হৃদয়েশ্বরী পর্ব-৩৯+৪০

0
1006

#হৃদয়েশ্বরী – ৩৯
সাদিয়া মেহরুজ দোলা

অতঃপর দীর্ঘ এক সময়ের পরিসমাপ্তি। বোধকরি সময় কেটেছে এবার ঝড়ের গতিতে। তখন মধ্য রজনীর প্রহর। অম্বর থমথমে ভীষণ। বাতাবরণে বইছে এলোমেলো অনিল। হিমশীতল সমীর সাইঁ সাইঁ শব্দের উৎপত্তি করে কোমল সব গাছের পাতা মৃদু করে ছুঁইয়ে দিচ্ছে। নিকষকালো অন্তরীক্ষে চুমু দিচ্ছিলো কমলাটে মেঘের দল। থেমে থেমে কিয়ৎ সময় পরপর মেঘের গর্জন করে মেদিনী কাঁপাচ্ছে। মেঘমেদুর অম্বর হতে আসা দানবীয় গর্জন শ্রবণ করে তন্দ্রাঘোরে মৃদু পরিমাণে নড়েচড়ে উঠছিলো টুইঙ্কেল। নেত্রপল্লব আঠার ন্যায় একে অপরের সাথে যুক্ত থাকায় সে আর নেত্রযুগল উন্মুক্ত করতে পারলো না।সহসা মুখোশ্রী কুঁচকে অস্ফুটস্বরে ক্রন্দনের সুর বের করতেই উশান ব্যাস্ত হয়ে উঠলো।টুইঙ্কেলের মাথা এলিয়ে তার চওড়া কাঁধে। মেয়েটা একাধারে তার সাথে খেলাধুলা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।

উশান হাঁটছে আর টুইঙ্কেলের পিঠে আদুরে করে চাপড় দিচ্ছে তন্দ্রায় ডুবে যেতে সহায়তা করার প্রয়াসে। একসময় তন্দ্রাঘোরে পুরোপুরি নিমজ্জিত হলো টুইঙ্কেল। উশান ঘড়িতে সময় দেখলো। যেতে হবে তাকে। শ্রান্ত পায়ে সে এগোল রুহির রুমটায়। দরজার সামনে আসতেই তার কর্ণকুহরে ভেসে এলো ভিতরে অবস্থান করা মানবীর করুণ ক্রন্দনের সুর৷ উশান বুক ফুলিয়ে শ্বাস ফেললো। কড়াঘাত করলো দরজায়। এক, দুই মিনিট পর রুহি দ্রুত পদে এসে দরজা খুললো। উশানকে দেখে সে অপ্রতিভ হয়। দৃষ্টি নত করে জিজ্ঞেস করে,

-‘ ভাইয়া! টুইঙ্কেল ঘুমিয়ে গেছে? ‘

উশান ভরাট কন্ঠে জবাব দিলো,

-‘ হ্যা। ওকে তোমার কাছে রাখো। বাহিরে বাজ পড়ছে। বাজ পড়ার শব্দে ভয় পায় ও। দেখে রেখো। একা ফেলে যেওনা যতটুকু সম্ভব হয়। ‘

-‘ জি ভাইয়া। দিন ওকে আমার কাছে। ‘

টুইঙ্কেল কে আলগোছে, সন্তর্পণে কোলে তুলে নিলো রুহি। শেষে রুমে প্রবেশ করে দরজা লাগাতে নিবে তৎক্ষনাৎ তার পদচারণ থমকে দেয় উশানের করা প্রশ্ন।

-‘ কাঁদছিলে রুহি? কাঁদতে নিষেধ করেছিনা আমি?’

ধরা পড়ে যাওয়াতে ভীষণ অপ্রতিভ হলো রুহি। সে ঘুরে দাঁড়ালো। চেপে রাখা বুক ভর্তি আর্তনাদ এবার ছিটকে বেড়িয়ে এলো। বলল,

-‘ মীরা! ওকে কবে আবার আগের মতো দেখতে পাবো ভাইয়া? ছয়টা মাস পার হয়ে গেলো। ‘

উশান ভরাট কন্ঠে বলে উঠলো,

-‘ বলেছিনা ঠিক হয়ে যাবে? এভাবে কাঁদলে কি করে হয়? নিজের খেয়াল রাখো ঠিকমতো। ক’দিন হলো সুস্থ হলে। তুমি আবার অসুস্থ হলে টুইঙ্কেল কে দেখবে রুহি? আমি একদমই সময় পাচ্ছিনা ওকে দেখার। তোমাদের দেখে রাখার। ‘

