হৃদয়েশ্বরী পর্ব-২৯+৩০

0
1043

#হৃদয়েশ্বরী
#লেখিকা-সাদিয়া মেহরুজ দোলা
#পর্ব-২৯
______________

বসন্তটা এবার একটু অন্যরকম।মিষ্টি রৌদ্দুরের বদলে থেমে থেমে বৃষ্টি নামছে একটুক্ষণ পর পর।মেদিনীর রূপ দেখে মনে হবে এখন বর্ষা চলছে।প্রভাতে একাধারে মেদিনীতে বর্ষণ হওয়ার পর দ্বিপ্রহর নামতে ক্ষীণ থেমেছে বৃষ্টির তেজ। মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকা হলদেটে সূর্য উঁকি দিচ্ছে ক্ষণিক পরপরই। শিমুল গাছটার মগডালে বসে থাকা দুই জোড়া কাক ডানা ঝাপটে উড়াল দিলো। ধূসর মেঘের আবর্তে ছেয়ে থাকা অম্বর ধীর পর্যায়ে শুভ্রতায় ছেয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। ঘন সবুজ ঘাসে বর্ষণের জল জমে আঁটসাঁট প্রায়।দুই, তিনটে নেড়ি কুকুর সূর্যের কিরণ দর্শন করা মাত্র ছুটে এলো পরিত্যাক্ত বাড়িটা থেকে।

হাতের ছাতা বেজায় বিরক্তি নিয়ে বন্ধ করে নিলো মীরা। এই বৃষ্টি তো এই রোদ! প্রকৃতির ক্ষণে ক্ষণে রূপ পাল্টানো নিয়ে এই মানবী ভীষণ বিরক্তি, অতিষ্ঠ! হ্যান্ডব্যাগে ছাতা ঢুকিয়ে মীরা হাঁটা ধরলো সামনে। রুহি রিকশার সামনে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে। পদচারণের গতী কিঞ্চিৎ বাড়িয়ে দিয়ে রুহির সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ালো সে।অতঃপর বিরক্তি নিয়ে শুধালো,

-‘ অযথা ছাতাটা আনলাম! বৃষ্টি তো থেমেই গেলো।’

রুহি রিকশায় উঠে বসে মীরার জন্য জায়গা করে দিলো। শ্রবণ করা বার্তা শুনে প্রতিত্তুরে বলল,

-‘ আরেহ্ চিল! আজকে আমরা সারাদিন বাহিরেই। আবার বৃষ্টি আসলে কাজে লাগবে। এখন ওঠ! ‘

মীরা উঠে বসার পর রিকশা চালক যাত্রা শুরু করলো। সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার আজ চারদিন পার হয়েছে। মীরা আস্তে আস্তে করে সেই কালো সৃতিগুলো মস্তিষ্কের নিউরন থেকে মুছে ফেলার প্রয়াস চালাচ্ছে। তিক্তপূর্ণ অতীত মনে রেখে অযথা নিজেকে কষ্ট দিয়ে কি লাভ? ক্যালিফোর্নিয়া যাওয়া প্রসঙ্গে মীরা যখন মাহদির নিকট আবেদন করলো কাল রাতে মাহদি তার আবেদন নাকচ করেননি। স্কলারশিপের ব্যাপারটা তুমুল খুশি হয়ে সে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে। মীরা চমকেছিলো প্রচন্ড। বাবা যে তাকে এতোটা সহজে বাহিরের দেশে পড়তে যাওয়ার অনুমতি দিবে তা সে ভাবেনি। তবে এখানে উশানের হাত আছে কিছুটা। উশানও যাচ্ছে ট্রেনিং নিতে ক্যালিফোর্নিয়া। মাহদির মতে উশান যখন আছে সেখানে মীরা নিশ্চয়ই সুরক্ষিত থাকবে, তারই পরিপ্রেক্ষিতে তার এই সিদ্ধান্ত গ্রহন।

রিকশা উশানের দাদু বাড়ির সামনে থামতেই মীরা ভ্রু’কুটি কুঁচকে নিলো। জিজ্ঞেস করলো,

-‘ রিকশা এখানে থামলো কেনো রুহি?’

