হৃদয়েশ্বরী পর্ব-১৮+১৯

0
1110

#হৃদয়েশ্বরী
#লেখিকাঃ সাদিয়া মেহরুজ দোলা
#পর্ব-১৮
__________________

ট্রেনের দরজা হতে ঠিক মাঝে টিমটিম করে জ্বলছে সোডিয়াম লাইট। হলদেটে রশ্মিতে মীরা উশানের মুখোশ্রীর ভাষা পড়ার চেষ্টা করলো। তবে সম্ভব হলো না তা। হতাশ হয়ে মৃদু শ্বাস ফেলে বহির্ভাগে দৃষ্টি ফেলে আনমনে বলল,

-‘ লাইফ ইজ নট এ সার্কাস! ইচ্ছে হলে মরে যাওয়া যায় নাকি? আমি অসাবধান বশত পড়ে যেতে নিয়েছিলাম। এতটুকুই! ‘

উশান জবাবহীন রইল ফের। মীরা বিরক্ত হলো বড্ড! একটু আগে কৌতুকের ছলে কথা বলে এখন মুখোশ্রীতে এমন গাম্ভীর্যতা, থমথমে ভাব ফুটিয়ে তোলার মানে কি? উশানকে বোঝা বড় দায়। এই লোক হাসতে হাসতে রেগে যায় আবার রাগতে গিয়ে হেঁসে ফেলে। উদ্ভট! দ্বিতীয় বার বার্তা পেশ করে উত্তর না পেয়ে মীরা অপমানিত বোধ করে। ঘাড় বাঁকিয়ে দৃষ্টিপাত উশানের পানে ফেলে ফিরে যেতে নিতেই উশানের কড়া কন্ঠ তার পদচারণ থমকে দেয়।

-‘ ডোন্ট মুভ! সামওয়ান ইজ ফলোয়িং আস(us)।’

মীরা বিমূঢ়! উশান নেত্র ইশারায় মীরাকে আগের স্থানে ফিরে আসতে বললে সে তাই করলো। উশান এগোল সেদিকে। মীরার পাশে দাঁড়িয়ে তার এক হাত আঁকড়ে নিলো সন্তর্পণে। মীরার মুখোশ্রীতে ফুটে ওঠা ভীতি দেখে কন্ঠের খাদ নামিয়ে বলল,

-‘ ভয় পেয়ো না মীরা। আমি আছি না? আই উইল সেভ ইউ! ‘

হাতের বাঁধন শক্ত হলো আরেকটু। ‘ আমি আছি না ‘ বাক্যটিতে থাকা আশ্বাস মীরাকে শান্ত করে দিলো তৎক্ষনাৎ। আঁড়চোখে তাকালো উশানের পানে। তার এই মূর্হতে কাঁদতে ইচ্ছে করে। হাত – পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে কান্না করার প্রবল ইচ্ছে জাগ্রত হয়েছে অন্তঃকরণে। এই মানবের থেকে যতই সে দূরে যাওয়ার পরিকল্পনা করুক না কেনো! সেই কিভাবে যেনো তারা ক্ষণে ক্ষণে একই ভাবে জরীয়ে যায়। উশানের বাদামী মনি বিশিষ্ট নেত্র যুগলে নম্রতা বিরাজ করছে। মীরার বক্ষঃস্থল কাঁপুনি দিলো। এই নম্র চাহনি-ই তো মীরাকে প্রথম প্রেমে ফেলেছিলো। রাতের ঘুম, নির্ঘুম হওয়ার মতো প্রেমে।

-‘ চশমা ছাড়া কি কিছুই দেখতে পাওনা মীরা?’

উশানের নিচু স্বর। মীরা চশমায় হাত দিলো। নিম্ন সুরে বলল,

-‘ দেখতে পাই কিন্তু ঝাপসা। কেনো? ‘

উশানের ওষ্ঠাধর দ্বারা ছিটকে আসলো ব্যার্থতার সুর। মীরার করা প্রশ্নে জবাব দিলো না। ইশারায় ঠোঁটে আঙুল রেখে চুপ থাকতে বলল। পদধ্বনির শব্দ শোনা যাচ্ছে। খুব কাছেই হয়তো! উশান চটজলদি নিচু হয়ে ডান পায়ের কাছে গুঁজে রাখা ধারালো ছু’রি বের করলো। হলদেটে, স্বল্প আলোয় চকচক করছে ছু’রিটা। মীরার হাত ছেড়ে দিয়ে হাত উঁচু করে লাল, কালো দু’টো তার কেটে ফেললো অভ্যস্ত হাতে। সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকারের রাজত্ব শুরু হলো সেখানটায়। মীরা আঁতকে উঠে বলল,

