#হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#নুুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১২
প্রিয়া ঘরে উপস্থিত সকলের মুখের দিকে বারকয়েক তাকালো। নাহ্! কারও মুখশ্রীতে প্রিয়ার মনের অবস্থার প্রতি সমবেদনা পরিলক্ষিত হলো না বরং নিজের আপন মায়ের পেটের ভাইও কেমন মিটমিট করে হাসছে! প্রিয়া দেখল জারিফের ভাবিও মিটমিট করে হাসছে। তবে কি এরা জানতো?
এদিকে কাজী বিয়ে পড়ানোর জন্য নাম ঠিকানা বলছে। প্রিয়া ওর ভাইকে ইশারায় কাঁদো কাঁদো চাহনিতে ডাকলে প্রিয়ম হাসি চেপে হালকা গলা ঝেড়ে প্রিয়ার পেছোনে এসে ঝুঁকে। প্রিয়ার অন্তরে শীতল অনুভূতি হচ্ছে। প্রিয়ম জিজ্ঞেস করে,
“কী বলবি বল।”
“ভাই উনি কে? উনাকে আমি চিনি ভাই!”
প্রিয়ার জড়তাগ্রস্ত কথায় প্রিয়ম হাসে তারপর ফিসফিস করে বলে,
“উনি ‘জারিফ আহমেদ’। আমার বেস্টফ্রেন্ড ও তোদের ডিপার্টমেন্টের নিউ লেকচারার। আর কিছুক্ষণের মধ্যে তোর স্বামী হবে!”
প্রিয়া আঁতকে উঠে বড়ো বড়ো চোখ করে প্রিয়মের দিকে ঘার ঘুরায়। প্রিয়ম এবার শান্ত কন্ঠে বলে,
“বিয়েটা করে নে। তোর তো অন্য কাউকে পছন্দও নেই। শুধু তোর স্যার বলে বিয়েতে মানা করবি এটা ভালো দেখায় না। আমরা সবকিছু জেনেই এগিয়েছি। জারিফ তোর জন্য ঠিক। তোর মা-বাবা, ভাইকে তো তুই চিনিস, নিশ্চয়ই তোর খারাপ চাইবে না।”
প্রিয়া চোখ বন্ধ করে দুইবার নিঃশ্বাস নিলো তারপর জারিফের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালো। তখনি জারিফও তাকালো। নয়নযুগলের শুভদৃষ্টির মাঝে কাজী সাহেব জারিফকে কবুল বলতে বলল। জারিফ প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে চোখে হাসলো অতঃপর তিনবার কবুল বলে দিলো। এবার কাজী সাহেব প্রিয়াকে কবুল বলতে বললে প্রিয়ার হৃৎপিন্ডের ধুকপুকানি কয়েকগুণ বেড়ে গেলো। ঢোল পে*টানোর মতো ধ্রিম ধ্রিম করছে। শ্বাসটাও আটকে আসছে। বাবা-মায়ের দিকে তাকালে তারা কবুল বলতে ইশারা করে। প্রিয়া জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো সাথে ওর গলাও শুকিয়ে গেছে। প্রিয়ম রাহাকে ইশারা করলো প্রিয়াকে পানি দিতে। এদিকে জারিফের ভাবী বলছেন,
“কবুল বলো প্রিয়া।”
প্রিয়া শুকনো ঢোক গিলে জারিফের দিকে তাকালে দেখে জারিফ প্রিয়ার দিকে কেমন করে যেনো তাকিয়ে আছে। চোখের ভাষা প্রিয়ার জন্য এই মূহুর্তে অপ্রতিরোধ্য। রাহা পানি এনে দিলে প্রিয়া খপ করে নিয়ে সবটুকু পানি খেয়ে নিয়ে বুক ভরে শ্বাস নেয়। ইয়াং জেনারেশনের সবাই হেসে উঠে একমাত্র জারিফ বাদে। সে এখনও প্রিয়ার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখে তার তীক্ষ্ম হাসি। প্রিয়াকে কাজী সাহেব আবারও কবুল বলতে বললে সবার পিড়াপীড়িতে প্রিয়া ধীর স্বরে কবুল বলে চোখ মুখ খিঁচে নেয়। হয়ে গেলো স্যারের বউ! লোকটার সাথে বাসে প্রথম দেখা আর তিক্ত অনুভূতি সেই সাথে স্যার হয়ে আগমন। সবটা অক্ষিপটে ফুটে উঠছে তার।
ঘরময় সকলে খুশিতে আলহামদুলিল্লাহ্ বলে মিষ্টিমুখ করছে। ডার্ক ওয়াইন রঙের পাঞ্জবি পরিহিত জারিফকে সত্যি অসম্ভব সুন্দর লাগছে। স্বাভাবিক পরিস্থিতে থাকলে প্রিয়াও কয়েকবার ক্রাশ খেয়ে বসতো! প্রিয়ম এসে জারিফকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“হয়ে গেলাম তোর শা*লা! বেস্টফ্রেন্ড থেকে শা*লা! হোয়াট অ্যা নাইস জার্নি!”
