#হৃদয়েশ্বরী
#লেখিকাঃ সাদিয়া_মেহরুজ_দোলা
#পর্ব-২৫
________________
পূর্ব আকাশে সবেমাত্র সূর্য উদয় হয়েছে। চারিপাশে ক্ষীণ কুয়াশা পড়েছে। বসন্তের প্রথমাংশ হওয়াতে শীতের রেশটা কাটেনি এখনো পুরোপুরি। গাছের কিশলয়ে ঝমেছে রয়েছে বিন্দু বিন্দু শিশির কণা। হালকা রোদে ঝলমল আশপাশ। ব্যাস্ত সড়ক দিয়ে হটাৎ দানবীয় আকৃতির ট্রাক শা শা করে বিকট, কর্কশ শব্দে হর্ণ দিয়ে গেলো। সেই কর্কশ ধ্বনি কর্ণপাত হয়ে ধ্যান ফিরে মীরার। ভোরে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস তার বহু বছরের। প্রভাতের আগমন মেদিনীতে ঘটতেই তার ঘুমের রেশটা অভ্যাসবশত কেটে যায়। মীরার হাতে ধোঁয়া উড়ন্ত কফির মগ। এলোমেলো আকৃতির ধোঁয়া বের হচ্ছে মগ দিয়ে। উত্তপ্ত কফির কাপে অধর ছোঁয়ার মীরা। অদূরে দৃষ্টি দিতেই সে কিয়ৎক্ষণ থমকালো! চমকালো! স্থির রূপে দাঁড়িয়ে রইল।
মীরার বাসা থেকে তিনটা বিল্ডিং পর উশানের দাদু বাড়ি। মাঝখানের তিনটা বিল্ডিং তূলনামূলক কম তলার হওয়াতে উশানের দাদু বাড়ি মীরার বাসার ছাদ থেকে স্পষ্টতই দেখা যায়। অদূরে ছাঁদে উশান উদাম গায়ে পুশ-আপ করছে। এতদূর থেকে, চশমার তীক্ষ্ণতার জোড়ে মীরা স্পষ্টত দেখতে পারছে উশানের পেশিবহুল, বলিষ্ঠ দেহ। দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছে বলিষ্ঠ, সুঠাম দেহ এখন ঘেমে একাকার। মীরা নির্লজ্জের মতো উশানকে পরখ করলো সুক্ষ্ম নজরে। শেষে হুঁশে ফিরে নিজের গালে চড় মেরে বসলো। ইতস্তত কন্ঠে আপনমনে বলল,
-‘ ছিহঃ মীরা! শেইম অন ইউ। ‘
উশানের আশপাশের কোনো দিকে ধ্যান নেই। সে ব্যাস্ত তুমুল নিজের কাজে। মিনিট বিশেক বাদে ক্লান্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালো। শুভ্র তোয়ালে দিয়ে শরীরে অবশিষ্ট ঘামটুকু মুছে নিলো দ্রুত। উশানের থেকে ঠিক তিন ফিট দূরে দাঁড়ানো তীব্র। ঠিক দাঁড়ানো না দাঁড়িয়ে ঘুমে ঢুলুঢুলু বলা যায়। দিগন্ত ব্যাস্ত হাতে উশানের দেয়া তার ওপর আরোপিত কাজ গুলো সম্পূর্ণ করছে। উশান ওয়াটার বোতলে অধর স্পর্শ করার আগ মূর্হতে শক্ত কন্ঠে বলল,
-‘ দিগন্ত? ইজেন্ট ইট ডান? ‘
দিগন্ত দ্রুত গলায় বলল,
-‘ স্যার আরেকটু সময় দিন। হয়ে যাবে। ‘
– ‘ ডু ইট ফার্স্ট! ‘
-‘ ইয়েস স্যার। ‘
উশান তোয়ালে ফেলে টিশার্ট পড়লো। সে একটু খেয়াল করলেই হয়তো দেখতে পেতো অদূরে কেও তাকে স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছে৷ তবে উশান আজ আর আশপাশ দেখলো না। তার মুখোশ্রীতে কঠোরতা! বহুদিন বাদে গম্ভীরতার ছাপ পড়েছে। দ্রুত পায়ে তীব্রের পাশে দাঁড়িয়ে ঝাঝ মেশানো কন্ঠে বলল,