-‘ যতটুকু দেখছেন আলহামদুলিল্লাহ। এখন কোথায় যাচ্ছেন ভাইয়া? মীরার কাছে? ‘

কয়েকপল মৌনতা বিচরণ। জোড়াল শ্বাস ফেলে উশান প্রতিত্তুর করলো,

-‘ হ্যা। ওকে দেখেই ক্যাম্পে ফিরবো। নিজের খেয়াল রেখো। কোনো দরকার হলে ফোন দিও। ‘

রুহি কতক্ষণ তাকিয়ে থাকলো উশানের যাওয়ার পানে। অন্তঃস্থল তার বিষাক্ত, তিক্তপূর্ন। উশান কতোটা কষ্ট করছে, কতোটা চাপে আছে তা যেনো চক্ষু সমেত টকটক করে ফুটে উঠছে। আহ্! এসবের শেষ কবে? কবে?

হাসপাতালে পৌঁছে মোটরসাইকেল নির্দিষ্ট স্থানে পার্ক করলো উশান। অতঃপর চাবি পকেটে ঢুকিয়ে হাঁটা ধরলো সামনে। আঁখিজোড়া তার অনুভূতিহীন, নিষ্প্রাণ হয়ে রয়েছে। কাঙ্ক্ষিত সেই স্থানে পৌঁছে দরজা ঠেলে প্রবেশ করলো ভিতরে। সামনে তার প্রিয় মানবী শুয়ে। ক্লান্ত, জীর্ণশীর্ণ দেহ! মুখোশ্রীর মায়াটা আর নেই। বিভিন্ন ঔষধের সাইড এফেক্ট এর ফলস্বরূপ হাত – পা, মুখোশ্রী হয়েছে ফ্যাকাশে। উশান মীরার সন্নিকটে এগোল। টুল টেনে বসলো তার পাশে। কয়েকপল পলকহীন ভাবে দেখলো সে মীরাকে। তার চটপটে মীরা এখন মৌন, দীর্ঘ ছয় মাস যাবৎ সে বিছানায় পড়ে। সারাক্ষণ মূর্তির ন্যায় এক স্থানে সে স্তব্ধ থাকে। উশান দুইবার পলক ঝাপটালো। টপটপ করে দুই চোখ হতে অশ্রু গড়ালো গাল বেয়ে। সিক্ত কন্ঠে ভাঙা গলায় সে বলল,

-‘ আর কতদিন মীরা? আর কত অপেক্ষা? আমি সত্যিই এবার ধৈর্যহারা হয়ে পড়ছি। আমাকে এই পরিস্থিতিতে কেনো ফেললে মেয়ে! সবকিছু আজ আমার এলোমেলো, অবিন্যস্ত। ঠিক হয়ে যাও তুমি মাদকতা। আর কতদিন বিরহে কাটাবো? ‘

মীরা কোমায় গিয়েছে আজ ছয় মাস পেরুলো।দীর্ঘ এক সময়! এই ছয়টা মাস সে স্তব্ধ আকার ধারণ করে সেই যে মৌনতা পালন করা শুরু করেছে, সেই মৌনতার ধ্বংসাত্নক পরিণতি আর ঘটেনি। মানবী একবারও চক্ষু জোড়া আর উন্মুক্ত করে দেখেনি। মীরা কোমায় গিয়েছে ব্রেইন স্ট্রোকের কারণে।উশান যেদিন ক্যাম্পে ফিরে গেলো তাকে সুরক্ষায় রেখে তার পরদিনই অনাকাঙ্ক্ষিত এক ঘটনা ঘটলো তার সহিত। ঠিক কি ঘটেছিলো জানা নেই। তবে সে ঘটনার জেরে মীরার সর্বপ্রথম ব্রেইন স্ট্রোক হয়েছে।অতঃপর মস্তিষ্কের তুমুল রক্তক্ষরণ।মস্তিষ্কের রক্তনালিতে রক্ত জমাট বাঁধলো। ঘটনা এতোই দ্রুত ঘটলো মীরা কাওকে আর সুযোগ দিলোনা তাকে সুস্থ করার৷ আচানক সবকিছু নিস্তব্ধ। গোটা চারটে মানুষকে বেহাল পরিণতিতে রেখে মীরা কোমায় চলে গেলো। তবে মীরার বর্তমান পরিস্থিতি দর্শন করে ডাক্তার’রা মনে করছেন মীরা অতীব জলদিই রিকোভার করবে। মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে পরিবর্তন এসেছে। রোগীর দিক দিয়েও ইতিবাচক নির্দেশনা আসছে।