-‘ লাইটের তার কে’টে ফেললেন কেনো? ‘

-‘ দরকার ছিলো বলে। আসো আমার সাথে। ‘

-‘ কেবিনে ফিরে যাবেন? ‘

উশান মীরার হাত ধরে খালি এক কেবিনের দিকে এগোচ্ছে। পথিমধ্যে জবাব দিলো ক্ষীণ সুরে,

-‘ উঁহুম! আমাদের জন্য অন্য কাওকে বিপদে ফেলবো কেনো? আপু অসুস্থ এমনিতেই। আপাতত যেখানে নিয়ে যাচ্ছি চলো। ‘

ট্রেনের উত্তর দিকের কেবিনগুলো প্রায় খালি। মানুষ জন নেই। মীরার হাত ধরে সেদিকেই এগোচ্ছে উশান। সচেতন ষষ্ঠী ইন্দ্রীয় তার জানান দিচ্ছে পিছন থেকে পদধ্বনির শব্দ জোরদার হয়েছে। তার মানে তাদের অনুসরণ করা লোক দু’টো এবার দৌড় শুরু করেছে। উশান এক খালি কেবিনে প্রবেশ করে দরজা ভিড়িয়ে রাখলো। মীরা উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করলো,

-‘ দরজা লাগালেন না কেনো? যারা আমাদের ফলো করছে তারা যদি এসে পড়ে ভেতরে? ‘

উশান হেঁটে এসে আয়েশ করে বসলো।কোমড়ের কাছে গুঁজে রাখা কালো ধাতব যন্ত্রটি বের করলো। আঁধারের মাঝে হটাৎ রশ্মির উৎস থেকে মীরার বোধগম্য হলো উশানের হাতের যন্ত্রটি পি’স্ত’ল। দুই, তিন সেকেন্ড পর উশান বলল,

-‘ আমি তো এটাই চাই। ওরা ভেতরে আসুক। আমার আপ্যায়ন গ্রহণ করুক। ‘

মীরা হতভম্ব হয়ে রইল। উশানের কথা গুলো ঠিক তার মাথার ওপর দিয়ে শা শা করে উড়ে যাচ্ছে। আসলে কি করতে চাচ্ছে এই লোক? অন্তঃকরণে প্রশ্নের আদান-প্রদান কালীন কর্ণকুহরে ভেসে এলো উশানের ভরাট কন্ঠ,

-‘ আমার বাম পাশে এসে বসো। ওখানে দাঁড়িয়ে থাকা সেইফ না। ‘

মীরা ত্রস্ত পায়ে এগোল। উশানের বাম পাশে গিয়ে বসলো। তার ভীষণ ভয় করছে। বারংবার অন্তরাল থেকে বার্তা আসছে, অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু হতে চলেছে। মীরা ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,

-‘ আপনি আসলে কি করতে চাইছেন উশান? ‘

উশান ব্যাস্ত হাতে পি’স্ত’লে বু’লে’ট চেক করছিলো। মীরার ভয়ার্ত কন্ঠ তাকে এবার থমকে দিলো। মেয়েটা ভয় পাচ্ছে? তাহলে তো মুশকিল বেশ!সে তার কার্য সমাপ্ত করতে পারবে না কিছুতেই তাহলে।পিস্তলটা হাতের মুঠোয় রেখে শীতল কন্ঠে উশান বলে উঠলো,

-‘ মারপিট, র’ক্ত! এসবে ভয় পাও? র’ক্তে ফোবিয়া আছে?’