-‘ কালকের থাপ্পড় মনেহয় কাজে লাগেনি? কাজ ফেলে এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? ‘
তীব্র হাই তুলে অলসতা ছাড়ালো। আঁড়চোখে তাকালো উশানের দিকে। ছেলেটাকে কঠোর দেখাচ্ছে ভীষণ। নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। গুরুতর কিছু। অতীব গুরুতর কোনো কিছু হলে উশান তার অফিসিয়ালি রূপ প্রদর্শন করে। যেমনটা সে কর্মক্ষেত্রে প্রয়োগ করে থাকে। তীব্র বিরস কন্ঠে বলল,
-‘ কোথায় কালকের হটাৎ থাপ্পড় মারার জন্য সরি, টরি বলবি তা না! এখন বলছিস থাপ্পড় কাজে লাগেনি? তুই আসলেই মানুষ না শা’লা! তোর মন- প্রান, হৃদয় সব পাথরের। ‘
উশান থমথমে দৃষ্টিতে তাকালো। তীব্র তটস্থ হয়। বলে,
-‘ কি হয়েছে? এভাবে তাকাস ক্যানো? ‘
-‘ কালকের থাপ্পড় মারার যথেষ্ট কারণ ছিলো। ‘
-‘ হাহ্! যথেষ্ট কারণ ছিলো..! কাল যা বলছি আমি তা সত্যি না এটা তুই অস্বীকার করতে পারবি?সত্যি বললেই দোষ। ‘
-‘ ফাইল রেডি কর। ৩০ মিনিটের মধ্যে আমার চাই। ‘
ছাঁদ থেকে প্রস্থান করলো উশান। তীব্র দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। ছেলেটা অদ্ভুত ভীষণ! এভাবে নিজের চরম শুদ্ধ, পবিত্র, প্রেমময় অনুভূতি গুলো গোপণ করে সে আসলে কি প্রমাণ করতে চাচ্ছে? তা বলা মুশকিল বটে। এত বছরের বন্ধুত্ব উশানের সাথে তীব্রের। তবুও কিছু কিছু বিষয়ে সে উশানকে বুঝতে পারেনা একদমই। উশান যেনো পুরোটাই এক রহস্য। তীব্র অলসতা ফেলে এগোলো সম্মুখে। দিগন্তের নিকট। যাওয়ার পথে অদূরে দৃশ্যমান হলো তার মীরাকে৷ তপ্তশ্বাস ছাড়লো সে। বিড়বিড় করে বলল,
-‘ মেয়েটাকে আর কষ্ট দিস না উশান। নয়তো এর ফল তোকে প্রকৃতি দ্বিগুণ করে ফিরিয়ে দিবে। ‘
____
ফেব্রুয়ারীর এক অলস দুপুর। শুনশান নীরবতা বজায় চারিপাশে৷ মীরা সচেতন দৃষ্টিতে আশেপাশ দেখতে দেখতে এগোচ্ছে। এক বিশেষ কাজে সে এসেছিলো পাহাড়ের এদিকের জঙ্গলে। জঙ্গলের ওপর প্রান্তে মূলত ছিলো তার কাজ। হাসপাতাল ছিলো সেখানে। পায়ের ব্যান্ডেজ চেইঞ্জ করিয়ে কিছু ঔষধ নিয়ে এসেছে। আজকাল পায়ে চিনচিন ব্যাথা করে তার। ব্যাথা উঠলে সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ে।দুপুরের দিকে ফের ব্যাথা ওঠায় একাই বেড়িয়ে ছিলো সে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। মাথার ওপর কড়া রোদ্দুরের তাপ। তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে চৌচির তার। ক্ষীণ দূরে যাওয়ার পর হটাৎ তার মনে হলো তার পিছন পিছন কেও আসছে। শুকনো, ঝড়ে পড়া পাতায় মড়মড় শব্দ হচ্ছে।
