহির ও বাসা।রুহিকে আমি নিজের ছোট বোনের মতো দেখি। ছোট বোনের বাসায় স্বাচ্ছন্দেই তো থাকা উচিত রাইট?’

মীরা ঠোঁট বাঁকিয়ে বহির্ভাগে দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে। লোকটা চালাক বেশ! সব প্রশ্নের উত্তর যেনো ঠোঁটের ডগায় থাকে।কখনোই সে উশানকে ঠিক মতোন কথার প্যাচে ফেলে কাবু করতে পারলো না। ব্যার্থতা! উশান অনায়াসে নেত্রযুগল বন্ধ করে নিয়েছে সেই কখন। যন্ত্রণা হচ্ছে মাথায়।

আশপাশ দেখায় ব্যাস্ত মীরা এক পলক উশানের পানে দৃষ্টি ফেলে। সঙ্গে সঙ্গে থমকানো অনুভূতি অনুভব হলো তার। বহু বছর পর আজ আবারও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার ইচ্ছে হলো পাথর মানবটাকে। উশানের গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের। সহজ বর্ণনায় তাকে হলুদ ফর্সা বলা চলে। বাদামী রঙের চুল। ঘন কালো নেত্র উপরের ভ্রু যুগল। প্রতিদিন কড়া নিয়মে শারীরিক ব্যায়াম করার ফলস্বরূপ ফিটফাট বডি। লম্বায়ও বিশাল। পাঁচ ফুট নয় তো হবেই মীরার বোধগম্য হলো। তবে কয়েকদিন ধরে মুখের সেই প্রাণোচ্ছল, সতেজতা নেই। মুখোশ্রী শুকিয়ে কাঠ। লালচে, বাদামী সংমিশ্রণের ওষ্ঠাধর যুগল শুষ্কতায় চৌচির। গালের চাপ দাঁড়ি বেড়েছে অনেক। শীতল অনিল শা শা শব্দে এসে বাদামী রঙা একগাছি কেশ উশানের মুখোশ্রীর ওপর এসে পড়লো। তবুও নেত্রযুগল উন্মুক্ত করার কোনো তাড়না নেই উশানের মাঝে। ঘুমিয়ে কুপোকাত নাকি?

দৃষ্টিপাত, গভীর চাহনি সরিয়ে অন্যত্রে ছুঁড়ে ফেলে মীরা। লোকটাকে দেখলে শ্বাস রুখে আসে। যদিও তেমন কোনো বিশেষত্ব নেই উশানের মুখোশ্রীতে। তবে চেহারায় উপচে পড়া মায়া আছে শতগুণ। এই দিকটা! মীরাকে পদে পদে আকৃষ্ট করে। দূর্বল করে ফেলে।

-‘ কাছে আয় তো মীরা। ‘ ভরাট কন্ঠ!

মীরা চমকিত হয়ে পিছনে ফিরলো। উশান তখন তার একহাত দিয়ে মাথার ঘন কালো কেশে হাত ডুবিয়ে চুল জোরে জোরে টানছে৷ মীরা চমকে বলে উঠলো,

-‘ কেনো? কিসের জন্য? কি কারণে? ‘

-‘ আয় তো আগে। তারপর বলছি। ‘ উশানের কন্ঠে যন্ত্রণার আভাস।

মীরা নিভলো। বক্ষঃস্থল কেমন চিনচিন করছে হুট করেই। লোকটার কন্ঠ এমন শোনালো কেনো?ত্রস্ত পায়ে এগোল মীরা। উশানের পাশের বেতের সোফায় গিয়ে বসলো সে। উদ্বেগ নিয়ে বলল,

-‘ আর ইউ ওকে? ‘

উশান নেত্রযুগল উন্মুক্ত করলো। নেত্র জোড়ার সাদা অংশ রক্তিম। টলমলে চাহনি। মীরা ভড়কালো। কি আশ্চর্য! এর আবার কি হলো? উশান কন্ঠের খাদ নামিয়ে বলল,

-‘ আমার মাথায় খুব যন্ত্রণা হচ্ছে মীরা। চারদিকের এতো এতো ঘটনা আমি আর নিতে পারছি না। একটা, একটা রিকুয়েষ্ট রাখবি? ‘

