#হৃদয়েশ্বরী – ৩৭
সাদিয়া মেহরুজ দোলা
_______________________________
মীরা পাগলের ন্যায় আচরণ করছে। কখনো নিজের চুল টানছে তো কখনো নিজেকেই অত্যান্ত বাজে ভাবে আঘাত করছে।নার্স তাকে ঘুমের ঔষধ দিতে আসায় দেখা গেলো মীরা তাকেও আঘাত করে বসলো। কেবিনে উপস্থিত ডাক্তার দু’জন অতিষ্ঠ। তাদের মতানুসারে, মেয়েটার মাথায় এতোটা গভীর ক্ষতের ফলস্বরূপ তার ব্যাথায় ক্ষণে ক্ষণে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার কথা। আর এই মেয়েকে দেখো! একটু যদি শান্ত হতো। তীব্র দৌড়ে আসলো পরপরই। এসে মীরার অবস্থা দর্শন করে শুকনো ঢোক গিললো। কেবিনের এক কোণে ডাক্তার দু’জনকে নিজেদের মধ্যে আলাপচারিত করতে দেখে তার মাথায় রক্ত উঠে গেলো মূর্হতেই।উশান এসময় এখানে উপস্থিত থাকলে ডাক্তার দু’জনের মাথা ফাটিয়ে দিতো বোধহয়।
-‘ পেশেন্টকে এভাবে বাজে অবস্থায় রেখে আপনারা ওখানে কি কিসের পিরীতের আলাপ করছেন?’
পরপর বাজে দুই তিনটা গালি ছুড়লো তীব্র বাংলা ভাষায়। যা ডাক্তার দু’জন বুঝলো না। তবে তাদের যে অতি সুন্দর বার্তাও ছুঁড়ে দেয়া হয়নি তা তারা তীব্রের মুখোশ্রী দর্শন করা মাত্রই বুঝেছে। ডক্টর. ক্লিওরা এগিয়ে এলো বিরক্তি সহিত। তীব্রের সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলল,
-‘ মাইন্ড ইউর ল্যাঙ্গুয়েজ! স্পিক ইন এ লো ভয়েজ।’
তীব্রের ইচ্ছে হলো ক্লিওরার মাথা ফাটিয়ে দেয়।পরবর্তী কথাগুলো ইংলিশেই বলা শুরু করলো সে,
-‘ মীরা এমন করছে কেনো? কি হয়েছে ওর? ‘
-‘ ও কাওকে চাচ্ছে! যার কারণে ওকে আমরা শান্ত করতে পারছিনা। নার্স ঘুমের ঔষধ দেয়ার চেষ্টা করেছিলো কিন্তু ও নার্সের ওপর হামলা করেছে। আঘাত করেছে। আপাতত মনে হচ্ছে না ওকে ঘুমের ঔষধ দিয়ে বশে রাখা যাবে না। ওর মাথা ঠান্ডা রাখা প্রয়োজন। চিন্তামুক্ত থাকতে হবে। তাই সে যাকে চাচ্ছে তাকে আসতে বলুন। ‘
-‘ কাকে চাচ্ছে? কারো নাম বলেছে? ‘
ক্লিওরা নিজের ভ্রু’দ্বয়ের মাঝখানে ভাজ ফেললো। মনে করার চেষ্টা করলো সে এতক্ষণ যাবৎ কি শ্রবণ করেছে। কাঙ্ক্ষিত বার্তা স্বরণে আসতেই শুধালো,
-‘ ও বলছে ‘ উশান! হি ইজ অলরাইট? ‘ এটাই বলছিলো বারবার। উশান কে? আপনি? ‘
তীব্র দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো।মীরার দিকে আঁড়চোখে তাকিয়ে জবাব দিলো,
-‘ উশান হার হ্যাজবেন্ড। আই এ্যাম নট উশান। ‘
-‘ ওহ! হোয়ার ইজ হি? ডিড হি ডাই ইন দ্যাট এক্সিডেন্ট? ‘
তীব্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত ছুড়লো। ক্লিওরা অপ্রতিভ হয়। আচানক এরূপ চাহনির অর্থ তার বোধগম্য হলো না। তীব্র শক্ত কন্ঠে প্রতিত্তুর করলো,
-‘ হি ইজ এলাইভ। ‘