মীরা নতজানু হয়ে জবাব দিলো,

-‘ উঁহু নেই। আপনি কি ওদের কে মা’র’বে’ন? ‘

-‘ হু, অবশ্যই! ওদের থেকে কথা বের করতে হবেনা? কেনো আমাদের ফলো করছে?সোজাসাপ্টা ভাবে উত্তর দিবে বলে তো মনে হচ্ছে না। ‘

মীরা মৌন রইল কিয়ৎক্ষণ। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। অতিরিক্ত যখন সে চিন্তিত হয় তখন তার হার্ট দূর্বল হয়ে শ্বাস – প্রশ্বাসে ঝামেলা তৈরি করে। মীরা বিচলিত হয়ে বলল,

-‘ আমার ভীষণ ভয় করছে উশান। ‘

হাতের কাজ ফেলে উশান তপ্তশ্বাস ফেললো। তার বোধগম্য হয়েছিলো বহু আগেই, মীরা ভয় পাচ্ছে। হাতের ধা’রা’লো ছু’রি টাকে পায়ে গুঁজে নিয়ে উশান মীরার দিকে কাত হয়ে বসলো। প্রথমবারের মতো স্ব-ইচ্ছায় মীরার গালে আদুরে, উষ্ণ হাত স্থাপন করলো। নম্র কন্ঠে বলল,

-‘ কেনো ভয় পাচ্ছো মীরা? আমি আছি না? আমার ওপর তোমার ভরসা নেই? আমি ঠিক তোমায় আগলে রাখবো। কিছু হবেনা তোমার। হতে দিবো না। বুঝেছো? শান্ত হও এবার! এমন ভয় পেলে চলে নাকি? আমার পাশে থাকলে দুনিয়ার কোনো বিপদ তোমাকে স্পর্শ করতে দিবো না মীরা। ‘

মীরা চোখ তুলে তাকালো না উশানের দিকে। তার হটাৎ – ই ভীষণ লজ্জা করছে৷ উশানের আকস্মিক স্পর্শ তার বক্ষঃস্থলে উথাল-পাতাল ঝড় তুলেছে। ইচ্ছে করছে এ লহমায় কোথাও লুকিয়ে পড়তে। নির্মেদ গাল দু’টোর লাল আভা লুকাতে চেয়েও পারলো না মীরা৷ রাশ রাশ অনুভূতি গুলো হানা দিলো মন গহীনে। ইশ! কি ভয়ানক অনুভূতির ক্ষণ। প্রেমিকের আদুরে স্পর্শ বুঝি এমনই মারাত্মক ভয়ংকর? হাত – পা হীম হয়ে আসছে তার। বারংবার কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে উশানের আশ্বাস ভরা কন্ঠ এবং সেই মন – মাতানো চমৎকার কথা গুলো। আচ্ছা কি মিশে ছিলো কথা গুলোয়?মাদকতা? অবশ্যই! মাদকতার সাগরে মাখো মাখো ছিলো নিশ্চয়ই এই কথা গুলো। নয়তো মীরাকে বর্তমান পরিস্থিতি থেকে মাদকতা গ্রাস করবে কেনো? নিজেকে সামলে কোনোমতে মীরা বলল,

-‘ আমি ঠিক আছি। নিজেকে সামলাতে পারবো। ‘

উশান স্বস্তির শ্বাস ফেলে মীরার গাল থেকে হাত সরালো। আদুরে ভাবে আলত করে গাল টেনে দিয়ে বলল,

-‘ গুড গার্ল! ‘

উশান আচানক খেয়াল করলো মীরার মুখোশ্রীতে উপচে পড়া লজ্জার রেশ। শ্যামবর্ণের গাল দু’টো টকটকে লাল, গোলাপি আভায় সেজে উঠেছে যেনো। নেত্র জোড়া স্পষ্টত জানান দিচ্ছে তাদের ভীষণ লজ্জা পাওয়ার কথা। মীরা’র লাজুক রূপে দৃষ্টি দিয়ে উশান ঠোঁট চেপে হাসলো। শেষে কৌতুক মাখা কন্ঠে বলে উঠলো,

-‘ কি ব্যাপার বলো তো? এমন ভাবে লজ্জা পাচ্ছো কেনো? তোমায় দেখে কি মনে হচ্ছে জানো? তুমি বাসর ঘরে বসে আছো! সিনিয়র সিটিজেন তোমায় দুষ্টু দুষ্ট উপদেশ দিচ্ছে আর তুমি লজ্জায় মিনিটে, মিনিটে চুপসে যাচ্ছো। কিন্তু ম্যাম! আমি তো এমন দুষ্টু কথা বলিনি। এমন লজ্জা পাওয়ার কারণটা যদি বলতেন।’