মীরা সচেতন হয়। আলগোছে ব্যাগে হাত দিয়ে ছোট ধারালো ছু’রিটা সে হাতের মুঠোয় নেয়। পদচারণ থামিয়ে হুট করে পিছন ঘাড় কাত করে তাকাতেই তার সম্মুখে দৃশ্যমান রোগা ধরনের এক কম বয়সী তরুণকে। ছেলেটা বোধহয় তার থেকেও ছোট হবে। মীরা কয়েক কদম পিছিয়ে গিয়ে কঠিন কন্ঠে বলল,
-‘ কে আপনি? আমার পিছু নিচ্ছেন কেনো? ‘
ছেলেটা হাসলো। অদ্ভুত, গা শিরশির করা হাসি।ক্ষীণ কেঁপে উঠে মীরা। ভীতি ভাব অন্তরালে পুরে রেখে ধমকে উঠে জিজ্ঞেস করে,
-‘ কি সমস্যা? ‘
-‘ কোনো সমস্যা না। জাস্ট কিছু জিজ্ঞেস করার ছিলো। মে আই? ‘
-‘ বলুন! ‘ কাঠ কাঠ গলায় জবাব দেয় মীরা।
-‘ থ্যাঙ্কিউ! আমি শুভ্র। এখানে নতুন। ভুলবশত রাস্তা গুলিয়ে ফেলে এখানে এসে পড়েছি। আমাকে একটু লোকালয় সম্পর্কে ধারণা দিতে পারবেন? আর কত দূরে সেটা? ‘
-‘ সোজা হাঁটবেন। বিশ মিনিট পরই লোকালয়। ‘
-‘ আপনি বুঝি সেখানেই যাচ্ছেন? ‘
মীরা জবাব দিলো না। সোজা হাঁটা শুরু করলো। কিছু তো একটা গড়বড় আছে। শুভ্রের ব্যাবহার, চাহনি, দিক – নির্দেশনা তার ভালো লাগেনি। উদ্ভট ঠেকছে কেমন। দ্রুত হাঁটা ধরলো মীরা। হাতের মুঠোয় ছোট্ট ছু’রিটা ধরেই রাখলো। খেয়াল করে দেখলো শুভ্র তার পিছনেই আসছে। হেলেদুলে, আস্তেধীরে। মীরা পদচারণের গতি বাড়িয়ে দেয়। তবে কিয়ৎক্ষণ বাদে তার সন্দেহ দূর হয়। সে যখন দৌড়াতে শুরু করলো। শুভ্র তখন প্রায় ছুটে আসলো। এসেই শক্ত করে ধরলো তার হাত। মীরা ছিটকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়। চেঁচিয়ে প্রশ্ন করে,
-‘ আপনার সাহস কি করে হয় আমাকে স্পর্শ করার? ‘
শুভ্র অদ্ভুত ইঙ্গিত দিলো নেত্র যুগল দ্বারা। মীরার বুঝতে বেগ পেতে হলোনা এই ইঙ্গিতের। এর সাথে আর ভালোভাবে কথা বলার কোনো মানেই হয়না। ব্যাগের পকেট থেকে ছু’রিটা ব্যাগ করে মীরা শুভ্রের হাতে শক্ত করে ঢুকিয়ে দিয়ে বের করে নিলো। পা দিয়ে সজোরে লাথি মারলো শুভ্রের স্পর্শকাতর স্থানে। ছু’রিটা দিয়ে সে দ্বিতীয় আঘাত করলো শুভ্রের ঘাড়ে। ছিটকে আর্তনাদ করে উঠলো শুভ্র। ব্যাথায় যন্ত্রণার সহিত বলল,
-‘ ইউ ব্লা’ডি বি’চ! ‘