উশান আশঙ্কা করে এসবের পেছনে একজনেরই হাত আছে। আর তা হচ্ছে ঊষার। কারণ ইফরাদের এক্সিডেন্ট ঊষাই করিয়েছিলো। সেদিন রেষ্টুরেন্টের সিসিটিভি ফুটেজ দেখে উশান অনেকটা নিশ্চিত হয়েছে। সেই আসল দোষী, যার কারণে ইফরাদ আজ মৃত্য সে যখন গাড়িতে গড়বড় করছিলো তখন ঐ ছেলেটাকে চিনে রাখার মতো বেশ কিছু কারণ উশান চিহ্নিত করে রেখেছিলো যেমন, ছেলেটা বাম হাতে সব কাজ করে। ডান পা একটু বাঁকানো অর্থাৎ এ্যাবনরমাল। ছেলেটাকে ধরার সুযোগ হয়নি তাই এই বিষয় গুলো মাথায় রেখেছিলো সে। অতঃপর কাজেও দিয়েছে। সেই ছেলেটা রুহি, মীরা এবং টুইঙ্কেল যেই হাসপাতালে ভর্তি ছিলো সেখানেও এসেছিলো সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে নিশ্চিত হয়েছে উশান। সে এসে প্রবেশ করেছিলো মীরার কেবিনে। অতঃপর ঘটলো সেই সর্বনাশা কান্ড! ছেলেটা টুইঙ্কেল কে দেখভাল করা নার্স দু’টোকেও হাত করেছিলো। কষ্ট দিতে চেয়েছিলো মেয়েটাকে। রুহিকেও মেরে ফেলার পরিকল্পনা ছিলো। তবে তার আগেই উশান সবকিছু আয়ত্তে আনার চেষ্টা করেছে। রুহি, টুইঙ্কেল সুস্থ হয়ে উঠাতে তাদের বাসায় এনে বাসার বাহিরে সর্ব সময় সুরক্ষা দেয়ার স্বার্থে গার্ড রেখেছে তিনজন। মীরাকে ভর্তি করিয়েছে এখানকার আর্মি হাসপাতালে। আর্মি হাসপাতালে মীরা সম্পূর্ণ রূপে সুরক্ষিত। তবে এখানে ভর্তি করাতে কিছুটা হলেও বেগ পেতে হয়েছে উশানকে।

টুইঙ্কেল এখন অনেকটাই স্বাভাবিকতা। রুহি সুস্থ! মাঝখান থেকে এলোমেলো শুধু মীরা। টুইঙ্কেল এখন নিয়ম করে স্কুলে যায়, বিকেলে বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা সায়াহ্ন হলে রুহির সঙ্গ অতঃপর রাত্রি নামলে উশানের সাথে তার জম্পেশ আড্ডা বসে। শত কষ্ট হলেও উশান কোনোরকম ক্যাম্প থেকে সময় বের করে রাতে আসে টুইঙ্কেলের কাছে। ও ঘুমিয়ে গেলে রওনা দেয় মীরার নিকট। মীরার কাছে মাঝরাত পর্যন্ত থেকে সেখান থেকে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে চলে যায় আবার ক্যাম্পে।
প্রতিদিনকার মতো আজও উশান সালাত আদায় করতে প্রস্তুতি নিলো। সালাত শেষে সে শেষবারের মতো মীরার মুখোশ্রী দর্শন করে আলত করে মীরার গাল ছুঁয়ে দিয়ে বেড়িয়ে গেলো। প্রভাতের আলো ফুটতে শুরু করেছে। ভোর হওয়ার পূর্বেই তাকে ফিরতে হবে ক্যাম্পে। নাহলে বিশাল সমস্যা।