মীরার গাল দু’টো রক্তিম হয়ে উঠলো ফের৷ লজ্জায় লাল, নীল হয়ে সে অন্যদিকে তাকালো।অন্তরালে উশানকে আচ্ছা মতোন কয়েকটা বকা ছুঁড়ে দিলো। উশান চোখে হাসলো এবার। ওষ্ঠাধর তার স্থির। মীরা মনে মনে প্রার্থনা করলো, যেনো এই পরিস্থিতি থেকে দ্রুত তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। ইশ! কি বিব্রতকর অবস্থা। নেত্র যুগল বন্ধ করে মীরা শান্ত হলো। এমন লজ্জা পাওয়ার কোনো মানে হয় না। তেজ নিয়ে পরিশেষে বলল,

-‘ একদম উল্টোপাল্টা কথা বলবেন না। আমি অবশ্যই লজ্জা পাচ্ছি না। আমার ঠান্ডা লাগছিলো তাই গাল হয়তো লাল হয়ে আছে। ‘

মীরার উদ্ভট, অযৌক্তিক উত্তর শ্রবণ করে উশান গলায় শব্দ করে হাসলো। হাস্যরত অবস্থাতেই বলল, ‘ আচ্ছা তাই ম্যাডাম? ‘

উশান হুট করে হাসি থামিয়ে সচেতন হলো। বিড়াল পায়ে হেঁটে আসা মানুষ দু’টোর মৃদু শব্দ কর্ণপাত হলো। হাতে পি’স্ত’ল টা তুলে নিয়ে কায়দা করে এক পাশে দাঁড়ালো। মীরার হাত টেনে দাঁড় করিয়ে নিজের কাছে আনলো। মীরার কোমড় একহাত রেখে মৃদু কন্ঠে বলল,

-‘ একদম চুপ মীরা। শব্দ করো না কোনো। ওরা এসে গেছে। ‘

মীরা তটস্থ হলো। আধারের মাঝে দেখলো দু’টো বলিষ্ঠ দেহ কেবিনে ঢুকছে।উঁচু করে রাখা হাতে পিস্তল। মীরা চিন্তায় পড়লো বেশ। এই বলিষ্ঠ দেহী দু’জন পুরুষকে উশান সামলাবে কি করে? মীরাকে চমকে দিয়ে উশান এক অদ্ভুত কর্ম করে বসলো। ট্রেন টানেলে প্রবেশ করতেই অন্ধকারে বিনাশব্দে উশান এগোল লোক দু’টোর দিকে। তারপর কি হলো কিছু দেখতে পারলো না মীরা। দুই মিনিট পর উশানের উপস্থিতি ফের নিজের সন্নিকটে আবিষ্কার করলো। ট্রেন টানেল থেকে বের হতেই মীরা দেখলো বলিষ্ঠ দেহের এক ব্যাক্তি মাটিতে পড়ে রয়েছে। ২য় লোকটা বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে দেখছে তাকে।

উশান এবার ছুটলো সেদিকে। পিছন থেকে ২য় লোকটার ভোকাল কর্ড চেপে ধরে দু’হাত পিছনে মুড়িয়ে ধরলো। পিছন থেকেই লাথি মারলো সজোরে লোকটার গুপ্ত স্থানে। ব্যাথায় চেঁচিয়ে উঠে লোকটা মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। লোকটার মাথার চুলের একাংশ শক্ত করে মুঠোয় নিয়ে চোয়াল বরাবর ঘুষি মারে উশান। ক্ষীণ রশ্মিতে মীরার দর্শন হলো লোকটার ঠোঁট দিয়ে রক্ত পড়া শুরু হয়েছে। আরেকটু খেয়াল করতেই তার বোধগম্য হলো লোক দুটো বাংলাদেশী নয়। ভীনদেশী তারা! সম্ভবত আমেরিকান। বয়স কম।