রুহি জবাব দেয়,’ তোরে তো বলাই হয়নি। আমাদের সাথে উমাইশা আপুও যাবে শপিং এ। আপুরও কিছু কেনাকাটা করার আছে। ‘

তপ্তশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে সম্মুখে তাকাতেই থমকে রইল মীরা। উমাইশার সাথে আরেকজন ব্যাক্তিও আসছে। উশান!বেশভূষা আকর্ষনীয় বড্ড।কালো টিশার্টের এবং টিশার্টের ওপরে ক্যাজুয়াল হালকা বাদামী রঙের লেদারের জ্যাকেট।চাপ দাঁড়ি সাথে মাথার ছোট্ট ছোট্ট আর্মি কাট দেয়া চুল গুলোই যেনো উশানকে মানিয়েছে বেশ। চোখে চশমা। হাঁটার ধরণের চমৎকার পদচারণ দর্শণ করার পর মীরা শ্বাস রুখে রইল। লোকটা এতো বেশি সুন্দর কেনো?কেনো সর্বদা তাকে ঘোরে ফেলে দেয় এই মানব? চটজলদি অন্যত্রে দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করলো মীরা। উমাইশা তাদের নিকট এগিয়ে মিষ্টি কন্ঠে বলল,

-‘ তোমাদের সমস্যা হবেনা তো আমি সঙ্গে গেলে?বেশি ডিস্টার্ব করছি আমি তাই না? ‘

রুহি চটপট উত্তর দিলো,

-‘ আরে আপু! কিসের সমস্যা? আর বড় বোন সাথে গেলে ডিস্টার্ব ফিল করার কোনো মানেই হয়না। ‘

মীরা অন্যমনস্ক। হুঁশে ফিরিয়ে আনার জন্য রুহি হাতের কনুই দিয়ে মীরার বাহুতে গুঁতো দিলো।সম্বিৎ ফিরে পেয়ে মীরা হকচকিয়ে বলে উঠলো,

-‘ তুমি অযথা নার্ভাস ফিল করছো আপু। আমাদের কোনো ডিস্টার্ব হচ্ছে না। ট্রাষ্ট মি! ‘

-‘ থ্যাঙ্কিউ বোথ অফ ইউ। আসলে কি বলো তো। তোমরা দুইটা এতো চমৎকার মানুষ। তোমাদের সাথে টাইম স্পেন্ড করতে ভালো লাগে। ‘

রুহি গমগম সুরে বলল, ‘ আপু তুমি রিকশায় বসো আমার সাথে। মীরা উশান ভাইয়ার সঙ্গে যাক?উশান ভাইয়াও তো মনে হয় আমাদের সাথে যাচ্ছে তাই না?’

-‘ হ্যা যাবে। ও আমাকে একা ছাড়তেই চাচ্ছে না।’

উশান ফোনে কথা বলায় ব্যাস্ত অদূরে দাঁড়িয়ে। মীরা রুহির প্রতি কড়া দৃষ্টি ফেলে হতাশ হয়ে নামলো রিকশা থেকে। উমাইশা উঠে বসে উশানকে ডাক দিলো উঁচু কন্ঠে। খানিকক্ষণ বাদে উশান ফিরে আসলো। জিজ্ঞেস করলো,

-‘ রুহির সাথে যাচ্ছো আপু?’

-‘ হ্যা। তুই মীরাকে সঙ্গে করে নিয়ে আয়। বাইক আস্তে চালিয়ে আসবি। ‘ মোলায়েম কন্ঠে প্রতিত্তুর।

রিকশা চলে যায়। মীরা অন্তঃকরণে রুহিকে বেশ কয়েকটা ব’কা দিয়ে উশানের মুখোশ্রীর প্রতি দৃষ্টি ফেললো। উশান তার পানেই তাকিয়ে ছিলো। দু’জন এর একসঙ্গে চোখাচোখি হতেই লজ্জায়, ইতস্তত বোধ করে নেত্রপল্লব নিচের দিকে ঝুঁকিয়ে নিলো। মনে মনে প্রস্তুতি নিলো সে কঠিন কন্ঠে কথা বলার।তার বলার পূর্বেই উশান জিজ্ঞেস করলো,

-‘ সারাদিন কি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকার প্ল্যান আছে নাকি মীরা? ‘

হতবিহ্বল হয়ে মাথা তুললো মীরা। কি আশ্চর্য!এই লোক বাইকে গিয়ে কখন বসলো?
মীরা এগোল সামনে। সন্তপর্ণে বসলো বাইকের পিছন দিকের সিটে। অতঃপর কঠোরতা নিয়ে বলল,