____

তমসা বিরাজ করা ছোট্ট কক্ষ হতে ভেঙে ভেঙে ভেসে আসছে কারো আকুতি – মিনুতি। বাঁচার জন্য প্রবল আকাঙ্খা তার কন্ঠে নিপুণ ভাবে প্রকাশ পাচ্ছে।দরজার এপাশে দাঁড়িয়ে উশান ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে ফেললো। হাতে তার প্রিয় সেই ছোট্ট ছু’রিটা। দরজায় এক প্রকার লাথি মেরেই ভেতরে প্রবেশ করলো উশান। তার থেকে তিন ফুট দূরে দাঁড়িয়ে তীব্র। কাঠের চেয়ারে বসে সামনে তাকিয়ে। তীব্রের দৃষ্টি অনুসরণ করে উশান সেদিকে তাকালো।পরপর হাঁটা ধরলো সেদিকের উদ্দেশ্যে।

হাঁটু গেড়ে রক্তাক্ত অবস্থায় বসে রয়েছে কেও।পুরো দেহ তার র’ক্তা’ক্ত। রক্তিম তরল দ্বারা রঞ্জিত তার পরনের পোশাক৷ উশান লম্বা কদম ফেলে ছেলেটার গলার পিছনে হাত দিয়ে চুল মুঠো করে ধরলো। মুখোশ্রীতে গম্ভীরতা টেনে তুমুল আক্রোশ নিয়ে হুংকার ছেড়ে বলল,

-‘ তোকে কে পাঠিয়েছে? ঊষা? জলদি বলবি! সময় ১ মিনিটেরও কম। ‘

তীব্র শার্টের হাতা ঝাড়া মেরে উঠে দাঁড়ালো। বলল,

-‘ দোস্ত, ইংলিশ না স্প্যানিশে বল। এইটা ইংলিশ বুঝে না তেমন। আমি স্প্যানিশ ভাষা পারিনা তাই কোনো কথা এখনো বের করতে পারিনাই। ‘

মাত্রাতিরিক্ত বিরক্তিমাখা নজরে একপলক তীব্রকে দর্শন করে উশান ফের দৃষ্টি ফেললো ছেলেটার প্রতি। ভীতিগ্রস্ত নয়নে কেমন হাসঁফাসঁ করছে সে। উশান স্প্যানিশে বলল। ছেলেটা জবাব দিচ্ছে না দেখে হাতের সেই ধারালো ছু’রিটা ছেলেটার বাম হাতে ঢুকিয়ে দিলো। তীব্র যন্ত্রণায় ছাড়খাড় হয়ে সে এবার শিকার করলো, ঊষাই তাকে পাঠিয়েছে।তাকে বলা হয়েছিলো ইফরাদ, টুইঙ্কেল, রুহি এবং মীরা! এই চারজনকে জানে মেরে ফেলতে। কারণটা জানতে চাইলো না উশান।সবটা সম্পর্কেই অবগত সে।কেনো ঊষা এমন করছে তা সে জেনেছে ক’দিন পূর্বে। উশান হাতের ছু’রিটা ছেলেটার কন্ঠনালী বরাবর দুই তিনবার ঢুকিয়ে নিথর, মৃত্যদেহটাকে ধাক্কা দিয়ে ছুঁড়ে ফেললো ক্ষীণ দূরে।

_____

পরিস্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে উশান অপরাহ্নের দিকে এসেছে হাসপাতালে। তার উচাটন মন আজ হুট করেই আনচান করছে। ছটফটিয়া অন্তরাল কে শিথিল করার প্রয়াসে মীরার নিকট ছুটে আসা। ডাক্তারের সাথে একবার কথা বলে উশান আসলো মীরার নিকটবর্তী। ক্লান্ত দেহ নিয়ে শুয়ে পড়লো মীরার পাশে। অতঃপর কাত হয়ে অনিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মীরার পানে। অন্তঃকরণ অস্থির তুমুল! এই বুঝি আঁখি জোড়া উন্মুক্ত করলো মীরা। কিন্তু কই? কিসের কি! সেই তো সব একই। আর কত? আর কত অপেক্ষা?