-‘ বলুন। ‘

-‘ একটু মাথা চেপে দিবি? শুধু চুলগুলো টানলেই হবে। স্পর্শ করতে না চাইলে করার বিন্দুমাত্র দরকার নেই। ‘

উশানের কন্ঠে আকুতি প্রকাশ পেলো। মীরা মনে মনে ভাবলো, ‘ আপনি এমন আকুতি – মিনুতি করে না বলে আমায় আদেশ স্বরূপ কথাটা বললেও আমি পালন করতাম আপনার আদেশ উশান। ‘

তন্মধ্যে কিয়ৎক্ষণ চুপ রইলো মীরা। তারপর উঠে চলে গেলো। উশান তপ্তশ্বাস ফেলে নেত্রযুগল ফের বন্ধ করে নিলো। এমনটাই প্রাপ্য সে। কম কষ্ট তো দেয়নি মেয়েটাকে। এখন কেনো আবার মীরা তাকে সাহায্য করবে?
কিয়ংদাশে বাদে! উশান তখন বদ্ধ আঁখিতে মাথার তীব্র যন্ত্রণা সহন করতে ব্যাস্ত। শীতল হাতের কোমল স্পর্শ তীব্রতর ভাবে সে টের পেলো নিজের কপালে। অতীব শীতল, ঠান্ডা, জ্বলুনি অনুভূত হলো তারপর স্বস্তি। মীরা মাথা ব্যাথা কমানোর জন্য মুভ আনতেই গিয়েছিলো ভিতরে। মাথায় ধীরস্থির হাতে তরল প্রলেপ লাগিয়ে আস্তে আস্তে চেপে দিতে থাকলো। উশান নেত্রপল্লব উন্মুক্ত করলো না। উন্মুক্ত করলেই বিপদ! তার চোখ কথা বলে, হাসে, কাঁদে, রাগ প্রকাশ করে, দুঃখ বিলাপ করে! আরও কত কি অনুভূতি প্রকাশ করে ফেলে।মনোযোগ দিয়ে দেখলে বোঝা যায় চোখের ভাষা তবে মনোবিজ্ঞানী ছাড়া স্পষ্টত কেও এই চাহনি সম্পর্কে সঠিক ধারণা রপ্ত করতে পারবে না। এদিকে মীরা তো মনোবিজ্ঞানের ছাত্রী। আপাতত যে অনুভূতি ফুটে উঠেছে তার নেত্র পাতায়। তা সে দেখাতে বিন্দুমাত্র ইচ্ছুক নয়৷

তারপর ঘোর নীরবতা পালন। মীরা মৌনতা ভেঙে বলল,

-‘ তূর্শীর সাথে আপনার সম্পর্ক কি বলুন তো? ও আপনাকে জ্বেলে কেনো পাঠালো তাও মেন্টালি হ্যারেজ করার মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে। ‘

উশান ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। মৃদু কন্ঠে বলল,

-‘ জেনে গেছো তাহলে। ওয়েল, সো! তূর্শী আমার এক্স গার্লফ্রেন্ড ছিলো। ‘

চলবে…

#হৃদয়েশ্বরী
#লেখিকাঃ সাদিয়া মেহরুজ দোলা
#পর্ব-১৭
_______

উশান, তূর্শীর প্রেমের সম্পর্কটা ছিলো দুই বছর পাচঁ মাসের। বেশ দীর্ঘ সময়! উশান এবং তূর্শী দু’জনের প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে হসপিটালে। বেসামাল রূপে বাইক চালাতে গিয়ে উশান এক্সিডেন্টের শিকার হলে তূর্শী তাকে মূর্মূর্ষ অবস্থাতে হাসপাতালে ভর্তি করে। সেদিনিই প্রথম সাক্ষাৎ দু’জনের। তূর্শী মাকে নিয়ে ঢাকাতেই থাকতো। উশানের বিল্ডিং এর পাশে ছিলো তার বাসা।ছাঁদ থেকে প্রায়সই চোখাচোখি হতো দু’জনের। কখনো কথা বলতো না উশান। তূ্র্শী আগ বাড়িয়ে কথা বলতে আসলে সে এড়িয়ে চলতো। নারী সঙ্গ পছন্দ না তার। যার দরুন এই কর্ম।