-‘ বাইক আস্তে চালাবেন। আমার কিছু হলে আপনাকে কিন্তু জেলে পুরে দিবো। ‘

উশানের তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো। বলল,

-‘ তোমার দ্বারা আদও এটা সম্ভব হবে কিনা ভেবে দেখো তো। ‘

নেত্র পলকে বাইক ছুটছে। মীরা হিমশিম খাচ্ছে ব্যালেন্স ঠিক রাখতে। উশানকে সে ধমকে, রাগ নিয়ে কয়েকবার বলেছিলো বাইকের গতি কমাতে। জেদি, একরোখা লোকটা তার কথা শুনেনি। বরং সে যতো বলতো ততই আরো গতি বাড়াতো উশান। শেষে জরোসরো হয়ে উশানের নিকটবর্তী আসলো মীরা। বিড়বিড় করে স্বগোতক্তি করলো,

-‘ আজ জাস্ট আপনাকে পছন্দ করি বলে উশান। আপনার জায়গায় অন্যকেও হলে তাকে বাইক থেকে ফেলে আমি চরম আঘাত দিয়ে ফেলতাম।’

বাইক থামতেই দ্রুত পদে নামলো মীরা। মাথা থেকে হেলমেট খুলে রুষ্ট কন্ঠে বলল,

-‘ এতো জোরে বাইক চালালেন কেনো আপনি?খারাপ কিছু যদি হয়ে যেতো?তার দায়ভার কি আপনি নিতেন?’

জবানহীন উশান। বাইক থেকে নেমে পার্ক করলো। পরিশেষে নিজ মনে হেঁটে মীরার পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় বলল,

-‘ বাইকটা আমার ম্যাডাম। আমি কিভাবে বাইক চালাবো সেটা নিতান্তই আমার একান্ত ব্যাপার। এখন তোমার সমস্যা হলে আই হ্যাভ নাথিং টু ডু!দোষ এখানে তোমার। আমি তোমাকে বলেছি নাকি আসো! আমার বাইকে বসো। আমার সাথে যাও?’

ক্রোধে কেঁপে উঠলো মীরা। চূড়ান্ত মাত্রার অসভ্য লোকটা তাকে অপমান করে গেলো। উশানের বর্তমান প্রদর্শন করা এটিটিউড দেখে মীরার রাগ হৈ হৈ করে বাড়লো। রাগের প্রকোপে সে লম্বা লম্বা কদম ফেলে সামনে এগোল। পথিমধ্যে পায়ের কাছে আটকালো তার খালি একটা ক্যান। উদ্ভট বুদ্ধি আসে মীরার মস্তিষ্কে। পা দিয়ে খালি ক্যানটাকে সে শূন্যে তুলে উশানের মাথায় নিক্ষেপ করে। কিঞ্চিৎ আঘাতে অস্ফুটস্বরে বিরক্তির ন্যায় ওষ্ঠাধর দু’টো ‘চ’ আকৃতির করে নিয়ে পেছন তাকায় কঠিন কয়েক বার্তা পেশ করতে। ঠিক তখনিই তার পাশ দিয়ে শা শা করে দ্রুত গতিতে ছুটে গেলো মীরা।এবং তার সামনেই পড়ে খালি ক্যান। পুরে ঘটনা সেকেন্ডর মাঝে বুঝে ফেললো উশান। ইশ! মীরাকে যদি এই মূর্হতে সে তুলে আছাড় দিতে পারতো…,

-‘ ভাবীর লগে কাইজ্জ্যা লাগছে নাকি ভাই? ‘

কর্ণকুহরে কৌতূহলী কন্ঠস্বর আসতেই ডানে দৃষ্টি ফেলে উশান। মধ্য বয়সী এক লোক। শপিং মলের সামনে ফলমূল নিয়ে বসেছে বিক্রি করতে।উশান প্রশ্ন করলো,

-‘ জি? ‘

-‘ না মানে কইতাছিলাম যে আপনার বউয়ের লগে কি ঝগড়া লাগছে?একটু আগে হেতি যে আপনার মাথায় বোতলটা লাথি মাইরা দিয়া গেলো। ‘