মীরা কান্না শুরু করেছে।তীব্র বারবার করে বোঝানোর চেষ্টা করেছে তাকে, যে উশান ঠিক আছে।সুস্থ আছে। তবে মীরা মানছেই না৷ ক্লিওরা সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে উশানকে মীরার কাছে না আনা পর্যন্ত তাকে শান্ত করা যাবেনা কিছুতেই। তীব্র হতাশ হয়! উশান তাকে পাঠিয়েছিলো মীরা রুহি আর টুইঙ্কেলের দেখভাল করার জন্য। রুহি, টুইঙ্কেল সুস্থ আছে।তারা ঘুমে বিভোর। আঘাত বেশি পেয়েছে মীরা। তার মাথায় স্টিচ লেগেছে। হাত ভেঙেছে, পা মচকে গিয়েছে।উশান আপাতত এক্সিডেন্ট স্পটে আছে।ইফরাদের লাশ খোঁজা হচ্ছে। ছেলেটার শরীরের এক টুকরো মাংসও খুঁজে পাওয়া যায়নি। গাড়ি বিস্ফোরণের সাথে সাথে ইফরাদের পুরো শরীর শত খন্ডে বিভক্ত হয়েছে।দেহ ছিন্ন – বিচ্ছিন্ন হয়ে পানির অতল গহ্বরে তলিয়ে গিয়েছে। গাড়ি সড়ক ছিটকে পড়েছিলো নদীর ভেতর৷
তীব্র কল করে উশানকে।দুই, একবার রিং হওয়ার পর ফোন রিসিভ হয়। ওপাশ থেকে ভেঙে ভেঙে আসে উশানের জলদগম্ভীর কন্ঠ,
-‘ কি হয়েছে? ‘
-‘ মীরার অবস্থা ভালো না উশান। ও অদ্ভুত আচরণ করছে। বারবার তোকে দেখার জন্য আকুতি মিনুতি করছে। আমাকে চিনছেই না ঠিকমতো। ডাক্তার বারবার করে বলছে ও যাকে চাচ্ছে তাকে যেনো এখনি ওর সামনে হাজির করা হয়। নাহলে বিরাট সমস্যা হবে। তুই একটু আসবি?আমি নাহয় ওদিকটা দেখি। ‘
মিনিট দুয়েকের নীরবতা।তীব্র ভাবলো, হয়তো সংযোগ বিছিন্ন হয়েছে। তাই সে বেশ কয়েকবার উশানের নাম ধরে ডাকলো। অতঃপর আচানক ওপাশ হতে নিজের স্বভাবগত কন্ঠে বলল,
-‘ আসছি আমি। ‘
মীরার পানে অবলোকন করে স্বস্তির শ্বাস ফেলে তীব্র। তবুও কোথায় যেনো কিঞ্চিৎ পরিমাণ ভীতি জমে। মীরার অবস্থা ভালো না। ক্লিওরার সাথে কথা বলে সে জানতে পেরেছে। টুইঙ্কেল কে সুরক্ষিত রাখতে গিয়ে মীরা নিজেতে ধ্যান দিতে পারেনি। তার মাথা গিয়ে বাড়ি খেয়েছে পাথরের ওপর। কিছু ঘটনা সে ভুলে যাবে বলে আশঙ্কা করছে ক্লিওরা।সে বলেছে এই আঘাত ভবিষ্যতে খুব সমস্যায় ফেলতে পারে মীরাকে৷
____
-‘ আম্মু! আমাদের তো যথেষ্ট পরিমাণে টাকা আছে, তবুও কেনো তুমি আমায় প্রতিনিয়ত টাকার জন্য মানুষ খু’ন করতে বলছো?আমার আর এসব ভালো লাগেনা আম্মু। আমাকে তুমি মুক্তি দাও! বাবাকে ফেরত দাও। ‘
রাহনুমা পানি খাচ্ছিলো। সিয়ার কথা তার কর্ণপাত হতেই হাতের কাঁচের গ্লাসটি সে সিয়ার পায়ের দিকে ছুঁড়ে মারে স্ব-শক্তিতে। অস্ফুট আর্তনাদ বেড়োয় তৎক্ষনাৎ সিয়ার ওষ্ঠাধর প্রসারিত হয়ে। পায়ের দিকে অবলোকন করতেই দর্শন হয় কাঁচের গ্লাসের প্রতেকটি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র টুকরো তার পায়ের নরম মাংস ভেদ করে ভেতরে ঢুকে গিয়েছে। শুষ্ক ভূমিতে ক্ষণেই রক্তিম তরল পদার্থ দ্বারা সিক্ত হয়। রাহনুমা দ্রুত পদে এগোল সিয়ার সন্নিকটে। সিয়ার নিকটবর্তী পৌঁছে সে বাজখাঁই কন্ঠে বলল,
-‘ বাপ! বাপ আর বাপ! ঐ ফ’কি’ন্নি, তোর বাপ তোর আর আমার সাথে কি করছে মনে নাই তোর? সব ভুলছস? আর টাকা থাকুক! তবুও আমি যাই বলমু তোরে তা করতে হইবো। বুঝছস? নাইলে তোর বাপ কে আমি কাইট্টা এই সাগরে ভাসামু। ‘