মীরা উল্টো ঘুরে দৌড়ানো শুরু করে। শুভ্র তার আহত হাত দিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করে তার দলের কয়েকটা ছেলেকে ফোন করে সেখানে উপস্থিত হতে বলে জলদি। শেষে ফোন কেটে দিয়ে পিছু নেয় মীরার। লোকালয় পৌঁছাতে আরেকটু সময় বাকি। মীরা অন্তঃকরণে নিজেকে ধাতস্থ করলো। সাহস দিলো! তবে বিপদ বুঝি তখনও তার পিছু ছাড়েনি। ক্ষীণ দূর যেতেই তিনটে ছেলে এসে উপস্থিত হয় তার সম্মুখে। মীরা ভড়কালো। প্রশ্ন করলো,
-‘ কি চাই? ‘
উপস্থিত একজন বিশ্রী হেঁসে বলল, ‘ তোমারে! ‘
দ্বিতীয়জন ক্রোধ নিয়ে বলল, ‘ আমার ভাইরে মেরে ভাগতে চাও? এতো সহজ? আজকে তোমারে খা’ই’ছি ফুলটুসি। ‘
মীরার বোধগম্য হয়। শুভ্রের দলবল এরা। পিছন ফিরে তাকানোর পর এবার দমিয়ে রাখা আতঙ্কটা তার বেড়ে গেলে হু হু করে। মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো চিন্তা। বারংবার অন্তঃকরণে সে প্রার্থনা করছে যেনো খারাপ কিছু না হয়৷ মীরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করলো উপস্থিত তিনজনকে দমানোর জন্য। ছু’রি দিয়ে আঘাত করলো অব্দি তবে কাজ হলো না। আঘাত করার ফলস্বরূপ তাকে পাল্টা থাপ্পড় মারা হলো। অধর চুইয়ে তরল র’ক্ত গড়িয়ে পড়লো এক ফোটা, দুই ফোটা অবিরত! মীরা চেঁচিয়ে আকুতি স্বরে বলল,
-‘ প্লিজ ছেড়ে দিন আমায়। যেতে দিন। আল্লাহর দোহাই লাগে। ‘
চারটে ছেলের নিষ্ঠুর, নিকৃষ্ট, পাষাণ হৃদয় মীরার ব্যাকুল, কাতর, আকুতি শুনলো না। লোলুপ দৃষ্টিতে তাকালো তারা। তাদের মুখোশ্রীতে বজায় মান অদ্ভুত চাহনি দেখে মীরা বুঝে গেলো তার সাথে ঠিক কি হতে যাচ্ছে। অন্তঃকরণে নাজেহাল অবস্থা তার। সবকিছু এলোমেলো লাগছে। শেষ মূর্হতে আকুতি স্বরে বিড়বিড়িয়ে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করছে সে। হৃদপিন্জর চাইছে, উশান আসুক! একবার আসুক। তিন চারটে ছেলের সাথে পেরে উঠলো না মীরা। পালাতে চেয়েও পারলো না। শুভ্র মীরার হাত পা বেধে নিয়ে বলল,
-‘ ওরে বস্তায় ঢুকা জলদি। জঙ্গলের ভিতর নিয়া যাই। ‘
মীরার মুখে এক দলা পুরোনো কাপড় ঢোকানো। কিছু বলার প্রয়াসে কন্ঠ দ্বারা শব্দ করলো হলো না তা সম্ভব। মীরাকে বস্তায় ভরে নেয় দু’জন। তার পূর্বে সে দু’জন ভীষণ বাজে ভাবে মীরার স্পর্শকাতর স্থানে স্পর্শ করে। নেত্র যুগল বন্ধ করে মীরা অস্ফুটস্বরে বলল,
-‘ কিচ্ছু হয়নি! ওরা ব্যাড টার্চ করেনি। সব ঠিক হয়ে যাবে। সব ঠিক হয়ে যাবে। ‘
বস্তায় ভরে বস্তার মুখ বন্ধ করে টানতে টানতে মীরাকে জঙ্গলের ভেতর নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠছে সে ক্ষণে ক্ষণে। বর্তমান অবস্থা দেখে অন্তরাল হুহু করছে। আদও কি সব ঠিক হবে?