জারিফ ও প্রিয়ম দুজনেই হেসে উঠে। রাহা দৌঁড়ে এসে প্রিয়াকে জড়িয়ে ধরে খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলে,
“কনগ্রাচুলেট আপি। বলেছিলাম না? জিজু খুব হ্যান্ডসাম। আজকে জিজুকে ডার্ক ওয়াইন কালারের উপর সোনালি সুতোর কারুকাজ করা পাঞ্জাবিতে কেমন রূপকথার প্রিন্স চার্মিংয়ের মতো লাগছে না? তুমি তার জন্য আসা এক প্রিন্সেস। উফ! আমার তো খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে। তোমার কী ইচ্ছে হচ্ছে?”
প্রিয়া রাহার দিকে তাকিয়ে খুব সুন্দর করে হাসলো। রাহা প্রিয়ার চাহনিতে কনফিউজড হয়ে তাকিয়ে আছে। এরপর প্রিয়া চোখ-মুখ শক্ত করে দাঁত কটমট করে ধীর স্বরে বলে,
“তোকে বরফ কুচি পানিতে চু*বা*ইতে! বারবার চু*বাবো। পারলে ডিফ ফ্রিজে ভরে রাখব। তোকে বরফের ম*মি বানাবো!”
রাহার হাসি-খুশি মুখটা খনিকেই আষাঢ়ের কালোমেঘে ছেঁয়ে গেলো।
“আমি কী করেছি? তোমার শীতকালে এসব ভয়ংকর, নির্দয় ইচ্ছেগুলো কেনো হচ্ছে আমার প্রতি?”
“তোর ওই ফা*লতু এক্সাইটমেন্টের জন্য আমার সাথে কী ঘটেছে জানিস?”
প্রিয়ার হিসহিসিয়ে বলা কথায় রাহা অবাক হয়ে সুধায়,
“কী ঘটেছে? তোমার কি জিজুকে পছন্দ হয়নি? এতো হ্যান্ডসাম জিজুকে তোমার পছন্দ হলো না! এই তোমার চোখের পাওয়ার ঠিক আছে? ডাক্তার তো তোমায় মাথাব্যথা হলে চশমা দিয়েছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে পার্মানেন্ট চশমা লাগবে তোমার। চোখে ছানি পরেছে তোমার।”
প্রিয়া ভ্রুঁকুটি করে রাহাকে দেখলো। তামান্না এসে প্রিয়ার মুখের কাছে ছানা মিষ্টি ধরলে প্রিয়া জোরপূর্বক হেসে একটু খায় সাথে তামান্নাকেও খাওয়ায়। তুতুল এসে প্রিয়ার মুখের কাছে মিষ্টি ধরে তার মায়ের দেখাদেখি। প্রিয়া তুতুলকে কোলে তুলে নিয়ে ওর গালে চু*মু খায় তারপর তুতুলকে একটু মিষ্টি খাওয়ায় সাথে নিজেও তুতুলের হাত থেকে খায়। এরপর তুতুলকে কোল থেকে নামিয়ে সবাইকে একটু আসছি বলে নিজের রুমে গিয়ে দরজা লাগায়।
রাহা প্রিয়ার ভাবগতি না বুঝে প্রিয়মকে জিজ্ঞেস করে,
“ভাই, প্রিয়ুপির কি জিজুকে পছন্দ হয়নি? সে আমাকে কতো থ্রে*ট দিলো।”
প্রিয়ম রাহার মাথায় টো*কা দিয়ে হেসে বলে,
“পছন্দ হলেও সে এখন বুঝতে পারছে না কারণ সে যে তার ভার্সিটির স্যারকে বিয়ে করেছে! শ*কে আছে বেচারি। কাছে যাস না ভুলেও। কখন তোকে শ*ক দিয়ে তোর ঘো*ড়ার লে*জের মতো চুলগুলো তারকাঁটার মতো খাড়া খাড়া করে দিবে!”