অস্থির পদচারণের শব্দে মুখরিত হলো চারিপাশ। সিয়া এক প্রকার দৌড়ে বেড়িয়ে আসলো রুম থেকে। এখানে থাকা মানে স্বেচ্ছায় নরক যন্ত্রণা উপভোগ করা।এই স্থানটা তার সবকিছু কেঁড়ে নিয়েছে। তার মা, তার বাবা,তার সম্মান, ইজ্জত! সুন্দর একটা জীবন! সবকিছুই কেঁড়ে নিয়েছে।অতি অল্প বয়সে হয়েছে সে ধ’র্ষি’তা এই স্থানটায়।বাবাকে শেষ দেখেছে এখানে।রাহনুমাকে স্বচ্ছ মানুষ থেকে জা’নো’য়া’রে রূপান্তর হতে দেখছে এখানটাতেই। সিয়া অস্থির পায়ে দৌড়ানো আরম্ভ করলো।থামার নামগন্ধ নেই তার মাঝে। আশপাশে অনেকে বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছিলো।সিয়াকে দৌড়ে যেতে দেখে তারা শালীন পোশাক দ্বারা আবৃত সিয়ার দেহে লোলুপ দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে ভুললো না। সমুদ্র পৃষ্ঠ এবং পুরোপুরি নির্জন, জনমানবহীন এক স্থানে আস্তানা গেঁড়েছে এই তুখোড় সন্ত্রাসী দল। তারা তাদের আস্তানা এমনই এক জায়গায় তৈরি করেছে দেখা যায় এখানে অনেক সময় সূর্যের রশ্মি অব্দি পৌঁছায় না। বাহিরে আসার পর সিয়া ফ্লাশ লাইট অন করলো ফোনের। দিন হলেও রশ্মি নেই এখানকার বাতাবরণে। প্রায় দুই ঘন্টার মতো হেঁটে সমুদ্রের দেখা মিললো তার। এলোমেলো, অবিন্যস্ত কদম ফেলে সিয়া মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো ভূমিতে৷ সমুদ্রের লবনাক্ত পানি তৎক্ষনাৎ তার পুরো দেহ স্পর্শ করে আবারও পূর্বের স্থানে ফিরে গেলো চট করেই। নিভু নিভু নেত্রে সে সম্মুখে দৃষ্টি ফেলে। এই স্থানটা তার চির-পরিচিত। যেদিন তাকে প্রথম ধ’র্ষণ করা হলো, ধ’র্ষ’ণ শেষে তাকে এখানেই ফেলে গিয়েছিলো। বয়স বড়জোর তার কত ছিলো তখন?নয় কি দশ! লবনাক্ত পানি গলাধঃকরণ করা মাত্র তার আঁখি জোড়া বদ্ধ রূপে রূপ নিলো। অপরাহ্নের সেই অলস লহমায় তার দেহ বালির ওপর পড়ে রইল নিষ্প্রাণ রূপে।
___
-‘ উঠবেনা? ‘
মীরা জড়োসড়ো হলো। আরেকটু নিবিড় করলো বন্ধন। দুরত্ব ঘুচালো মধ্যকার। উশানের বক্ষঃস্থলে ঘন ঘন মুখে ঘষেঁ বুক ভরে শ্বাস টানলো। মিষ্টি এক ঘ্রাণ তার নাসারন্ধ্র দ্বারা তরতর করে প্রবেশ করলো অন্তর্ভাগে। পুরুষালি ঘ্রাণ!উশানের গা থেকে মৃদু রূপে আসছে। প্রায় চার, পাঁচ মিনিট পর মৌনতা কাটালো মীরা। অভিযোগের স্বরে বলল,
-‘ আপনি খারাপ। বেয়াদব, অসভ্য! ‘
উশান হেঁসে উঠলো। হাসি থামলো মিনিটখানেক পর। গাঢ় কন্ঠে সে বলল,
-‘ আচ্ছা? লুকিয়ে লুকিয়ে আমাকে শেহজাদা কিন্তু আপনিই বলেন ম্যাডাম। বাহিরে এসব আমাকে দেখিয়ে অসভ্য, বেয়াদব বলে লাভ নেই। ‘
স্থির মুখোশ্রীতে ত্রপা এসে আক্রমণ করে বসলো। মেদহীন,শ্যাম বর্ণের গাল দু’টো হলো লাল।অন্তঃস্থল প্রশ্ন ছুড়লো, লোকটা জেনে গিয়েছে তাহলে?