চলবে…
#সাদিয়া_মেহরুজ_দোলা
#হৃদয়েশ্বরী
#লেখিকাঃ সাদিয়া মেহরুজ দোলা
#পর্ব-২৬
_______________
রুহির অবস্থা করুন। পাগলের মতো ছুটছে এদিক- সেদিক। দুপুরে মীরা বেড়িয়ে যাওয়ার পর এখন সন্ধ্যা হতে চললো মেয়েটার কোনো হদিস নেই। জঙ্গলের দিকে এসেছিলো সে মীরাকে খুঁজতে। হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে এসেছে। মীরা নাকি দুপুর বেলাই বেড়িয়ে গিয়েছে। জঙ্গলে আসার পর মীরার ফোন আর চশমা খুঁজে পায় রুহি। তার বুঝতে বেগ পেতে হলোনা ঠিক কি হয়েছে মীরার সাথে। অস্ফুটস্বরে কেঁদে উঠলো সে। বক্ষঃস্থল কেঁপে কেঁপে উঠছে আর্তনাদে৷ বিড়বিড় করে ক্রন্দনরত কন্ঠে বলল,
-‘ আল্লাহ মেয়েটাকে বাঁচাও। ও নিষ্পাপ আল্লাহ। ওকে তুমি রক্ষা করো মাবুদ! ‘
রুহি বদ্ধ উন্মাদের মতো ছটফট করলো কিয়ৎক্ষণ। শেষে ভাবনা – চিন্তা করে উশানকে ফোন করলো। একবার, দুইবার ঠিক তিনবার কল দেয়ার পর ফোন রিসিভ করলো উশান। ঘুমু ঘুমু কন্ঠ। রুহি বুঝলো ফোন দেরীতে রিসিভ করার কারণটা। ওপাশ হতে উশান নম্র কন্ঠে বলল,
-‘ কিছু বলবে রুহি? এই অসময়ে কল করলে যে?’
রুহি ওষ্ঠ দ্বারা অধর চেপে ক্রন্দনের সীমা কমিয়ে আনলো। লম্বা করে শ্বাস টানলো কয়েকবার। অতঃপর নিষ্প্রভ কন্ঠে বলল,
-‘ ভাইয়া..,ভাইয়া মীরা! ‘
মীরা নামটা শ্রবণ করার পর উশান একটু নড়েচড়ে উঠলো। নেত্রপল্লবের বন্ধ পল্লব উন্মুক্ত করে উঠে বসলো সে। ললাটে ইতিমধ্যে বলিরেখা পড়েছে। উশান প্রশ্ন ছুড়লো,
-‘ হু মীরা? তারপর? ‘
-‘ ভাইয়া মীরার সাথে নিশ্চয়ই খুব বাজে কিছু হয়েছে। কেও ওকে তুলে নিয়ে গেছে। ও দুপুর বেলা হাসপাতালে এসেছিলো। এখন সন্ধ্যাবেলা। বাসায় ফিরেনি। আমি জঙ্গলে এসেছিলাম ওর খোঁজ নিতে। তখন জঙ্গলের প্রবেশ মুখে ওর ফোন আর চশমা পরে থাকতে দেখি। সাথে মাটিতে টেনে হিঁচড়ে নেয়ার দাগ। মনে হচ্ছে কেও ওকে টানতে টানতে নিয়ে গেছে কোথাও। আমি আঙ্কেলকে কিছু বলিনি ভাইয়া। আঙ্কেল হার্টের পেশেন্ট! আপনি কিছু করুন না প্লিজ। ‘
অপাশে ঘোর নিস্তব্ধতা! নীরবতার রেশ বজায় তুমুল রূপে। রুহি ভাবলো উশান হয়তো লাইনে নেই। সে চেঁচিয়ে বলল,
-‘ হ্যালো!উশান ভাইয়া? আপনি কি শুনছেন আমার কথা?’