উশান উঠে বসলো। কক্ষ জুড়ে পদচারণ করলো। ফের এসে বসলো মীরার পাশে। তারপর কি হলো কে জানে। নিস্তব্ধ কামড়ায় সবকিছু এলোমেলো হতে লাগল। এতোদিন নিস্তব্ধ রূপে থাকা মীরার শ্বাস দ্রুত গতিতে উঠানামা করছে। অক্সিজেন মাস্ক লাগানো সত্বেও শ্বাস নিতে তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। উশান অস্থির, উন্মাদ হলো। হন্য হয়ে ডাক্তার ডাকলো। প্রায় পাঁচজন ডাক্তার উপস্থিত কামড়ায়। সকলের মুখোশ্রীতে চিন্তার ছাপ। ক্লিওরা মীরাকে চেকআপ করে বলল,

-‘ রিকোভার টাইম স্যার। এই সময় হয় সে চোখ খুলে স্বাভাবিক হবে নয়তো চিরতরের জন্য শ্বাস নেয়া বন্ধ করবে। প্রে ফর হার। ‘

উশান ব্যাকুল হলো। চটজলদি উঠে ওজু করে এসে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ পড়তে বসলো। প্রতিটি সিজদায় আল্লাহর নিকট তার আর্জি, মীরা সুস্থ হোক। সুস্থ হয়ে উঠুক তার মীরাবতী। বদলে তার জীবন চলে যাক তবুও মাদকতা সুস্থ হোক।

~চলবে~

#হৃদয়েশ্বরী – ৪০
সাদিয়া মেহরুজ দোলা

মীরা যেদিন হতে উশানের জীবন হতে নিরবিচ্ছিন্ন হয়ে স্তব্ধতার রাজ্যে পারি দিলো, সেদিন হতেই উশান এক বাজে অভ্যাসের সাথে লিপ্ত হলো। যেই ছেলের সিগারেট দেখলেই ঘৃণায় গা গুলিয়ে আসতো! সেই ছেলে এখন দিনকে দিন সিগারেট খাওয়া রপ্ত করেছে দারুণ ভাবে। বর্তমানের বিষন্ন সব প্রহর উশানের কাটে সিগারেটের সাথে। সিগারেটের এলোমেলো ধোঁয়ার মতো তার জীবন। সবকিছুই অবিন্যস্ত! কিছুই ঠিক নেই। কিচ্ছুটি না।

মীরাকে শান্ত করার জন্য ইনজেকশন পুশ করা হয়েছে। কোমায় থাকা পেশেন্টদের রিকোভার টাইমে উত্তেজিত হওয়া ক্ষতিকর তারজন্য। মীরাকে ইনজেকশন পুশ করার পর সে আগের ন্যায় নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছে। ঔষধের প্রতিক্রিয়া কাটার পর দেখা যাবে কি হয়। উশান অস্থির, শ্বাস রুখে বাহিরে চলে এসেছে। বাহিরে আসার পর থেকে একের পর এক সিগারেট শেষ করে পায়ের কাছে স্তুপ জমিয়েছে। সে এখনো হাসপাতাল থেকে অদূরে নির্জন এক স্থানে বসে। মানষিক টানাপোড়নে মস্তিষ্কের নিউরন এখন অস্থিতিশীল, উচাটন! সিগারেটের প্যাকেট শূন্যের কোঠায়। উশান হুঁশে ফিরলো। হাত দু’টো ধুলো ঝাড়ার মতো করে উঠে দাঁড়ালো। পায়চারি করতে করতে ভাবলো কিছু। যেই ভাবনার গভীরতা অনেক। পকেটে পুরে রাখা তার ফোন হটাৎ কেঁপে উঠলো। উশান পায়চারি থামিয়ে ব্যাস্ত হাতে ফোন বের করে। ক্লিওরা ফোন দিয়েছে। বিন্দুমাত্র সময় অপচয় না করে উশান ফোন রিসিভ করে চট করে কানে লাগালো। অপাশ হতে গমগমে সুরে তৎক্ষনাৎ ক্লিওরা বলে উঠলো,

-‘ স্যার মীরা! সে চোখ খুলেছে। আপনাকে দেখতে চাচ্ছে স্যার। জলদি ফিরে আসুন। ‘

নিঃশব্দতা বজায় স্থানটিতে ছোটখাট্টো বিস্ফোরণ ঘটে গেলো। তবে তা উশানের অন্তঃস্থলে। হাতের ফোনটা কোনোমতে পকেটে পুরে সে পাগলের মতো দৌড়ানো শুরু করলো। আশ্চর্য! পথটা এতো দীর্ঘ হলো কি করে?