-‘ আমাদের বিয়ে হয়েছে। এই ব্যাপারটা আগে পরিস্কার করে বললে কি হতো আপনার? হাত – পা ভেঙে, ফকির হয়ে রাস্তার ভিক্ষুক হয়ে যেতেন? ‘
-‘ ফকির তো হতাম না ম্যাডাম তবে এখন যে আপনাকে সামলাতে এটাই কাজে দিলো। আগে বললে এই ট্রিক’স কাজে লাগতো? উঁহু! ‘
কথাটা সঠিক বৈকি। মীরার অস্থির, আনচান অবস্থা স্থির করতে উশানের বলা মাত্র একটি বাক্য অস্থির মীরাকে চির নিস্তব্ধ করেছে। শিথিল করেছে মীরার পাগলামি, ছোটাছুটি! মীরা এখন থেকে উশানের বউ। তাদের বিয়ে হয়েছে। বাকদ্ব্যয় শ্রবণ করা মাত্র মীরা মৌনতায় ধাপ টেনেছিলো নিজের মাঝে।
উশান মীরাকে গভীর, সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে নিলো পুরো লহমা জুড়ে৷ তার চাহনি বেফাঁস, একটু অন্যরকম। মীরার পিঠে নিজের হাত শক্তপোক্ত করে স্থাপন করে মীরাকে কাছে টানলো সে।কন্ঠের খাদ নামিয়ে হিসহিসিয়ে বলল,
-‘ এভাবে লজ্জা পাচ্ছেন কেনো ম্যাডাম? আমি কি আপনাকে দুষ্টু আদর দিয়েছি? ‘
চমকিত নেত্রে মীরা মাথা ওপর করলো। দৃষ্টি একত্রিত হলো দু’জনের। উশানের নেত্রে বজায়মান অদ্ভুত, উচাটন অনুভূতি পড়ে শিরশিরিয়ে উঠলো তার সর্বাঙ্গ। উশান নিয়ন্ত্রণহীন হলো ক্ষনেই৷অস্থির কন্ঠে শুধালো,
-‘ কাঁপাকাপিঁ থামান ম্যাডাম। আমি কন্ট্রোলেস হয়ে পড়ছি৷ ‘
উশান থামলো। কিয়ৎ পর আচানক বলে উঠলো,
-‘ তোমাকে চুমু খেতে ইচ্ছে করছে মীরা। ক্যান আই?’