ব্যাবসার কাজে দেশের বাহিরে থাকা আয়মান একদিন হুট করেই উশানের ফ্লাটে এসে চমকে দেন।সাথে চমকপ্রদ বার্তার সাথে ছুঁড়ে দেন, তূর্শীর সাথে উশানের বিয়ে ঠিক করার ব্যাপারটা৷ উশান সর্ব প্রথম বাবার সিদ্ধান্তে ঘোর মতবিরোধ করার পরও কাজ হয়নি। তেমন কোনো জোর দিয়ে বাবাকে বলতে পারেনি বিয়ে করবো না। আয়মানের কথার খেলাপ করা উশানের পক্ষে সম্ভব নয়। তোরশার সাথে আলাপ করে ঠিক করেন উশান, তূর্শী নিজ পায়ে দাঁড়ালে তবেই তাদের বিয়ে হবে। বিয়ের ব্যাপারটা ওখানেই স্থগিত হলো। আয়মান ফিরে গেলো নিজের কর্মস্থলে। তারপর হতে উশান না চাইতেও তূর্শীকে ইগনোর করতে পারেনি। তরুণী তূর্শীর চঞ্চলতা, ম্যাচিউরিটি, চমৎকার সৌন্দর্য সব মিলিয়ে উশান নারী জাতির প্রতি বোধহয় সেইবার বহু বছর পর একটুখানি নম্র হলো। প্রণয়ের বাঁধনে একটু একটু করে আটকা পড়লো। দুই পরিবারের পক্ষ হতেই ‘ ম্যারিটিয়াল কোর্টশিপ ‘ এর অনুমতি ছিলো। ব্যাস! এখন আর বাঁধা কিসের? দু’জনে জরীয়ে পড়লো প্রণয়ের সম্পর্কে। আশেপাশের সকলের কাছে তখন তারা প্রেমিক – প্রেমিকা।উশান এর দিক থেকে প্রেমটা ছিলো পবিত্র, শুদ্ধতম। তবে তূর্শীর দিকটা ধোঁয়াশা কেবল।

উশান, তূর্শী নিয়ম করে প্রতিদিন সময় বের করে ঘুরতে যাওয়া। পার্কে হাত ধরে হাঁটা- হাঁটি, একসাথে শপিং করা, লেট নাইট লং ড্রাইভ! আরও কত কি। কিন্তু সময় বহমানের সহিত উশান খেয়াল করলো তূর্শীর বিশাল পরিবর্তন। ‘ ছলনা ‘ বলে এক নতুন শব্দ তার সাথে যুক্ত হলো বোধহয়। বছর দুয়েক পার হতেই তূর্শী সম্পর্কে আনমনা। উশানের সাথে পদে পদে অকারণে ঝগড়া, রাগারাগি প্রকাশ। হুট করে এমনটা হওয়ার কারণ উশান খুঁজে পেলো না। পাঁচ মাস পেরুতে না পেরুতেই মিললো তূর্শীর পরিবর্তনের কারণ। সম্পর্ক ভাঙার জন্য তার কত কি উদ্ভট বক্তব্য! উশান বেকার। উশানের পরিবার নিম্নতর৷ কথা গুলো যখন তূর্শী ক্যাফেতে বসে বলল, উশান চরম মাত্রার রেগে সেই প্রথমবার কোনো নারীর গায়ে আঘাত তুললো। থাপ্পড় মে’রে বসলো পরাপর দু’টো নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে। কড়া কয়েক কথা, অপমান করে সে চিরতরে সরে আসলো তূর্শী থেকে। তার কয়েক দিন পর। সকালে তার ফ্লাটে তূর্শী পুলিশ নিয়ে হাজির হয়। অভিযোগ করে তাকে মেন্টালি হ্যারেজ করছে উশান কয়েকমাস সম্পর্ক ভাঙার জন্য। তাকে কাল রাতে ফ্লাটে ডেকে জবরদস্তি করার চেষ্টা করেছে। মিথ্যা কথা বলা শেষে ইডিটেড এক ভিডিও প্রদান করে তূর্শী। সেই ভিডিওতে ছিলো প্রথম সে যেদিন উশানের ফ্লাটে এসেছিলো সম্পর্কে থাকাকালীন সেদিন ইচ্ছে বসতই উশানের ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করে। সেটাকে ইডিট করে বিশ্রি বানিয়েছে। উশানের পাশের ফ্লাটের মানুষদের দ্বারা মিথ্যা বক্তব্য পেশ করে উশানকে সে সেদিন জেলে ঢোকাতে সফল হয়েছিলো বটে। তার কয়েক মাস পর! উপযুক্ত প্রমাণে বেড়িয়ে আসে জেল থেকে উশান। তারপর আর কোথাও তূর্শীর হদিস পায়নি সে। জানতে পারেনি কেনো সে এমনটা করলো? মিথ্যা অভিযোগ করে জেলে পাঠানোর কারণটা আজও খুঁজে পায়নি উশান। তূর্শীকে খুঁজেছে, কিন্তু পায়নি! দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলো তূর্শী।
শেষে কয়েকদিন পূর্বেই দিগন্ত দ্বারা বার্তা মিলেছে, তূর্শীর বর্তমান অবস্থা ক্যালিফোর্নিয়া। সে সি.আই.ডি অফিসার পদে অন্তর্ভুক্ত আছে।