ব্যাথাতুর, আর্তনাদ জরানো কন্ঠে লোকটি বলল,

-‘ হোয়াট হ্যাভ ইউ ডান টু মাই ব্রাদার? ‘

-‘ ড্রাগ পুশ করেছি।’ উশান কড়া গলায় ছেলেটার ভাষাতেই পরিপক্ব কন্ঠে জবাব দিলো।

ছেলেটা চমকালো বোধহয়। চমকিত কন্ঠে বলল,

-‘ তুমি আমেরিকান নাকি? আমাদের মতো পরিপক্ক ভাষায় কথা বলছো যে, ‘

উশান ছেলেটার চিবুক ধরে মাথা কাত করে দিলো।উত্তর দিলো না। ব্যাথায় কুকিয়ে উঠে চক্ষু জোড়া বন্ধ করে নিলো ছেলেটা। উশান তেজি কন্ঠে বলল,

-‘ নাম কি তোর? কে পাঠিয়েছে তোকে? জলদি বল! ‘

-‘ আমাকে ছাড়ো! বলতে পারবো না আমি। নিষেধ আছে৷ ‘

উশান ধারালো ছু’রিটা বের করে ছেলেটার পায়ে ঢুকিয়ে দিলো। শেষে কঠিন গলায় বলল,

-‘ এখন বলবি নাকি তোর হৃদপিণ্ডে ঢোকাবো এবার? ‘

-‘ বলছি! বলছি! আমি রায়ান। আর যাকে তুমি ড্রাগ দিয়েছো ও আমার ছোট ভাই এলেন। আমরা আমেরিকা থেকে এসেছি। আমাদের দু’জনকে এরিক ইহরাম পাঠিয়েছে তোমাকে মে’রে ফেলার জন্য। ‘

‘ এরিক ইহরাম ‘
এই ব্যাক্তিকে চেনে উশান। তূর্শীর স্বামী সে। এই কয়েকদিনে উশান অনেকটা তথ্য জোগাড় করেছে তূর্শী সম্মন্ধে। এরিক কেনো তাকে মারতে চাইছে তাও জানে সে। বিরক্ত হলো উশান! রায়ান কে ছেড়ে দিয়ে হাতের রক্ত টিস্যু দিয়ে পরিস্কার করলো। রায়ান তখন ব্যাথায় ছটফট করতে ব্যাস্ত।কারণ তাকে ছেড়ে দেয়ার পূর্বে উশান সজোরে আঘাত করেছে তার দূর্বল স্থানে।
উশান বিরক্তিমাখা কন্ঠে বিড়বিড়িয়ে বলল,

-‘ সামনে এসে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই। পেছন থেকে সর্বদা আঘাত করার চেষ্টা করে। কাপুরুষ একটা! ‘

মীরা তখনও থম মেরে দাঁড়িয়ে। দৃষ্টি অন্যত্রে। এসব দেখার ক্ষমতা তার নেই। বমি পায়, হাসঁফাসঁ করে, শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। উশান এগোল মীরার দিকে। কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো,

-‘ ঠিক আছো তুমি? ‘

মীরা ফিরে তাকালো। বলল, ‘ হু! এদের দু’জনকে কি করবেন? ‘

উশান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠলো, ‘ মে’রে ফেলবো। ট্রেন থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিবো।ভালো হবে না? ‘

চলবে…
#সাদিয়া_মেহরুজ_দোলা

#হৃদয়েশ্বরী
#লেখিকা- সাদিয়া মেহরুজ দোলা
#পর্ব- ১৯
___________________

শূন্য কেবিনে ছটফট করছে মীরা। বারংবার দৃষ্টি ফেলছে সম্মুখে। মৃদু শব্দ কর্ণপাত হলেই অন্তঃকরণ নড়েচড়ে উঠে এই বলে উঠলো, সে আসছে! কিন্তু কোথায়? সেই কাঙ্খিত ব্যাক্তির দেখা নেই আধা ঘন্টা যাবৎ। মীরা আগত ক্রন্দন ঠোঁট কামড়ে রুখে নেয়। মাত্রাতিরিক্ত চিন্তায় ললাটে উৎপত্তি ঘটেছে বলিরেখার। শান্ত, স্থির মস্তিষ্কের নিউরন বর্তমানে অস্থিতিশীল। পা দু’টো কম্পমান। হাত জোড়া কম্পমানশূন্য তবে হীম হয়ে পাথর। মীরা নেত্রযুগল বন্ধ করলো। ফিসফিসিয়ে বলল,