অনুমতি চাইলো ঠিকই তবে উচাটন অন্তঃকরণ অনুমতির অপেক্ষায় আর রইল না। উশান নতজানু হয়ে ওষ্ঠাধর ছোঁয়ালো মীরার ললাটে। একবার, দুইবার, পরাপর তিনবার উত্তাপ অধর ছুঁইয়ে সে বেড়িয়ে আসলো কেবিন থেকে৷ ওখানে আপাত লহমায় উপস্থিত থাকা মানেই বিপদ। নিশ্চিত মীরা এখন লজ্জায় লাল, নীল হবে। তা দর্শন করা মাত্র উশানের অবস্থা আরো বেহাল হবে। অনর্থ করতে মন চাইবে। তার চেয়ে বরং মীরার থেকে আপাতত দূরে থাকাই ভালো।
উশান করিডরে আসলো। ফোন বের করে তার আর ইফরাদের বহু পুরাতন ছবিটা স্ক্রিনে মেলে ধরলো। অধর জোড়া তার প্রসারিত হয়ে বের হয়ে আসলো দীর্ঘ নিঃশ্বাস। বিড়বিড়িয়ে আপনমনে বলল কিছু। অতঃপর দৃষ্টি ফেললো সম্মুখে। সূর্য ডুবো ডুবো প্রায়। বিদায় নিচ্ছে মেদিনী হতে। উশানের আচানক মনে হলো, ইফরাদ সেই সূর্যটার সহিত আস্তে ধীরে পৃথিবীর অনিল, সৃতিচারণ, বাতাবরণ হতে পূর্ণ রূপে বিদায় নিচ্ছে। বক্ষঃস্থল ভার হয়ে এলো তার।নিম্ন কন্ঠে বলল,
-‘ হাশরের ময়দানে যেদিন আমাদের দেখা হবে আবার সেদিন তোকে আমি কখনোই মাফ করবো না ইফরাদ। নিজের ইচ্ছেয় মৃত্যু গ্রহণ করলি। একবারও টুইঙ্কেলের কথা ভাবলি না।ওকে এখন কিভাবে সামলাবো আমি? ‘
চলবে…
#হৃদয়েশ্বরী – ৩৮
সাদিয়া মেহরুজ দোলা
টুইঙ্কেলের ঘুম ভেঙেছে আধাঘন্টা হলো। তার কাছে কেও নেই। একা শুয়ে বসে টুইঙ্কেল তার হাতে করা ক্যানুলা খোলার প্রয়াস চালাচ্ছিলো। তবে ক্যানুলা ধরে টান দিতেই তার অনুভূত হয় অসীম যন্ত্রণা। ব্যাথায় ঠোঁট উল্টে ছোট্ট ছোট্ট আঙুল দ্বারা নিজের অধর জোড়া চেপে ধরে সে। নিম্ন কন্ঠে ক্রন্দনরত কন্ঠে বলে,
-‘ হোয়ার আর ইউ পাপা? আই মিস ইউ সো মাচ।’
একা একা বিনাশব্দে ক্রন্দনকালীন টুইঙ্কেল টের পেলো তার ভীষণ খিদে পেয়েছে। সাথে প্রাকৃতিক ডাকও এসেছে। লহমায় তার অবস্থা এলোমেলো, অবিন্যস্ত হয়ে পড়লো। পায়ে এমন মোটা ব্যান্ডেজ, তার ওপর হাতে লাগানো ক্যানুলা! এভাবে করে সে ওয়াশরুমে যাবে কি করে? খাবার বা চাইবে কার কাছে? কেও তো নেই আশপাশে। অনেকবার হাঁক ছেড়ে সে ডেকেছিলো ইফরাদকে, উশানকে। কেওই সাড়া দেয়নি। খুদা সহন করতে পারে না টুইঙ্কেল। সে ফের ভাঙা গলায় ডাকলো ইফরাদকে। আসলো না কেও। ঠোঁট ভেঙে ডুকরে কেঁদে উঠলো টুইঙ্কেল।অস্ফুটস্বরে বলল,
-‘ বাবা! তুমি কি আমার ওপর রাগ করেছো? আমি কি কোনো দুষ্টুমি করেছি? কেনো আসছো না তুমি আমার কাছে? আই প্রমিজ বাবা আমি আর দুষ্টুমি করবো না। তুমি একটু আমার কাছে আসো। হাতে ব্যাথা করছে আমার, ফু দিয়ে দাও না।খুদা পেয়েছে বাবা। একটু খেতে দাও৷ ‘
গুমোট, নিস্তব্ধ কক্ষটায় টুইঙ্কেলের বক্ষপিঞ্জর ভাঙা আর্তনাদ ছিটকে গিয়ে ছড়ালো চারপাশে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়লো ক্রন্দনের গতি। কারো দেখা নেই তবুও। তীব্র ক্ষুধার চোটে, অনাকাঙ্ক্ষিত অদৃশ্য এক কষ্ট ছাপ নিয়ে টুইঙ্কেল তুলতুলে সেই বিছানায় পড়ে রইল অনেকক্ষণ দূর্বল রূপে।