মীরা এই নিয়ে দ্বিতীয়বার কথাগুলো স্বগতোক্তি করলো। তার অন্তঃকরণের দশা বেহাল প্রায়।এই তবে কারণ তার প্রপোজাল রিজেক্ট করার?তূর্শী উশানের প্রেমিকা ছিলো! উশান ভালোবাসতো তূর্শী কে। এই কথাগুলো যতবার স্বগোতক্তি করেছে মীরা ততবারই কষ্টে তার বক্ষঃস্থল কেঁপে কেঁপে উঠেছে। ইশ! এক তরফা ভালোবাসার এতোটা কষ্ট কেনো?

-‘ মীরা! চলে যাচ্ছি আমি। আপুকে দেখে রেখো কষ্ট করে। আমি আসার পরই একসাথে চট্টগ্রামের জন্য বের হবো। ‘ উশানের ভরাট কন্ঠ!

মীরা চমকে ডিভান থেকে উঠে সটান হয়ে বসলো। উশান দাঁড়িয়ে। তার পিছনে ঘুমে ঢুলছে তীব্র, উজান, দিগন্ত! উঠে দাঁড়িয়ে উশানের নিকটবর্তী আসলো মীরা। জিজ্ঞেস করলো,

-‘ ব্রেকফাস্ট না করেই চলে যাচ্ছেন কেনো? বসুন!আমি ব্রেকফাস্ট দিচ্ছি। ‘

-‘ উঁহু! তার দরকার নেই। অলরেডি লেট হয়ে গেছে অনেক। কোনো দরকার পড়লে ফোন দিও। ‘

চারজন দ্রুত পদে বের হলো। মীরা তপ্তশ্বাস ছেড়ে দরজা লাগিয়ে পূর্বের ন্যায় ডিভানে এসে বসলো। উশান তাকে এখন আর ‘ তুই ‘ করে সম্মোধন করে না। ‘ তুমি ‘ বলেই সম্মোধন করে। মীরা কারণ জিজ্ঞেস করেছিলো। উশানের প্রতিত্তুর ছিলো এরূপ কিছুটা, ‘ তোমার এবং আমার মাঝে তেমন কোনো আত্নীয়তা নেই। কাজিন নয় যে তোমাকে আমার ‘ তুই ‘ বলার অধিকারটা থাকবে। তাই তুমিই বলবো। এতদিন ‘ তুই ‘ বলার জন্য সরি। ‘

মীরা আহত হয়! উশান কি তাকে একটুও আপন মনে করে না? উশানের মুখে ‘ তুমি ‘ ডাকটা ভীষণ মিষ্টি লাগে বৈকি। তবে তবুও! কোথায় যেনো এক শূন্যতা থাকেই।