উশান হুঁশে আসলো। দুই, একবার ভীষণ চেষ্টা করলো কিছু বলার। কিন্তু, কি আশ্চর্য! কন্ঠনালীতে যে শব্দজোট পেকেছে। মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। উশান নিজেকেই প্রশ্ন করলো, তার এতো খারাপ কেনো লাগছে? মীরার উধাও হওয়ার খবর শুনে হাত – পা হীম হয়ে অসার হয়ে আসছে কেনো?হতবিহ্বল হতে শান্ত হয় উশান। জিজ্ঞেস করে,
-‘ তুমি জঙ্গলে একা কেনো গিয়েছো রুহি?জলদি ফোনের লোকেশন অন করে ফিরে আসো। আর আমি দেখছি ব্যাপারটা। মীরার কিচ্ছু হবেনা। কান্না বন্ধ করো৷ মাহদি আঙ্কেল কে তো জানাতেই হবে। তার মেয়ে নিখোঁজ! তুমি দ্রুত ফিরে আসো। তারপর দেখছি। ‘
-‘ আমি দ্রুতই ফিরছি ভাইয়া। ‘
উশান কল কেটে ফোন ছুড়লো বিছানায়। ল্যাপটপ অন করে শুভ্রের ডিটেইলস আবার ঘাটতে বসলো। শুভ্র! এই ছেলেই মূলত উশানকে হ’ত্যা করার জন্য হন্য হয়ে চেষ্টা করছিলো। উশান তা আজই জানতে পেরেছে বহু চেষ্টার পরিবর্তে। সকালে তীব্র, দিগন্ত কে সে এই কাজেই ব্যাস্ত রেখেছিলো। কারণ শুভ্রকে খুঁজে বের করা দরকার ছিলো বড্ড। শুভ্র এখন উশানকে মা’রতে না পেরে উশানের আপনজনের পিছে লেগেছে তাদের হ’ত্যা করার উদ্দেশ্যে। নিকট আত্মীয়, আপনজন এরা মানুষের তুমুল দূর্বলতা। শুভ্র হয়তো তাই ভেবেছিলো তাই এরূপ কাজ শুরু করেছে। কিন্তু শুভ্র কি আর জানে?উশানের নিজের জীবনের প্রতি যেখানে বিন্দুমাত্র মায়া নেই সেখানে আপনজনের প্রতি দরদ,মায়া, ভালোবাসা কিভাবে জন্মাবে? ডিফেন্স অফিসারদের পরিবারের প্রতি মায়া রাখতে হয়না। তাদের সবকিছু দেশকে ঘিরে।
তূর্শীর মা তোয়াশাকে শুভ্রই মে’রে’ছে। উশানের সহিত শুভ্রের এরূপ কর্ম করার কারণ অতী তুচ্ছ! আকাশপথে এক মিশনের সময় উশান কিছু সন্ত্রাসী কে গু’লি করে হ’ত্যা করে। সন্ত্রাসীদের মধ্যে ছিলো শুভ্রের বাবা৷শুভ্রের বাবা ছিলো মূল আসামি! তারই পরিপ্রেক্ষিতে শুভ্র বাবার হ’ত্যার বদলা নিতে উশানের পিছে উঠে পড়ে লেগেছে। রুহির কথা শ্রবণ করার পর উশানের কেনো যেনো মনে হচ্ছে মীরার গুম হওয়ার পিছনে শুভ্রের বিশাল বড় হাত আছে অথবা এ কাজ শুভ্রই করেছে। ল্যাপটপে রিসার্চ করার সময় উশানের ফোনে ম্যাসেজ আসে।ক্ষীণ সময়ের জন্য নিজের করা কৃত কাজ বন্ধ রেখে ফোন হাতে নিলো সে। ম্যাসেজটা আননোন নাম্বার থেকে আসা। ম্যাসেজে ছিলো মীরার অচেতন রূপ এবং ছোট্ট কয়েক বার্তা,
-‘ কি অফিসার? গার্লফ্রেন্ড কে নিতে আসবা না? আর কতক্ষন অপেক্ষা করবো? বেশি লেট করলে কিন্তু আমি আপনার সুন্দরী প্রেমিকাকে ছোঁয়ার লোভটা আর সামলাতে পারবোনা। ‘
ম্যাসেজের নিচে ছোট্ট করে লিখা ‘ শুভ্র ‘ নামটি। উশান চটজলদি নাম্বার থেকে লোকেশন ট্র্যাক করার চেষ্টা করে। তবে চেষ্টা বিফলে গিয়েছে!উশান খেয়াল করে, মীরার বিধ্বস্ত রূপ দর্শন করার পর তার হৃদকম্পন শুরু হয়েছে। হাত দু’টো কাঁপছে প্রবল। উশান কয়েকবার উঁচু কন্ঠে তীব্রকে ডাক দেয়ার প্রয়াস চালায়। তবে সে ব্যার্থ! কি আশ্চর্য! কঠিন মানুষটা সামান্য এক নারীর জ্ঞানহীন মলিন মুখোশ্রী দেখে এতোটা এলোমেলো হয়ে পড়ছে কেনো?