____
উজান আজকাল বিশেষ ভাবে পর্যবেক্ষণ করার পর একটা জিনিস উপলব্ধি করেছে আর তা হচ্ছে সিয়া! সিয়ার ব্যাপারটা। সিয়া ইদানীং খুব বেশি তার সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করছে। জানার আগ্রহ প্রকাশ করছে তার ব্যাক্তিগত জীবন সম্পর্কে। সিয়ার আরো কিছু ব্যাবহার এবং আচরণ উজানকে দিনকে দিন নানাবিধ প্রশ্নের সামনে ঠেলে দিচ্ছে। সিয়াকে তার নিকট সুবিধার ঠেকছে না। একটুও না! গন্ডগোল আছে বিশাল আকৃতির। সে কয়েকদিন আগেই জানতে পেরেছে রাহনুমা, সেই তুখোড় সন্ত্রাসী দল, তারা উশান, উজানের পিছে লোক লাগিয়েছে। উজানের সন্দেহ গাঢ় হচ্ছে।তার বারবার মনে হচ্ছে সিয়া সেই সন্ত্রাসী দলের সাথে কোনো না কোনোভাবে জড়িত রয়েছে। তার আচরণ – কর্ম তাই পেশ করছে।
ল্যান্ডলাইন কানে ধরে রাখা। মুক্ত হাতটা দ্বারা ব্যাস্ত হাতে টেবিলে রাখা স্যান্ড ক্লক উল্টালো উজান। মুখোশ্রীতে আচানক রাজ্যের ব্যাস্ততা ফুটে উঠেছে। অন্তঃস্থল বারংবার কু ডেকে বলছে হিসাব মিলেছে!তার সন্দেহটাই সঠিক৷
কড়মড় ধ্বনি তুলে উশানের কামড়ায় কেও আসছে তখন। ল্যান্ডলাইন কান থেকে নামিয়ে রেখে সম্মুখে দৃষ্টিপাত স্থির করলো উজান। তার চক্ষু সম্মুখে তখন দাঁড়িয়ে সিয়া। অদ্ভুত বেশে। এলোমেলো পায়ে ছুটে আসলো সে।উজানের নিকটবর্তী দাঁড়িয়ে টলমলে নেত্রে তাকালো। উজান ভড়কায়! কন্ঠে স্বাভাবিকতা বজায় রেখে প্রশ্ন ছুঁড়ে,
-‘ আপনি এখানে! ‘
প্রতিত্তুর পাওয়া গেলো না। তবে তৎক্ষনাৎ ভীষণ অদ্ভুত এক দৃশ্যের দর্শন মিললো। সিয়া হাঁটুগেড়ে বসলো ভূমিতে। আচানক, শব্দ করে! উজানের দুই পা জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে দিয়ে বলল,
-‘ আমাকে বাঁচান! আ..আমাকে বাঁচান দয়া করে।ওরা,..ওরা আমাকে বাজে ভাবে ছুঁইয়ে দিচ্ছে, ব্যাথা দিচ্ছে। আমার সম্মানে কলঙ্ক এঁটে দিচ্ছে। দয়া করে আমাকে বাঁচিয়ে নিন। ‘
কাঁপাটে, ভীতিগ্রস্ত কন্ঠস্বর। উজানের অন্তর্ভাগ উলোট-পালোট হলো। সিয়া তখন হুঁশে নেই। সে নিজেকে লুকাতে ব্যাস্ত। টেবিলের নিচে গিয়ে হাটুঁ ভেঙে গুটিশুটি মেরে বসলো। তার মাঝে হিতাহিত জ্ঞান নেই আপাতত। সিয়ার মস্তিষ্ক জুড়ে বিচরণ করছে সেই দশ বছর আগের রাত্রিকালীন লহমা। যেদিন তাকে নিষ্ঠুর, পাষণ্ডিক ভাবে নির্যাতন করা হলো। রক্তা’ক্ত করে ফেলে রাখা হলো। সেই মন – প্রাণ ধ্বংস করা কটু, তিক্ত লহমা তার নিউরন জুড়ে বিচরণ করছে আপাত ক্ষণে।
বলা হয়! দুঃখের সময় নাকি নিতান্তই ক্ষনিকের। অল্প পরিসরের।দুঃখের পর সুখ আসে এটাই নাকি প্রকৃতির নিয়ম। কিন্তু সিয়ার গোটা জীবনটা জুড়েই যে কষ্ট, দুঃখে ভরা। তাহলে এ কথার মিল হলো কোথায়?