লোকটার দুই নেত্রে কৌতূক। কন্ঠে কৌতূকের রেশ।যেনো সে বেশ আনন্দ পেয়েছে মাত্র ঘটা ঘটনায়৷ উশান খানিক ইতস্তত বোধ করলো। শ্লেষের গলায় বলল,

-‘ ঝগড়া লেগেছে কিনা জানিনা ভাই বাট আরেকটু পর যে আপনার অবস্থা জনসম্মুখে নাজেহাল হবে তা নিশ্চিত জানি। লুঙ্গি সামলান ভাই! ‘

কিয়ৎক্ষণ পূর্বে মুখোশ্রীতে বিদ্যমান কৌতূক এখন লজ্জায় ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেছে। লোকটা ব্যাস্ত হাতে লুঙ্গিতে হাত দিলো। গিট ঢিলে হয়ে গেছে অনেকটা। উশানের এরূপ কথা বলার মানে বুঝতে পারে সে।
উশান তখন পগারপার! বড্ড বেশি বিরক্ত সে। নিজ ব্যাক্তিগত ব্যাপারে যখন বাহিরের মানুষের উপস্থিতি দেখে তখন ব্যাপারটা বড্ড বিরক্তিকর ঠেকে তার নিকট।

.

মীরা নিজের জন্য কিছু পোশাক দেখছিলো। কোথা থেকে তখন উশান আসলো দ্রুত পায়ে। মীরা তাকে দেখে উল্টো হাটা ধরেছিলো তবে উশানের ধমক তাকে মাঝপথে স্থির রূপে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। মীরা কপাল চাপড়ায়! কি দরকার ছিলো? ক্যানটা এর মাথায় ছুঁড়ে মা’রা’র? তখন অমনটা না করলে কি আর এভাবে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হতো?

উশান মীরার বাহু ধরে হেঁচকা টান দিয়ে নির্জন এক কর্ণারে আসলো। এটা মূলত শপিং মলের সিঁড়ির পেছন দিকটা। কারো নজর যাওয়ার উপক্রম নেই। মীরাকে এক প্রকার ছিটকেঁ ছেড়ে দিয়ে উশান দূরে দাঁড়ালো।শেষে রুষ্ট কন্ঠে বলল,

-‘ এভাবে পালিয়ে পালিয়ে বেড়ালেই মনেহয় আমার থেকে নিস্তার পাবে তুমি! বেয়াদব মেয়ে। রাস্তায় ঐ কাজটা কেনো করলে? ‘

মীরা স্বাভাবিক রাখলো নিজেকে। স্বভাবগত কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়লো,

-‘ কোন কাজটার কথা বলছেন? ‘

-‘ জানোনা না? রাগাবে না মীরা আমাকে। ‘ ধমকের সুরে জবাব।

-‘ ইচ্ছে হয়েছে করেছি। আপনি যেমন আমায় পুরো রাস্তা আতঙ্কে নিয়ে এসেছেন! আমার কথা শোনেননি। তার শাস্তি প্রাপ্য ছিলেন আপনি, সো.. দ্যাট’স হোয়াই আই ডু ইট! ‘

এখন পড়ন্ত বিকেল। সকাল জুড়ে তীব্র বর্ষণের পর দ্বিপ্রহর হতে শীতল হাওয়া বইছে। শীতলতা মীরাকে এসে ছুঁইয়ে দেয়ার পর যতটা না কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়ে গেলো তার থেকেও বেশি কাঁপুনি দিলো উশানের বর্তমান চাহনি। এই লোকটার চোখের গভীরতা অনেক। ধারালো দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে হুহু করে ওঠে বক্ষঃস্থল। এখনকার দৃষ্টি একটু অন্যরকম! আসক্তির ন্যায় মাদকতাময় চাহনি। উশানের নেত্র জোড়া বর্তমানে মীরার প্রতি সম্মোহনী নেত্রযুগল লাগছে।কয়েক মূর্হত চোখে চোখেই কাটলো। মিনিট খানেক পর সম্বিৎ ফিরে পেয়ে মীরা তাকালো অন্যদিকে।