_________
মীরা টেনে টেনে শ্বাস নিচ্ছে। সময়ের তালে তালে তার শ্বাস নেয়াটা বড়ই মুশকিল হয়ে পড়েছে। শ্বাসকষ্টের সমস্যা আছে মীরার। নির্দির্ষ্ট সময় পর পর ইনহেলা নিতে হয়। আজ সারাদিনে ইনহেলা নেওয়া হয়নি তার। তার ওপর ধুলোবালি স্তুপে পড়ে আছে। ধুলোবালিতে শ্বাসকষ্টের সমস্যা তার দ্বিগুণ হয়।
মীরার সামনে বসে শুভ্র এবং বাকি কয়েকটা ছেলে বসে মদ্যপান করছে। ম’দ্যপান কালীন মাঝেমধ্যেই ছেলেগুলো লোলুপ, বিশ্রী, কুরুচিপূর্ণ দৃষ্টিপাত ফেলছে মীরার ওপর। নিজেকে আশ্বস্ত, শান্ত করে মীরা। হাতের মুঠোয় লুকিয়ে রাখা ধারালো ছু’রিতে তার হাতের চামড়া কে’টে রক্তিম তরল টপটপ করে গড়িয়ে পড়ছে। সুযোগের অপেক্ষায় অধীর হয়ে বসে থাকে মীরা। এবং ক্ষনিক বাদেই সেই সুযোগটা তার পানে আসে। শুভ্র উঠে দাঁড়ায়। হাতে তার সিরিঞ্জ! সিরিঞ্জে থাকা তরল পদার্থ সে মীরার ঘাড়ে পুশ করে দেয়। এটা নিয়ে মোটা আটবার তাকে সিরিঞ্জ পুশ করা হলো। আঁধারে, চশমা বিহীন মীরা বুঝতে পারে না সিরিঞ্জের তরল পদার্থটা আসলে কি? শুভ্র কাজ শেষে হেলতে দুলতে বিড়বিড় করে গান গাইতে গাইতে বেড়িয়ে যায়। বাকি ছেলে ৩ টে তখন ম’দ্যপানে করে ঝিমুচ্ছে।
শুভ্র যাওয়ার পরই নেত্রযুগল উন্মুক্ত করলো মীরা।পরপর প্রায় ৮ বার সিরিঞ্জ পুশ করার কারণে তার বা দিকের ঘাড় অবশ প্রায়। আলগোছে উঠে দাঁড়ালো মীরা। হাতের রশি ছু’রি দিয়ে আগেই কেটে ফেলেছিলো৷ স্বল্প রশ্মিতে অদূরে দৃশ্যমান হলো তার পার্স। বিড়াল পায়ে এগোলো সেদিকে। ব্যাগ থেকে সন্তপর্ণে ক্লোরোফর্ম বের করে ছেলে গুলোর দিকে এগিয়ে ক্লোরোফর্ম স্প্রে করে। তৎক্ষনাৎ তারা অচেতন হয়ে পড়ে রইল। মীরা মুখে ওড়না চেপেই দ্রুত বেড়িয়ে আসে। তাকে আঁটকে রাখা হয়েছে এখানকার জঙ্গলের পরিত্যাক্ত এক তেলের গোডাউনে। চারপাশ খুঁজে বের হওয়ার রাস্তা পাওয়া গেলো না। মীরা হাস ফাঁস করে বিড়বিড়িয়ে বলল,
-‘ আল্লাহ আমাকে পথ দেখাও। আমায় বাবার কাছে পৌঁছে দাও আল্লাহ!’