-‘ আমাকে এভাবে চিন্তায় ফেলে উধাও হয়ে ভালো করেননি আপনি। একদমই ভালো করেননি। ‘

রায়ানের দুই হাত বেঁধে রেখে উশান ধমকে – ধামকে মীরা কে এসে কেবিনে রেখে যায়। পথিমধ্যে মীরা নিষেধ করছিলো বারংবার না যেতে এভাবে একা। কিন্তু জেদী, একরোখা উশান তার কথা শুনলে তো।বাহির থেকে মীরাকে লক করে রেখে সেই যে গেছে, আধাঘন্টা পার হলো, উশান লাপাত্তা! মীরার মনে কু ডাকছে। লোকটা ঠিক আছে তো? সুস্থ রূপে আছে তো?

পদধ্বনির জোরদার শব্দ। মীরা উঠে দাঁড়ালো। কেবিনের দরজা খুলে এবার তার কাঙ্ক্ষিত ব্যাক্তি দর্শন দিলো। উশানের হাতে তার ফোন। ব্যাস্ত হাতে টাইপিং করতে করতে প্রবেশ করলো। সিটে বসে ক্লান্তি নিয়ে বলল,

-‘ পানি দাও তো মীরা। গলা শুকিয়ে গেছে। ‘

মীরা দ্রুত পায়ে ব্যাগের নিকট এগোল। পানির বোতল নিয়ে ফিরে আসার পর উশানের নিকট এগিয়ে দিয়ে উশানকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল কোথাও আঘাত লেগেছে কিনা। শেষে উশানের গলার কাছে শার্টে লেপ্টে থাকা রক্তিম তরল পদার্থ দর্শন করে শিউরে উঠলো মীরা। বেশ খানিকটা রক্ত বের হয়েছে আঘাতপ্রাপ্ত স্থান হতে তা শার্টের সিক্ত অংশ দেখে মীরা ঢের বুঝতে পারলো। আতঙ্কিত হয়ে অকস্মাৎ সে বসলো উশানের পাশে। দ্বিধা ফেলে হাত দিলো উশানের ঘাড়ে। বিচলিত কন্ঠে বলল,

-‘ এখানে আঘাত পেলেন কি করে? রক্ত বের হচ্ছে তো অনেক। ‘

মীরার হটাৎ হামলে পড়াতে উশান চমকে বিষম খেলো। পানি নাক দিয়ে উঠে গিয়েছে। কাশতে শুরু করলে হুঁশে ফিরে মীরা। ইতস্তত বোধ করে বলল,

-‘ সরি! সরি! ‘

উশান স্বাভাবিক হয়ে বক্ষঃস্থলের মাঝে হাত দিয়ে শ্বাস টানলো। গভীর, দীপ্ত নেত্রে দৃষ্টি দিয়ে বলল,

-‘ এভাবে শার্টের কলার ধরে টান দিলে কেনো মেয়ে? দেখছোনা পানি খাচ্ছি? ‘

-‘ বললাম তো সরি। আপনার কাঁধে রক্ত দেখে..,ইয়ে মানে! আপনার কাঁধে আঘাত কিভাবে পেলেন? বললেন না তো। ‘

উশান বিরক্তি সহিত নাক-মুখ কুঁচকে নিলো। জবাব দিলো ক্ষীণ সুরে,

-‘ এলেন! ঘাড়ত্যাড়া একটা। সেন্সে এসেই ছু’রি দিয়ে আঘাত করে বসলো। ঐটার হাত ভেঙে এসেছি। আঘাত তেমন গুরুতর না। এমনিই ঠিক হয়ে যাবে। ‘

মীরা মৌন! ফের নিজের স্থান থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ব্যাগের কাছে গেলো। হাতে ফার্স্ট এইড বক্সটা নিয়ে এসে বসলো উশানের পাশে৷ দ্বিধা নিয়ে বলল,

-‘ রক্ত তো এখনো পড়ছে। আমি ড্রেসিং করে দিচ্ছি। প্লিজ না করবেন না। না করলে আমি শুনবো না। ‘