উশান এগোল মীরার নিকটবর্তী। মীরার সন্নিকটে, নিবিড় রূপে দাঁড়ালো। হতচকিত হয়ে মীরা পিছন ফিরতে গেলে উশান বাঁধা প্রদান করে। আলগোছে এক হাত স্থাপন করে মীরার কোমড়ে। টেনে নিয়ে নিজের সাথে আরেকটু নিবিড় করে। তাদের মাঝে ব্যাবধান এখন অতি নূনতম।মীরা কাঁপুনি দিলো! ভয়ংকর কাঁপুনি। হাত – পা শিরশির করছে। লোকটার উদ্দেশ্য কি? কাঁপা কন্ঠে মীরা কোনোমতে জিজ্ঞেস করল,

-‘ এ..এমন করছেন কেনো? ‘

নিরুত্তর উশান! মাথা নামালো মীরার ঘাড়ে।বেশ অনেকটা তাকে নিচু হতে হয়েছে। মীরার কাঁধে থুতনি রাখলো উশান। মুক্ত আরেক হাত দিয়ে জরিয়ে ধরলো মীরার পিঠ। কানের কাছে ওষ্ঠাধর নিয়ে কন্ঠের খাদ নামিয়ে বলল,

-‘ তুমি মানুষ নও মীরা। তুমি মাদকতা, আসক্তি!’

কাঁধ থেকে থুতনি সরিয়ে উশান সোজা হতেই দেখলো মীরার চরম আশ্চর্যজনক দৃষ্টিপাত। ম্লান হাসলো সে। ভরাট কন্ঠে বলল,

-‘ আই এক্সেপ্টেড ইউ ম্যাডাম! গ্রহণ করলাম আপনাকে। আপনার সকল আর্জিকে! আপনার প্রেমময় শহরে প্রবেশ করার নিবেদন আমি গ্রহণ করলাম। ‘

চলবে…

#হৃদয়েশ্বরী
#লেখিকা- সাদিয়া মেহরুজ দোলা
#পর্ব__৩০.
_______________

‘ After Thunder Come’s Rain. ‘

আপাত লহমা দর্শন করার পর উশানের এই বাক্যটি সম্পূর্ণ মিথ্যা মনে হলো। সে যে এই মাত্র বিনা মেঘে বজ্রপাত ঘটালো! কই? মীরার আঁখি দ্বারা তো এক ফোঁটা আনন্দ অশ্রুও বর্ষিত হলো না। বরং মীরা এখন ঠায় দাঁড়িয়ে। কেমন নির্জীব,নিষ্প্রাণ নেত্রে তাকিয়ে আছে।সে ভেবেছিলো মীরা কাঁদবে।খুশির জোয়ারে ভেসে কেঁদে দিবে। কিন্তু তা তো হলোনা।মেয়েটার কান্না ভারী মিষ্টি, সুন্দর!উশান ভেবেছিলো এবার বুঝি আরো একবার মীরার গুপ্ত ক্রন্দন কালীন সৌন্দর্য দেখতে পাবে। তবে তা আর হলো কই? ‘ আচানক অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু পেয়ে খুশির জোয়ারে আত্মহারা রূপে নিস্তব্ধ।’ মীরার ক্ষেত্রে এটাই ঘটেছে বলে মনস্থির করলো উশান।

অচঞ্চল নেত্রযুগল। স্থির, নড়চড় বিহীন পুরো দেহ। নির্মেদ গাল দু’টো মাত্রাতিরিক্ত শীতল হয়ে আসছে ক্ষণে ক্ষণে। হৃদয়স্পর্শী বার্তা গুলো মীরা স্বগোতক্তি করলো পরপর দুইবার, তিনবার! মীরার শান্ত বক্ষঃস্থলে প্রশান্তির অনিল ছুঁয়ে গেলো। মুখোশ্রীতে তার তুমুল হৃষ্টচিত্ত বজায়। তবে তা বুঝি ক্ষনিকের জন্য। কিয়ৎক্ষণ বাদে যখন সে তার জীবনের চরম সত্য মনে করলো, তখন তিক্ততায় অন্তঃকরণ ছাড়ঁখাড়ঁ, এলোমেলো হলো। নিজেকে সামলালো সে। নিষ্প্রাণ কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়লো,