রাহা বলে,
“প্রিয়ুপি কী শ*ক খাবে! আমি নিজেই শ*কড! প্রিয়ুপি কাল রাতে এক স্যারের কথা বলেছিল। সে নাকি নতুন এসেছে আর সে পড়া ধরেছে সেটা আপি পারেনি। তারপর সেই স্যারের সাথে বাসে ঝামেলা হয়েছিল তারপর থেকে আপি লুকিয়ে থাকে ওই স্যারের থেকে। এটাই কী সে?”
প্রিয়ম কনফিউজড হয়ে বলে,
“নতুন তো জারিফই জয়েন করেছে ওদের ডিপার্টমেন্টে। হতে পারে। দাঁড়া, আমি জারিফকে জিজ্ঞেস করি।”
“আচ্ছা করো।”
________
প্রিয়া নিজের রুমে গিয়ে চুপচাপ বসে আছে। তার এখনও মনে হচ্ছে সে ঘুম থেকে উঠেনি। কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে। নিজেকে সামলাতে ফোনটা হাতে নিলো। ফোনের লক খুলে নেট অন করতেই ফোন কেঁপে উঠলো। নিশি, মিম, অর্ষাদের থেকে এতো এতো কল আর ওদের সাতজনের গ্রুপে এতো এতো মেসেজ দেখে প্রিয়া ভড়কে গেলো। প্রিয়া ফোনকে একটু সময় দিয়ে সবার আগে গ্রুপে ঢুকলো। তারপর সেন্টি ইমোজি সেন্ড করলো। প্রিয়া মেসেজ করতেই ওরা জিজ্ঞেস করা শুরু করলো, জিজুর ছবি দে? বিয়ে কি হয়ে গেছে? তোর ছবি দে? কেমন দেখতে জিজু? নাম কী জিজুর? আরও অনেক কিছু। প্রিয়া বিনিময়ে একটা উলটো সেন্টি ইমোজি দিয়ে বলে,
“তোরা তাকে চিনিস ও দেখেছিসও!”
অর্ষা ও সাদ একসাথে মেসেজ করে,
“আমরা চিনি? কে সে?”
“আর কে! তোদের শ্রদ্ধেয় জারিফ স্যার!”
মেসেজ সেনড হওয়া এক মিনিট হয়ে গেলো কিন্তু কোনো রিপ্লাই এলো না। তৎক্ষণাৎ মেসেজের উপর হাহা রিয়াক্ট পরতে শুরু করলো। ওরা সবাই এরপর রিপ্লাইতে মজা নিচ্ছে। প্রিয়া ওদের আবার বলে,
“অ্যাই অ্যাম সিরিয়াস। ফান করছি না। জারিফ স্যার ভাইয়ার বেস্টফ্রেন্ড। তোরা তো হাসছিস আর তাকে বরের জায়গায় দেখে আমার যেনো ৪৪০ ভোল্টের ঝটকা লেগেছিল। কিন্তু সে নির্বিকার। তার মানে সে জানতো!”
নিশি বলে,
“স্যার তাহলে সেদিন জেনে শুনেই তোকে পড়া ধরেছে। স্যার জেনেও চুপ ছিল।”
অর্ষা ফান করে বলে,
“স্যার কি তবে আমার মতো তোর উপর ক্রাশ খেয়ে বসলো! একেবারে বউ করে তুলল!”
সবাই অনেক হাসি-ঠাট্টা করলেও আয়ান একদম চুপচাপ সব মেসেজ সিন করছিল। সে প্রিয়াকে হারিয়ে ফেলেছে। প্রিয়া এখন অন্যের বউ! কথাটা ভাবতেই হৃদয়ে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। নেট অফ করে অফলাইন হয়ে গেলো। অন্ধকার রুমে খোলা জানালা দিয়ে পূর্ণ চাঁদ দেখছে। জোৎসনার আলোতে মোহনীয় চারিপাশ। আজ প্রেয়সী অন্যকারও লিখিত প্রিয়তমা। প্রকৃতির অন্তরিক্ষে পূর্ণ চাঁদ হলেও আয়ানের মনের আকাশে ঘোর অমাবস্যা।
চলবে ইনশাআল্লাহ্,