ক্লিওরা ফোন কেটে মিটিমিটি হাসছে। সে আজ খুশি। ভীষণ রকমের খুশি। হৃষ্টচিত্ততায় মন প্রাণ আজ উজার। এই ছয়টা মাস মীরা তার আন্ডারে ছিলো। প্রতিটা লহমা সে দেখেছে উশান যখন মীরার নিকট থাকতো তখন ছেলেটা কেমন করে ছটফট, হাসঁফাসঁ করতো! কষ্ট পেয়ে দুমড়ে মুচড়ে যেতো তা ঢের বুঝতে পারতো ক্লিওরা। আজ যখন মীরার জ্ঞান ফিরলো। চোখ খুলে তাকালো মেয়েটা, কাঁপা ঠোঁটে এলোমেলো করে উশানের নাম নিলো তখন ক্লিওরা বুঝেই নিলো আসলেই ভালোবাসা সুন্দর। স্বচ্ছ এবং পবিত্র!

লিফটে জায়গা পেলো না উশান। পর্যাপ্ত মানুষে ভরপুর হয়েছে তখন সেই আধুনিক যান্ত্রিক কক্ষটা। লিফটের কথা ভুলে উশান উঠে পড়ে ছুটলো সিঁড়ির দিকে। ১৭ তলা সে উঠে এলো বিনা ক্লান্তিতায়।উঠে এসে ক্লান্ততার রেশ তার মুখোশ্রীতে খুঁজে পাওয়া গেলো না। বরঞ্চ অদৃশ্য এক হৃষ্টচিত্ত, বক্ষঃস্থল ভরা লুকিয়ে রাখা চরম খুশি। তাই ফুটে উঠলো মীরার কেবিনের দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করলো সে। দুই, তিনজন ডাক্টার দাঁড়িয়ে। মীরার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে তারা। উশান মীরার পানে দৃষ্টিপাত ফেললো। মেয়েটা পিটপিট করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এতোমাস পর চোখ খুললো! বাহিরের তীব্র রশ্মির কারণে ঠিক মতো সে তাকাতেও পারছে না। ক্লিওরা বুঝলো বিষয়টা। সে গিয়ে লাইট বন্ধ করে ডিম লাইট জ্বালালো। তারপর উপস্থিত ডাক্তারদের নিয়ে বেড়িয়ে যেতে যেতে উশানকে উদ্দেশ্য করে বলল,

-‘ আপনি লাকি স্যার। খুব লাকি। কোমার এই সিচুয়েশনে থেকে মূলত কেও সুস্থ রূপে বেঁচে ফিরে না। কিন্তু মীরা ফিরেছে। সুস্থ রূপে! খেয়াল রাখবেন ওর। ‘

মীরা নড়াচড়া করার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না কিছুতেই। বলা চলে, নড়াচড়া কিভাবে করে? তা সে ভুলে গিয়েছে। উশান ত্রস্ত পায়ে এগোল। পা দু’টো তার এতো কাঁপছে কেনো?এতো ধীরাজ হলে চলে? মীরাবতীকে ঝাপটে ধরে আদর দিতে হবে না? বকুনি দিতে হবে না?মেয়েটা এতো এতো কষ্ট দিলো তাকে! বদমাইশ!

মীরার মুখে লাগানো অক্সিজেন মাস্ক, হাতে লাগানো স্যালাইনের ক্যানুলা আরো যাবতীয় সবকিছু খুলে দিয়ে নার্স চলে গেলো। উশান পরপরই মীরার পাশে বসলো। মীরার হাড্ডিসার গাল দু’টো নম্র, কোমল হাতে ছুঁয়ে দিলো কম্পমান হাতে। কন্ঠনালী দ্বারা সে শব্দ উচ্চারণ করতে পারছে না কিছুতেই। শব্দজোট বেঁধেছে গলায়। সর্বপ্রথম নীরবতা কাটালো মীরা। খুব কষ্টে আঠালো ন্যায় অধর জোড়া প্রসারিত করে ভাঙা গলায় সে বলল,

-‘ আমাকে একটু উঠিয়ে বসান না। ‘

উশান তাই করলো। মীরাকে ধরে আধশোয়া করে বসিয়ে দিলো। কতমাস পর মীরা উঠে বসলো। মাথা চক্কর দিতে নিলেও সে নিজেকে সামলালো। সামনে বসা থাকা নিস্তব্ধ মূর্তির ন্যায় পাথর মানবটার বুকে হুমড়ি খেয়ে পড়লো। দু’হাতে জোর নেই বলা চলে। তবুও অবশিষ্ট শক্তি দিয়ে সে উশানের পিঠ খামচে ধরলো। ধারালো আঘাতে অস্ফুটস্বরে আর্তনাদ করে পুরোপুরি শান্ত হলো উশান। মীরার পিঠে সে একহাত রাখলো। অন্যহাত দিয়ে মীরার গাল ধরে নিজের দিকে ফেরালো। মেয়েটার ঠোঁট দু’টো কেমন অবিরত কাঁপছে। কাঁদবে বোধহয়! আঁখি দু’টোও কেমন টলমলে হয়ে।