_____
মীরার মেডিক্যাল রিপোর্ট হাতে নিয়ে উশান বসে ছিলো একাকী। নিষ্প্রাণ, নির্জীব নেত্র যুগলের স্থির দৃষ্টি তখন আবদ্ধ রিপোর্টের গোটা কালো অক্ষর দিয়ে লিখা শব্দগুলোর প্রতি। শব্দ গুলো বিষাক্ত! বিষে ভরা তিক্তপূর্ণ বাক্য। এই রিপোর্ট মীরার মাথার গুরুতর আঘাত পাওয়ার জন্য করা হয়েছে। রিপোর্ট এ্যাবনরমাল, নেগেটিভ। মীরা সুস্থ নেই! একটুও না। এমনিতে ছোট সময়ে মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত ছিলো তার ওপর আবার নতুন করে এই আঘাত সংযুক্ত হলো। সৃতিজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে। নয়তো মীরার পাগল হয়ে যাওয়ার চান্স আছে। সৃতি শক্তি জনিত সমস্যাটার ইতিমধ্যে দর্শন মিলেছে। মীরার জ্ঞান ফেরার পর উশান ছাড়া আর কাওকেই সে চিনতে পারেনি। উশানের সঙ্গ পেলেও তার ব্যাবহার ছিলো উদ্ভটতম।
খামের ভেতর রিপোর্ট ঢুকিয়ে উশান হাঁটা ধরলো মীরার কেবিনের উদ্দেশ্যে। থেমে থেমে অন্তঃকরণ থেকে বেড়িয়ে আসলো জোড়াল দীর্ঘ নিঃশ্বাস।এই দিনটাই বোধহয় অভিশপ্ত। তাই সবকিছু খারাপ হচ্ছে। ডাক্তারের সাথে কথা বলেছে উশান। তাদের বক্তব্য দীর্ঘ সময় নিয়ে মীরার চিকিৎসা করতে হবে। তাহলে মীরার সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়াটা হয়তো দেখা যাবে।
মীরা ঘুমোচ্ছে। উশান আসার পরপরই ঘুমিয়ে পড়েছে সে। উশান নিঃশব্দে এগোল মীরার নিকট। ফিরে যেতে হবে তাকে ক্যাম্পে। বারংবার ফোন আসছে। মীরার পাশে বসে উশান মীরার মুখোশ্রী দর্শন করলো সময় নিয়ে। অবিন্যস্ত কোঁকড়া চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে মৃদু রূপে ওষ্ঠাধর ছোঁয়ালো মীরার ললাটে৷ ঘুমন্ত মীরা নড়েচড়ে উঠলো। হুঁশে থাকলে এতক্ষণ নিশ্চিত নিজের গাল দু’টো লাল করে ফেলতো। মেয়েটা লাজুক! মাত্রাতিরিক্ত। মীরার কানের পিঠে আঙুল ছুঁইয়ে কন্ঠের খাদ নামিয়ে উশান বলে উঠলো,
-‘ দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠো মীরাবতী। তোমাকে এই দূর্বল রূপে দেখতে আমার ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। ‘
যাওয়ার পথে উশান ঠিক করলো টুইঙ্কেলের সাথে সে দেখা করে তবেই যাবে। টুইঙ্কেল আর রুহির দেখাশোনার জন্য উশান চারজন নার্স ঠিক করেছে।তারা সর্বসময় টুইঙ্কেল এবং রুহির দেখভাল করবে। টুইঙ্কেলের কেবিনের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করতেই উশান দেখলো মেয়েটা অতি দ্রুততার সাথে খাবার খাচ্ছে। আশপাশে কোনো দিকে ধ্যান নেই তার। অত্যান্ত তাড়াহুড়ো করে খাওয়া শেষ করছে। উশান মৃদু হেঁসে এগোল। টুইঙ্কেলের পাশে বসে ওকে টেনে নিজের কোলে বসালো। অতঃপর বলল,
-‘ আস্তে খাও প্রিন্সেস। গলায় খাবার আঁটকে যাবে তো। ‘
মেয়েটা শুনলো বলে মনে হলো না। সে নিজের মতো করে খাচ্ছে। খাওয়া শেষ ঢকঢক করে দুই গ্লাস পানি শেষ করে হাত ধুয়ে নিলো একজন নার্সের সাহায্যে। পরিশেষে সে উশানের গলা জড়িয়ে ধরে উশানের চওড়া কাঁধে মাথা রাখলো। নম্র গলায় জিজ্ঞেস করলো,
-‘ পাপা কোথায় চাচ্চু? আমি পাপার কাছে যাবো। নিয়ে চলো না। ‘
উশান অপ্রতিভ হলো। পাথর বুকটা তার থেমে থেমে কেঁপে উঠলো। বেফাঁস হলো স্বাভাবিকতা। ধৈর্য নিয়ে ভাবলো কিছু। শেষে গাঢ় কন্ঠে বলল,
-‘ প্রিন্সেস! তোমাকে আমি কিছু কথা বলি। মনোযোগ দিয়ে শুনবে। ওকে? ‘
-‘ ওকে চাচু। ‘
-‘ তোমার মাম্মার কথা মনে আছে? সে যেভাবে স্কাই এর স্টার হয়ে গিয়েছে। সেভাবে তোমার বাবাও স্কাই এর স্টার হয়ে গিয়েছে আম্মু। তোমার মাম্মা খুব ভয় পেতো না একা থাকতে? তাই বাবা তার ভয় কাটাতে তোমার মাম্মার কাছে গিয়েছে। বুঝেছো?’