উশান ঘোর অনিচ্ছা প্রকাশ করলো। মীরার তাতে ভাবান্তর নেই। সে ইতিমধ্যে নিজের কাজে তুমুল ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে। বিনা স্পর্শে ড্রেসিং করছে ক্ষত স্থান। উশান উঠে যেতে নিলেও উঠলো না। রক্ত পরিস্কার আবশ্যক। এভাবে রক্তক্ষরণ হলে বাহিরে যাবে কি করে? ট্রেনে আরো মানুষ জন্য রয়েছে। মুঠোফোনে দৃষ্টি ফেলে পিছনে পিঠ এলিয়ে দেয় উশান। তপ্তশ্বাস ফেলে বলে উঠলো,

-‘ ফার্স্ট এইড বক্স এখানে? এইটা নিয়েই ঘোরাঘুরি করো নাকি? ‘

-‘ উঁহু! তবে লং জার্নিতে ক্যারি করি। দরকার পড়ে অনেক সময়। যেমন এখন পড়লো। ‘ মীরার কাঠ কাঠ, একটু অন্যমনস্ক প্রতিত্তুর।

উশান তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,

-‘ আমি তো জাস্ট এক্সকিউজ! দরকার টা আসল পড়ে তো তোমার। বাচ্চা মানুষ তুমি। হাঁটতে, চলতে ধপাধপ পড়ে গিয়ে আঘাত পাও। ‘

মীরা রুষ্ট চাহনি নিক্ষেপ করলো। তবে, কন্ঠনালী দ্বারা একটা শব্দও উচ্চারণ করলো না। এখন কিছু বলা মানেই বিপদ। মহা বিপদ! এমনিতে উশানের কাঁধের ক্ষতটা মোটামুটি গভীর। অদূর থেকে ক্ষতের গভীরতা বোঝা যায় অতোটা কিন্তু কাছে এসে দেখলে উপলব্ধি করতে পারবে ক্ষতের পরিমাপ। মীরার হাত কাঁপছে প্রবল। নেত্রপল্লব ঘন ঘন পল্লব ফেলছে। বক্ষ পিঞ্জর হু হু করে উঠলো তার। লোকটার নিশ্চয়ই ভীষণ ব্যাথা করছে? কষ্ট হচ্ছে? যন্ত্রণা হচ্ছে? নেত্রকোণায় উপস্থিত অশ্রুকণা পল্লব ঝাপটে বিতাড়িত করলো মীরা। এখন কিছু বলবে না সে। বললে যদি একরোখা লোকটা উঠে চলে যায়? তাহলে তো ইনফেকশন হয়ে যাওয়া আশঙ্কা আছে।

মীরার নির্লিপ্ততা উশানের পছন্দ হলো না। মীরা কে রাগাতে না পারলে কেনো যেনো তার মনে শান্তি মিলে না। উশান চুপ রইল কয়েক সেকেন্ড। অতঃপর ভরাট কন্ঠে বলল,

-‘ রায়ান, এলেনের সাথে তোমাকেও ট্রেন থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিবো ভাবছি? হোয়াট ছে? তুমি তো তখন মরতেই চাচ্ছিলে। ‘

ব্যান্ডেজ করা শেষ মীরার। উশানের কথা শ্রবণ করে তার হাত দু’টো থমকে গেলো প্রায়। বিষ্নয়কর দৃষ্টি দিয়ে বলল,

-‘ মানে? ওদের দু’জনকে কে কি সত্যিই ট্রেন থেকে ফেলে দিবেন? ‘

গলায় শব্দ করে হাসলো উশান। যেনো কৌতূক শুনেছে। বড্ড বিরক্ত হলো সে। মেয়েটা এতো বোকা কেনো?হোয়াই?
উশানের হাসির মাধ্যমে মীরা বুঝে গেলো, সে ভুল প্রশ্ন করেছে। নিজেকে আবারও উশানের কাছে বোকা প্রমাণিত করেছে। উঠে দাঁড়িয়ে সামনের সিটে গিয়ে বসলো মীরা। রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি। লজ্জা লাগছে তার। সঙ্কোচ পায়ে ঠেলে বহু চেষ্টায় বলল,

-‘ রুহি, উমাইশা আপু, তীব্র, দিগন্ত ভাইয়া তারা কোথায়? রুহি আর আপু তো এই কেবিনেই ছিলো। আমি আসার পর তো আর দেখলাম না এখানে। ‘

-‘ তীব্র, দিগন্ত রায়ান এলেনের সাথে। রুহি আর আপুকে একটা সেফ কেবিনে সরিয়ে নিয়েছি। ‘