-‘ আমার এটা কেনো মনে হচ্ছে উশান? যে আপনি আমায় দয়া দেখাচ্ছেন। ‘

চমকালো উশান! অবাক হয়ে বলল,

-‘ আশ্চর্য! এখানে ‘ দয়া ‘ শব্দটা কেনো আসলো মীরা? ‘

-‘ আসার কথা নয় কি? যেখানে আমি একদিক দিয়ে অসম্পূর্ণ! কখনো মা হতে পারবো না।আপনাকে কখনো বাবা ডাকার জন্য কাওকে এনে দিতে পারবো না। আমার ভবিষ্যত যেখানে এই অক্ষমতার কারণে বিয়ে হওয়া সম্পূর্ণ অনিশ্চিত সেখানে আপনি হটাৎ আমায় গ্রহণ করছেন? এতদিন আমি আপনার পেছনে ঘুরলাম আর এই সময়টাতেই মনে হলো আপনার আমাকে গ্রহণ করা উচিত? ‘

উশান থমকালো, ভীষণ চমকালো! নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে সে জিজ্ঞেস করলো,

-‘ তুমি জানলে কি করে? আঙ্কেল বলেছে এটা? ‘

মীরা তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো। নেত্র কার্নিশে অদৃশ্য অশ্রুজল ধীরে ধীরে দর্শন দিচ্ছে। দৃষ্টি নত করে মীরা জবাব দিলো,

-‘ না। বাবা বলেনি। আমিই জেনেছি। শুভ্র যখন ১ম বার আমায় সিরিঞ্জ দিয়ে ইনজেকশন পুশ করেছিল তার পূর্বে যেই শিশি থেকে তরল পদার্থ নিয়েছিলো সেই শিশিতে লিখা বাক্য গুলো আমি দেখেছিলাম চশমা ছাড়াই! প্রথমে লিখা গুলো বিশ্বাস করিনি কিন্তু যখন ও আমায় কোমড়ের পাশে পুশ করলো ইনজেকশন তখন ধীরে ধীরে নিশ্চিত হয়েছিলাম ও কোন ইনজেকশন পুশ করেছিলো৷যে ড্রাগ(ঔষধ) শুভ্র আমার ঘাড়ে পুশ করেছে সেগুলে করেছে যাতে প’য়ে’জ’ন এর এফেক্ট জ’রা’য়ু ছাড়া অন্য কোথাও ছড়িয়ে না পড়ে। হাসপাতালে যখন প্রথম জ্ঞান আসলো তখন পেটের অসহনীয় যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে আমার সন্দেহ গাঢ় হয়েছিলো বাকিটা ডাক্তার রাহির কাছ থেকে জেনেছি। ‘

তার কন্ঠে স্বাভাবিকতা। কন্ঠনালী কাঁপলো না বিন্দু মাত্র।কেমন কাঠ কাঠ গলায় জবাব! মীরা কঠিন মনের মেয়ে। সকল পরিস্থিতি দারুণ ভাবে সামলাতে জানে। উশান গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করলো তাকে। পরিশেষে ভাবনা বদলালো। অনেক কিছু বলার আছে তার।

-‘ তোমায় আমি আগে বলেছিলাম কিছু কথা মীরা। তা ভুলে গেছো? নাকি বিশ্বাস করোনি? ‘
অদ্ভুতুরে শোনালে উশানের কন্ঠস্বর। তার নেত্রে হতাশা বজায়! সুপ্ত ব্যার্থতা ফুটফুটে অবস্থায় নজর কেঁড়ে কিছু বলছে যেনো। মীরা খেয়াল করলো তা। কন্ঠে প্রগাঢ়তা টেনে বলল,

-‘ মনে আছে! শুভ্র আপনাকে মারতে না পেরে তখন আপনার নিকটবর্তী আপনজনদের ক্ষতি করা শুরু করেছিলো৷ তাই আপনি আমায় দূরে রাখতেন সর্বদা।অপমান করতেন পদে পদে যাতে আপনাকে আমি ভুলে যাই। এটা বুঝলাম কিন্তু বাকিদের কথা? যারা এ মূর্হতে আপনার সাথে আছে? তাদের সেফটির দরকার ছিলো না?শুধু আমিই কেনো? ‘

-‘ দে আর ট্রেইন’ড! উজান পুলিশ অফিসার,তীব্রের কথা নিশ্চয়ই বলা লাগবে না!দাদু একসময় পুলিশ অফিসার ছিলেন। সবাই নিজেকে সেইফটি দিতে, সেইফ রাখতে জানে। আর কার কথা বলছো তুমি? বাবা? বাবা দেশের বাহিরে থাকে। আপু?সে কয়েকদিন হলো আমার কাছে ফিরে এসেছে।আপু আমার কাছে আসার পর তাকে যথেষ্ট সেফটি দিচ্ছি আমি। ‘