-‘ দীর্ঘ ছয় মাস আমায় নরক যন্ত্রণা দিয়েছো মীরা। এই যন্ত্রণার উপশম দাও এবার। একটু আদর করি? জাস্ট একটুখানি! ‘

কন্ঠ জমাট। মীরা নতজানু হলো। স্বগতোক্তি করে বলল, নির্লজ্জ লোক! এতো লজ্জার কথাটা সে মুখে বলে কি করে?লোকটা কি বুঝে নিতে পারে না তার ইশারা? হাহ্!

মীরার অন্তঃকরণ বার্তা বোধকরি উশান বুঝে নিলো চট করে। সে মাথা নিচু করে অধর ছোঁয়ালো মীরার গালে। অনবরত আদুরে স্পর্শ একেঁ দিলো সময় নিয়ে। মীরা তখন গুটিশুটি মেরে এমন ঝংকার তোলা আদর পেয়ে। ঘন ঘন শ্বাস ফেলে উশানকে দূরে ঠেলে দেয়ার চেষ্টায় সে ব্যার্থ হলো। উশান খপ করে তার হাত ধরে ফেলে হিসহিসিয়ে বলল,

-‘ আজ না মীরাবতী। আজ বাঁধা দিও না। আজ বাঁধা দিলে উশান রেজওয়ান সেই বাঁধা মানবে না।’

বাদামী রঙের মীরার ওষ্ঠাধর। উশান আলত করে ছুঁয়ে দিলো মীরার অধর জোড়া। আঙুল দিয়ে। দুই, তিনটে প্রগাঢ় চু’মু খেয়ে উশান মীরাট জীর্ণশীর্ণ দেহটাকে নিজের সাথে আলত করে জড়িয়ে ধরে রাখলো। এইতো, এতোদিনের ছটফট করা হৃদপিণ্ড, হৃদঃস্থলে উৎপত্তি হওয়া বেসামাল ঝড় আজ এতোদিন পর শিথিল হলো।

___

কতক্ষণ এভাবে উষ্ণ আলিঙ্গনে নিবদ্ধ হয়ে কেটে গেলো দুজনের কারোরই জানা নেই। তবে এক সময় মীরা এই আলিঙ্গন ছেড়ে মুক্ত হয়ে সটান হয়ে বসলো। অবলোকন করলো উশানের প্রতি। উশান তখন প্রশ্নবিদ্ধ নজরে তাকিয়ে। সে জিজ্ঞেস করলো,

-‘ কি হয়েছে? দূরে সরে গেলে কেনো? কাছে এসো।’

উশানকে খুঁটিয়ে, খুঁটিয়ে দর্শন করতে ব্যাস্ত মীরা।সে উশানের বলা বাক্যটা শ্রবণ করেও সে উশানের কাছ ঘেঁষলো না। কিছুক্ষণ পর ভাঙা গলায় প্রশ্ন করলো,

-‘ কতদিন ধরে খাওয়া দাওয়া করেননি? ‘

শার্টের কলার ঠিক করলো উশান। মীরাকে আলত হাতে টান দিয়ে নিজের কাছে এনে ফের আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলো। উত্তর দিলোনা কোনো। মীরা তাতে ক্ষুব্ধ হয়! পুনরায় জিজ্ঞেস করে,

-‘ উত্তর দিচ্ছেন না যে? ‘

-‘ এতদিন ঘুমালে। ঘুম থেকে উঠেই এতো রাগ? শান্ত হও! ‘

-‘ আপনি আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দিন। নিজের এই অবস্থা করেছেন কেনো? আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে ছ্যাকা খেয়ে ব্যাকা হওয়া সন্নাসী প্রেমিক! সত্যি করে বলুন তো, আমি যখন অসুস্থ ছিলাম তখন আপনি অন্য কোনো মেয়ের সাথে রিলেশনে ছিলেন? ‘