____

গোধূলি বেলা। বিকেলের শেষাংশ চলছে মেদিনীতে।বাতাসে বহমান আমের মুকুলের মিষ্টি সুঘ্রাণ। পশ্চিমে হেলে পড়েছে হলদেটে সূর্য। জানান দিচ্ছে তার বিদায় বার্তা৷ নামবে ঘোরতর আঁধার কিয়দংশ এর মাঝেই। বহির্ভাগ হতে দৃষ্টি সরিয়ে মীরা ব্যাস্ত হয় ব্যাগ গুছাতে। তাকে সাহায্য করছে উমাইশা। মেয়েটা স্বাভাবিক হয়েছে বেশ খানিক। মীরা,রুহি দু’জনের সাথেই হেঁসে কথা বলছে। মীরা স্বস্তি পায় এতে কিছুটা। সে ভেবেছিলো ঘুম থেকে ওঠার পর উমাইশা হয়তো অনেকটা অস্বাভাবিক আচরণ করবে। উমাইশার মুখোশ্রীতে হটাৎ ক্লান্ততা ফুটে উঠে। মীরা তা খেয়াল করে চটপট বলল,

-‘ আপু তোমার আর হেল্প করা লাগবে না। তুমি বসে রেস্ট করো আমিই পারবো। ‘

উমাইশা বিরোধিতা প্রকাশ করে বলল,

-‘ না! তা কি করে হয়? এতো কাজ একা হাতে সামলাতে তোমার কষ্ট হবে মীরা। ‘

-‘ একটুও কষ্ট হবেনা। বসো তুমি! আমি নাহয় রুহির থেকে হেল্প নিবো। ‘

উমাইশা অনিচ্ছা সত্বেও বসলো। মীরা উঁচু কন্ঠে রুহিকে দুই একবার ডাক দেয়ার পর কক্ষে হাজির হয় রুহি। তার মুখোশ্রী ফ্যাকাশে, বিবর্ণ! ওষ্ঠাধর শুকিয়ে চৌচির! কালো ঘন কেশের দল সম্পূর্ণ এলোমেলো। মীরা, উমাইশা দু’জনেই চমকে উঠলো রুহির বেশভূষা দেখে। কিয়ৎ বিচলিত কন্ঠে মীরা বলে উঠলো,

-‘ তোর আবার কি হলো? এমন পাগলের বেশভূষায় ঘুরতেছিস যে। ‘

রুহি স্বশব্দে বসলো ভূমিতে। মুখোশ্রীতে কৃত্রিম ক্রন্দন ভাব টেনে বলল,

-‘ দোস্ত..! ব্রেকআপ হয়ে গেছে আমার। ‘

মীরা ফিক করে হেঁসে দিয়ে বলল, ‘ এই নিয়ে কত নাম্বার ব্রেক-আপ হলো তোর? ৬ নাকি ৭? ‘

রুহি নাক টেনে বলল, ‘ ৭! আর খবরদার মীরা হাসবি না। আমি কষ্ট পাইতেছি আর তুই হাসতেছিস? ‘

-‘ একশোবার হাসবো! তুই আমার সামনে যতক্ষণ থাকবি ততবারই হাসবো। ‘

-‘ চুপ কর মীরা..! ব্রেকআপ এর থেকে আমার বেশি কষ্ট হচ্ছে এটা ভেবে আমি এখন সিঙ্গেল। তুই ভাবতে পারতেছিস? সিঙ্গেল আমি এখন! আহ্! জীবনে এতো কষ্ট কেনো আমার? ‘

মীরা হতাশ দৃষ্টিতে তাকালো। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে নিজের কাজে মনোযোগী হলো সে। রুহির দিকে ধ্যান দিয়ে আপাতত লাভ নেই। এই মেয়ের অহেতুক আহাজারি প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে চলবে।আপনমনে বিড়বিড় করতে করতে কক্ষ থেকে প্রস্থান করলো রুহি। উমাইশা তখনও হতভম্ব! কি থেকে কি হয়ে গেলো বুঝলো না সে। মীরাকে স্বাভাবিক দেখে তার কৌতূহল বাড়লো। তৎক্ষনাৎ প্রশ্ন ছুড়লো,