তপ্তশ্বাস ছাড়ার মৃদু শব্দ।তার অধীর দৃষ্টি পড়লো মীরার ওপর। মীরা অন্যত্রে তাকিয়ে। এক দৃষ্টিতে! তার রাগ লাগল একটু।মেয়েটা এমন অন্যমনষ্ক, মনমরা রূপে কেনো? তার কথা গুলো কেনো সে মনোযোগ সহিত শ্রবণ করছে না?

উশান থেমে যাওয়ার পর মীরা মুখ খুললো।জমাট কন্ঠনালী দ্বারা শব্দগুচ্ছ বের করলো,

-‘ আপনার চোখে আমি কখনো নিজের জন্য ভালোবাসা দেখিনি উশান। হটাৎ তাহলে এভাবে কোনো কারণ ছাড়া আমায় এক্সেপ্ট করার মানে কি? ‘

কঠোরতায় ছেয়ে থাকা মুখোশ্রীতে এতক্ষণ পর হাসি ফুটে উঠলো। সে ধরতে পারলো মীরার লক্ষ। ধীরস্থির হাতে উশান মীরার গাল স্পর্শ করলো।অতি কোমলতার সহিত! মীরা ইতস্তত বোধ করলো ফের।লোকটা আজ তাকে এমন আদুরে, মায়াময় স্পর্শ করছে কেনো?
তারপর কয়েকপল! আলগোছে মীরার এলোমেলো কেশের দলকে কানের পিঠে গুঁজে দিতে দিতে প্রতিত্তুর করলো,

-‘ কে বলেছে তোমায় আমি ভালোবাসি?ভালোবাসা কি এতো সহজে, এতো কম সময়ে হয়? তুমি আমার জন্য অন্যকিছু! আমার মাদকতা তুমি। এক বিশেষ মাদকতা। যাকে ছাড়া এক দন্ড শান্তিতে শ্বাস নেয়া দায়! কষ্টকর ভীষণ! ‘

স্থির দু’জনের নেত্র। চোখে চোখে কাটলো কয়েকপল। উশান পল্লব ঝাপটালেও মীরা পলক ফেলতে ভুলে গেলো যেনো। ওষ্ঠাধর কোণে মৃদু হাসির রেশ ফুটে উঠলো।ভারী কন্ঠে বলে উঠলো,

-‘ চোখের পলক ফেলুন ম্যাডাম। পানি এসে জমেছে। এভাবে তাকিয়ে থাকলে চোখে জ্বালা করবে। ‘

ঝটপট নেত্রপল্লব দুই, তিনবার ফেলে মীরা ছিটঁকে সরে দাঁড়ালো৷ স্থিরচিত্তে আঁড়চোখে একবার উশান কে দর্শন করলো। উশানের বলা প্রতিটা বাক্য তার অনেকদিনের আকাঙ্খিত ছিলো। কিন্তু আজ!আজ যখন আকাঙ্খিত চাওয়া পূর্ণ হলো তখন তার মনে হচ্ছে উশানকে নিজের জীবনের সাথে জরানো’টা ভুল হবে? সে যে অক্ষম! উশানের তো কোনো দোষ নেই। তাহলে সে কেনো ‘ বাবা ‘ হওয়া হতে বঞ্চিত হবে? মীরা সিক্ত কন্ঠে শুধালো,

-‘ আমার সাথে জরিয়ে অযথা নিজের জীবনটা নষ্ট করছেন। আমি অক্ষম! কখনো বাবা হতে পারবেন না আপনি। ভেবে দেখুন। ‘

উশান এগিয়ে গেলো। ফের আগের মতো করেই মীরাকে কাছে টেনে নিলো। অতঃপর ফিসফিস করে বলল,

-‘ বাবা হতে চাইনা!হ্যাজবেন্ড হতে পারলেই চলবে তবে তা শুধুমাত্র তোমার হ্যাজবেন্ড। আমার তুমি হলেই চলবে মীরা।আমার আর কাওকে চাইনা।কাওকে না! আমরা দু’জনই যথেষ্ট! ‘