উশানের উচিৎ মীরাকে ধরে এখন চড়ানো! ইচ্ছে হলোও তাই। কিন্তু ইচ্ছে বাস্তবায়ন সে করলো না। রুষ্ট চাহনি নিক্ষেপ করে সে গর্জে উঠলো। বলল,

-‘ উল্টোপাল্টা কথা বলবে না মীরা! তুমি জানো না? আমার এ অবস্থা কেনো! হাহ্? ‘

পরিস্থিতি বিগড়ে যাচ্ছে। মীরা বুঝলো। সে এই বিষয়ে আর কথা বাড়ালো না। মিনিটখানেক পর নিম্ন সুরে বলল,

-‘ ভাত নিয়ে আসুন। ‘

-‘ খিদে পেয়েছে? খাবে? ‘

-‘ তো ভাত কি আমি ভূতের জন্য আনতে বলছি?’

কেবিন থেকে চলে গেলো উশান। মীরার ত্যাড়া উত্তর গায়ে মাখলো না। রাগ লেগেছিলো যদিও। তবুও চলে গেলো! মীরা সেখানেই কোনোমতে ঠেস দিয়ে বসে রইল। শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তি নেই বোধহয়। বসেও থাকা যাচ্ছেনা। হাত – পা কেমন তিরতির করে কাঁপছে।

উশান ফিরে আসলো পনেরো মিনিটের মাধ্যমে। চোখ মুখ তার আঁধারে বিলীন। মীরা তা দেখে চট করে বলল,

-‘ কি হয়েছে? ‘

উশান মন খারাপ নিয়ে প্রতিত্তুর করে,

-‘ খাবার খেতে পারবেনা এখন মীরা। ডাক্তার নিষেধ করলো। বলেছে এখনি খাওয়া ঠিক হবেনা। এক ঘন্টার মতো ওয়েট করতে হবে। পারবেনা? খুব বেশি খুদা পেয়েছে? ‘

মীরা মৃদু হেঁসে বলল, ‘ ভাত কি আমি আমার জন্য আনতে বলেছি? ‘

ভ্রু দ্বয়ের মধ্যে ভাজ ফেললো উশান। ভারী কন্ঠে বলল,

-‘ তাহলে? ‘

-‘ এদিকে আসুন। ‘

উশান এগোল। খাবার প্যাকেট মীরার হাতে ধরিয়ে দিলো। ভাত আনেনি উশান।ফ্রাইড রাইস এনেছে। তাছাড়া এখানে ভাত পাওয়াও সম্ভব নয়। মীরা চামচে করে কিছুটা রাইস তুলে নিলো। উশানের মুখের সামনে তুললো চামচ।জেদ ধরে বলল,

-‘ হা করুন তো জলদি! আমি খাইয়ে দিবো আপনাকে। নিষেধ করবেন না। আপনার কথা আমি শুনবো না। ‘

-‘ আপনার হাতে খাওয়ার সুযোগ আমি কিছুতেই মিস করবো না ম্যাডাম। ‘

চামচে খাবার তুলে একনাগাড়ে উশানকে খাওয়াচ্ছে মীরা। তার হাত দু’টো কাঁপছে প্রবল। কাঁপা কাঁপি থামানোর প্রবল চেষ্টা করছে মীরা। লোকটা নিশ্চিত তার কাঁপা হাত দেখলে আর খাওয়াতে দেবেনা!এটা আপাতত চাচ্ছে না মীরা। উশানকে কতদিন পর সে নিজ হাতে খাওয়াচ্ছে। আনন্দের চোটে তার নেত্র কোণে পানি এসে জমেছে। সে কোনোদিনও ভাবেইনি যে সে বেঁচে ফিরবে।

উশান খাচ্ছে আর মীরাকে নির্নিমেষে দেখে যাচ্ছে। তার এখনো বিশ্বাসই হচ্ছে না তার সামনে মীরা বসে রয়েছে। তাকে খাইয়ে দিচ্ছে! কাল পর্যন্তও তো এই মেয়েটা এসময় স্তব্ধতা ধারণ করে ঘুমোচ্ছিলো! আর আজ দেখো। উশান ঠিক করলো খাওয়া শেষে সে দুই রাকআত নফল নামাজ পড়বে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায়ের জন্য।

চলবে~

( রি-চেইক করতে পারিনি। ক্লান্ত লাগছে ভীষণ!)