-‘ এটা কি ছিলো মীরা? রুহি এমন কেনো করলো?যতদূর বুঝলাম ব্রেকআপ হয়েছে দেখে এমনটা করলো কিন্তু ৬,৭ নাম্বার মানে? ‘

মীরা ম্লান হেঁসে বলল, ‘ রুহির ব্রেকআপ হওয়া নতুন কিছু নয় বুঝলে আপু? ও এর আগে আরো ছয়টা রিলেশনে ছিলো। দুই, তিন মাস পরপরই ব্রেকআপ করে ফেলে। সি ইজ এ প্লে গার্ল! ‘

উমাইশা বিস্মিত কন্ঠে বলল, ‘ এমনটা করার কারণ নাকি অযথাই?’

-‘ উঁহু! আছে কারণ। অন্য একদিন বলবো তোমায়।’

উমাইশা খেয়াল করলো মীরার মুখোশ্রীতে সুপ্ত পরিবর্তন।অদৃশ্য যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ কি?
মীরা ঘড়িতে সময় দেখলো। উশান তাকে দুপুরে ফোন করে বলেছিলো তিন জন কে তৈরি হয়ে থাকতে বলেছে। রাতে ফিরে এসেই রওনা দিবে বিলম্ব দেরী না করে।

___

রজনীর দ্বিতীয় প্রহর। ঘড়ির কাটা তখন বারোটা ছুঁই ছুঁই! ট্রেনে ওঠার বিশ মিনিট পেরুতে না পেরুতেই কেমন শ্বাস রুখে আসছে মীরার। বাধ্য হয়ে উঠে দাঁড়ালো কেবিন থেকে বের হওয়ার উদ্দেশ্যে। উমাইশা এবং রুহি দু’জনেই ঘুমে মগ্ন। এই কেবিনে শুধু তারা তিনজন। পাশের কেবিনে উশান, তীব্র আর দিগন্ত বুক করেছে।

মীরা বিড়াল পায়ে বিনাশব্দে এসে দাঁড়ালো ট্রেনের দরজার নিকট। দমকা শীতল হাওয়া তৎক্ষনাৎ তার সর্বাঙ্গ মিষ্টি করে ছুঁয়ে গেলো। মীরা নেত্র যুগল বন্ধ করলো। টেনে নিতে লাগলো সতেজ অনিল। অনিলে বহমান বুনো ফুলের সুমিষ্ট ঘ্রাণ। কিয়ৎক্ষণ বাদে আনমনা হয়ে নেত্রযুগল বন্ধ থাকা অবস্থায় অস্থিতিশীল পায়ে কাত হয়ে ট্রেনের দরজা দিয়ে বাহিরে পড়ে যেতে নিতেই আৎকেঁ উঠে মৃদু শব্দে ‘আল্লাহ ‘ বলে চেঁচিয়ে উঠতেই হাতে হেঁচকা টান অনুভূত করলো সে। স্পষ্টত উপলব্ধি করলো তার কো’মড়ের পিছন বজায় শক্তপোক্ত এক বলিষ্ঠ হাত। ঘাড়ের কাছে আরেক হাত আগলে ধরে রয়েছে তাকে। মীরা চমকে নেত্রজোড়া উন্মুক্ত করলো। সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্যমান হলো তার উশানের রুষ্ট চাহনি। তড়িৎ বেগে উশান ছিটকে সরে দাঁড়ালো। বিরক্তমাখা সুরে বলল,

-‘ মারা যেতে ইচ্ছুক হলে মারা যাবি সুন্দর ভাবে। এভাবে ট্রেন থেকে ছিটকে পড়ে গিয়ে মরে মজা আছে নাকি? ‘

মীরা হকচকিয়ে তাকালো। আশ্চর্য! লোকটা পাগল হলো নাকি? বিষ্ময়কর দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে মীরা বলে উঠলো,

-‘ আশ্চর্য তো! আমি মরতে যাবো কেনো? মাথা খারাপ হয়েছে আপনার? ‘

চলবে…
#সাদিয়া_মেহরুজ_দোলা।

[ রি – চেইক করা হয়নি! ]