মীরা হটাৎ তাড়া দেখিয়ে অস্থিরপ্রায় হয়ে বলল,

-‘ আই নিড টাইম! আসছি।’

-‘ ও.কে! টেক ইউর টাইম। বাট এন্সার পজিটিভ চাই ম্যাডাম। নয়তো আপনাকে কিডন্যাপ করে তুলে আনতে আমি দ্বিধা করবো না। মাইন্ড ইট! ‘

দ্রুত পদে সিঁড়ির পেছন হতে বেড়িয়ে আসলো মীরা। আসার মাঝে, পথিমধ্যে হটাৎ থেমে গিয়ে বিড়বিড়িয়ে বলল,

-‘ কম কষ্ট দেননি উশান। আপনাকে নাকানিচুবানি না খাইয়ে আমি আপাতত কোনো কিছুই জানাচ্ছি না। ইউ হ্যাভ টু ফিল মাই পেইন! হাহ্! ‘

____

রজনীর তৃতীয় প্রহর। ঘুমন্ত নগরীতে মাঝেমধ্যে ডেকে উঠছে তিন, চারটে নেড়ি কুকুর। সময় সাপেক্ষে ফের তারা মৌন রূপ ধারণ করছে।অনিলে বইছে বিভিন্ন পুষ্পের মিষ্টি সুঘ্রাণ। কৃষ্ণপক্ষের শেষ তিথির রজনী আজ। কৃত্রিম রশ্মি ব্যাতীত চন্দ্রের দর্শন পাওয়া মুশকিল! ভোর হয়ে এলো বলে এখনি, গাছের ডালে বসে থাকা পক্ষী দল ডেকে উঠলো মৃদু শব্দে। সেই শব্দ প্রতিধ্বনিত হলো চারপাশে ঘোর নীরবতা ধ্বংস করে।

চার দেয়ালের কক্ষটায় শীতলতা বজায়।ওয়াশরুম থেকে থেমে থেমে আসছে গুমোট ক্রন্দনের বিষন্ন সুর। ডুকঁরে কেঁদে উঠছে মীরা। সাওয়ারের নিচে এলোমেলো রূপে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে সে শুয়ে রয়েছে শুভ্র রাঙা ভূমিতে। সাওয়ার থেকে পানি পড়ছে ঝমঝম শব্দ করে। এই শব্দ তার ক্রন্দনের ধ্বনি বহির্ভাগে যাওয়া হতে রুখে দিচ্ছে ক্রমাগত। মীরা শপিং মল থেকে আসার পর সেই যে সাওয়ার নিচে শুয়ে কাঁদছে, এখন প্রায় আট ঘন্টা হতে চললো ওর কোনো হেলদোল নেই। শরীরের তাপমাত্রা ইতিমধ্যে কমতে শুরু করেছে। মুখোশ্রী ফ্যাকাশে, বিবর্ণ তার! হাত- পা, সর্বাঙ্গ অতি মাত্রায় শীতল, হীম। বিড়বিড় করে মীরা কিছুক্ষণ পর পর বলছে,

-‘ আমি কখনো ‘ মা ‘ ডাকটা শুনতে পাবোনা আম্মু। ওরা আমার মা হওয়ার ক্ষমতা কেঁড়ে নিয়েছে।আমাকে বাজে ভাবে ছুঁইয়ে দিয়েছে। আমাকে তোমার আঁচলের নিচে লুকিয়ে নাও আম্মু। আমার প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে! যন্ত্রণা হচ্ছে! আমি আর পারছিনা। পারছিনা ভালো থাকার কৃত্রিম নাটক করতে। আমি তোমার কাছে যাবো আম্মু। আমাকে নিয়ে যাও তুমি। ‘

অতঃপর ভারী ক্রন্দন! কান ফাটা আর্তনাদময়ী কান্না ছাপিয়ে পড়লো চার দেয়াল জুড়ে। কিয়ৎক্ষণ বাদে মীরা আবছা দেখলো তার মা’কে আরশির মাঝে।নীল শাড়ী পরিহিত তিনি। তার দিকে চেয়ে মুচকি হাসছে। হাসলো সে! মিষ্টি হাসি। হাত বাড়িয়ে দিলো মায়ের দিকে। অতঃপর সবকিছু অন্ধকার..! নেত্রযুগল অনায়াসে বন্ধ হয়ে এলো তার।

চলবে…