টুইঙ্কেল অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকালো। গাঢ় গোলাপি অধর জোড়া তার কম্পমান। ফুঁপিয়ে উঠে সে বলল,
-‘ বাবা কি আর আসবে না চাচু? ‘
-‘ নো প্রিন্সেস। ওখান থেকে আরো ফিরে আসা যায় না। ”
টুইঙ্কেল মায়ের প্রতি বড্ড বেশি দূর্বল। মায়ের জন্য সে সবকিছু করতে পারে। নিজের ভালোলাগা ত্যাগ করতে পারে। এইযে উশান যখন বলল তার মা একা থাকতে পারেনা তাই বাবা তাকে সঙ্গ দিতে তার নিকট গিয়েছে! সে ব্যাপারটা বুঝলো। টুইঙ্কেল জানে তার মা একদমই একা থাকতে পারে না। মা’র কথা মনে করে ইফরাদের তাকে ছেড়ে চলে যাওয়াটা নিয়ে সে যে ভীষণ কষ্ট পেলো, তা প্রকাশ করলো না। অন্তর্লীন করে রাখলো দুঃখ টুকু। উশান জানতো মায়ের কথা টানলো টুইঙ্কেল লক্ষী বাচ্চার মতো নিশ্চুপ হয়ে যাবে। তাই সে কায়দা করে এই কথাটা বলেছে।
কয়েকপল কাটলো মৌনতায়। খানিকক্ষণ বাদে টুইঙ্কেল ভীষণ মন খারাপ নিয়ে বলল,
-‘ বাবা কেনো আমাকে একা ফেলে গেলো চাচু?আমি এখন কার কাছে থাকবো? ‘
উশান টুইঙ্কেলকে আঁকড়ে ধরে গালে ঠোঁটের স্পর্শ আঁকে। অতঃপর মিষ্টি কন্ঠে শুধায়,
-‘ আমার সাথে থাকবে প্রিন্সেস। তোমার মিষ্টি আর আমার সাথে। আমরা একসাথে থাকবো। ঠিক আছে?’
কিয়ংদশের হৃষ্টচিত্ততা লক্ষ্য করা গেলো টুইঙ্কেলের মুখোশ্রী জুড়ে। তবে তা ক্ষনিকের। উশান তার থেকে বিদায় নিয়ে নার্স দু’জনকে কড়া গলায় শাসিয়ে গেলো যাতে টুইঙ্কেলকে চোখের দৃষ্টি আড়াল না করে। উশান বেড়িয়ে যেতেই নার্স দু’টো টুইঙ্কেল কে শাসালো। ধমক দিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে তারা দু’জন প্রস্থান করলো কক্ষ হতে। টুইঙ্কেল তখন সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ।
রজনী নামতেই সে কেবিনের জানালার কপাট উন্মুক্ত করে অন্তরীক্ষে দৃষ্টিপাত ফেলে। অভিযোগ ছুঁড়ে দেয় অম্বরে। মৃদু স্বরে বলে,
-‘ তোমরা পঁচা বাবা, মা! আমাকে কেনো নিয়ে যাওনি তোমরা? ‘
একাকীত্বের প্রহর বিচরণকালীন টুইঙ্কেল বুঝলো তার পাশে কেও নেই। কেওই নেই৷ ধীর – স্থির রূপে, সময়ের তালে তার ক্রন্দন বাড়লো। মাটিতে গড়াগড়ি খেয়ে সে কান্না শুরু করলো। বারংবার অস্ফুটস্বরে বাবা, মার নাম ধরে চেঁচাতে লাগল৷ সে।
চলবে~