-‘ অহ! আমি ওদের কাছে যেতে পারি? ‘

-‘ সকাল হওয়ার আগে কেবিন থেকে বের হওয়া যাবে না। ঘুমিয়ে পড়ো। বাহিরে গার্ড পাহারা দিবে। চিন্তার কিছু নেই। আমি এখনি চলে যাবো। ‘

মীরার ভীষণ বলতে ইচ্ছে করলো, আপনি একটু থাকুন উশান। আমার এতদিনের নির্ঘুমতা একটা দিনে একটু ভিন্ন হোক। প্রশান্তির ঘুম আসুক। ‘
বলা হলোনা! মীরা শুয়ে পড়তেই উশান বেড়িয়ে গেলো। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ঘুমানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা শুরু করলো সে।

__

বৃষ্টিস্নাত প্রভাত। সকাল হতেই ঝুম বৃষ্টির তান্ডব লীলা শুরু হয়েছে। ট্রেন থামবে আর আধা ঘন্টা পর অথচ বৃষ্টি থামার কোনো নাম গন্ধ নেই। মীরা চিন্তায় পড়ে গেলো। বৃষ্টিতে ভিজলে উশানের জ্বর আসে প্রচন্ড।এক সপ্তাহ ধরে সেই জ্বর আষ্টেপৃষ্টে জরিয়ে থাকে তার। এটা সম্পর্কে অবগত সে।মূলত এ কারণেই চিন্তিত মীরা। পরক্ষণেই সিটে মাথা এলিয়ে নেত্র জোড়া বন্ধ করে জোড়াল শ্বাস ফেললো। নিষ্প্রাণ কন্ঠে আনমনে বলল,

-‘ কুল ডাউন মীরা! উশান ডাজেন্ট লাভ ইউ। তাকে নিয়ে এতোটা চিন্তিত হওয়ার মানেই হয় না। ‘

দরজায় কড়াঘাত পড়লো। সচেতন হলো মীরা। দুই সেকেন্ড অতিবাহিত হওয়ার পর কেবিনে হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করলো রুহি। দৌড়ে এসে মীরাকে জরিয়ে ধরে বলল,

-‘ তুমি ঠিক আছো জান? আমার কতোটা চিন্তা হইছে তোমার জন্য জানো? ‘

মীরা তপ্তশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘ ঠিক আছি আমি। ছাড়, দূরে গিয়ে বস!’

রুহি মীরাকে ছেড়ে তার পাশ ঘেঁষে বসলো। মীরার প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত ফেলে পর্যবেক্ষণ করলো কিছু। শেষে সন্দিহান গলায় বলল,

-‘ ঠিক আছিস? দিবো এক থাপ্পড়! চেহারার এই অবস্থা কেন? কি নিয়ে চিন্তা করতেছিস? ‘

হতাশ দৃষ্টিতে তাকালো মীরা। রুহি তার মন অবস্থা সর্বক্ষণ বুঝে ফেলে ভাষায় প্রকাশ না করলেও। সে চাইছিলো তার বর্তমান অবস্থা অন্তর্লীন থাকুক।

-‘ বৃষ্টি পড়ছে রুহি। ‘

-‘ তো? ‘

-‘ উশানের বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর আসে। ‘ মীরার মিনমিনে সুর।

রুহি রাগতে গিয়েও পারলো না। নিষ্প্রভ চাহনি নিক্ষেপ করলো। মলিন কন্ঠে বলল,

-‘ তুই..! তুই উশান ভাইরে কি ভুলতে পারবি না মীরা? মানে এটা কি পসিবল না? উশান ভাই তোকে ভালোবাসে না মীরা। দূরে থাক তার থেকে। যে তোর মূল্য বোঝেনা অযথা সেই লোকের পিছে পড়ে থেকে কি লাভ বল?আমি তোকে উশান ভাইয়ের থেকেও ভালো কাওকে এনে দিবো জান। মন খারাপ করে না। ‘

মীরা অন্যত্রে দৃষ্টিপাত ছুড়লো। আপনমনে স্বগতোক্তি করলো, ‘ আমার কাওকে চাইনা রুহি! কাওকে না। কেও আমার উশানের মতো হতে পারবে না। কক্ষনো না। ‘

চলবে…

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। রি- চেইক করিনি। ]