শুভ্র আসছে ফিরে। পদধ্বনির শব্দ জোরদার হচ্ছে। মীরা দিকবেদিক শুন্য হয়ে একটা খালি তেলের ড্রামে ঢুকে পড়ে। ড্রামগুলো প্রায় তার সমান এবং যথেষ্ট মোটা। অনায়াসে দুইজন মানুষ বসা যায়। ড্রামের ভিতর থেকেই মীরা শুনলো শুভ্রের উচ্চ স্বরে হাঁকডাক! মীরা আপনমনে বিড়বিড় করে। উশান যেনো আসে। নয়তো তার বাবা! একবার আসুক তার ভরসা যোগ্য দু’জন মানুষ।
_____
-‘ আমার সাথে কেও যাচ্ছেনা। তীব্র তুই এখানে সবার খেয়াল রাখবি। দিগন্ত আমায় ইনফরমেশন দিবে। ‘
সাইলেন্সার লাগানো পিস্তলটা পিছনের দিকে কোমড়ে গুঁজে ব্যাস্ত, কঠিন, গম্ভীর কন্ঠে নিজের বক্তব্য পেশ করলো উশান। শরীরের সকল পেশী তখন টান টান! মাথার শিরা ক্রোধে দপদপ করছে।
তীব্র আতঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-‘ কাওকেই নিবিনা? একদম একা যাবি? রিস্কি এটা উশান। ‘
উশান জলদগম্ভীর কন্ঠে বলল,
-‘ কাওকেই নিচ্ছিনা। শুধু স্থানীয় দু’জন পুলিশ আসবে আমি সেখানকার সবকিছু আয়ত্তে আনার পর।শুভ্র আর ওর দলের লোকদের লাশ আনতে যাবে পুলিশ দু’জন। ‘
উশানের কঠিন মুখোশ্রী দর্শন করে তীব্রের বলার সাহসে কুলালো না ‘ কাওকে নিয়ে যা সাথে! ‘ সে উশানের গম্ভীর রূপটা দেখলে মাত্রাতিরিক্ত নার্ভাস হয়ে পড়ে। তাছাড়া উশান কখনো কারো কথা শুনে না। সে যা বলে তাই। একরোখা, জেদী মানুষটাকে স্বয়ং ক্যাপ্টেন অব্দি বসে আনতে পারেনি। মিশনে নিজের জেদ চাপিয়ে বেড়ায়। তবে দক্ষ, বুদ্ধিমান অফিসার হওয়াতে উশানকে কেও কখনো কোনো কথা শোনাতে পারেনা, পারেনি!
উশান নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সঙ্গে নিয়ে এগোল মায়ানের নিকট। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আদুরে সুরে বলল,
-‘ আমি তোমার বোনকে ফিরিয়ে আনবো।প্রমিস! মন খারাপ করে থাকে না। তুমি চ্যাম্প না? বাবাকে দেখে রাখবে, ওকে?’
-‘ ওকে! ‘ মায়ানের দৃঢ় মন্তব্য।
উশান যাওয়ার পথে একবার মাহদির সাথে দেখা করতে যায়। মাহদি মেয়ের খবর শোনার পর থেকে একদম নিশ্চুপ, মৌন। কারো সাথে কোনো কথা বলছে না। উশান মাহদির নিকট এগিয়ে আশ্বাস দিয়ে বলল,
-‘ মীরার কিচ্ছু হবেনা আঙ্কেল। ট্রাস্ট মি! আমি হতে দিবোনা। আপনি একটু বিশ্বাস রাখুন আমার ওপর।আল্লাহ হাফেজ! ‘
ঝড়ো আবহাওয়ার মাঝে নিজের বাইক নিয়ে শা শা করে ছুটে গহীন অন্ধকারের মাঝে। কানে লাগানো ব্লুটুথ! সেখানে দিক – নির্দেশনা দিচ্ছে দিগন্ত। কোথাও যেতে হবে তা বিশদ বর্ণনা করে উশানকে জানাচ্ছে সে। উশান দিগন্তের বার্তা শ্রবণ করতে করতে এগোচ্ছে সম্মুখে। তার পাথর কঠিন বক্ষঃস্থল আজ অজানা আতঙ্কে নড়বড়ে। নিজের ওপর বিশ্বাস আছে তার। মীরাকে ঠিকই উদ্ধার করে আনবে। কিন্তু কথা হচ্ছে, মীরা কেমন আছে?শুভ্র মেয়েটার ওপর কোনোরূপ অত্যাচার করেনি তো? এই কথা যতবার উশান মনে আওড়াচ্ছে ততবারই কঠিন বক্ষঃস্থলটা হুহু করে কেঁপে উঠেছে। উশান হিসহিসিয়ে বলে উঠলো,
-‘ কঠিনতার খোলসটা তাহলে নম্র হতে চললো? সে দূর্বল হলো প্রথমবার কোনো নারীর প্রতি? ‘
চলবে…
#সাদিয়া_মেহরুজ_দোলা.